ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

আশির দশকের মাঝামাঝির কথা । আমি তখন ছত্তিশগড়ের রায়পুরে থাকি । এদেশে সার্বজনিক টেলিভিশনে বয়স তখন পাঁচ বছরও হয়নি । টেলিভিশন সঞ্চালনায় তখনও পেশাদারিত্বের ছোঁয়া লাগেনি । মাঝে মাঝেই সম্প্রচারে বিঘ্ন ঘটতো আর পর্দায় ফুটে উঠতো একটা লেখা ‘রুকাবটকে লিয়ে খেদ হ্যায়’মানে অনুষ্ঠান সম্প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় দুঃখিত । । আমার সাড়ে তিন চার বছরের মেয়ে, পড়তে শেখেনি, টিভির পর্দায় অন্য কোন লেখা ফুটে উঠলেই চেচিয়ে উঠতো ‘রুকাবটকে লিয়ে খেদ হ্যায়’ । এখন শয়ে শয়ে চ্যানেল, ‘আমার সয় না সয় না, কিছুতেই সয়না প্রাণে’অবস্থা । বিনোদনের হরেকরকম আয়োজন । তবু চল্লিশ বছর পরেও স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি, মনেহয় ছাদে এন্টেনা লাগানো সেই ‘রুকাবটকে লিয়ে খেদ হ্যায়’জমানার টেলি-বিনোদনের দিনগুলোই ভালো ছিল ।

আমার নিশ্চিত মনে হয়, টেলি-বিনোদন উপভোগ করার সেরা সময় ছিল ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৬ এই বারো বছর । তখন অবশ্য টেলি-বিনোদন বলতে সবেধন নীলমণি ছিল দূরদর্শনের ন্যাশানাল চ্যানেল আর সীমিত সময়ের সম্প্রচার ডিডি বাংলা। এখন কেবল বাহিত হরেক চ্যানেলের দাপটে দূরদর্শনের ন্যাশানাল চ্যানেল তার কৌলিন্য হারিয়েছে ঠিকই কিন্তু সেই ১৯৮৪ থেকে ৯৬ এই বারো বছরের টেলিভিশনের সামনে বসে থাকার অভিজ্ঞতা আজও ভোলার নয় । এই সময়কালে যারা তারুণ্য পার করেছেন তারাও আমার সঙ্গে একমত হবেন যে এখনকার টেলি-বিনোদন সম্প্রচারে পেশাদারিত্ব ও প্রযুক্তিগত উন্নতি হয়েছে যথেষ্ঠই, কিন্তু তার কনটেন্ট ও উপস্থাপনার গুনগত মান শুধুই পিছিয়েছে ।টেলি সম্প্রচারের দুটি গুরুত্বপূর্ন অঙ্গ হল সংবাদ ও সাময়িক প্রসঙ্গের আলোচনা এবং বিনোদন মূলক সম্প্রচার যার প্রধানতম অংশ টেলি-সিরিয়াল ।

পরিসংখ্যানের হিসাবে ভারতে টেলিভিশনের বয়স একষট্টি হল এ বছর, যদিও তার সর্বজনীন হয়ে ওঠার বয়স বিয়াল্লিশ বছর । ১৯৫৯ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওর স্টুডিওতে একটি ছোট ট্রান্সমিটার ও অস্থায়ী স্টুডিও নিয়ে কাজ শুরু করে দূরদর্শন। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম সম্প্রচার শুরু হওয়ার পরে ১৯৬৫ সালে আকাশবাণীর একটি অংশ হিসেবে আরম্ভ হয় দূরদর্শনের নিয়মিত সম্প্রচার। এরপর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত মোট সাতটি শহর দূরদর্শন পরিষেবার আওতাভুক্ত হয়। ১৯৭৫ সালের ৯ অগস্ট কলকাতায় স্থাপিত হয় "দূরদর্শন কেন্দ্র"। ১৯৭৬ সালে দূরদর্শনকে আকাশবাণী থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বতন্ত্র এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিষেবায় রূপান্তরিত করা হয়। 

১৯৮২ সালে দূরদর্শন জাতীয় স্তরের টেলিভিশন চ্যানেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং সেই বছরেই ভারতের বাজারে প্রথম রঙিন টেলিভিশন বিক্রীত হয়। ১৯৮২ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণ প্রথমবার সরাসরি সম্প্রচারিত হয় দূরদর্শনের পর্দায়। ১৯৮২ সালে  দিল্লিতে অনুষ্ঠিত  এশিয়ান গেমসকে সামনে রেখেই দূরদর্শনের জাতীয় সম্প্রচার বন্দোবস্ত হয় । এই হল এদেশে টেলি-সম্প্রচার ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস । 

এখন স্যাটেলাইট ব্যবস্থায় টেলিসম্প্রচার বহুমাত্রিক হয়েছে । শাড়ি বিক্রি, বাবাজিদের টোটকা চিকিৎসা, জ্যোতিষিদের ভবিষ্যৎ গণনা,হয় মা নাহয় বউমা মার্কা টেলি সিরিয়াল আর ঘন্টাখানেক টক শোর নামে রাজনৈতিক নেতা নামধারি গোটা চারেক ‘হুলো বেড়ালে’র লড়াইয়ের মজা  সব পেয়ে যাচ্ছি বোকা বাক্সের পর্দায় ।দুধে জল মেশানো না বলে জলে দুধ মেশানোর মত ‘বিজ্ঞাপনের ফাঁকে বিনোদন’। এটাই আসল ছবি ।আর চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপন পাওয়ার জন্য টি আর পি কি করে ম্যা্নিপুলেট করে টাকা দিয়ে, তা সম্প্রতি খোলসা করে দিয়েছে মুম্বাই পুলিশ ।এমন নয় যে আগের জমানার সব ভালো ছিল আর এখন সব খারাপ।কিন্তু টেলি সম্প্রচারের গুণগত তফাত বড়ই প্রকট ।পঁচিশ/ত্রিশ বছর আগের বিনোদন ও সংবাদ বিষয়ক অনুষ্ঠানগুলির তুলনা এসে যাবেই ।সেই সময়ের যারা দূরদর্শন সম্প্রচারিত সংবাদ বা সংবাদভিত্তিক অনুষ্ঠান দেখতেন তারা কি ভুলতে পারবেন নীতি রবীন্দ্রন, গীতাঞ্জলি আয়ার , সুনীত ট্যান্ডন, সালমা সুলতান, মিনু তলওয়ার, অবিনাশ কাউর, বিনোদ দুয়া, প্রণয় রায়, ছন্দা সেন, পঙ্কজ সাহা, ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়দের শিক্ষিত কন্ঠের সংবাদ পাঠ ?

সংবাদ ও সংবাদভিত্তিক অনুষ্ঠানের বাইরে টেলিভিশনের মুখ্য কাজ বিনোদন পরিবেশন ।টেলিভিশনের বিনোদন মানেই টেলি সিরিয়াল, বিদেশে যাকে বলে সোপ অপেরা। এই নিবন্ধকার এ দেশে টেলিভিশনের প্রবর্তন সময়ের সাক্ষি, সাক্ষি টেলি-বিনোদনের বেড়ে ওঠার নান পর্যায়েরও । ভারতীয় সাহিত্যে জীবনধর্মী সাহিত্যের অভাব নেই । তাই অতীতে আমরা পেয়েছি সাহিত্যনির্ভর অসামান্য সব টেলি সিরিয়াল । হামলোগ(১৯৮৪), করমচাদ(১৯৮৫) বুনিয়াদ(১৯৮৬) তমস, মালগুডি ডেস(১০৮৬), নুক্কড় (১০৮৬),মুজরিম হাজির(১৯৮৮), ব্যোমকেশ বক্সি(১৯৯৩), সার্কাশ(১৯৮৯), আরো কত মনে রাখার মত সিরিয়াল । আর ওম পুরি, নূতন, অনিল চ্যাটার্জী, উৎপল দত্ত, অলোকনাথ, বিনোদ নাগপাল, ফারুখ সেখদের অভিনয় দেখেছি সেইসব সিরিয়ালে । আজকের মহা তারকা শাহরুক খানের অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল দূরদর্শন সিরিয়াল ‘ফৌজি’(১৯৮৯) থেকে। আজ যে নানান ভাষায় টিভি সিরিয়াল এতো লোকপ্রিয় হয়েছে, যার টানে আফিং’এর নেশার মত আচ্ছন্ন হয়ে ঘরবন্দী হতেও সম্মত হয়েছে সে, তার কিছু কৃতিত্ব দাবী করতে পারেন তখনকার কেন্দ্রীয় সম্প্রচার মন্ত্রী প্রয়াত বসন্ত শাঠে । ১৯৮২তে মেক্সিকো সফরে গিয়ে মেক্সিকান টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ‘ভেন কনমিগো’ বিনোদনের মাধ্যমে শিক্ষামূলক একটি জনপ্রিয় টিভি ধারাবাহিক দেখেন । শাঠে অতঃপর ভারতের টেলিভিশনে এমন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেন । শাঠের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করলেন লেখক মনোহর শ্যাম যোশি ও পরিচালক পি কুমার বাসুদেব আর প্রতিটি পর্বের শেষে সেই পর্বের মেসেজ ব্যাখ্যা করার জন্য আসতেন প্রবাদপ্রতীম অভিনেতা অশোক কুমার, আর সঙ্গীত নির্দেশক ছিলেন আর এক প্রবাদপ্রতীম সঙ্গীতকার অনিল বিশ্বাস । জন্ম নিল ভারতের প্রথম ছোট পর্দার বিনোদন ধারাবাহিক ‘হাম লোগ’ । অভিনয় করেছিলেন দিল্লীর ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার শিল্পীরা । ৭ই জুলাই ১৯৮৪ থেকে ১৭ই ডিসেম্বর ১৯৮৫ পর্যন্ত ১৫৪টি পর্বে শেষ হয়েছিল । তারপর বুনিয়াদ (মে ৮৬ ), ইত্যাদি কত সিরিয়াল দর্শককে টেলিভিশনের সামনে টেনে নিয়ে যেত। হামলোগ, বুনিয়াদ, নুক্কড় বাঙালি টেলিদর্শককে এই নব্য বিনোদনে বেশ অভ্যস্ত করে দিল আর ১৯৮৬তেই তৈরি হয়ে গেল প্রথম বাংলা মেগা সিরিয়াল ‘তেরো পার্বণ’ । খ্যাতনামা নাট্যকার অভিনেতা জ্যোছন দস্তিদারের ‘সোনেক্স’ বানিয়েছিল সমরেশ মজুমদারের কাহনী নিয়ে কলকাতা দূরদর্শনের প্রথম মেগা সিরিয়াল ‘তেরো পার্বণ’ । দূরদর্শনের নিয়মানুযায়ী প্রযোজককে ১৩টি পর্বের অনুমোদন দিত । সিরিয়ালের নামও তাই রাখলেন ‘তেরো পার্বণ’ । প্রবল জনপ্রিয়তার কারণে কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিয়েছিল আরো আরো দু বার ২৬ পর্বের । অর্থাৎ মোট ৩৯ পর্ব চলেছিল ‘তেরো পার্বণ’। তেরো পার্বণ’ থেকেই আত্মপ্রকাশ হল আজকের জনপ্রিয় অভিনেতা সব্যসাচি চক্রবর্তীর । এ সব গল্প দূরদর্শ যুগের, নব্বইয়ের আগে ।

তখন দূরদর্শনের যুগ । নব্বইএর দশক থেকে অবস্থাটা পাল্টাতে শুরু করলো দ্রুত । শুরু হল বিনোদনের কর্পোরেটায়ন অতয়েব এই সময় থেকে শুরু হল এলোমেলো হওয়ার যুগ । আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, সমাজবোধ, চাওয়া-পাওয়া, বিশ্বাস, ভালোবাসা সব কেমন এলোমেলো করে দিল পণ্যায়ন বা পণ্য সংস্কৃতি । হংকং’এর বৃটিশ দখলদারি শেষ হয়ে চিনে অন্তর্ভুক্ত হল। মিডিয়া ব্যারন রুপার্ট মারডক তাঁর স্টার টিভির ব্যবসার পাততাড়ি গুটিয়ে মুম্বাইতে স্টার ইন্ডিয়া’র পত্তন করলেন। মারডকের প্রবল প্রতিদ্বন্দী সুভাষ জৈন অক্টবর ৯২এ পত্তন করেছেন জি টিভির । অতঃপর তারা দুজনেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন বাংলার বিনোদন বাজারে । জি বাংলার সম্প্রচার শুরু হল ১৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ থেকে তাদের থিম স্লোগান ‘জীবন মানে জি বাংলা’ দিয়ে আর স্টার টিভি ‘চলো পালটাই’ থিম স্লোগান দিয়ে বাংলার টেলি-বিনোদন বাজারে ঝাঁপিয়ে পড়লো ৮ই সেপ্টেম্বর ২০০৮ থেকে । ‘চলো পালটাই’ স্লোগানে সামিল হয়ে গেলাম আমরা । ভেতর থেকে পালটাতে শুরু করলাম । আমাদের সুস্থ্য বোধ,জীবনের প্রতি ভালোবাসা, সমাজের বাঁধন আর জীবনকে দেখা বা চেনাটাও পালটে ফেলতে শুরু করলাম । জীবনটা যে আমার নিজস্ব সেই ভাবনা ভুলে ‘জীবন মানে……’ভাবতে শুরু করলাম ।

স্মৃতিপীড়া ছাড়া আমাদের কিছুই থাকে না এটাই প্রবহমান বাস্তব । ‘দাও ফিরে সে অরণ্য’বলে যতই হাহাকার করি টেলি-বিনোদনের সেই বারো বছরের সময়টা আর ফিরে আসবে না ।আমার এবং অনেকের কাছেই ৯৬ পরবর্তী সময়কালটাই টেলিবিনোদনের ক্ষত্রে এক বড় রুকাবট বা বিঘ্ন ।সেই রুকাবট আর হটবার নয়।

■ পরিচিতি

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.