না, এমন দিন আগে আসেনি। এরকম দুঃসময়কে সামনে রেখে কখনও ঘরের বাইরে বেরতে হয়নি। সর্বসুখী কোনদিনই হতে পারেনি মানুষ। অভাব, কষ্ট, টানাটানি, সংকট সামলে সামলে তাকে পথ চলতে হয় প্রতিদিন। তবু তারই মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে সে আরাধনা করে দুর্গতিনাশিনীর, আয়োজন করে উৎসবের। কখনও কখনও উৎসবের মুখে মানুষ বানভাসি হয়েছে, রিক্ত হয়ে গেছে, কিন্তু এবারে যেরকম দুর্গত অবস্থায় পড়তে হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা আগে কখনও হয়নি। এই বছরটা তাই সুদূর অতীতের থেকেও একেবারে আলাদা।
জীবনের দাবিই এগিয়ে চলা। থামতে জানেনা সে। তবু মাঝখানে অনেকদিন জীবনের জানলাগুলো বন্ধ ছিল। ভয়, হতাশা আর অন্ধকার যেভাবে গ্রাস করেছে সারা পৃথিবীকে, তাতে এ ছাড়া আর উপায়ই বা কি? সৌজন্যে করোনা সংক্রমণ, অতিমারী। কিন্তু যখন সেই জানলাগুলো একে একে খুলতে শুরু করলো, যখন আবার জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার আকুতি মনের মধ্যে জোরদার হয়ে উঠলো, তখনও কিন্তু সংক্রমণ কমেনি। বরং বেড়ে চলেছে। এই আবহে সামনে এসে গেছে সেই উৎসবের মরসুম।
সেটাই আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আর একটা গভীর সংকটে। এটা ঠিক যে সময়টা উৎসবের। সারা বছর জীবনের গোলকধাঁধায় ঘুরতে ঘুরতে মাঝখানে একটু জিরিয়ে নেওয়ার আর নিজেকে রিফ্রেশ করে নেওয়ার এটা একটা সুযোগ বাঙালির। সেটা সে যতটা সম্ভব উশুল করেও নেয়। কিন্তু সময়টাই যখন মহামারীর কবলে? যখন চারপাশে তাকালে দেখা যায় যে তা থেকে নিস্তার পাওয়ার কোন উপায়ই এখনও আয়ত্ত নয়? তখনও কি ‘যা হবে দেখা যাবে’ গোছের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই আমরা জনসমুদ্রে মিশে যাবো? প্রকোপটা তো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চোখের সামনে। একটা দিন থেকে পরের দিনে যে বেড়েই চলেছে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা? পুজো তো শুধু পুজো নয়, আমরা বলি মহামিলন। যেখানে দুটি মানুষের কাছাকাছি চলে আসাটাই সংক্রমণের একটা বড় কারণ, সেখানে এত জনসংখ্যার দেশে মহামিলনের এত বড় উৎসবে তা এড়ানো যাবে কিভাবে? এক জায়গায় প্রচুর মানুষ মানেই নিয়ম নীতি শিথিল হতে বাধ্য। তাহলে উৎসবের মেজাজে আমরা যখন মজে থাকবো, তার ফলে সংক্রমণ আরও হু হু করে বেড়ে যাবেনা তো?
এটা ঠিক যে উৎসবের শিকড়টা বহুকাল আগে থেকেই অনেক গভীরে। নানান বদল আসতে আসতে আজকের যে রূপ সে ধারণ করেছে, সেখানে ঢুকে গেছে অনেকের বেঁচে থাকার নেপথ্যের গল্প। তাঁরা কেউ শিল্পী, কেউ কর্মী, কেউ যোগানদার, কেউ নিছকই উদ্যোক্তা। এইভাবে পুজোর সঙ্গে কত মানুষই না জড়িত। কত সহস্র পরিবার তাকিয়ে থাকে এই সময়টার জন্য। কেউ পণ্যের বিনিময়ে, কেউ শ্রমের বিনিময়ে যে উপার্জনটুকু করতে পারে তাই দিয়েই বছরের অনেকগুলো দিনের নিশ্চিন্ততা কেনা যায়। একদিক থেকে সেটা অর্থনীতির একটা উজ্জীবন। দুর্গাপুজোর মত একটা বড় উৎসব তার অনেকটাই নিশ্চয়তা দেয়। তাই পুজোর আয়োজন মানে তাদের সকলের আয়ের পথ খুলে যাওয়ার একটা উপায়।
এই যুক্তিতে আমরা তো আশ্বস্ত হতেই চাই, অবশ্যই চাই মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা কিছুটা হলেও ফিরুক। কিন্তু অভিজ্ঞতা যে বাধ সাধে! এতগুলো মাস ধরে বিভিন্ন সময় আমরা সেই ছবিগুলো দেখেছি। সামান্য মাস্ক পরতে আমাদের প্রচণ্ড অনীহা, লকডাউনের সময়েও চায়ের দোকানে আড্ডা না দিলে আমাদের চলেনা, এমনকি নিয়ম না মানার জন্য পুলিশের সামনে কান ধরে উঠবোস করতেও আমাদের লজ্জা নেই। নিজের জীবন রক্ষার তাগিদেই যে বাইক চালালে হেলমেট পরতে হয়, সেটাকেও গোঁয়ার্তুমি করে উপেক্ষা করি। কেনাকাটার উৎসাহে একজন অন্যজনের ঘাড়ে পড়ে দরদাম করি, মাস্ক ঝুলে থাকে থুঁতনির নিচে। সেই আমরা যখন মাইকে ডাক শুনবো, যারা যারা অঞ্জলি দেবেন চলে আসুন, তখন কি ছুটে গিয়ে গায়ে গা লাগিয়ে হাতে হাতে ফুল নিয়ে আমরা অঞ্জলি দেবোনা? ভোগ, প্রসাদ, এগুলো অগ্রাহ্য করবো? সন্ধ্যার জলসায় স্টেজের সামনে গিয়ে বসবনা? আমরা কি উৎসবের মেজাজে বিপদ এড়াতে আদৌ সচেষ্ট থাকতে পারবো? সেটাই আমার কাছে দারুণ ভয়ের।
একটা ভয় থেকে আর একটা ভয়ের দিকে যেতে খুব ভয় করে। এক গর্ত থেকে আর এক গর্তের ঘূর্ণিতে পড়তে আর ইচ্ছে করেনা। যদি ঠাকুর দেখার জন্য, খাওয়া দাওয়ার জন্য বা অন্য কারণে এক জায়গায় অনেক মানুষ একসঙ্গে খুব কাছাকাছি আসি, সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে পড়তেই পারে। বিশেষজ্ঞরাই সেকথা বলছেন। সেটা আর এক সংকট ডেকে আনবে। আবার যদি জনজীবনের মিনিমাম ছন্দটুকু বন্ধ করে দিতে হয়, আবার যদি কারফিউয়ের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, যা যা খোলা আছে তার অনেকই কিছু আবার বন্ধ রাখতে হয়, তাহলে তো নেমে আসবে আরও বড় এক অন্য সংকট। সেও তো আবার ভাতে মারা যাওয়ার ভয়!
মানুষ কি বিপদ সম্বন্ধে অসচেতন? তা ঠিক নয়। সবাই প্রায় সবটাই জানে, অন্যকে সাবধান করে স্ট্যাটাস দেয়। তবু আমাদের মনের গভীরে অদ্ভুত একটা বাসনা কাজ করে। যেখানে নিষেধ, সেখানেই তা অমান্য করার ইচ্ছা জাগে। ঝুঁকি আছে জেনেও বিপদের পথে এগিয়ে যাই। ক্যান্সারের ভয় আছে জেনেও সিগারেট ধরিয়ে তৃপ্তির ধোঁয়া উগরানো যেমন। এরকম আরও অজস্র আছে, যেমন একটু আগেই বললাম। তাই উৎসাহী মানুষ হয়তো বিধি নিয়ম ভুলে ঠাকুর দেখার ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাবে। এবছরটা নাই বা অনেকের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে ঠাকুর দেখলাম, এই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা যেন অনেক কষ্টের। তাই মাস্ক ছাড়াই গা ঘেঁষাঘেষি ভিড়ে পুজোর বাজার করতে অনেকেই দুবার ভাবেনা। এটা অর্থনীতিকে সচল রাখার কোন দায় থেকে নয়, দুর্গত মানুষদের হাতে কিছু অর্থ আসবে এই মহান ভাবনা থেকে নয়। ঘুরে ঘুরে নতুন জামা জুতো না কিনলে আবার পুজো কি? শুধু এই আত্মতুষ্টির জন্য।
সমস্ত দুঃখ যন্ত্রণা অপ্রাপ্তি আর হতাশা থেকে বেরিয়ে আমরা তো আলোর দিকে যেতে চাই। আনন্দের দিকে যেতে চাই। তার উল্টোদিকে আরও অন্ধকার আরও অসুন্দরের দিকে আমাদের গতিপথ যাতে ঘুরে না যায় তার জন্য সচেতন হতে হবে আমাদেরই। সদিচ্ছা থাকলে সেটুকু পারা কঠিন নয়। আর্তের পাশেও দাঁড়াতে পারি যেকোনো সময়। এখন একটু দূরত্ব রাখলে তবেই কাছাকাছি থাকতে পারবো, সেই বোধটুকু লালিত থাক মনের মধ্যে। এমন দুর্গত দিন তো আগে দেখিনি। তার ভয়াবহতাকে মনে রেখে উৎসবের মরশুমকে আমরা নিশ্চয় সুন্দর ও ঝুঁকিহীন করে তুলতে পারি, যদি সাবধান থাকি। যদি জীবনের প্রতি একটুও ভালোবাসা থাকে।
সুচিন্তিত মতামত দিন