বিসর্জন বলতে আমাদের মনে প্রথমেই আসে দুর্গাপ্রতিমার দশমীর দিনের পূজার পর বিকেলে বা সন্ধ্যায় খোলা ট্রাকে বা ভ্যানে প্রতিমা তুলে দল বেঁধে ঢাক বাজিয়ে নাচতে নাচতে কাছাকাছি পুকুর বা নদীতে নিয়ে গিয়ে প্রতিমাগুলি জলে ডুবিয়ে দিয়ে আসা। ফিরে এসে ওই নদী বা পুকুর থেকে ঘট ভ’রে আনা জল আম পল্লবের-সাহায্যে শান্তিজল বলে সবার মাথায় ছিটিয়ে দেন পুরোহিত মশাই, সকলে একটু মিষ্টি খেয়ে যে যার ঘরে ফিরে যান। পুরোহিত মশাই প্রতিমা যেখানে পূজার জন্য ছিল সেই বেদীতে একটি প্রদীপ জ্বেলে রেখে বিদায় নেন।
বিসর্জন সব দেবদেবী প্রতিমার হয়ে থাকে। জলে নিয়ে গিয়ে ভাসিয়ে বা ডুবিয়ে দিয়ে আসার বিসর্জন। পূজার প্রতিমা এক্ষেত্রে মাটি, খড়, বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা হয়। বলা হয় এই মাটিতেই ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ , ব্যোম এই পঞ্চভুত যা দিয়ে জীবজগৎ গঠিত তাই বর্তমান। পূজা করার আগে আবাহনের মধ্য দিয়ে দেব বা দেবীরূপ শুভ শক্তিকে প্রতিমায় তথা তার সামনে রাখা জল ভ’রা ঘটে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সে ভাবেই শুরু হয় পূজা এবং পূজা সমাপ্তিতে মন্ত্র উচ্চরণের সাথে সাথে ওই ঘটটিকে অল্প নাড়িয়ে বিসর্জন দেওয়া হয়। বলা হয়, হে দেব বা দেবী তুমি যেখান থেকে এসেছো সেই স্থানে গমন করো। যেমন আবাহনের সময় তাকে ঘটে অধিষ্ঠান করতে বলা হয় তেমনই বিসর্জনে তাকে সসম্মানে স্থান ত্যাগ করতে বলা হয়। দুর্গাপূজার ঘট নাড়িয়ে দিতেই ঢাকি তার ঢাকে বোল তোলে, ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন। প্রতিমা জলে দেওয়া আনুষ্ঠানিক মাত্র।
প্রতিমাটি মাটি, খড়, বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে তৈরি যা মোটেও দীর্ঘস্থায়ী নয়। মূর্তির অঙ্গসজ্জা, অলঙ্কার, অস্ত্র ইত্যাকার সব কিছুই অল্প সময় ব্যবহারের উপযুক্ত। যদি কেউ জলে না দিয়ে প্রতিমা রেখে দেন তবে ওই সব অস্থায়ী বস্তু যা দিয়ে প্রতিমা তৈরি সেগুলি মলিন হবে, খসে পড়বে মাটিতে অযত্নে অনবধানে। যে প্রতিমাটিকে সুন্দর করে সাজিয়ে তাতে দেবত্ব আরোপ করে এক সময় অন্তরের ভক্তি দিয়ে পূজা করা হলো তাকে মলিন, অঙ্গহীন, কুরূপ দেখতে কি ভালো লাগবে ? মনে হবে না, একেই একদিন আহ্লাদে পূজা করেছি ? কেউ কেউ বলতেই পারেন নিজের কমবয়সের সুন্দরী মাকে বৃদ্ধবয়সে লোলচর্ম কুরূপা দেখলে কি ছেলে-মেয়ের খারাপ লাগে ? আমি বলবো লাগেনা, কারণ তাঁর সাথে নিয়ত interaction. হ্যাঁ, যেখানে সন্তান দূরে থাকে সেখানে প্রতিদিনের interaction-এর সুযোগ নেই। তবু যে বোধটা তখন সক্রিয় থাকে তা অত্যন্ত মানবিক। সন্তানের ভাবনায় থাকে, সে ওই নারীর গর্ভে জন্মেছে। পিতার ক্ষেত্রে, সে তার ঔরসজাত। তাই বললাম মানবিক। মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর এই ভাবনাটা আসার কথা নয়। মূল আলোচনায় ফিরে যাই। সুন্দরকে অসুন্দর করা চলবে না, কারণ সেই সূত্রে অশ্রদ্ধা এসে যাবে। উৎসবের কয়দিন যেখানে ভক্তি শ্রদ্ধাই মূল প্রতিপাদ্য সেখানে অশ্রদ্ধার অসুর হয়ে প্রবেশ সমগ্র উৎসবকে নিজের কাছে ম্যাড়মেড়ে করে দেবে। উৎসবের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। উৎসবে সুন্দরের আবাহন ও স্বল্প সময়ের উৎসব অন্তে সেই সুন্দরকে নিজের হাতে বিসর্জনের নামে জলে ডুবিয়ে দিয়ে আসা আসলে সুন্দরকে সুন্দর হিসাবেই স্মৃতির মণিকোঠায় জমা করে রাখা ছাড়া আর কি ? মাটির প্রতিমা না হয়ে যেখানে পাথরের বা ধাতুর তৈরি মূর্তির পূজা করা হয় সেখানে মূর্তি জলে দিয়ে আসা হয়না। তার নিত্য পূজা বজায় থাকে। শুধু উৎসবের দিনে তাকে ঘষে মেজে পরিষ্কার করে নূতন অঙ্গবস্ত্র, নূতন সাজ, অস্ত্র ইত্যাদি দেওয়া হয়। বিসর্জন দেওয়া হয় ঘট বা ঘটের জল ও পূজার আনুসঙ্গিক উপকরণ।
এবার আলোচনাটিকে একটু অন্য খাতে বইয়ে দিতে চাই। কেন উৎসব করে আবাহন-বিসর্জনের খেলা বা নাটক। কি প্রয়োজন ? জীবজগতে প্রতিটি জীব জন্মের পর কর্ম করতে বাধ্য। না হলে সে খাদ্য পাবে না ফলে বাঁচবে না। বাঁচার তাগিদে ও নিজেকে রক্ষা করতে সে আহার সংগ্রহ ও আত্মরক্ষার কর্ম করবে। এরপর তার পালা আসবে বংশবিস্তার করা। সেও প্রাকৃতিক কর্ম, প্রকৃতিই তাকে দিয়ে ঠিক সময়ে সেটাও করিয়ে নেয়। এবং সব ক্ষেত্রেই যোগ্যতমের স্থান হয় সবার আগে। দুর্বল ও অক্ষম জীবের প্রকৃতিতে স্থান নেই। সে এমনিই odd man out –এর নিয়মে মরে গিয়ে নিষ্কৃতি পায়, বা কারো খাদ্য হয়ে। মানুষের বেলায় এই নিয়ম খাটে না। মায়ের কোলে, বাবার তত্ত্বাবধানে, অন্যসব আত্মীয়- প্রতিবেশীদের প্রযত্নে মানব শিশু বাড়ে, শক্ত-পোক্ত হয়, জ্ঞান অর্জন করে, পেশা বেছে নেয়। প্রকৃতির সাধারণ নিয়ম (General rule) অস্বীকার করে মানুষ কিছু মানবিক নিয়ম তৈরি করেছে মানবগোষ্ঠিকে টিকিয়ে রাখার জন্য ও উন্নত করার জন্য। তা না হলে তো জন্মের পরে সব মানব শিশুই খাদ্য সংগ্রহে অপারগতার কারণে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়তো, যেহেতু সেই শিশু অন্যান্য প্রাণীর শিশুর মতো জন্মের অল্পক্ষণের মধ্যেই দৌড়তে পারেনা, পারেনা তার জন্মদাত্রী মাকে অনুসরণ করতে। যেহেতু তার মগজের ওজন বেশি তাই সে দাঁড়াতে সক্ষম হবে অনেক পরে। তবু সেও কর্ম করে। ঘুমন্ত মায়ের স্তনের দিকে সে এগিয়ে যায়, জানে ওখানেই তার জীবনধারণের খাদ্য মজুত আছে। না পেলে সে চিৎকার করে, কাঁদে। সেও তো কর্ম। এভাবে সে প্রাথমিক ভাবে প্রকৃতির দেওয়া সাধারণ নিয়ম মেনে চলে। মানুষকে বাকি পুরো জীবন জুড়ে যতো কর্ম করে যেতে হয় তাতে প্রকৃতির সাধারণ নিয়ম খাটে না। প্রকৃতিতে কোনো সক্ষম প্রাণী না খেয়ে থাকে কি ? আর তাদের খাবার পেতে রোজগার করতে হয়েছে বলে তো শুনিনি। হ্যাঁ, মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে কিছু কিছু প্রাণী পোষে, রক্ষণাবেক্ষণ করে, তাদের দিয়ে নির্দিষ্ট কাজ করিয়ে নিয়ে খাবার ও আশ্রয় দেয়। এটা মানুষের নিজের স্বার্থে এবং যথারীতি প্রকৃতির নিয়মে পড়েনা। কিন্তু মানুষকে খেতে গেলে রোজগার করতে হয়। কারণ মানুষের পছন্দ (Choice) আছে। সে তার মনের মতো জিনিস গ্রহণ করে। পছন্দ না হলে এবং সে অক্ষম না হয়ে থাকলে তার পছন্দেরটি সে যে ভাবেই হোক সংগ্রহ করে ফেলে। এর জন্য ছল-বল-কৌশল সে নানা ভাবে অবলম্বন করে থাকে। এই ছল-বল-কৌশল সব সময় যে আইন গ্রাহ্য বা সম্পূর্ণ মানবিক রীতি নীতি মেনে হবে এমন নয়। এইখানেই আছে একটি দারুণ টুইস্ট বা মোচড়।
ছল-বল-কৌশল যাই সে অবলম্বন করুক তাকে কিছু কর্ম করতে হবে। যে কর্মের পদ্ধতি হবে, হয় ছল নয় বল অথবা কৌশল, ফল হিসাবে তার প্রয়োজন মিটবে, আকাঙ্খা পূরণ হবে। কর্ম প্রধানত তিন প্রকার, সুকর্ম, কুকর্ম ও অকর্ম। অকর্ম গৃহীমানুষের জন্য নয়, ফলের আশা না করে যে সকল কর্ম করা হয় তা অকর্ম। এমনটা কেউ পারলে সে গৃহে থাকলে বা সংসার করলেও সে প্রকৃত সন্ন্যাসী। যাক সে কথা, সুকর্ম আর কুকর্ম নিয়ে অধিকাংশ মানুষ আমরা জীবন কাটাই। যখন কাউকে জীবনের প্রতিকুল স্রোতে টিকে থাকতে সাহায্য করলো কেউ, প্রতিদানে কিছুই পেলো না বা যা পেলো তা অতি নগন্য এবং তা নিয়ে সাহায্যকারীর কোন খেদ বা আপসোস হলো না তাহলে বলা যেতে পারে কাজটি সুকর্ম হয়েছে। কিন্তু আমরা কতজন পারি এমনটা করতে। কেউ সাহায্য পেয়ে সাহায্যকারীর সাথে বেইমানি করতেই পারে। সেটা তার কুকর্ম কিন্তু সাহায্যকারীর মনকে তা এমন পীড়িত করলো যে সে তার ক্ষতির চিন্তা করতে লাগলো। অর্থাৎ একটি নেগেটিভ ভাবনাকে আশ্রয় করলো। কুকর্মের শুরুটা ওখানেই। এভাবেই সুকর্ম ও কুকর্ম এই উভয় প্রকার কর্ম নিয়ে চলতে থাকে আমাদের পার্থিব জীবন। সুকর্মের ফল বেশিরভাগ সময় আমরা হাতে-হাতে পেয়ে যাই, মোটামুটি কাজের শেষে যেমন বেতন। কিছু সুকর্মের ফল সুদূরপ্রসারী, নিজের জীবন ছাড়িয়ে সমাজকেও প্রভাবিত করে। যা থেকে মানবজাতি উপকৃত হতে পারে। মানবজীবনে কুকর্ম তিনধরণের হয়। অন্যায়, অপরাধ ও পাপ। এরমধ্যে অপরাধের বিচার ও শাস্তিবিধান হয় সমাজে। শাস্তির মাধ্যমে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হয় যুক্তিনির্ভর সভ্য ও সচেতন সমাজে। কিন্তু অন্যায় ও পাপ এই দুই কুকর্মের কোন শাস্তিবিধান নেই মানবসমাজে ও রাষ্ট্রে। ওই দুইপ্রকার কুকর্ম কোষের ডিএনএ বাহিত হয়ে পরবর্তী প্রজন্মে বয়ে যায়। নষ্ট হয় পরের প্রজন্মের জীবনের ছন্দ, বিভিন্নভাবে ভুগতে হয় বংশধরদের। অন্যায় ও পাপের ছোট করে উদাহরণ দিলে একটু খোলসা হবে। খুবই সাধারণ একটি বিষয়, ধরুণ রিক্সায় চড়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে নেমে কত ভাড়া হবে জানা থাকা সত্ত্বেও কিছু টাকা কম দিলাম। রিক্সাওয়ালা প্রতিবাদ করায় তাকে জোর করলাম ওই কম ভাড়াই নিতে, এমনকি দু’একজন আত্মীয়-বন্ধু পেয়ে গিয়ে তাদের দিয়ে আমার দেওয়া ভাড়াটাই প্রতিষ্ঠা করলাম ও গালাগাল সহযোগে নিতে বাধ্য করলাম। এটা অন্যায়। আবার ধরুণ আমি একপিস মাছ দিয়ে আরামে দুপুরের আহার সারি। কারো অনুরোধে দুইপিস খেতেই পারি। কিন্তু নিমন্ত্রণের ভোজে ভাল লেগেছে বলে অন্য খাবার কম খেয়ে দশ-বারো পিস মাছ খেয়ে ফেলাম। তারপর বদহজম। সহ্য না হওয়ায় হতে পারে বাড়িতে এসে বমি করে নিষ্কৃতি পেতে চাইলো শরীর। এটি পাপ। শরীরকে প্রয়োজনের পুষ্টি দিতে হবে যাতে তার দ্বারা অনেক কর্ম যা বাকি আছে সেগুলি সমাধা করতে পারা যায়। তাই শরীরকে বাঁচাতে খাদ্য দিতে হবে, পুষ্টি দিতে হবে। কিন্তু সেই শরীরে লোভের বশবর্তী হয়ে অত্যধিক খাবার ঢুকিয়ে তাকে অসুস্থ করে ফেলা অবশ্যই পাপ। আমি এক একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ দিলাম যা আমরা সচরাচর করেই থাকি। এগুলো অপরাধের মধ্যে পড়েনা, কিন্তু এগুলোই অন্যায় ও পাপ।
আমরা সারা বছর ধরে হাজার হাজার অন্যায় ও পাপ করে থাকি। আমাদের মিথ্যে অহংবোধ এই কুকর্মগুলো করার পরও নিজেকে বিচার করতে দিতে চায়না। ফলতঃ জীবনে বাড়তে থাকে হীনতার বোঝা ও নেগেটিভিটি। যা আমাদের জীবনের স্বাভাবিক চলনে বাধা দেয়। ভারী বোঝা নিয়ে কেই বা খুশিতে চলতে পারে? সেই জন্য আমাদের প্রয়োজন পড়ে বছরের কোন এক সময়ে উৎসবের আঙ্গিকে পূজার আয়োজন করার। দেব বা দেবী যাই হোক না কেন তাঁকে আবাহন করে, ইহ গচ্ছ ইহ তিষ্ঠ ইত্যাদি মন্ত্রপাঠ করে জলপূর্ণ ঘটে তাঁকে অধিষ্ঠান করতে সানুনয় সবিনয় অনুরোধ করা হয়। প্রতিমার জাঁক তো বহিরঙ্গ। সম্মুখে সুন্দর পোশাক ও গহনা সহ পৌরাণিক একটি চরিত্র আশীর্বাদের ভঙ্গিতে উপস্থিত থাকলে আমাদের সাধারণের চোখ ও অতঃপর মনে একটা ম্যাজিক কাজ করে। আমরা আকর্ষণ অনুভব করি। পায়ের নিচে কোথায় জলপূর্ণ ঘটে দেব দেবীদের আবাহন করা হয়েছে সেদিকে খেয়াল না দিয়েও আমরা কৃতাঞ্জলিপুটে প্রতিমার সামনে দাঁড়াই। ভিতর থেকে প্রার্থনা উঠে আসে, সারাবছর যেন ভাল কাটে। সুস্থতা, সচ্ছলতা, সন্তানকামনা, রুজি-রোজগারের দিশা ইত্যাকার শতেক প্রার্থনা নিয়ে বিশ্বাসকে সম্বল করে মানুষ পুজো দিতে ছুটে আসে। একটু বিনীত হয়। একটু ভাঙ্গে নিজেকে, একটু চিত্তশুদ্ধির কথাও ভাবে। পাহাড়ের খাঁজে আটকে থাকা পাথরখানা সরিয়ে নেমে আসে স্বতোৎসারিত ঝর্ণাধারা। পুরজনের হিতার্থে পুরোভাগে দাঁড়িয়ে পুরোহিত দলবদ্ধ ভাবে অঞ্জলি দেওয়াচ্ছেন, এতে গন্ধ পুষ্পে.... অঞ্জলির মন্ত্রপাঠ শেষে হাতের ফুল-বেলপাতা ছুঁড়ে দিচ্ছি দেব-দেবীর পা লক্ষ্য করে। কিছু ফুল, পাতা প্রতিমার পায়ে, কিছু ঘটের উপরে গিয়ে পড়ে। আসলে কিন্তু ফুল-বেলপাতার সঙ্গে ছুঁড়ে ছুঁড়ে সমর্পণ করি আমার বছরের বিগত দিনগুলোতে করে আসা কুকর্মের অশুভত্বগুলি, অর্থাৎ আমার নেগেটিভ এনার্জি, যা বোঝা হয়ে আমার জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে পতন ডেকে আনছে। যখন চাইছি আমার একটা চাকরি হোক, তখন ওই চাকরি না হওয়ার জন্য যে উদ্যমের অভাব সেটা বিসর্জন দিতে হবে, যদি যোগ্যতার অভাব থাকে তবে তা অর্জনের জন্য উদ্যোগী হতে যে পিছটান, যে উদ্যোগহীনতা বাধা হচ্ছিলো সেসকল ত্যাগ করতে হবে। দেব-দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনার অর্থ আমি যেন শুভত্ব অর্জন করি। আমার কাঙ্খিত বস্তু যেন পেয়ে যাই।
প্রকৃতিতে একটা স্বাভাবিক ভারসাম্য বজায় রাখার ক্রিয়া সর্বদা চলতে থাকে। আমরা যদি কিছু বর্জ্য ত্যাগ করি কাউকে সেটা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় তার চলাচল রুদ্ধ হবে। নষ্ট হবে ভারসাম্য, দূষিত হবে প্রকৃতি ও পরিবেশ। আমরা বর্জ্য হিসেবে নিশ্বাসের সাথে ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করি, গ্রহণ করে সবুজ উদ্ভিদ। তাই উদ্ভিদের ঘাটতিতে প্রাণীকুল বাতাস থেকে অতিপ্রয়োজনীয় অক্সিজেন পাবেনা। ভারসাম্য নষ্ট হবে। সেরকমই আমাদের সারাবছর ধরে সঞ্চিত কুকর্মের নেগেটিভ এনার্জি গ্রহণ করে আমাদের বোঝা কমাতে বা মুক্ত করতে প্রয়োজন পড়ে দেব-দেবীর আবাহন ও অর্চনা। আমাদের অর্চনায়, প্রার্থনায়, অঞ্জলিতে দেব-দেবী বা তাঁদের অধিষ্ঠান জলপূর্ণ ঘট অবশেষে এক বড়সড় নেগেটিভ এনার্জির ভাণ্ডারে পরিনত হয়। তখন কে তাকে পুষে রাখবে ? বিসর্জন তাই পূজাশেষে অবশ্য কর্ম। দেখতে সুন্দর প্রতিমা সারা বছর ধরে রেখে দিলে প্রতিমা নষ্ট হতে থাকবে ও তার চাকচিক্য হারিয়ে ফেলবে। মানুষ সুন্দরকে পূজা করে অসুন্দরকে নয়। অসুন্দরের প্রতি অশ্রদ্ধা শেষ পর্যন্ত দেব-দেবীর প্রতি অশ্রদ্ধাতে দাঁড়াতে পারে। এছাড়া সারা বছর ধরে যদি সুন্দরকেও প্রতি নিয়ত চোখের সামনে দেখি তবে তার বিশেষ চমক থাকেনা, যা আবার আমাদের অল্প সময়ের জন্য হলেও যে আন্তরিকতা আরোপিত হয় তা নষ্ট হয়ে যাবে দৈনন্দিনতার কারণে। তবে পাথর বা ধাতু নির্মিত মূর্তি অভিষেক, স্নান ইত্যাদির মাধ্যমে পুনরায় নিত্যপূজায় ফিরে যায়। পূজার শেষে ঘট বা ঘটের জল ও পূজার উপকরণ, ফুল-বেলপাতা বিসর্জন হয় জলে। যে রকম ময়লা মাটি মাখা হাত আমরা জলেই ধুয়ে পরিষ্কার করি তেমনই পূজা অন্তে নেগেটিভ এনার্জি সমেত ঘটের জল আরো বড় জলের আশ্রয়ে দিয়ে আসতে হয়। প্রতিমার নিরঞ্জন তো প্রতীকমাত্র। পাথর বা ধাতু নির্মিত মূর্তির স্নান জলেই হয়, যাতে ভক্তদের, কৃপাপ্রার্থীদের ত্যাগ করা অশুভশক্তি জলে ধুয়ে শুদ্ধ, পরিস্নাত করা যায়। পরের বছর আবার জাঁক-জমক করে নতুন একখানি সুন্দর প্রতিমা আনা হবে আমাদের চক্ষু সার্থক করে মনের দোরে ঘোর লাগাতে। জল অপেক্ষায় থাকবে আমাদের সব পাপ ধুয়ে দিতে।
সুচিন্তিত মতামত দিন