মাসে ৩৭ টা বাচ্চা নিরুদ্দেশ, তাও আবার শুধু রামপুর এলাকাতেই। চোখ কপালে উঠল দীপ্তির। নতুন দায়িত্বভার গ্রহণ করে সব ফাইলপত্র ঘাটছিল দীপ্তি দেশমুখ। খোঁজ নিয়ে জানতে পারল প্রত্যেক টা কেস ই বন্ধ হয়ে পড়ে আছে, তদবীর করার লোকের অভাবে। দলিত বাচ্চাদের নিয়ে মাথা ব্যাথা করার সময় কার আছে? এস পি সাহেবের সাথে কথা বলাটাও খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। তার ট্রান্সফার অর্ডার এসে গেছে, তিনি এখন পাততাড়ি গুটোতে ব্যস্ত। "আরে ছড়িয়ে না ম্যাডাম, আপ খামকা কিউ আপনা দিমাগ খারাপ কারতি হ্যায়?" বলে তিনি প্রসঙ্গটা ওখানেই ইতি করে দিলেন। দীপ্তি কিন্তু দিমাগ থেকে ব্যাপারটা সরাতে পারল না।
সন্ধ্যেবেলা এক মগ ব্ল্যাক কফি আর কুকিজ নিয়ে বসেছে দীপ্তি। ফাইলগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছে। আজ অফিস থেকে আসার সময় সব ফাইল বাড়িতে নিয়ে এসেছে। ভালো করে স্টাডি করতে হবে। কাজের মাঝে মনসংযোগ হারাতে চায় না বলে ফাইল নিয়ে বসার আগেই প্রমিতের সাথে কথা বলে নিয়েছে। দীপ্তির স্বামী প্রমিত এমসের ডাক্তার। এখন কোভিড ডিউটি চলছে, তাই একটু দুশ্চিন্তা হয়। পড়াশুনোর সুবিধের জন্য ওদের মেয়েও বাবার কাছে দিল্লিতেই থাকে। এই কোভিড পরিস্থিতিতে বাবা কোয়ারেন্টাইন বলে দাদু দিদিমা এসে এখন নাতনির সঙ্গে থাকছেন।
প্রায় প্রতিটা বাচ্চাই দলিত। বয়েস আট, নয় থেকে চোদ্দ পনেরো। বেশিরভাগই স্কুলছুট। বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করে যে এন জি ও গুলো তাদের একটা লিস্ট ও নিয়ে বসেছে। তাদের মধ্যে অনেকের সাথে কথা বলে যা শুনল তাতে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল দীপ্তির। এখানে দলিত পরিবারের বেশিরভাগ বাচ্চাই ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জারের কাজ করে। ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার নিয়ে খুব বেশি গভীর ধারণা ছিল না এতদিন। এখন ব্যাপারটা নিয়ে পড়াশুনো করতে শুরু করল দীপ্তি। গুজরাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ এসব রাজ্যে এখনও নিচু জাতের লোকেরা এবং বাচ্চারা খোলা নালা, নর্দমা,পায়খানার মধ্যে ঢুকে হাতে করে তা পরিষ্কার করে। ২০২০র জানুয়ারি মাসের তথ্য অনুসারে দেশের আঠারো টি রাজ্যে প্রায় উনোপঞ্চাশ হাজার মানুষ এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। সবচেয়ে বেশি উত্তরপ্রদেশে। ২০১৩ সালে এর বিরুদ্ধে আইন পাস হওয়া সত্বেও এখনও রমরম করে চলছে এই প্রথা। শুধু তাই নয় ২০১৮-২০১৯ এর মধ্যে এই পেশায় মৃত্যু সংখ্যা বেড়েছে ৬১%।
দীপ্তি ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে তথ্যের গভীরে। কলিং বেলের আওয়াজটা কানে গেছিল। মিনিট দুয়েক বাদে সবিতা এসে খবর দিল কেউ একজন ওর সাথে দেখা করতে এসেছে। ওনাকে বসতে বলো বলে দীপ্তি চেঞ্জ করতে গেল। পোশাক বদলে বসার ঘরে ঢুকে তো অবাক। এ তো প্রশান্ত রাঠোর। দিল্লিতে ইউ পি এস সির কোচিং সেন্টারে ওরা একসাথে পড়ত। ভালো বন্ধুত্ব ছিল ওদের। পরে অবশ্য একজন আই এ এস, আরেকজন আই পি এস জয়েন করে। ওদের একটা গ্রুপ ও ছিল। বেশিরভাগই এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মাঝে মাঝে যোগ সাজোগ হয়। এবার প্রশান্তর আগমনের কারন জানা গেল। এই এলাকার এস পি হিসেবে চার্জ নিয়েছে ও। দীপ্তি এখন এখানকার ডি এম জানতে পেরে সারপ্রাইজ দিতে এসেছে। প্রশান্ত এখন এখানকার এস পি জেনে হাতে যেন স্বর্গ পেল দীপ্তি।
পরেরদিন অফিসে এন জিও দের নিয়ে একটা মিটিং ডাকল দীপ্তি। ওদের সহায়তায় নিখোঁজ হওয়া বাচ্চাগুলোর পরিবারের সাথে কথা বলল। বেশিরভাগই মুখ খুলতে নারাজ। উচ্চবর্ণের মানুষের অত্যাচারে ওরা এতটাই ভীত আর সন্ত্রস্ত যে নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে ভাবতেও ভুলে গেছে ওরা। কাজটা সহজ নয়, দীপ্তি বুঝতে পারল খুব ধীরে এগোতে হবে। এন জিওর পরে ডেকে নিল স্থানীয় স্কুল শিক্ষকদের। শিক্ষকদের চিরকালই একটা বড় ভূমিকা থাকে সমাজে। সকলের কাছ থেকে আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া না পেলেও একদল নবীন শিক্ষক শিক্ষিকারা এগিয়ে এলেন দীপ্তির পাশে। অনেক গুরুত্বপূর্ন তথ্যও জোগাড় হল ওনাদের থেকে। শুধু তাই নয় ওনাদের নিয়ে ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং এর বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলার একটা প্রজেক্টের ব্লু প্রিন্ট ও তৈরি করতে শুরু করল দীপ্তি।
বিভিন্ন মানুষের সাহায্য আর সহযোগিতায় কিছু নির্দিষ্ট খোঁজ খবর পাওয়া গেল। বাকি কাজটা অনেকটাই প্রশান্ত সামলে নিল। উচ্চ বর্ণের প্রভাবশালী মানুষের বাড়িতে তল্লাশি করাটা খুব একটা সহজ কাজ নয়। তবে প্রশান্তও দীপ্তির মতই সৎ আর নির্ভীক। আর জেদিও বটে। ঠাকুর রণ দেব সিংহের বাড়ি থেকে উদ্ধার হল দুই কিশোরের কঙ্কাল। শনাক্তকরণ এখনও সম্পন্ন হয় নি। এতদিন হয়ে গেছে যে ফরেনসিক টেস্ট করে কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছনো একটু কঠিন। তবে এই ঘটনায় অনেকেই নড়ে চড়ে বসল। সাহস পেয়ে আরো কিছু সন্তান হারানো অভিভাবক এগিয়ে এলেন, জানালেন তারা এবং তাদের বাচ্চারা কোথায় কোথায় কাজে যেতেন। শুরু হল আরো ধর পাকর। বেরোলো আরো লাশ, কোথাও বাড়ির মেঝে থেকে, কোথাও জঙ্গল বা ধান ক্ষেত থেকে। রামপুর এখন সংবাদের শিরোনামে।
রাজ্যে সামনে নির্বাচন। সুতরাং এই জাতীয় ফোন কল বা সাক্ষাৎ আশাই করছিল দীপ্তি। খুব পরিষ্কার ভাষায় ওকে বোঝানো হল এই কেসটা এক্ষুনি ধামা চাপা না দিলে ফল ভালো হবে না। কম বছর হল না দীপ্তি চাকরি করছে। সেও এর মধ্যে পোড় খাওয়া হয়ে গেছে। তাছাড়া ব্যক্তিত্ব ছাড়া এমনি এমনি তো এই এস এ প্রথম দশের মধ্যে স্থান পায় নি। খুব শান্ত গলায় ওনাদের জানালো "দেখিয়ে স্যার মেরি ফ্যামিলি মে আধে সে জাদা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস মে হ্যায় ঔর মেরে দো বারে ভাই ফৌজ মে হ্যায়। দেশ কে সেভা তো হামারি খুন মে হ্যায়। ইসসে তো মে হাট নেহি সাক্তি হু। আপ আপনা কাম কিজিয়ে, মে আপনি কারতি হুঁ"। অপমানে চোয়াল শক্ত করে সেদিন বেরিয়ে গেছিল মুখ্যমন্ত্রীর চ্যালা চামুন্ডারা। দীপ্তি জানত যে কোনো মুহূর্তে ট্রান্সফার অর্ডার, কম্পালসারি ওয়েটিং বা যেকোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে ওর বিরুদ্ধে। খতম ও করে দেওয়া হতে পারে।
রাজনৈতিক চাপ মোকাবিলা করার এখন একটা বড় অস্ত্র হল সোশ্যাল মিডিয়া। দীপ্তির পরামর্শে ওর ডিপার্টমেন্টের কিছু কম বয়েসী ছেলেমেয়ে "জাস্টিস ফর দা মিসিং ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার্স" নামে ফেসবুকে একটা কমিউনিটি খুলে ফেলল। আগুনটা ছড়াতে বেশি সময় লাগল না। দেশ বিদেশ থেকে নেটিজেনরা সোচ্চার হয়ে উঠলেন। নিখোঁজ বাচ্চাদের সন্ধান করতে গিয়ে যে প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছিল সেই সূত্র ধরে আরও অনেক মৃত্যুর তথ্য সামনে এল। রাজ্য সরকার প্রথমদিকে ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে ঠেকানোর প্রবল চেষ্টা করলেও রাজনৈতিক সমীকরণের কথা ভেবে পরে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
দীপ্তির কাজ এখন কয়েকগুন বেড়ে গেছে। শুধু ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং বন্ধ করাই নয়, মানুষগুলোর রিহ্যাবিলিটেশনের ব্যবস্থাও করতে হবে। সরকার থেকে এদের যে ৪০,০০০ টাকা করে এককালীন বরাদ্দ সেই টাকা যথাযত ভাবে এদের হাতে তুলে দেওয়া, অন্যান্য জীবিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে কম সুদে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া এবং সর্বোপরি বাচ্চাগুলোকে স্কুলমুখি করা বিস্তর কাজ এখন সামনে। ইতিমধ্যে কয়েকটা সেলফ হেল্প গ্রুপ ও তৈরি করে ফেলেছে মহিলাদের বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত করার জন্য। কাজের শত ব্যস্ততার মধ্যেও মেয়েটার জন্য খুব মন খারাপ করে। ভাবছে কয়েকদিন ছুটি নিয়ে দিল্লী থেকে ঘুরে আসবে। স্বচ্ছ সুখী ভারতের সাথে স্বচ্ছ সুখী পরিবারটাও তো জরুরী।
সুচিন্তিত মতামত দিন