মনোনীতা চক্রবর্তী

'দীপালিকায় জ্বালাও আলো / মনোনীতা চক্রবর্তী

সকাল থেকেই আজ ছেলের পছন্দ মতো খাবার বানিয়েছেন বরুণ। বরুণ রক্ষিত। আজ বুকানের জন্মদিন। বছর দশের বুকানকে কোনোদিন মায়ের অভাব বুঝতে দেননি বরুণ। বুকানের জন্মের পরই সেপটিসিমিয়ায় ওর মা ওদের ছেড়ে চলে যায় চিরকালের মতো। সেদিন ছিল কালী পুজো। চারদিকে আলোর মিছিল আর মিছিল! তারিখটা মনে রাখতে চায় না বরুণ; ওর শুধু মনে হয় রুবি আলোর পথ ধরে আকাশে যাচ্ছে আর দিয়ে যাচ্ছে আজীবনের এক প্রাণের উপহার ও গুরু দায়িত্ব! আসা-যাওয়ার ওপর কারই-বা হাত রয়েছে, গভীর ব্যথাভারের মধ্যেও ওই অমাবস্যার রাতে একটা আলো রুবি বরুণের হাতে তুলে দিয়েছে! সেই আলোই তো বুকান, যাকে সামলাতে-সামলাতে নিজের জীবনকে সামলানোর কথা ওঁর আর মাথাতেই আসেনি! আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী কতবার ওকে বলেছে আবার বিয়ে করার কথা, কিন্তু বরুণ কিছুতেই রাজি নন। তার একটাই স্বপ্ন, ছেলেকে মানুষ করে তোলা। একেক সময় খুব বিরক্তবোধও করেন। এই একইকথার উত্তর দিতে বরুণের ভালো লাগে না। ঘরে বসেই দুটো ব্যাচে ছাত্র পড়ায় সে। বুকান হওয়ার পরই ওঁকে এম আর-এর চাকরিটা ছেড়ে দিতে হয়েছিল। আপাতত অনলাইনেই ক্লাস করানো হচ্ছে। লক্ষ্মী পুজো পর্যন্ত ছুটি ছিল। আবার কালী পুজো উপলক্ষে দু-দিন ছুটি। বাবা হয়েও একজন কী চমৎকার মা বরুণ! আসলে, সবটাই তো অন্তর্গত একটা তাগিদ! আমি কত মা-কেও দেখেছি কী অসামান্য পিতৃত্বের ছায়াগাছ হয়ে সন্তানকে লালন করছেন! গত দু-দিন থেকেই বুকানের বেশ ভালোই ঠাণ্ডা লেগেছে! সিজন-চেঞ্জের সময় হেমন্তের মিহি কুয়াশা এভাবেই বুকে বাসর বসায়, এই এক জ্বালা! ইনহেলার নেওয়ার পরও 'হ্যাচ্চও-হ্যাচ্চও" যায় না! তাই আজকের মেন্যুতে আইসক্রিম খুব পছন্দের হলেও তা রাখেননি বুকানের বাবা বুকানের জন্য। আজকের দিনটা এলেই শত ব্যস্ততার মধ্যেও সে কেমন বারবার আনমনা হয়ে যায়! রুবির মুখটা বারবার ভেসে ওঠে! আত্মীয়স্বজন কতবার বলেছে যে ঘরে রুবির একটা ফটোতে মালা-চন্দন দিয়ে সাজিয়ে অন্তত আজকের দিনে ধূপ-ধুনো-ফুল দিতে কিংবা দীপাবলিতে জন্মদিন না-করে, ওর জন্ম-তারিখেই ওর জন্মদিন করতে; কিন্তু নাঃ, বরুণ কারও কথাই শোনেননি আজ পর্যন্ত। ওঁর কাছে আলোটুকুই সব। বারান্দায় কয়েকটি প্রদীপও জ্বালিয়ে দিয়েছেন ইতিমধ্যেই। পায়েস সহ সব খাবার তো সব রেডিই আছে। হঠাৎ মনে হল যে এবার তো বুকানের প্রিয় আইসক্রিম দেওয়া হবে না, তাই বরুণ খাবার সব ডাইনিং-টেবিলে সাজিয়ে, দেওয়ালে নানা রঙের বেলুন সাজিয়ে ছেলের পছন্দের মিহিদানা মোড়ের মাথার সামনের দোকান থেকে আনতে গেছেন। বুকানকে আগে থেকে কিছু বলেননি। ও ঘুমোচ্ছিল। কিন্তু মোড়ের দোকানে মিহিদানা ফুরিয়ে গেছে বলে সে টার্মিনাসের সামনে কুন্ডু কেবিন থেকে মিহিদানা আর একটা ক্যাডবেরি কেনেন। তাড়াহুড়ো ছিল খুব, ঘরে বুকান একা তো! ঘরের জানালাটাও বন্ধ করা হয়নি, পোকার যা অত্যাচার!হেঁটে-হেঁটে আসছিলেন বরুণ আর ভাবছিলেন যে বিকেলে যে কেন মনে পড়লো না, মিহিদানা আনার কথা... রাস্তায় এক্স আর্মি-ম্যান হাজরা বাবুর সাথে অনেকদিন পর দ্যাখা; প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে কথায়-কথায়; তাড়াহুড়ো করে মোবাইলটাও আনতে ভুলে গিয়েছেন। মোড়ের কাছে আসতেই পাড়ার রণ কাকুর ছেলে বলে, -শিগগির বাড়ি যাও...

বরুণ ওর দু-কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে কেন রে, বুকান ঠিক আছে তো?

কথার অসম্পূর্ণ রেশ। বাড়ির খোলা জানালার সামনে ভিড়। তালা খুলে দ্যাখেন ওঁর বেলুন সাজানো ঘরটায় বিছানা থেকে ছিটকে চাদর সমেত মেঝেতে পড়ে আছে বুকান...

হাত থেকে সব পড়ে যায় বরুণের। পাগলের মতো কাঁদতে থাকেন বরুণ! ওঁর দশ বছরের অটিজম আক্রান্ত নন-ভারবাল বাচ্চাটা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে! বরুণের ফোনে অসংখ্য মিসড-কল! চারপাশে প্রচুর কথারা উড়ছে-ভাসছে! বুকানকে একটা এমব্যুলেন্স-এ করে বরুণ বুকে জড়িয়ে হসপিটালে নিয়ে যান, সাথে রণ কাকু ও পাড়ার ছেলেরা...

ইমার্জেন্সির ভারপ্রাপ্ত ডাক্তার সঙ্গে-সঙ্গে বুকানকে ভেন্টিলেশনে দেন, চারপাশে লাল রঙে লেখা আই সি ইউ আর তার কাচের দেওয়াল...

হঠাৎ কাচের দরজা দুটো কেমন রাক্ষসের হাঁ-এর মতো খুলে গেল... একটা নিটোল স্তব্ধতা শুধু..

অনবরত আতস-বাজি আর রং-মশালের তীব্র বিষাক্ত গ্যাস বুকানের সবটুকু শ্বাসকে দুমড়ে-মুচড়ে আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিল...ডাক্তার তেমনই জানান রণ বাবুকে...

প্রতিরাতে অন্তত একবার আকাশ দ্যাখা যাঁর অভ্যেস, সেই বরুণ আজ আর আকাশের দিকে তাকাতে পারেননি...

আলো জ্বলছে; আলো পুড়ছে; চারপাশে দলাপাকানো ধোঁয়া; বরুণের সমস্ত পৃথিবীটাই আকাশ হয়ে গেছে... একটা ভয়ঙ্কর ঝাপসা ঝলসানো আকাশ...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.