নন্দিনী চট্টোপাধ্যায়

নন্দিনী চট্টোপাধ্যায়

তিয়াসা রুপাঞ্জনাকে সেই একঘেয়ে প্রশ্নটা আবার করলো ---তুই কি সত্যি সত্যি  বিতানকে ভালবাসিস রূপ? এর আগে  রুপাঞ্জনাকে এই একই প্রশ্ন তিয়াসা অনেকবার করেছে ।  আর প্রত্যেকবারই রুপাঞ্জনা উত্তর দিয়েছে । একবারও প্রশ্নটাকে এড়িয়ে যায়নি । কোনও পাল্টা প্রশ্নও করেনি কখনও । এমনকি বিরক্তি প্রকাশও করেনি ।বরং প্রত্যেকবারই মাথাটা নিচু করে মৃদু অথচ স্পষ্ট স্বরে উত্তর দিয়েছে - হ্যাঁ ভালবাসি তো ।  তিয়াসা   প্রত্যেকবারই ভেবেছে যে রুপাঞ্জনা মিথ্যে বলছে কারন কোন সুস্থ চিন্তার মেয়ে কখনও  বিতান সেনের মত একটা বেহদ্দ লম্পটকে ভালবাসতে পারেনা ।

তিয়াসা ও  রুপাঞ্জনা   সম্পর্কে দুই  জা । তিয়াসার শাশুড়ি  ও রুপাঞ্জনার শাশুড়ি সম্পর্কে ননদ  ও বউদি । সেই হিসেবে  তিয়াসার বর দীপ হল  রুপাঞ্জনার বর বিতানের পিসতুতো  ভাই। এখানে বিয়ে হওয়ার অনেক আগে থেকেই তিয়াসা  ও রুপাঞ্জনা পরস্পরকে চিনত ।  আসলে  ওরা দুজনেই দুরগাপুরের মেয়ে । একই স্কুলে পড়াশুনা তারপর উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতার হস্টেলে থেকে ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা পাস । তারপর আবার যে যার বাড়ি বা কর্মস্থলে  গিয়ে থিতু হওয়া। বিভিন্ন  জেলা থেকে ছেলে মেয়েরা এভাবেই উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতায়  আসে যায় । তিয়াসা কলকাতায় কলেজের পড়া শেষ করে বি এড করবার জন্য এখানেই রয়ে গেছিল আর রুপাঞ্জনাকে এল এল বি পড়ার জন্য ওড়িশার একটি ল কলেজে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল । তিয়াসা ভেবেছিল এ আবার কি রে বাপু কলকাতা ছেড়ে মেয়েটা সেই উড়িষ্যাতে পাড়ি দিল কেন! এখানে কি ভাল ল কলেজ নেই নাকি ? আস্তে আস্তে যোগাযোগ কমেছিল। ক্ষীণ হতে হতে যোগাযোগের সুতোটা কখন যে সময়ের স্রোতের মাঝখানটিতে টুপ করে খসে পড়ে একেবারে হারিয়েই গেছিল সে খোঁজ তিয়াসা রাখে নি। অন্য সব কাজে কম্মে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল ।রুপাঞ্জনা তার সঙ্গে এক স্কুলে পড়লেও গ্রাজুয়েশনে সম্পূর্ণ আলাদা বিষয় ছিল তাদের । কিন্তু কলেজটা এক ছিল আর হস্টেলে পাশাপাশি রুম শেয়ার করত তারা । পুজো বা গরমের ছুটিতে এক সঙ্গে  গল্প করতে করতে বাড়ি ফেরার স্মৃতিগুলো সত্যি ভোলা যায় না । তবু মানুষ তো কালসমুদ্রে সাঁতার কাটতে কত কি ভুলে যায় ! তিয়াসাও তেমনই রুপাঞ্জনাকে প্রায় ভুলে গেল ।

কলেজ ছাড়ার পরের পাঁচ বছরে তার জীবনে দু একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল । সে বি এড শেষ করে কলকাতার খুব নামী একটি স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিল আর চাকরি  শুরু করার বছর খানেকের মধ্যে কোন এক দীপ বসুর সঙ্গে রীতিমত ঘটকালি করে তার বিয়ে হয়ে গেল ।দীপ পেশায় একজন চার্টার্ড একাউনট্যাঁনট ।কাজ পাগলা মানুষ ।বিয়ের আগে মায়ের আদরে থাকত আর বিয়ের পরে নিশ্চিতভাবে বউয়ের আদরে থাকে । নিশ্চিন্তে বউয়ের ঘাড়ে ঘরে বাইরের সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে সদানন্দ হয়ে ঘুরে বেড়ায় । ঘরে বাইরে যাবতীয় সমস্যা সামলাবে কে ? কেন ? তিয়াসা ত আছেই । তিয়াসার শ্বশুর শাশুড়ি মানে দীপের বাবা মাও মোটামুটি ছেলের পদাঙ্কই অনুসরণ করছেন দেখা গেল । বিয়ের অল্প দিন পরেই দেখা গেল কত্তা গিন্নি তিয়াসার ঘাড়ে সব দায়িত্ব সমর্পণ করে পরম আনন্দে কখনও শান্তিনিকেতন কখনও পটল ডাঙায় গিয়ে বেশ কিছুদিন করে থেকে আসতে লাগলেন ।শান্তিনিকেতন গিয়ে থাকতে ভালো লাগে বলে দীপের বাবা তো সেই কবেই ওখানে একখানা ফ্ল্যাট কিনে রেখে দিয়েছেন আর পটলডাঙায় দীপদের পৈত্রিক বাড়ীই রয়েছে । জায়গাবাসার সঙ্কুলান হয় না বলে অনেক শরিকই হয়তো বাড়ির বাইরে  বাসস্থান বানিয়ে নিয়েছে কিন্তু বাড়ি বলতে দীপরা আজও ঐ বাড়িটিকেই বোঝে । অতএব তিয়াসা বাড়ির একমাত্র ছেলের বৌ হয়েও প্রথম থেকেই ঘোর সংসারী হয়ে পড়ল।তার স্বামী তাকে প্রায় চোখে হারায় আর শ্বশুরমশাই শাশুড়ি মাও তথৈবচ । তিয়াসার  ওপর কাজের চাপ দায়িত্বের চাপ থাকলেও প্রতিদিনই তার সুখের ভাঁড়ার উথলে উঠতে লাগল ।

বিয়ের বছর তিনেক বাদে একদিন শ্বশুর শাশুড়ি যথারীতি শান্তিনিকেতন যাচ্ছেন , তিয়াসাকে ডেকে শাশুড়ি বললেন ,-----আরে আমি তো একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম । ভাগ্যিস এখন মনে পড়ল ! আজ তো বিতানের পাকাদেখা । সেই দেশপ্রিয় পার্ক মানে আমার বাপের বাড়িতে যেতে হবে , বুঝলে ।  আমরা তো ট্রেন ধরতে বেরিয়ে যাচ্ছি , তুমি একবার ঘুরে এস তো তিয়াসা। বেশিক্ষণ থাকতে হবে না । এই একটু    বুড়িছোঁয়া করে আসা , বুঝলে না ?

তিয়াসার গা জ্বলে যায় । একটা রবিবার । তাও ফরমায়েশের অন্ত নেই । নাও এখন শাশুড়ির ভাইপোর পাকাদেখা অনুষ্ঠানে শাশুড়ির প্রতিনিধি হয়ে দাঁত বের করে হাজিরা দাও ! এত কিসের বেড়ানোর নেশা ? নিজের ভাইপোর পাকাদেখার তারিখটাও খেয়াল রাখতে পারে না ! ধন্য পিসি পিসেমশাই একখানা ।তিয়াসা গাল দেয় মনে মনে । তারপর ঠিক সময় একখানা লাল টুকটুকে কাঞ্জিভরম গায়ে চড়িয়ে লাল টুকটুকে লিপস্টিক ঠোঁটে ঘষে বেশ সেজে গুজে দীপের মামারবাড়ীতে গিয়ে হাজির হয় । ও বাড়ীটাও এ বাড়িটারই একটা জেরক্স কপি বলা যায় । অত বড় বাড়িটাতে বাসিন্দা বলতে একটি মাত্র ছেলে বিতান আর তার বাবা মা মানে দীপের মামা মামী । আজ দীপের মা না এসে দীপের বৌ আসায় বিতানের মা খুশিই হলেন । ননদের খামখেয়ালি ধরণ মোটে পছন্দ নয় বউদির ।কে জানে পাত্রীপক্ষের লোকজনের সামনে কি না কি বলে দিত !  বিতানের মতো ছেলে যার ঘরে থাকে একমাত্র সেই মা ই জানে শাক দিয়ে সর্বদা মাছ ঢেকে চলার কৌশলটি। বিতানও যদি আজ দীপের মতই ঘর মুখী আর মা বাবার বাধ্য ছেলে হত! ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বিতানের মা ।

সেদিন শরীরটা একটু টায়ার্ড থাকায় তিয়াসা বেশীক্ষণ বসেনি ।মেয়ের বাড়ির লোকেদের সঙ্গে  ভালো করে কথা না বলেই বাড়ী ফিরে এসেছিল । আসলে দীপের মামাতো দাদা ঐ বিতানকে সে কোনদিনই পছন্দ করেনা ।বড্ড যেন চালিয়াত মার্কা ভাবভঙ্গি । কথাবার্তায় অকারণ সবজান্তা ভাব আর অর্থহীন ক্যাটকেটে কথা ।তিয়াসা বিয়ের পর দু চারটে কথা বলতে গিয়ে অনর্থক কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়েছিল । তার পর থেকে সে বিতান সম্পর্কিত অনেক ব্যাপার বেশ এড়িয়ে চলে ।সেটা মানুষজন বোঝেনা এমনও নয় । দীপের কা্ছে সে শুনেছে যে বিতান নাকি বেশ একটু রংবাহারি মানুষ । অজস্র বান্ধবী তার ।নিজস্ব ভুবনে তার যে জায়গাটা রয়েছে সেটা নাকি রীতিমত  চিত্তাকর্ষক ও লোমহর্ষক । কিন্তু কথা হচ্ছে কোন মেয়ে এহেন লোকের বউ হয়ে ফাঁসবে বলে গলাটা এমন ভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে ? তিয়াসার জানার জন্য একটু কৌতূহল রয়েই গেল । কিন্তু সে বিতানের সামনে নিঃস্পৃহ ভাব দেখাল।বিতানও তার স্বভাব অনুযায়ী ভাইয়ের দিদিমণি সুলভ বউটিকে বিশেষ পাত্তা দিল না্ । তিয়াসা শুধু এটুকু জানল যে মেয়ে  বিতানেরই পছন্দ করা ।অতএব যে আসছে সে সবকিছু জেনেই আসছে।তিয়াসার গাটা রি রি করে ওঠে । মাগো এমন একটা ছেলেকে কেউ জেনেশুনে বিয়ে করে ! যাকগে তার আর কি ? বিয়ের দিনে সাজবে গুজবে আর হাবলাকান্ত বরটিকে বেশ করে আঁচলে বেঁধে বিয়েবাড়ি গিয়ে আনন্দ করবে ।গল্পগুজবের একখানা দল পেয়ে গেলে একটু আধটু পর নিন্দে পরচর্চা করলেই বা মন্দ কি! রসালো আড্ডা নিন্দেচর্চা না হলে বিয়ে বাড়ি পানসে লাগে ।

বরযাত্রী যাওয়ার পথে সে প্রথমবার জানল যে বিতানের বউ দুরগাপুরের মেয়ে । মেয়ের বাড়ির বেশির ভাগ আত্মীয়স্বজন কলকাতায় থাকেন বলে বালিগঞ্জে হল ভাড়া করে বিয়ের আয়োজন করেছেন মেয়ের বাবা । দুরগাপুরের মেয়ে --- নাম রুপাঞ্জনা । নাম--  রুপাঞ্জনা --মনের মধ্যে কথাখানাকে নিয়ে এক মুহূর্ত নাড়াচাড়া করতেই ঝট করে মনে পড়ে গেছিল সব। স্কুল কলেজ হস্টেল নানা চেনা ছবির কোলাজ আর ভারি মিষ্টি একখানা মুখ । রুপাঞ্জনা !! বিতানের বউ সেই মিষ্টি মতন চেনা মেয়েটা নয়তো ? গাড়ির নরম সিটে শরীর ডুবিয়ে বসে দামি সাড়ি গয়না আর পত্নীগতপ্রাণ স্বামী পাওয়ার প্রচ্ছন্ন অহং ও বিদেশি পারফিউমের পাগল করা সুঘ্রান তাকে সেই মিষ্টি মতন মুখটার খুব কাছে নিয়ে যাচ্ছিল । মুখটার জন্য একটু ভালোবাসা একটু আশংকা আর অনেকখানি করুণা খেলা করে বেড়াচ্ছিল মনের মধ্যে ।  মনে পড়ছিল কত সব পুরনো কথা । সর্বদা পরীক্ষার ভয়ে নার্ভাস হয়ে থাকত রুপাঞ্জনা আর তিয়াসা ছিল তেমনিই অকুতোভয় । পরীক্ষার আগের দিনও পিকনিকে যাওয়া , বা সিনেমা দেখতে যাওয়া তার কাছে জলভাত ছিল ।বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ রূপকে অঞ্জনা বলে ডাকত । একমাত্র তিয়াসাই ওকে রূপ বলে ডাকত । সবার মধ্যে সবচে বেশিদিন সে রুপাঞ্জনাকে চেনে । তাই রুপাঞ্জনার ওপরে তার অধিকারবোধ প্রবল ছিল ।বলত এই ডাকটা একমাত্র আমার । এই নামে আমি আর কাউকে ডাকতে দেব না ।এই সব তুচ্ছ কারন্রে কতবার হস্টেলের মেয়েদের সঙ্গে ঝগড়াও করেছে তিয়াসা ।কিন্তু এ মেয়ে যদি তিয়াসার অনেক আদরের সেই রুপাঞ্জনা হয়ে থাকে তাহলে সে মেয়েটা বোধ হয় আজ জীবনের সবচে বড় ভুলটা করতে চলেছে ! বিতান সেনের মতন একটা মেয়েবাজ ছেলেকে বিয়ে করা তো আত্মহত্যারই সামিল । যাহোক তিয়াসা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল বৌ দেখার জন্য । এ মেয়েটি আর যেই হোক যেন রূপ না হয় ! বন্ধুর অন্ধকার ভবিষ্যৎ দেখতে একটুও ভালো লাগবে না তার ।কিন্তু তিয়াসার আশঙ্কা কোনভাবেই মিথ্যে হল না । কনে সেজে যে মেয়েটি শুভলগ্নের জন্য অপেক্ষা করছিল সে মেয়েটি অন্য কেউ নয় , রূপই ছিল । তিয়াসার ছেলেবেলার মিষ্টি বন্ধু রুপাঞ্জনা ! তিয়াসা বরযাত্রীদের সঙ্গে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই রূপের মুখে একরাশ খুশি উপছে পড়েছিল ! ----আরে আমি তো জানতামই না যে তুই এদের আত্মীয় ! তিয়াসা মনে মনে মুখ বাঁকিয়েছিল বিতানের উদ্দেশ্যে । পরিচয় দেবে কেন ? পরিচয় দিলেই যে বিয়েতে ভাংচি পড়বে ! সে মুখে জিজ্ঞেস করেছিল--- বিতানদার সঙ্গে তোর কোথায় আলাপ হল রূপ ?

---ওর সঙ্গে ? আমি যখন ভুবনেশ্বরে থাকতাম তখন ও একবার বন্ধুদের সঙ্গে ওখানে বেড়াতে গিয়েছিল । ওখানেই আলাপ ।

তিয়াসা মনে মনে ভাবে ,--বন্ধু না বান্ধবী! কে জানে বাবা ! শুভলগ্ন যত এগিয়ে আসছিল তিয়াসার মুখ মলিন হচ্ছিল । রূপটার সর্বনাশ হতে চলেছে আর সে বন্ধু হয়েও কিচ্ছুটি করতে পারছে না ! রুপাঞ্জনা অবশ্য এতদিন পরে তিয়াসাকে দেখে আনন্দে ঊছলে উঠেছিল ।শ্বশুরবাড়িতে এসেই  পুরোনো বন্ধুকে ফিরে পাওয়া অনেকখানি পাওয়া বলেই ভেবে নিয়েছিল সে ।আর বিয়েবাড়ির উল্লাসকে ছাপিয়ে তিয়াসার অন্তরাত্মা নীরবে একটি আর্তনাদ করে উঠেছিল ।

তারপর থেকে যত দিন কেটেছে বিতানের আচার আচরণে কোনও বদল তো আসেইনি উপরন্তু দিনকে দিন তা আরও বাঁধনছাড়া হয়ে ঊঠেছে । আগে মামীমা একটু ঢাকাঢুকি দিয়ে ছেলের  চালচলনের কথা ননদকে বলে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্নাকাটি করতেন। এখন আর তা হয় না । শ্রীমান বিতান সেন ওরফে সম্পর্কে ভাসুরঠাকুরের যাবতীয় কুকীর্তির খবরগুলি তিয়াসা ঘোড়ার মুখ থেকেই সবিস্তারে সংগ্রহ করে । রূপ সেই আগের মতোই তিয়াসাকে তার সব ভালোমন্দের খবর বলে । তিয়াসা জানতে পারে যে বিতানের বান্ধবীপ্রীতির কথা বিয়ের আগেই কিছুটা অনুমান করতে পেরেছিল রুপাঞ্জনা ।এখন বিয়ের পরে স্বচক্ষে দেখছে।তিয়াসা অবাক হয়ে বলে --- বিতানের এই স্বভাবের কথা জেনেও তুই ওকে বিয়ে করলি কেন ?বিয়ে ভেঙে দিতে পারতিস ।

তিয়াসাকে আরও অবাক করে দিয়ে রুপাঞ্জনা বলে----নারে পারতাম না।কারন বিতানের ভাল মন্দ সবটুকু নিয়েই আমি ওকে ভালবেসেছিলাম ।

কিছুদিন কাটে ।রুপাঞ্জনার একটি ছেলে হয় । জোজো। ওদের বিয়ের কিছুদিন পর তিয়াসা জানতে পারে যে বিতান দুর্গাপুরে রুপাঞ্জনাদের এক হতদরিদ্র আত্মীয়ের বাড়িতে হঠাৎই যাতায়াত বাড়িয়ে দিয়েছে । উদ্দেশ্য ওদের সাহায্য করা । কিন্তু বিতানের কাজ কর্ম দেখে রূপ স্বচ্ছন্দেই বুঝতে পেরেছে যে পরোপকারের পাশাপাশি আত্মীয়কন্যাটির আকর্ষণও কম নয় ।তিয়াসা ক্ষোভে ফেটে পড়ে----বাড়ী ফিরে যা রূপ । যা হওয়ার হয়ে গেছে। আবার ল প্র্যাকটিস শুরু কর । একার দায়িত্বে ছেলেটাকে বড় কর । এই ভাবে পড়ে পড়ে মার খাস না ।

রূপ মাথা ঝুঁকিয়ে বলেছিল ----কিন্তু আমি চলে গেলে ছেলেটা চিরদিনের জন্য ওর বাবাকে হারাবে । ছেলেটাকে তো ওর বাবা দারুণ ভালবাসে রে তিয়াসা । আমারও ঐ ছেলেই প্রাণ । ছেলেটাকে সময় দেব বলেই না ল প্র্যাকটিস ছাড়লাম । 

তিয়াসা ভেঙিয়ে ওঠে ---প্র্যাকটিস ছেড়ে দিলাম ! কেন রে আমরা কি বাইরের কাজের পাশাপাশি ঘর সংসার ছেলে মেয়ে সামলাচ্ছি না ?

রূপ মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে যেন মস্ত একটা বকুনি খেয়েছে সে ।তিয়াসা নিজেকে  একটু সামলে নিয়ে বলে---কিন্তু বিতান তো নিশ্চয়ই তোকে আর ভালবাসে না। 

রূপ কেমন স্বগতোক্তির মতো বলে---- ভালোবাসে না ? বিতান আমাকে ভালোবাসে না এ কথা ঠিক নয় রে তিয়াসা ।বিতান আমাকেই সবচে বেশি ভালোবাসে । আমি জানি ।

এত সব কাণ্ড জেনেও তুই এ কথা বলছিস রূপ? 

রূপ কেন যেন একটু কেঁপে ওঠে । তারপর বলে--- আমিও ভালবাসি বিতানকে ।

---তুই পাগল হয়ে গেছিস রূপ । তিয়াসা সেদিন চলে এসেছিল । তবে এরকম দিন বিগত কুড়িটা বছরে আরও অনেক বার এসেছিল ।নানা খবর শুনত সে রূপের মুখে । কখনও বিতান অফিসের সহকর্মীনীর সঙ্গে এন্তার বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে আবার কখনও বা পরিচিত কোনও মহিলার সঙ্গে বিতানের  অন্তরঙ্গতার অন্ত নেই । প্রত্যেকবারই তিয়াসা রূপকে ডিভোর্সের পরামর্শ দিত আর রূপ প্রত্যেকবারই কি এক অদ্ভুত ভাবে তার বাল্যবন্ধুকে বুঝিয়ে ছাড়ত যে এইসব ঘটনায় তাদের ভালবাসায় কোনও প্রভাব পড়েনি । বিতান বরাবরই রূপকে ভালবেসেছে আর রূপ বিতানকে ।

বয়স বাড়ছিল । তিয়াসা আর রূপ দুজনেরই চুলে এখন রুপোলী ঝলক ।  ত্বক ফ্যাকাসে ।শরীর তার জৌলুস হারাতে চলেছে ।তবু কি আশ্চর্য ভাবে বিতান আর রূপ যে যার অবস্থানে আজো একই ভাবে দিন কাটিয়ে চলেছে। কোথাও কোনও পরিবর্তন হয় নি । বিতানের বান্ধবীবিলাস আর  রূপের স্বামীর প্রতি অগাধ বিশ্বাস একই জায়গায় স্থির। শুধু তিয়াসা রূপ আর বিতানের ব্যাপারে রীতিমত তিতিবিরক্ত হয়ে গেছে। রূপকে ফোন করা তো কবেই ছেড়েছিল সে ,ইদানীং মামাশ্বশুরের বাড়ি যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছে তিয়াসা । আসলে নানান ঘটনায় তার নিজের জীবনটাই  একেবারে ঘেঁটে ঘ হয়ে গেছে , অপরকে উপদেশ দেওয়ার মতন সময় বা ইচ্ছে কোনটাই নেই তার ।

বছর দুয়েক আগে দারুন একটা বিজনেস অফার পেয়ে দীপ ইংল্যান্ডে গেছিল। পুরনো পেশায় কাজকম্ম করতে নাকি একেবারে ভালো লাগছিল না তার ।কাজের স্বাদবদলের পাশাপাশি অর্থকরী আমদানিও মোটা ।তাই তিয়াসাও কোনও আপত্তি করেনি । ছেলে মেয়েকে বিদেশে পড়ানো দু তিনবার ওয়ার্ল্ড ট্যুরের রেস্ত দিব্যি জোগাড় হয়ে যাবে ।  নির্ভুল হিসেবে ছেলে মেয়েকেও আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের দুটি নামী ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করে দিয়েছিল তিয়াসা । গোড়ার দিকে পত্নীগতপ্রাণ স্বামীটির সঙ্গেও দিনে এক দু বার কথা হত ।  কিন্তু কথার পরিমাণ কমতে কমতে এখন মাসে একবারও কথা হয় না দীপের সঙ্গে । তিয়াসা বেশ বুঝতে পারছে যে মহাসাগরের এপার ওপারের সুর একেবারেই মিলছে না । তাল কেটে যাচ্ছে । ছন্দ মিলের অভাবটা এত প্রকট হয়ে পড়েছে যে কোনও প্রলেপই সম্পর্কের ছিদ্রগুলিকে মেরামত করার পক্ষে যথেষ্ট হচ্ছে না । কানাঘুসো শোনা যাচ্ছে ইংল্যান্ডেই নাকি সেটল করতে চায় দীপ ।শুরু করতে চায় নতুন জীবন । সে জীবনে তিয়াসাকে সাথে নেবে না সে। অন্য একজন এসে তিয়াসার জায়গাটা ক-বে অধিকার করে নিয়েছে ! বলতে গেলে সেই একজনের আকর্ষণেই  এই বুড়ো বয়সে দেশ ছেড়েছে তিয়াসার হাবলাকান্ত বউসোহাগে বরটা । আর কি আশ্চর্য ! রুপাঞ্জনার লম্পট বরটার ব্যাপারে বিষ ওগরাতে গিয়ে সে লক্ষ্যই করেনি যে তার বউসোহাগে পত্নীনিষ্ঠ আপাতনিরীহ  পতিদেবতাটি কখন যেন তিয়াসাকে বাদ দিয়েই বাঁচতে শিখে গেছে ।হারিয়ে গেছে তার জীবন থেকে ।তিয়াসার অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে আসা ক্লান্ত চোখদুটি বেয়ে জলের ধারা নেমে আসে । 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.