শনির বচন | ফুটন্ত কড়াই থেকে জলন্ত উনুনে

ফুটন্ত কড়াই থেকে জলন্ত উনুনে

■ গরুর দুধে সোনা থাকুক না থাকুক। সহজপাঠ বিদ্যাসাগর লিখুন না লিখুন। যিনি বলেছেন, তাঁর উপরে ভরসা ও আস্থা বেড়ে গিয়েছে বহু মনুষেরই। মানুষ বুঝতে পেরেছে, ইনিই সেই ব্যক্তি যিনি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। পারলে ইনিই পারবেন দিনকে রাত, রাতকে দিন করতে। তাই গরুর দুধে সোনা খুঁজে না পেলেও মানুষ এমন একজনকে খুঁজে পেয়েছে যিনি বাঙালিকে রামরাজ্য পাইয়ে দিতে পারবেন। উত্তরপ্রদেশের মানুষ ত্রিপুরার মানুষের মতো এই রাজ্যেও মানুষ এখন রামরাজত্বের বাসিন্দা হতে উন্মুখ। মানুষের এই আগ্রহ দিনে দিনে, এলাকায় এলাকায় আরও বেশি করে সংক্রমিত হওয়ার মতো ছড়িয়ে পড়ছে হু হু করে। রাজনীতির বিষয় নয় এটা। মানুষের আগ্রহের বিষয়। রাজনৈতিক দলসমূহ নিজ নিজ গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষায় কি করবে না করবে সেটি তাদের বিষয়। নেতানেত্রীরা নিজ নিজ রাজনৈতিক স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে কতরকম আজগুবি কথা আউরিয়ে চলবেন সেটি তাদের মৌলিক স্বাধীনতার বিষয়। আমাদের আলোচনার বিষয় নয় সেসব। আমাদের আলোচনা মানুষকে নিয়ে। এই সময়ের মানুষ। তার আগ্রহের অভিমুখ নিয়েই এগোতে হবে আমাদেরকে। 

কি চাইছে রাজ্যবাসী? অনেকেই বলতে পারেন, সোজা কথায় রাজ্যবাসী হয়তো ফুটন্ত কড়াই থেকে উনুনে ঝাঁপ দিতে চাইছে। সমালোচনার কথা থাক। বাস্তব কথা তো এই, মানুষ আবারও একটি পরিবর্তন চাইছে। একবার পরিবর্তন চেয়ে মানুষের কোন স্বর্গলাভ হয়েছে। দেখে নিয়েছে সব। তাই ন্যাড়া কবার বেলতলায় যায়, সেসব হিসাব না করে মানুষ এবার রামাজত্বের বাসিন্দা হতে চাইছে কিনা, সেটাই আসল কথা। হাতের কাছে ত্রিপুরার অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু এই রাজ্যের বাসিন্দাদের সাথে ত্রিপুরার জনসংযোগ এতই ক্ষীণ যে, ত্রিপুরা গোল্লায় গেলেও এখানে মানুষের কিছু এসে যায় না। তাই ত্রিপুরার অভিজ্ঞতার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রয়েছে রাজ্যবাসী। বরং রাজ্যবাসীর অনেকেই উত্তরপ্রদেশের মতো এনকাউন্টার মডেল দেখতে উৎসাহী। যে বিরোধীতা করবে দাও উড়িয়ে। যে মতের সাথে মত মেলাবে না, সেই দেশদ্রোহী। যে সংখ্যালঘুদের স্বার্থে কিছু বলবে, সেই পাকিস্তানী। আর কম্যিউনিস্ট মাত্রেই তো চীনের দালাল। না এখন আর রাশিয়াকে টেনে আনার উপায় নাই। ফলে বাকি রয়েছে চীন। সেই চীনের হাতেই ভারতীয় জওয়ানদের মৃত্যু নিশ্চয় বিফলে যেতে দেওয়া যায় না। তাই রাজ্য থেকে কম্যিউনিস্ট বিতারণের এমন সুবর্ণ সুযোগ আর পাওয়া যাবে কি? ভাবতে চাইছেন কিন্তু অনেকেই। এমনিতেই সাত শতাংশে এসে ঠেকেছে। কিন্তু কথায় বলে শত্রুর শেষ রাখতে নাই। তাই রাজ্যকে কম্যিউনিস্ট মুক্ত করার এই তো সোনার সুযোগ। তাতে যদি গরুর দুধে সোনা আছে বিশ্বাসও করতে হয়, তো ক্ষতি কি? 

না সকলেরই লক্ষ্য কম্যিউনিস্ট বিতারণ নয়। অনেকেই রয়েছেন এক ফুলের প্রতি বিদ্বেষবশত অন্য ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠতে চাইছেন। অনেকেই পরিবর্তনের আঁচে দগ্ধ হয়েছেন এক দশক। এবার তারাই বদলা নিতে সমবেত হতে চাইছেন বিরোধী শিবিরের ছাতার তলায়। এখন বিরোধী শিবিরের যে ছাতাটির মালিক খোদ কেন্দ্রীয় সরকার, অনেকেই ভিড় করতে চাইছেন সেই ছাতার তালাতেই। তাদের বিশ্বাস কেন্দ্র ও রাজ্যে একই সরকার থাকলে তাতে রাজ্যবাসীরই লাভ। দীর্ঘ সাড়ে চার দশক রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রীয় বঞ্চনার ইতি টানা যাবে এইভাবেই। এই বিশ্বাস থেকেই তারা গরুর দুধে সোনার হিসাব কষছেন। নিত্যদিনের বঞ্চনার বদলা নেওয়ার এমন সোনার সুযোগ ছাড়তে রাজি নন অনেকেই। উন্নয়ন দাঁড়িয়ে থাকায় যাঁরা একদিন নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি বলে আফশোস করেছেন। তাদেরই হাত নিশপিশ করছে হয়তো সব থেকে বেশি। 

এঁদের বাইরেও অনেকেই আছেন। বাম আমলের সাড়ে তিনদশক জুড়ে যারা অন্তরের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষগুলির মুখে ঢাকনা লাগিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরিবর্তনের বিগত এক দশকে সেই ঢাকনা খুলি খুলি করেও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। খোলা উচিত হবে কিনা। খুললে কতটা খোলা সম্ভব হবে ভেবে। তাঁরা উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতি দেখে। সত্যিকারের হিন্দুরাজ্যের স্বপ্নে বিভোর বাঙালির সংখ্যা কত সেটি নিয়ে নানা জনের নানা মতো থাকতেই পারে। কিন্তু সেই সংখ্যাটি কতটা নির্ণায়ক ভুমিকা নিতে পারে, বুঝতে পারা যাবে সামনের ভোটেই। সংখ্যায় তাঁরা যত বেশি বা কমই হোন না কেন, গরুর দুধে সোনা থাকার গল্পে তাঁদের মজতে দেরি হয়নি। 

রাজ্যের বাঙালি জনসংখ্যার অধিকাংশেরই কোন ধারণা নাই, বিশেষ করে বিগত চার দশকে রাজ্যে স্থায়ী ভাবে বসবাসকারী অবাঙালি জনসাধারণের জনসংখ্যা কতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকেই জানেন না হয়তো, বর্তমানে রাজ্যবাসীর ৩০% এর বেশিই অবাঙালি। যাঁদের সাথে বাংলার ভাষা সংস্কৃতি ধর্ম ও লোকাচারের কোন মিল নাই। এই প্রসঙ্গে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ভারতীয় হিন্দু ও বাঙালি হিন্দুর ধর্ম হুবহু এক নয় কোনদিন। এই দুই জনগোষ্ঠীর ধর্মের ভিতর মিলের থেকে অমিলের পরিমাণই অনেক বেশি। সেটি বাংলার পুজা পার্বণের সাথে অবাঙালি হিন্দু ভারতীয়দের পুজা পার্বণের তুলনা করলেই বোঝা যায়। রাজ্যবাসীর এই বিপুল অংশ বাংলার জমি ও অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত থেকেও বাংলার ও বাঙালির সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত নয় কোনদিনই। আর সম্পৃক্ত হবেই বা কেন। তাঁদের নিজেদের ভাষা সংস্কৃতি সাহিত্য ধর্ম ও লোকাচার রয়েছে। সেসব বিসর্জন দিয়ে তারা বাঙালির সাথে মিশেই বা যাবে কেন? তাই তারা এই রাজ্যে থেকেও তাদের পৃথক জাতিসত্তা রক্ষা করে থাকে। সেই পৃথক জাতিসত্তা নিয়েই তারা দিনে দিনে রাজ্যের অর্থনীতি ব্যবসা বাণিজ্যের দখল নিয়ে নিয়েছে। বিগত চার পাঁচ দশকে রাজ্যের সরকারী বেসরকারী চাকুরীক্ষেত্রের দখল নিয়ে নিয়েছে। এবং বিগত তিন দশকে রাজ্যরাজনীতিতে তারা আত্মপরিচয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো একটা অবস্থানে চলেও আসছে দ্রুত বেগে। এই যে বিপুল পরিমাণে অবাঙালি ভোটার, তার বেশির ভাগটাই কিন্তু সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের। ফলে রাজ্যে উত্তরপ্রদেশের মতো রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠায় তারা যে স্বভাবতঃই উৎসাহে টগবগ করে ফুটবেন, সেকথা বলাই বাহুল্য। তারা স্বপ্ন দেখতেই চাইবেন গোটা রাজ্যটিকেই একদিন গোবলয়ের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার। রাজ্যজুড়ে আজ যত হিন্দী স্কুল চলছে, চোখবুঁজে বলে দেওয়া যায়, আগামী কয়েক দশকে সেই সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। ফলে অচিরেই যে হিন্দীই এই রাজ্যের প্রথম ভাষা হয়ে উঠবে সেই বিষয়ে তাদের মনে কোন সন্দেহ নাই। নাই আরও এই কারণেই যে, রাজ্যবাসীর বাঙালি জনসাধারণ তাদের সাথে হিন্দীতেই সংযোগ রাখতে গর্ববোধ করে। বাঙালির এই হিন্দীপ্রেমই বাংলাকে গোবলয়ের অন্তর্ভুক্ত করার প্রধান সুযোগ। শুধু রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় পৌঁছানোর অপেক্ষা মাত্র। স্বাধীনতার পর এই প্রথম সেই সুবর্ণ সুযোগ সমাগত। ফলত রাজ্যবাসীর অবাঙালি জনসম্প্রদায়ের একটা বৃহৎ অংশই চোখবুঁজে গরুর দুধে সোনা দেখে নিয়েছেন। ইভিএম-এ আঙ্গুল ছোঁয়ানোটুকু বাকি শুধু। 

না গরুর দুধে সোনা দেখার মানুষ আরও রয়েছেন। এই রাজ্যে বংশ পরম্পরায় চৌদ্দো পুরুষ ধরে বসবাসকারীদের অনেকেই বিশ্বাস করেন স্বাধীনতার পর পূর্ববঙ্গ আগত শরণার্থীরাই রাজ্যের লোকসংখ্যা বৃদ্ধি করে জমির উপর চাপ সৃষ্টি করে, অর্থনীতিতে ভাগ বসিয়ে এই রাজ্যের সর্বনাশ করেছে।এবং সেই বিষয়ে নিঃসন্দেহ যারা তারাও গরুর দুধে এখন সোনা দেখছেন বেশি করে। কারণ তাদের একটাই আশা। রাজ্যে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা হলে, বাঙালদের অন্তত ডি ভোটার করার কাজটা সহজ হয়ে যাবে। এতদিনের অবদমিত ক্ষোভ কিছুটা হলেও প্রশমিত করে নেওয়া যাবে। 

না শুধু তারও নন। গরুর দুধে সোনা দেখছেন পূর্ববঙ্গ আগত সেই শরাণার্থীদের বর্তমান প্রজন্মও। ভিটেমাটি হারানোর দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভুত ক্ষোভ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে পরিণত হয়ে বিশ্বাস করতে চাইছে, রাজ্যে রামরাজত্বের প্রতিষ্ঠা হলে, এই একটিই পথেই সংখ্যালঘুদের রাজ্য থেকে তাড়িয়ে আট দশক আগের ভিটেমাটি হারানোর শোক কিছুটা লাঘব হতে পারে। আজ এই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষচর্চার সংস্কৃতিতে তারাই কিন্তু মূল তুরুপের তাস। এবং তাদের মোট জনসংখ্যা কমও নয়। ফলে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠায় তাদের আঙুলগুলিও যে নিশপিশ করছে না, তেমনটা নয়। আর কয়টি দিনের অপেক্ষা মাত্র। 

ফলে গরুর দুধে সোনা থাকার গল্পটা রাজ্যবাসীর বিভিন্ন গোষ্ঠীর ভিতরেই উৎসাহের জোয়ার নিয়ে এসেছে। এবং যিনি বলেছেন। তার পিছনেই এই সকল কারণে দিনে দিনে ভিড় বেড়েই চলেছে। নয়তো এমন আজগুবি গল্পে যে কোন রাজনৈতিক ব্যক্তির রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্যতা কমে যাওয়ারই কথা। এই রাজ্যে ঘটনা ঘটেছে ঠিক তার উল্টো। এর একটি মারাত্মক প্রভাব রয়েছে। সেটি সদর্থক না নঙর্থক তার বিচার করবে পরবর্তী ইতিহাস। কিন্তু একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকের মুখে দাঁড়িয়ে রাজ্যবাসীর ভিড়ের গতি যে অভিমুখে, সেই অভিমুখই অন্ধবিশ্বাস ও অন্ধভক্তির অভিমুখ। রাজ্যবাসী যদি শেষমেশ সেই অভিমুখেই রওনা দেয়, তবে তার প্রভাব সমাজের সর্বস্তরের উপরে পড়তে বাধ্য। আর তখন নিন্দুকের কথা সত্যি হয়ে ফুটন্ত কড়াই থেকে জলন্ত উনুনে ঝাঁপ দেওয়াই রাজবাসীর জীবনসত্য হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। শেষকথা অবশ্য সময়ই বলবে। আপাতত গরুর দুধে সোনার জল্পনা জমে উঠেছে। 


৩০শে অক্টোবর’ ২০২০


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.