বসন্তের যাওয়ার এখনও দেরী আছে। তবে দেখতে দেখতে সময় ঠিক এসে যাবে। মা ঘ্যান ঘ্যান করেও শেষ পর্যন্ত বসন্তের জন্য কিছু মাস্কের অর্ডার দিয়েছেন। যদিও বসন্তকে কেউ দেখতে পাবে না। শুধু অনুভব করবে, কোকিলের ডাকে আর ‘বসন্ত এসে গেছে ’- গানে। তবুও মায়ের মন বলে কথা। সব সময় ভয়ে ভয়ে আছেন। হাহুতাশ করতে করতেও বলছেন – ‘ভাগ্যিস বসন্ত বাছা আমার গ্রীষ্ম অথবা বর্ষা নয়, তাহলে যে কী হতো! চিন্তায় চিন্তায় আমার সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়ে যেত। আমি যদিও এতোদিন গ্রীষ্ম ও বর্ষার মাকে মনে মনে হিংসাই করতাম। শুধু আমি একা নই। হেমন্ত, শরৎ ও শীতের মা-ও হিংসা করত কিন্তু এ বছর মনে হচ্ছে ভালই হলো। বসন্ত প্রকৃতিতে প্রেম প্রেম গন্ধ ছড়িয়ে ছুটে বাড়ি চলে আসবে। বসন্তের আগমনে পলাশ ও কৃষ্ণচূড়ায় ফুল ফুটতে না ফুটতেই সরস্বতী পুজো এসে যাবে। বসন্ত তল্পিতল্পা গুটিয়ে ফিরে আসবে বাড়ি।’ ততক্ষণে ব্যাটা গ্রীষ্ম বাক্সপ্যাটরা বেঁধে প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে নেমে পরবে। গ্রীষ্মের মা গ্রীষ্মের চিন্তায় বিছানা নিয়েছেন। সাতদিনে সাতটা ব্রত করছেন। মনে মনে বলছেন-‘ করোনাসুরকে বিনাশ কর ঈশ্বর। বাছা যেন সুস্থ থাকে।’
এখন গ্রীষ্ম এলে বর্ষা বাড়িতে বসে ছুটি কাটায় না। আবার ঘোর বর্ষায় গ্রীষ্ম ঘুমিয়ে কাটাতে পারে না। দুজনের এখন একই সঙ্গে সহাবস্থান চলে। এই প্যাঁচপ্যাঁচে গরম, পরক্ষণেই বৃষ্টি। তাই ষড়ঋতুদের পাড়ায় আড়ি পাতলে শোনা যাচ্ছে, গ্রীষ্মের মায়ের সঙ্গে বর্ষার মায়ের মুখ দেখাদেখি নাকি বন্ধ।
বর্ষার মা সেদিন শরতের মাকে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলছিলেন -‘ সেই কবে থেকে মনে সাধ ছিল শরৎএর সঙ্গে বর্ষার বিয়ে দেব। শান্ত, ভদ্র শরৎ আর সবুজে সবুজ বর্ষাকে রাজযোটক মনে হত। আমার ভালো মেয়ের কানে ফুসমন্তর দিয়ে গ্রীষ্ম বর্ষাকে বশ করেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে গ্রীষ্ম ও বর্ষা হাতে হাত ধরে সারা বছর চলেছে। লজ্জায় কানে তুলো দিয়ে থাকি।’ শরতের মা শরতের মতই শান্ত। এতক্ষণ চুপ চাপ কথা শুনেছেন। এখন খানিক ফিস-ফিস করে বলেন – ‘ অদৃষ্টের লেখা কে খন্ডাবে দিদি? দুঃখ করোনা, দেখ ওরা ভালো থাকবে। আরে থাকবে বলছি কেন, ভালই আছে। তাইতো শুনি। একই বাড়িতে থাকে। লিভ-ইন করে। মাঝে মাঝে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দুজনে কফি খায়। বাইরে তখন আকাশে রোদ থাকলেও বৃষ্টি পড়ে। সেই সময় আমার শরতের কষ্ট চোখে দেখা যায় না। নাওয়া খাওয়া ছেড়ে বিছানায় শুয়ে চোখের জল ফেলে। বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিল বর্ষাকে। গুণগুণ করে গান করে। আমার কানে এসে গানের কলি ঝাপটা মারে “এ ব্যাথা কি যে ব্যথা বোঝে কি আনজনে”, বেশ কয়েক বছর আগে যখন হেমন্ত, শরত, বসন্তকে উৎখাত করার জন্য গ্রীষ্ম ও বর্ষা উঠে পরে লেগেছিল তখন শরৎ কিছুতেই মানতে রাজি ছিল না যে, এটা গ্রীষ্ম ও বর্ষার আগ্রাসন নীতি। তখন শরৎ জোর গলায় বলত বর্ষা অথবা গ্রীষ্মের জন্য এগুলো হচ্ছে না। মানুষের লোভ দিনে দিনে বাড়ছে, প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে প্রকৃতির ক্ষতি করছে। সবুজ ধ্বংস্ব করছে তাই প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে। আমার ছেলেটা বড্ড চাপা। মনে মনে আজও ভালবাসে বর্ষাকে। বর্ষার জন্য খুব চিন্তা করে। প্রায়ই বলে গ্রীষ্মের দাবদাহে অদৃশ্য ভাইরাস থাকবে না কিন্তু স্যাতস্যাতে আবহাওয়ায় বর্ষাকে যদি অদৃশ্য ভাইরাস আক্রমণ করে? স্বপ্নের মধ্যে শরৎ চেঁচিয়ে ওঠে ‘ একদিন রুক্ষ, মাথা গরম গ্রীষ্মকে ছেড়ে বর্ষা আমার কাছে ফিরে আসবে। সেদিন প্রকৃতির আকাশে শুধু শরৎ ও বর্ষার সারা বছর খেলা করবে।’ বর্ষার মা চোখের জল মুছে বলেন, ‘তাই যেন হয়। ওই রুক্ষ, তপ্ত গ্রীষ্মের হাত থেকে আমার ভালো মেয়েটাকে বাঁচাও ঠাকুর।’
সুচিন্তিত মতামত দিন