শনির বচন | গোবলয়ের খপ্পরে

গোবলয়ের খপ্পরে

■ রাজনীতিতে মিছিল থাকবে। মিটিং থাকবে। জনসমাবেশ থাকবে। থাকবে রাজনৈতিক নেতা কর্মী। থাকবে সাধারণ জনতাও। থাকবে বিক্ষোভ সমাবেশ পথ অবরোধ থেকে শুরু করে সরকার বিরোধী অভিযান। এই সবই গণতান্ত্রিক রাজনীতির অঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতিতে এসব কোনটিই নতুন কোন বিষয় নয়। এমনকি নতুন বিষয় নয় জনতা পুলিশের খণ্ডযুদ্ধও। ধস্তাধস্তি। পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার দুরন্ত প্রয়াস। না, কোন কিছুই নতুন কোন সংস্কৃতি নয়। নতুন সংস্কৃতি হলো, রাজ্য রাজনীতিতে রাজনৈতিক মিছিলে ভিন রাজ্যের বহিরাগত নেতাকর্মী ভাড়া করে আনার প্রবণতা। যাদের জীবন জীবিকার সাথে পশ্চিমবঙ্গের কোন সংযোগ নাই। যাদের বাস এই রাজ্যেও নয়। রাজ্য রাজনীতিতে এই সংস্কৃতি আগে ছিল না। এটি একেবারেই হাল আমলের ঘটনা। রাজ্যের জনগণের বিপুল অংশের উপরে ভরসা না থাকাই এর প্রধান কারণ বলে মনে করা যেতে পারে। সেই কারণেই ভিন রাজ্য থেকে লোক ভাড়া করে নিয়ে এসে মিছিলে ভিড় বাড়ানোর প্রয়াস। না, গণতন্ত্রের পক্ষে এই সংস্কৃতি শুভ নয়। একটি রাজ্যের রাজনৈতিক সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে সেই রাজ্যের রাজ্যবাসীর ক্ষোভ বিক্ষোভ থাকতে পারে। এবং থাকবেই। সেই ক্ষোভ বিক্ষোভের লক্ষ্য থাকে সরকারে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নীতিমালা এবং কর্মকাণ্ডের বিরোধীতা করাই। সংশ্লিষ্ট দলের নেতানেত্রীর বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভ ইত্যাদি। কারণ দৈন্দিন জীবন যাপনের সাথে বিষয়গুলি সংশ্লিষ্ট। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের নানবিধ কর্মকাণ্ড ও নীতিমালার বিরুদ্ধেও জন বিক্ষোভ প্রদর্শন গনতন্ত্রেরই অন্যতম অংশ। কিন্তু এই সব কিছুর মূলেই সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মানুষের উপরে সরকারী কর্মকাণ্ডের নঙর্থক প্রভাব বিদ্যমান। যে প্রভাব ভিন রাজ্যের বাসিন্দাদের মাথাব্যাথার বিষয় নয়। রাজ্যবাসীই সেই বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য যথেষ্ঠ। এমনটাই হয়ে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতিতে। এতদিন।

কিন্তু বিগত কয়েক বছরে চিত্রটা অনেকটাই বদলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির পরিকল্পনায়। এবং সমগ্র পরিকল্পনার স্ক্রিপ্টই রচিত হচ্ছে রাজ্যের বাইরে থেকে। পশ্চিমবঙ্গ তথা বাংলা ও বাঙালির একটি স্বতন্ত্র অস্তিত, সত্তা এবং সংস্কৃতি বর্তমান। যে সংস্কৃতি উত্তর ভারতীয় গোবলয়ের সংস্কৃতির থেকে সম্পূর্ণত ভিন্নধর্মী। ভিন্ন প্রকৃতির। আমাদের এই স্বাতন্ত্রই আমাদের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার। কিন্তু এবারে সুপরিকল্পিত আঘাতটা আসছে সেই স্বতন্ত্র সত্তার উপরেই। সেই আঘাতের সূত্রপাতই হলো রাজ্য রাজনীতিতে গোবলয়ের সংস্কৃতির আমদানী করা। আমাদের মনে রাখতে হবে রাজ্যবাসীর মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশের বেশি কিন্তু অবাঙালি জনজাতি। যাদের ভাষা ও সংস্কৃতি আমাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। আর সেটিই হচ্ছে গোবলেয়র রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমদানী করে নিয়ে আসার প্রধান অনুঘটক। ভাষা ও সংস্খৃতির সমানধর্মীতার কারণে খুব সহজেই ভিন রাজ্যের বাসিন্দারা রাজ্যবাসীর এই এক তৃতীয়াংশের মতো জনজাতির সাথে মিশে যেতে পারে। বাইরে থেকে বোঝা দায়, কে রাজ্যের বাসিন্দা। আর কে ভিন রাজ্যের ভাড়াটে রাজনৈতিক কর্মী। এবং এই ভিনরাজ্যের ভাড়াটে রাজনৈতিক কর্মীদের সহায়তা নিয়ে রাজ্যবাসীর এক তৃতীয়াংশের বেশি অবাঙালিকে পাশে নিয়ে এক নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরী করা শুরু হয়ে গিয়েছে। যে সমীকরণে যত বেশি পরিমাণে বাঙালিকে সংযুক্ত করা যাবে তত সফল হয়ে উঠবে নির্দিষ্ট পরিকাল্পনা মাফিক রাজ্যের প্রশাসনিক ক্ষমতা দখল করা। সেটিই পাখির চোখ এখন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক শিবিরের। আমাদের বাঙালির চিরন্তন ঐতিহ্য নিজের পায়ে কুড়াল মারা। ফলে রাজ্যের বাইরে বসে তৈরী করা যে স্ক্রিপ্টের দৌলতে পশ্চিমবঙ্গে গোবলয়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমদানী করা হচ্ছে, বাঙালির একটি অংশ আগ বাড়িয়ে সেই স্ক্রিপ্টের সফল রূপায়নে কাঁধ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাঙালির ধর্মই তাই। এই আত্মঘাতী চরিত্রের কারণেই আজ বাংলা একধিক টুকরোয় বিভক্ত। বাংলার জমি ঢুকে গিয়েছে বিহার ঝাড়খণ্ড উড়িষ্যা ও আসামে। বাঙালি নির্বিকার। অবশিষ্ট ভুখণ্ডকে দুই ভাগ করে দিয়ে মাঝখানে কাঁটাতার বসিয়ে পরস্পর বিদেশী সেজে তোফা আনন্দে মশগুল আমরা। এদিকে রাজ্য রাজনীতিতে ভিনরাজ্যের অবাঙালিদের দাপট প্রভাব প্রতিপত্তি বেড়ে চলেছে দিনের পর দিন। আমরা বাঙালিরাই তাতে মদত দিচ্ছি বেশি করে। সেদিনের মীরজাফরের ব্রিটিশভক্তির মতো।

এবং ভিন রাজ্যের এই ভাড়াটে সৈনিকদের মাধ্যমে গোবলয়ের রজানীতির আরও একটি সংস্কৃতি আমদানী করা হচ্ছে। অত্যন্ত সচেতন ভাবেই। সেটি হলে অস্ত্র মিছিলের রাজনীতি। রাজনৈতিক বিক্ষোভ সমাবেশে বিশেষ গুণ্ডাবাহিনী থেকে শুরু করে ভাড়াটে রাজনৈতিক কর্মীদের কোমরে আগ্নেয়াস্ত্রের ঝনঝনানি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে খুনোখুনির ঘটনা নতুন নয়। নতুন হলো রাজনৈতিক মিছিলে জনসমাবেশে সাধারণ রাজনৈতিক কর্মীদের কোমরে আগ্নেয়াস্ত্রের উপস্থিতি। বিষয়টি ভয়াবহ। আরও ভয়াবহ এই কারণে যে সেই ঘটনার পক্ষ নিয়েই ওকালতি করে চলেছে বিশেষ রাজনৈতিক শিবির। এর ফল কিন্তু মারাত্মক। বাকি রাজনৈতিক দলগুলিও যে এই অন্যায় পথে পা বাড়াবে না, তার নিশ্চয়তা কি? ফলে এ এক নতুন প্রতিযেগিতার সম্মুখীন রাজ্য রাজনীতি। কোন দলের নেতা কর্মীদের হাতে কত বেশি আগ্নেয়াস্ত্র থাকবে। সেই সমীকরণেই ঠিক হবে কোন দলের মিছিল বা জনসমাবেশের গুরুত্ব কত বেশি। এটি বাঙালির রাজনৈতিক সংস্কৃতি ছিল না কোনকালেই। কিন্তু গোবলয়ের আধিপত্যের হাত ধরে রাজ্য রাজনীতিতে এই অসুখ ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুতবেগে। কথায় বলে ভয়ে ভীতিতে ভক্তি। গোবলয়ের রাজনীতির সেটিই অন্যতম সংস্কৃতি। সেই সংস্কৃতিই কি তবে রাজ্য রাজনীতির ভবিষ্যত গতিপথ ঠিক করে দেবে?

হ্যাঁ একথা অবশ্যই সত্য যে, রাজ্য রাজনীতিতে দুর্বিত্তের সংযোগ নতুন কোন ঘটনা নয়। সব রাজনৈতিক দলই দুর্বৃত্তদের শেষ আশ্রয় এবং প্রথম ভরসাস্থল। রাজনৈতিক গুণ্ডামী এখন একটি পেশা। বহু বাঙালি যুবকই এই পেশার সাথে জড়িত। কালো টাকা সাদা করার মতোনই গুণ্ডা বদমায়েশ দুর্বৃত্ত সমাজবিরোধীরা রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠতে উঠতে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে একবার জনপ্রতিনিধির তকমা পেয়ে গেলেই কেল্লাফতে। বহু রাজনৈতিক নেতাকর্মীরই অতীত এইভাবেই গড়ে উঠেছে। এটা এরাজ্যের বহুকাল আগের সংস্কৃতি। তবুও এই সংখ্যাটি রাজ্য রাজনীতিতে কোনদিনই কোনভাবেই নির্ণায়ক ভুমিকা নিতে পারেনি। রাজনৈতিক দলগুলি ভোট দখলের স্বার্থে এই শ্রেণীর নেতাকর্মীদের ব্যাবহার করে থাকে। কিন্তু দলের নীতিনির্ধারণে মতাদর্শ নির্মাণে এদের কোন ভুমিকা থাকতো না। কিন্তু গোবলয়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এরাই রাজনীতির শেষকথা। আমাদের রাজ্যেও সেই শেষকথা বলার সংস্কৃতিই কি তবে শুরু হতে চলেছে? অন্তত সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহের দিকে লক্ষ্য রাখলে সেই ভয় হওয়াই স্বাভাবিক।

ফলে যেকোন সচেতন রাজ্যবাসীই আজ বেশ আতঙ্কগ্রস্ত। এ কোন সংস্কৃতির খপ্পরে পড়লাম আমরা। যেখানে রাজনৈতিক মিছিলে তথাকথিত রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কোমরে আগ্নেয়াস্ত্র থাকাটাই বৈধতা পেতে চলেছে দিনে দিনে? এখন থেকে আর লুকিয়ে নয়। জনসমাবেশ মিটিং মিছিলে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্রের ঝনঝনানি দেখতে হবে। আরও দেখতে হতে পারে, বিভিন্ন রাজনৈতিক অক্ষের ভিতর অস্ত্র প্রতিযোগিতার এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত।

ফলে সাম্প্রতিক রাজনীতির গতি প্রকৃতির এই নতুন দুইটি দিকই কিন্তু ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে আমাদেরকে। ভিন রাজ্য থেকে ভাড়াটে রাজনৈতিক নেতাকর্মী নিয়ে এসে রাজনৈতিক আন্দোলন। আর সেই আন্দোলনে আগ্নেয়াস্ত্রের ঝনঝনানি। এমনিতেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বেচাকেনার গোবলয়ের সংস্কৃতি চালু হয়ে গিয়েছে আমাদের রাজ্যেও প্রায় এক দশক হল। ফলে রাজ্য রাজনীতিতে অর্থবল এবং বাহুবলই এখন শেষ কথা বলবে। জনসাধারণ ভয়ে ভীতে সেই বাহুবলী শক্তিকেই ক্ষমতায় নিয়ে আসবে বলে বিশ্বাসী আজকের বিশেষ রাজনৈতিক শক্তি। যারা পশ্চিমবঙ্গে শুধুই যে গোবলয়ের রাজনীতি আমদানী করছেন তাই নয়। গোটা পশ্চিমবঙ্গকেই গোবলয়ের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছেন এক পা এক পা করে।

কিন্তু বাঙালি কি সত্যই জেগে উঠবে কোনদিন? না কি এইভাবেই দিবানিদ্রা দিয়ে খাল কেটে কুমীর নিয়ে আসতে থাকবে। একজন মীরজাফর খাল কেটে যে কুমীর নিয়ে এসেছিল। তাতেই বাংলার জমি চলে গিয়েছে বিহার ঝাড়খণ্ড উড়িষ্যা আর আসামে। অবশিষ্ট অংশ ভাগ হয়ে গিয়েছে পরস্পর বিদেশী সেজে। আজ আর অখণ্ড বাংলার কোন অস্তিত্বই নাই। গড়ে ওঠেনি সার্বভৌম বাঙালি জাতিসত্তা। এই সব কিছুর মূল অনুঘটক পলাশীর প্রান্তরের সেই মীরজাফর। আর আজ বাংলার রাজনৈতিক প্রান্তরে গোবলয়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে যারা খাল কেটে নিয়ে আসছেন, তারা কি চান বাংলা ও বাঙালির শেষ চিহ্নটুকুও বিলীন হয়ে যাক? পশ্চিমবঙ্গ বিলীন হয়ে যাক গোবলয়ে। মহিন্দী হিন্দু হিন্দুস্তানের পেটে।

১৭ই অক্টোবর’ ২০২০

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.