বনবীথি পাত্র

বনবীথি পাত্র

শীতকালের দিন বড়ো তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায় । বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমেছে শহরতলিতে । ঝাপসা ঝাপসা কুয়াশা মাখা আঁধার । আশালতার প্রাণহীন দেহটা শোয়ানো রয়েছে একতলার বিশাল হলঘরটাতে । অন্যদিন এখানেই সান্ধ্যপ্রার্থনার আসর বসে । নাহলেই বা রক্তের কেউ , নাই বা হলো আপনজন ; শেষদিনের সাথী তো সবাই!

গতকাল সকাল থেকেই জ্বরটা বাড়ছিল , ডাক্তারবাবু দেখেও গিয়েছিলেন বার দুয়েক । কিন্তু ওষুধে যেন সাড়া মিলছিল না । রাত বাড়ার সাথেই বাড়তে লেগেছিল গায়ের তাত । জ্বরের ঘোরে শুধু একটাই কথা বলছিল আশালতা , বাড়ি যাব, বাড়ি। রাতেই ওনার ছেলেকে খবর দিয়েছিলেন ম্যানেজারবাবু , সকালেই একটিবার মা-কে দেখতে আসার জন্য । ছেলের আসার সময় হয়নি। দুপুরে চলে গেলেন আশালতা....

মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে ছেলে আসছে , মাকে বাড়ি নিয়ে যাবে , তারপর শ্মশানে ।

নয়নতারা ও তখন এখানে নতুন , মাস তিনেক হলো এসেছেন । চিরকালের ভোরবেলা ওঠার অভ্যাসটা এখানে এসেও ছাড়তে পারেন নি । রোজকার মতো সকালে উঠে সামনের বাগানটায় হাঁটতে গিয়ে খেয়াল করেন বকুলগাছটার বাঁধানো বেদিটাতে কে যেন বসে । কাছে যেতেই বুঝতে পারেন , "ভালো বাসা" র নতুন সদস্যা , গতকাল সন্ধ্যেতে এসেছেন । এখানে এলে মনটা ধাতস্ত হতে কিছুদিন সময় সবারি লাগে । আশালতার ও লেগেছিল । তবে সেদিন ভোরবেলার প্রথম পরিচয় থেকেই একটু বেশি বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল নয়নতারার সাথে । জন্মের হিসাবে আশালতা বছর দুয়েকের ছোট ছিল , তাই নয়নতারাকে দিদি বলেই ডাকতো আশালতা ।

আশালতার ছোটবেলা কেটেছিল বারো ঘর এক উঠানের ভাড়াবাড়িতে । ছোট একটা ঘরে তিন ভাইবোন আর বাবা-মায়ের সংসার । এতো জায়গা কম ছিল যে বুক ভরে দমটাও যেন নিতে পারতো না সবাই । বন্ধুদের সুন্দর সুন্দর বাড়িগুলো দেখতো আর একটা সুন্দর বাড়ির স্বপ্ন দেখতো আশা । বাবা সারাজীবনের সঞ্চয় জমিয়ে শেষ বয়সে একটা বাড়ি করেছিলেন , তিনকামরার একতলা বাড়ি । আশাদের কাছে সেটাই তখন স্বপ্নের মতো সুন্দর , নিজের বাড়ি । যে বাড়ির সবটুকুই নিজেদের , কারো সাথে ভাগ করে নিতে হবে না উঠোন-কলতলা-বাথরুম । নতুন বাড়িতে এসে বছর ঘুরতেই বিয়ে হয়ে গেল আশার। মফস্বল ছেড়ে পাড়ি দিল শ্বশুরবাড়িতে । যতবড়ো শহর আর ততবড়ো বাড়ি । কিছুদিন যেতেই এতোবড়ো বাড়িতে যেন হাঁফিয়ে উঠল আশা , বাড়ির বৌ তো নয় যেন বন্দিনী সে । ছাদে যাওয়া চলবে না - জোরে কথা বলা চলবে না - আওয়াজ করে হাসা চলবে না । একদিন সন্ধ্যেবেলা রান্নাঘরে কাজ করতে করতে গুনগুন স্বরে গান গেয়েছিল বলে শ্বশুরমশাই সবার সামনে বলেছিলেন , আমার বাড়িতে এইসমস্ত নাচগান চলবে না। এটা ভদ্রলোকের বাড়ি , এটা কোনো বাঈজি বাড়ি নয় ।

মফস্বলের নিজের ছোট বাড়িটার জন্য মনটা আনচান করতো । তাতেও শাশুড়িমার কতো কথা , বাপের বাড়ি র জন্য অত মন কেমন করে যদি তোমার বাবা তো মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে ঘরে বসিয়ে রাখলেই পারতেন!

"বাপের বাড়ি" আর "শ্বশুরবাড়ি" র মাঝে কেমন যেন গৃহহীন লাগতো নিজেকে ।

সংসার জীবনে ব্যস্ততার ফাঁকে আর পাঁচটা মেয়ের মতোই নিজের ভালোলাগা-মন্দলাগা গুলো হারিয়ে গিয়েছিল আশার । বাবা-মা চলে গেছেন , মফস্বলের ছোট্ট বাড়িটা হয়ে গেছে ভায়ের বাড়ি ।​

আশার স্বামী আশাকে একটা নিজের বাড়ি উপহার দিয়েছিলেন । নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মনের মতো করে বানিয়েছিলেন বাড়িটা , নাম রেখেছিলেন "আশালতা " ।​

শুধু তাঁর সাধের "আশালতা" তে ছটা মাস ও থাকতে পারেনি মানুষটা , বিনা নোটিশে চলে গেছেন সবাইকে ছেড়ে ।​

তারপরের পনেরটা বছর কেটে গেছে ঐ বাড়িতে । নাতি-নাতনি বড়ো হয়ে গেছে । ছেলেবৌমার সংসারে কখন যে প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে বুঝতেও পারেনি । ছেলে যেদিন বাড়িতে মায়ের সঙ্গীর অভাবের কথা তুলেছিল , সেদিন-ই বুঝতে পেরেছিল সবটুকু । "ভালো বাসা" তে আসতে কোন দ্বিমত করেননি । বাড়িটুকু নিজের হলেও সংসারটা তো ছেলের !!!! নিজের মানুষগুলোই যখন তাকে চাইছে না​ , ইঁট-কাছ-পাথরের বাড়িটাকে আগলে ধরে রাখেনি নিজের বলে । সমস্ত অধিকার নিঃশর্তে ছেড়ে চলে এসেছিল এখানে ।​

জীবনের শেষ কটা দিনের আশ্রয় হয়েছিল সাত বাই আটের একটা ঘর । আশা প্রায়ই একটা আফশোষ করতো , মেয়েদের নিজের বাড়ি বলে সত্যিই কিছু হয়না ।

দিনের আলোটুকু নিভে গেছে কিছু আগে । আশা চলে যাচ্ছে আমাদের ছেড়ে । ছেলে-বৌমা-নাতি-নাতনি-আরো কিছু আত্মীয়স্বজন এসেছে আশাকে নিয়ে যেতে । দুটো বছর একসাথে থাকার স্মৃতি কি কম! এভাবেই একে একে সবাই চলে যায় এখান থেকে ।

এতদিন পরে হয়তো আশা তার নিজের বাড়িতে ফিরছে , তবু কান্না পাচ্ছে । গাড়িটা "ভালো বাসা"র বড় গেটটা ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই , কান্নায় ভেঙে পড়লেন নয়নতারা... .


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.