মুনিম রাব্বী

মুনিম রাব্বী

শনিবারের বিকেল । টকটকে রোদের আলো এখনো  নিস্তেজ হয়নি।  আমু দরিয়ার জল শুকিয়ে পিঠ উচু করা চর জেগে আছে। এমন সময় একজন বৃদ্ধ লোক এল। মাথায় পুরোনো আফগানী টুপি । গায়ে নোঙড়া আলখেল্লা । মুখে বার্ধক্যের অজস্র বলি রেখার ফাঁক গলে যেন দুটি নীল চোখ তাকিয়ে আছে । 
বহুপথ পাড়ি দিয়ে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়া বৃদ্ধ মাানুুুটি ছোট্ট পাহাড়ের টিলার আড়ালে বসে পড়ল। দূর থেকে বাচ্চাদের হৈ হুল্লোরের আওয়াজ আসছে । বৃদ্ধ লোকটি  উটের মতো মাথা উঁচু করে বাচ্চাদের দেখতে পেলেন। নিমিষেই সমস্ত ক্লান্তি উবে গেল । দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে ডাকতে লাগলেন । গুলজান ......!! গুলজান ...এই গুলজান ...।

গুলজানের চোখও নীল । আট কি নয় বছরের চনমনে কিশোরী । গতরে গড়নে , মুখের কারুকার্যে দরিদ্রতা, সংকোচ আর প্রতিবন্ধকতার স্পষ্ট ছাপ পড়লেও নীল চোখ যেন অবিচল, সতন্ত্র স্বকিয়তায় চঞ্চল । গুলজান সেই চোখ প্রসারিত করল । কান, মন স্থির করে সেই ডাকের উৎস নির্ণয় করল । এই কন্ঠ গুলজানের খুব একটা পরিচিত নয় আবার অপরিচিতও মনে হচ্ছে না । পুরোপুরি পরিচিত না হলে লোকের ডাকে সারা দেওয়া  বারণ । গুলজান এক দৌড়ে মায়ের কাছে চলে গেল । জানালার দেয়াল ঘেঁসে দাঁড়িয়ে ছিল গুলজানের মা । গুলজানকে দেখে এগিয়ে আসলেন তিনি । ভীতসন্ত্রস্ত  নয় , বেশ কৌতুহলী হয়েই গুলজান তাঁর মাকে বলল মা- আমার নাম ধরে কেউ ডাকছে । বারবার ডাকছে। গুলজান ..., গুলজান... এভাবে ।

মা অপ্রস্তুত ছিলেন । পাঁচ বছর জানালার দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে দূর পাহাড়ের অদৃশ্যে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর তেমন কিছুই করার নেই । দেয়ালের এক কোনে বোরখা ঝুলে ছিল মুর্তিমানের মত । মা সেই বোরখা পড়ে মেয়ের হাত ধরে বেড়িয়ে পড়লেন। তবে কি এত দিন পরে গুলজানের বাবা ফিরে আসল ?

সেদিন রাতে তীব্র শীত পড়েছিল । শেষ রাতের মরাচাঁদ যেন হিন্দুকুশে ডুব মেরেছে । ফজরের আজান দেবে দেবে ভাব । মধ্যবয়সী এক নুরিস্তানী যুবক এসে ডেকে নিয়ে যায় গুলজানের বাবাকে । কেন বা কোথায় যাচ্ছে তাঁর কিছুই বলে যায়নি । তার পর থেকে আর কোন দিন দেখা হয়নি । জানা যায়নি হামিদুল্লাহ বেঁচে আছে না মরে গেছে ।

গুলজান তার মাকে পথ দেখায়। একটু দূরেই শুকনো পাহাড়ের টিলা। তাঁর পাদদেশে ছোট ছোট পল্লব শোভিত আখরোটের বাগান । তারই এক পাশে ছোট পাহাড়ের খাঁজে সুর্য আড়াল হয়েছে । সেই আড়ালে বসে বসে ঝিমোচ্ছে চুল দাড়ি পাকা এক বৃদ্ধ ।

বয়সের সমস্ত দায় বৃদ্ধের চোখে আর মাথায় এসে জুটেছে । চোখ ঘোলা হয়ে গেছে। মাথাও ঠিক কাজ করে না। বাড়ির কাছে এসে পথ ভুলে গেলেন তিনি । অনেক দূর থেকে সে এসেছেন । প্রচণ্ড গরমে চারিদিকে শুধু শোষিত দিগন্ত আর তাঁর মাঝে নিরুপায় দাড়িয়ে আছে ছোট বড় পাহাড়ের দল । গুলজান আর গুলজানের মা বৃদ্ধের সামনে এসে দাড়াল । বৃদ্ধ ঘুমিয়ে গেছে ততক্ষনে । গুলজানের মা আশাহত হলেন । এ যাত্রায়ও তিনি তাঁর স্বামীর দেখা পেলেন না ।

পাঞ্জশীর উপত্যকা থেকে তখন ঘোড়সওয়ারীরা এদিকেই আসছে । ঘোড়ার খুরের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল বৃদ্ধের । গুলজানের মা চোখ মুছে বৃদ্ধের পাশে এসে বসলেন । বৃদ্ধ তাঁর মেয়েকে অনেক দিন বাদে দেখছেন । বৃদ্ধ বাবাকে পেয়ে গুলজানের মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন ।

গুলজান তাদের দিকেই তাকিয়ে ছিল এতক্ষন । সে তাঁর নীল চোখের সমস্ত আলো দিয়ে নানা কে দেখতে লাগল । নানা আর দেড়ি করলেন না । যে বার্তা দিতে তিনি এত পথ পাড়ি দিয়েছেন তা জানিয়ে দিলেন গুলজানের মা কে । গুলজানের বাবার খোঁজ তিনি পেয়েছেন । হামিদুল্লাহ এখনও বেঁচে আছে ।

এইটুকুন খবর না পাওয়াই ভাল ছিল । এতে অস্বস্তি আরোও বেড়ে গেল । গুলজানের নানা এর থেকে আর বেশী কিছুই জানেন না । জানবার উপায়ও নেই। তবে যার মাধ্যমে খবর পেয়েছেন তাতে ভুল হবার সম্ভাবনা নেই । অপেক্ষা সেই অপেক্ষাই থেকে গেল , বরং অপেক্ষার যন্ত্রণা বেড়েই গেল গুলজানের মায়ের ।

#

রুবি পাথরের মত প্রতিদিন চকচকে ভোর নেমে আসে পাঞ্জশীর উপত্যকায় । পাহাড় থেকে নেমে আসা নীল পানির ফোয়ারায় উপরের আকাশ পরিচ্ছন্ন দেখায় । চোখের যৌবন ফিরিয়ে দেবার মত রূপ আছে উপত্যকার সবুজ পাহাড়ে । জনাদশেক ভীন দেশী এসেছে এখানে । তাদের নিরাপত্তায় আরও চারজন । মার্কিন আর জার্মান দেশীয় কিছু মানুষের আনাগোনা বেড়েছে ইদানিং । আফগানিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে এখানকার অবস্থা অনেকদিন দিন ধরেই ভাল । সেনাদের চোখের ঘুম আর হারাম হয় না । নিশ্চিন্তে থাকার মত একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে বলা যায় ।

আজও পথ চেয়ে বসে ছিল গুলজানের মা । ধূসর বিস্তীর্ন পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যেন আকাশের অগনিত তারার ভীরে খেয়াল হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর । কেউ হাটছে । বহুদূর থেকে নিঃশব্দে কেউ যেন লুকোচুরি খেলছে তাঁর সাথে। অতি সাবধানে পা ফেলছে , তাঁর চেয়েও বেশী সাবধানে দম ছাড়ছে । গুলজান এত রাত অব্দি জেগে থাকতে পারে না । গুলজানের মা চোখেরতারা সঙ্কুচিত করে খুঁজতে থাকে ছায়ামূর্তিকে । জানালার সামনে এসে দাঁড়ায় লোকটি । দীর্ঘ অপেক্ষার বা অনিশ্চিত প্রতিক্ষার পরে আঁচমকা কোন কিছু ফিরে পাওয়ায় একটা অস্বস্তিকর ব্যাপার থাকে । দুজন শুধু দুজনের দিকে চেয়ে আছে । পাথরের মুর্তির মত স্থির চোখ , সেই চোখে শুধু নিরব ঝর্নার মত অশ্রুর অবারিত সমর্পন ।

একটি কথাও হল না । শুধু দৃষ্টিইন্দ্রিয় ছাড়া আর কোন ইন্দ্রিয় সচল ছিল না । রাতের আঁধারও প্রতারণা করতে জানে । হামিদুল্লাহ আর বেশীক্ষন থাকতে চাইলেন না । যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই চলে গেলেন । বোবা বোকা মানুষের মত চেয়ে রইলেন শুধু । পপি ফুলের দোল খাওয়া গুলিস্তানে যেন আগুনহীন এক তীব্র তাপদাহ এসে সব পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে গেল । বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে নিশ্চই ।

#

গত রাতের ঘটনাটি যে স্বপ্ন ছিলনা তা গুলজানের মা জানে। কিন্তু তবুও তাঁর কাছে এটা স্বপ্নই মনে হচ্ছিল। দৈবাৎ ঘটে যাওয়া এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনাকে সে সাধারন ভাবে মেনে নিতে পারছে না। কত কিছু বলার ছিল তার । কিন্তু কিছুই বলা হয় নি। কত দিন পরে দেখা তবুও কেমন যেন নিত্যকার অন্ধকারে সবকিছু অচেনা মনে হচ্ছিল। 

নানার মুখে বাবার কথা শুনে গুলজান আজ সারা দিন বাবা বাবা বলে বিরক্ত করেছে ওর মাকে। বিরক্ত হবারই কথা । বাবা কোথায় এই প্রশ্নের কি কোন উত্তর আছে তার কাছে? জানিনার চেয়ে ভাল, সমীচীন জবাব আর ভেবে পায় না গুলজানের মা।

আজ রাতেও জানালার ধারে কান পেতে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে গুলজানের মায়ের। কিন্তু না । এভাবে দেখবার সাধ নেই তার । গুলজানের বাবা যদি এসেই থাকে তাহলে তারই ডাক দেওয়া উচিৎ । গুলজানের মায়ের সাথে কথা বলা উচিৎ।গুলজানের কপালে চুমু দেয়া উচিৎ। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন বাসি ফুলের গন্ধ ভেসে আসল গুলজানের মায়ের নাকে । রাতের ফুল গুলো ঝরে গেছে । পত্র বিয়োগের নিশ্চুপ শব্দও ঠাহর হলো ,কিন্তু হামিদুল্লাহর নিশ্বাসের উষ্ণ স্থলন শোনা গেল না । গুলজানের মায়ের চোখে কয়েক বিন্দু অশ্রু । সমস্ত চির সমর্পনের অণুরনন কত নিশ্বব্দের !

পাঞ্জশীর নদীর তীব্র জলস্রোত কল কল শব্দে এগিয়ে যাচ্ছে । সহস্রকাল আগে নাকি এই তীব্র জলস্রোত কে আটকে দিয়ে এই উপত্যকাকে রক্ষা করেছিল তাজিক পাঁচ যুবক । সেখান থেকেই এই নদী আর উপত্যকার নাম পাঁচ সিংহ বা পাঞ্জশীর । অনেক দেশী ভ্রমনচারীদের সাথে সেই মার্কিন আর জার্মানি থেকে আসা তরুনেরাও এখানে এসেছে । ডাইভিং করার ইচ্ছে জেগেছে ওদের । ডাইভিং করার জন্য এমন  স্বচ্ছ জলস্রোত দুনিয়ায় বিরল। যদিও দূতাবাস থেকে অনুমতি পেতে তাদের ভীষণ বেগ পেতে হয়েছে।

মেঘে বারবার ঢেকে যাচ্ছে দূরপ্রসারী তারাদের টিপটিপ আলো । নব বসন্তের আগে ঝুপ ঝপ বৃষ্টি শুরু হলো । বৃষ্টির নিরব ছন্দ পতনে ব্যাঘাত ঘটল । গুলজানের মা উঠে বসলেন । হাতের সিওরে রাখা চ্যারাগের সলতে আরও একটু কমিয়ে জানালায় চোখ স্থির করলেন । হামিদুল্লাহ এসেছে আজ । আজ তেমন লুকোচুরি ভাব ছিল না । ইশারায় দরজা খুলতে বললেন । অনেক দিন পর নিজের ঘরের অতি পরিচিত গন্ধ নিলেন বুক ভরে । যেন এই ঘরের মুক্ত স্বাধীনতা ছেড়ে এতদিন সে বাইরের আবদ্ধ চারদেয়ালে বন্দী হয়ে ছিল। চোখের জল মুছে দিল গুলজানের মা। ছল ছল চোখের গভীর থেকে উঠে আসল সুপ্তরাগ, ঘুম ভাঙা আগ্নেয়গিরির মত। স্বামীর উষ্ণ নিশ্বাসের প্রেম ও পুষ্পাগ্নিতে কবেকার ভর্ৎসনার গম্ভীর আকাশ রঙীন হয়ে উঠল ।

মন খুলে কথা বলার সুযোগ পেয়েছে গুলজানের মা।কী হয়েছে তোমার? কোথায় গিয়েছিলে ? আবার চলে যাবে? কেন যাও ? খুলে বলো গুলজানের বা্বা ! এই সব প্রশ্নের একই রকম মুখাভিব্যক্তি হামিদুল্লার । দু হাত দিয়ে স্ত্রীর চোখে চোখ স্থির করে হামিদুল্লাহ বলল , তোমার জন্যই যাই । গুলজানের জন্য যাই । তবে আর বেশী দিন নাই । খুব তাড়াতাড়িই আমি ফিরে আসব । তুমিত জানো এইখানে নিজের ইচ্ছামত বাঁচা যায়না । গুলজানরে ডাক দাও । ওর সাথে কথা বলি ।

কখন যেন গুলজান পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে । গুলজানের চোখে ঘুম । তবুও সেই ঘুম কে ছাপিয়ে চোখের তীক্ষ্ণ নজর গিয়ে পরেছে আগন্তুকের উপড়ে। হামিদউল্লাহ গুলজানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল । গুলজান মায়ের দিকে তাকাতেই মা গুলজান কে বলল , ইনি তোমার আব্বা গুলজান । গুলজান কিছুটা অপ্রস্তুত থাকলেও তার বাবার কোলে সে লুটিয়ে পড়ল । বাবার বুকের মত প্রসস্ত বুক সে কোনদিন অনুভব করেনি । এমন বিশ্বস্ত বুকে কোন দিন ঘুমায়নি গুলজান । কখন কিভাবে যেন আবার ঘুমিয়ে পরল সে । যখন তার ঘুম আক্রান্ত চোখের দিকে তাকাল হামিদুল্লাহ, তখন সে তার চোখের কোনে একফোটা স্থির সঞ্চিত জলবিন্দু দেখতে পেল। হামিদুল্লাহর বুকের ভিতরের মহাশূন্যতায় কে যেন বার বার আঘাত করতে লাগল আর সেই আঘাতের প্রতিধ্বনি তীরের মত এসে বিধছিল তার বুকে।

এবার দীর্ঘক্ষণ ছিল হামিদুল্লাহ । সে ফিরে এসেছে । এমন সুখের খবর গুলজান ও তাঁর মায়ের জন্য গোপন করা কঠিন । কিন্তু তবুও গোপন করতে হবে । এই ফিরে আসা আপাতত গোপন না করলে বিপদ হতে পারে । গুলজানের মায়ের জন্য এটা তেমন কিছু না । কিন্তু গুলজানের জন্য ? ছোট্ট বুকে কি এই খুশির জোয়ারে বাঁধ মানবে ?

গুলজান পারছে । তার কাছে বাবা ফিরে এসেছে , নিশ্চই এটা খুশির কিন্তু সেই খুশিকে সে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে । তাঁর বাবা এখন মাঝে মাঝেই আসছে । ভালোবাসা , ভালোলাগার যে কোন কোন কিছু বার বার পেতে যে কি আনন্দ তা বলে বোঝানো যায় না । কিন্তু গুলজানের ও অনেক ইচ্ছে বাবাকে নিয়ে । সে তাঁর সাথে খেলবে , পাহারের কোল বেয়ে বেয়ে সমতল ভুমিতে যাবে ভেরা গুলো নিয়ে । আবার সন্ধ্যা হলে বাবার কাঁধে চড়ে শেষ সূর্যের মুখ দেখতে দেখতে বাড়ি ফিরে আসবে।

এই কদিনে হামিদুল্লাহ অনেক বার এসেছে । কত কিছু নিয়ে এসেছে গুলজানের জন্য !দিনের চেয়ে রাতই বরং ইদানিং গুলজানের কাছে বেশী উপভোগ্য , আনন্দময় । তাঁর কেছে এই মুহুর্তটায় পৃথিবীটা সবচেয়ে পরিপূর্ণ মনে হয় । গুলজান টিপটিপ চোখে দেখে বাবা কিভাবে নিশ্বব্দে হাসতে পারে ! গুলজান তাঁর বাবাকে অনেক জিজ্ঞেস করল , আব্বা তুমি কোথায় যাও ? এত অন্ধকারে ভয় পাও না ? আমাকে নিয়ে যাবে তোমার সাথে ? হামিদুল্ললাহ মেয়েকে জড়িয়ে ধরে । এমন আদুরে গলায় ফিসফিস করে মেয়েকে কথা গুলোর উত্তর দেয় যে গুলজানের আর কিছুই জানতে ইচ্ছে করে না । কিন্তু তবুও দিন শেষে গুলজানের মনে একটাই প্রশ্ন থেকে যায় , আব্বু কোথায় যায় ?

#

সামনে নওরোজের উৎসব । চারিদিকে কেমন উৎসব মুখর একটা আমেজ । প্রতিবারের মত এবার আর নিরব নিশুতি অন্ধকার নেমে নেই গুলজান দের বাড়িতে । হামিদুল্লাহ কথা দিয়েছে এবার সে আসবে। এমনকি সে আবদার ও করে রেখেছে । ভেরার দুধের ছানা , নান রুটি , ভেরার পোড়া গোস্ত খাবে সে । কাবুলি পোলাও সে অনেক দিন খায় নি । তাই গুলজানের মাও যথা সম্ভব আয়োজন করছে চুপিশারে । গুলজান ও বেজায় ব্যস্ত । গত কয়েকদিনে সে খলতেও যাচ্ছে না । বাবার জন্য তারও কিছু করা উচিত । মাঝ রাতে বাবার আসতে খুব কষ্ট হয় । তীব্র শীতে বাবাকে সে কাঁপতে দেখেছে।

কালো উলের সুতো দিয়ে চাঁদর বুনছে গুলজান । বেশ মাঝাড়ি আকারের উলের চাঁদর । বাবার চওরা কাঁধে দারুন লাগবে । বিকেল গড়িয়েছে বেশ । গুলজান আর গুলজানের মায়ের প্রায় সকল প্রস্তুতি শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু হঠাৎ চারদিক কেমন যেন শুনশান হয়ে পড়ল । পাহারের গায়ে যেন অভিশাপের চাঁদড় ঢেকে গেছে । পাঞ্জশীরে নদীতে বিদেশী দের উপড় হামলা হয়েছে । পাঞ্জশীরের স্বচ্ছ সুন্দর জলরাশি লাল রক্তে রক্তিম হয়ে গেছে । সবচেয়ে শান্ত , শান্তি আর নিরাপদ পাঞ্জশীরে হঠাৎ অশান্তির আনাগোনা শুরু হয়ে গেল । যেই পথে নিশ্চিন্তে রাখাল ভেরা ,দুম্বা চড়িয়েছে সেই পথে আফগান পুলিশের কড়া প্রহড়া । চারিদিকে রেড এলার্ট । যারা এই গুপ্ত হামলা করেছে তারাও জানিয়ে দিয়েছে তাদের উদ্দেশ্য । সব কিছু কেমন এলোমেল হয়ে গেল ।

আশঙ্কাই সত্যি হলো। রাতের আধার জমে জমে আবার আলোয় মিলিয়ে গেল ।কিন্তু হামিদুল্লাহর দেখা পেলনা গুলজান । তাঁর পছন্দের খাবার , নান, কাবুলি পোলাও , দুধের ছানা পড়ে আছে । গুলজানের কোলে ছড়িয়ে আছে উলের চাঁদর । ছল ছল চোখে সেই চাঁদরে জোড়ির ফুলের অসমাপ্ত নকশা আঁকছে সে । বাবা হয়ত আগামী রাতে আসবে সেই চিন্তায় খাবার গুলো রেখে দেয়া হয়েছে। সন্ধ্যার মিটি মিটি সলতে আলোয় রাত জেগে জরির ফুল আঁকছে গুলজান । সলচের আলোয় চকমক করে উঠছে নার্গিস ফুলের নিখুঁত নকশা। পরের দিন ও দেখা নেই গুলজানের বাবার । গত দুই দিনের অপেক্ষা যেন পূর্বেকার বহু বছরের অপেক্ষার চেয়ে দীর্ঘ মনে হচ্ছে গুলজানের কাছে ।

গুলজান বাবার ফিরে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে আছে । কিন্তু সে পথ একটু দূড়ে গিয়েই পাহাড়ের আড়ালে আধারে ঢেকে গেছে । গাঢ় আঁধারের অমন ঘুটঘুটে নির্জীব অন্ধকারে গুলজান তাঁর বাবাকে হারিয়ে যেতে দেবে না। এদিকে চারিদিকে তখন কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনি । পাঞ্জশীরের সবুজ বুক চিড়ে কেমন একটা শঙ্কোচ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে । দেশী বিদেশি সেনারা ওত পেতে আছে এই হামলার বদলা নেয়ার জন্য । পাহারের খাঁজে , আড়ালে , অদৃশ্যে ইগল চোখে তাকিয়ে আছে ওরা ।

যে নতুন দিনের সুখে অনাগত ভবিষ্যৎএর স্বপ্ন দেখছিল গুলজান, তা আবার ঢাকা পড়ে গেল হিন্দু কূশের তীব্র শীতের জমাট অন্ধকারে । গুলজানের মাঝে মাঝে মন চায় পাহারের এই পথ ধরেই এগিয়ে যেতে । বাবা আবার কেমন করে ভুলে গেল তাদের ?

পূর্নিমার চাঁদ দুলছে আকাশে । নিয়ন আলোয় শীতের প্রভাতে মেঘ গুলো কেমন ঘুমন্ত বকের মত কুজ মেরে আছে । পাতায় পাতায় দোল খাচ্ছে ঠান্ডা শিশিরের জল। আবার সেই মৃদু পদক্ষেপের শব্দ । কেউই এই শব্দের অস্তিত্ব টের পায়নি । হামিদুল্লাহ আবার এসেছে । তাঁর মুখে সেই আনন্দ নেই । চোখে মুখে তীব্র ভয় । চোখের কোঠর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই কদিনে । হামিদুল্লাহ এসেই গুলজানকে জড়িয়ে ধরল। মা! গুলজান , বাইরে অনেক সমস্যা এখন । আর কয়টা দিন একটু কষ্ট হবে । আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি । একে বারে চলে আসব । চিরদিনের জন্য চলে আসব। সব ঠিক হয়ে গেছে । হামিদুল্লাহ গুলজানের কপালে চঞ্চল একটি চুমু দিয়ে গুলজানের মায়ের হাত ধরে বললেন , আমাকে মাফ করো গুলজানের মা । আজ এখনি চলে যেতে হবে । একটুও সময় নেই । হামিদুল্লাহ এই বলে ফিরে যাবে তখন গুলজান তাঁর নিজে হাতের বানানো ছোট্ট উলের চাঁদর হামিদুল্লাহর চওরা কাঁধে পড়িয়ে দিল । বাবা চাঁদরটি মুখের কাছে নিয়ে বড় একটা নিশ্বাস ফেলে ফিরে গেল । সেই চাঁদরে চোখ মুছলেন বার কয়েক ।

গুলজান বাবার ফিরে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে আছে এখনও । ছোট ছোট মেঘে বার বার ঢেকে যাচ্ছে আলোক-উজ্জল পুর্নিমার চাঁদ । চাঁদের আলোয় কখনও কখনও পাহারের গায়ের আঁকা বাঁকা পথ জেগে ওঠে। বাবা কোথায় যায় , এই পথের গন্তব্য কোথায় জানতে হবে গুলজানকে । গুলজান টিলার উপড়ে উঠে পথ অনুসরন করে । চারিদিকে অন্ধকার আর আলোর মৃদু মিশ্রনে সব কিছু অন্যরকম দেখাচ্ছে । হঠাৎ চাঁদের আলোয় যেন দূর পাহারের কৃষ্ণ সাগরে কিছু একটা চকচক করে উঠল । গুলজান আরও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল । হ্যা , চাঁদের আলোয় একটা নার্গিস ফুলের আদল চকমক উঠেছে । বাবার পিঠে জেগে ওঠা নার্গিসের নিশানায় অতি মনোযোগে অপলক তাকিয়ে থাকে গুলজান । কাল ভোর হলেই বাবার কাছে একাই পৌছে যাবে সে। গুলজান আরও ভালোভাবে দেখার জন্য একটু এগিয়ে যাবে ঠিক এমন সময় আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ঠাস ঠাস শব্দ করে চার-পাঁচটা গুলির আওয়াজ শোনা গেল । তীব্র শব্দে পাঞ্জশীরে উপত্যকার পাখিদের ঘুম ভেঙে গেল । জোড়ির নকশা করা নারগিস ফুলের সেই চকমকি আলোটাও আর দেখা যায় নি।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.