■ শনির বচন | ভিড়ের চাপ
বহুদিন আগের, শ্রদ্ধেয় তপন সিংহের একটি সিনেমার সংলাপ আজ প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়ে গিয়েছে। এইখানেই প্রতিভাধর শিল্পস্রষ্টাদের শ্রেষ্ঠত্ব। সময় ও সমাজের নাড়ির স্পন্দন টের পান তাঁরা আমাদের অনেক আগেই। সংলাপটা আজ প্রায় সকলেই জানেন, “মাষ্টারমশাই আপনি কিন্তু কিছুই দেখেন নি”। হাড়হিম করে দেওয়া সেই হুমকি’র অসীম কার্যকারিতা সম্বন্ধে কোন ভারতবাসীরই মনে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই। আঠাশ বছর বাদে বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলায় আদালতের রায়ে সেই হুমকি’র সুরই প্রচ্ছন্ন যেন। মসজিদ ধুলিস্মাৎ হয়েছিল জনতার ভিড়ের চাপে। অর্থাৎ আমি আপনি সেদিন লাইভ টেলিকাস্টে কিছুই দেখি নি কিন্তু। আমাদের এই না দেখার উপরেই এখন নির্ভর করতে শুরু করবে আমাদের দেশপ্রেম। এবং হিন্দুত্ব। আমরা কে কতখানি বেশি হিন্দু। সেটি নির্ভর করবে আমরা সেদিনের খবরে কে কতটা কম দেখেছিলাম আসল ঘটনার ছবি। তারই উপর। আর যাঁদের বাড়িতে সেদিন টেলিভিশনের সেট ছিল না। যে প্রজন্ম সেদিন জন্মেছিল না। লোকমুখে শোনা কথায় বিশ্বাস করার দায় নাই তাঁদেরও। লোকশ্রুতিই যে বাস্তব সত্য তার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নাই। জানি আমরা। শুধু আদালতের রায়ে লোকশ্রুতির ভিত্তিতে রামমন্দিরের ঐতিহাসিক অস্তিত্ব স্বীকৃত হতে পারে। সময় ও সুযোগ বুঝে। শাসকের ইচ্ছা ও অনিচ্ছার উপরে। তার বাইরে লোকশ্রুতির সত্যতা নিশ্চয় কেউ স্বীকার করবো না আমরা।
ভিড়ের চাপের এই তত্ব ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন একটি যুগের সূচনা করে দিল সন্দেহ নাই। দিল্লীর সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মুসলিম নিধনও নিশ্চয় এই ভিড়ের চাপেই ঘটে গিয়েছিল। পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া। রাজনৈতিক নেতানত্রীদের প্ররোচনা ছাড়াই। ফলে সেই ঘটনাতেও ভিড়ের চাপের এই একই তত্বে বেকসুর খালাস যাবতীয় অভিযুক্ত। অবশ্য যদি তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত হন তবেই। লকডাউন পর্বে হুগলীর তেলেনিপাড়ার বীভৎস দাঙ্গাও নিশ্চয় এই ভিড়ের চাপেই ঘটে গিয়েছিল পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই। আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি আগামীতে ভারতবর্ষ জুড়ে এমন ভিড়ের চাপে আরও অনেক কিছুই ধুলিস্মাৎ হয়ে যেতে পারে। সাধারণ মানুষের আবাসগৃহ থেকে শুরু করে প্রাচীন স্থাপত্য ইত্যাদি। বামিয়ানের সেই বৌদ্ধমূর্তি ধ্বংসের মতোই। এবং টিভির পর্দায়, কিংবা নিজের পাড়াতেও আমরা যাই দেখি না কেন। আইন আদালতের রায়ে প্রমাণ হয়ে যেতেই পারে, আমরা কিন্তু কিছুই দেখি নি।
এই যে আপনি কিন্তু কিছুই দেখেন নি’র শাসন। আর তার সাথে জুড়ে ভিড়ের চাপের তত্ব। এই দুই তত্বই আজ ভারতবর্ষ শাসন করছে। না তাই বলে এই কথা ভাবার কোন কারণ নাই, এই শাসনপর্ব একেবারে হাল আমলের ঘটনা। বিশেষ একটি শক্তিই ভারতবর্ষে এই তত্ব আমদানী করেছে। কথায় বলে যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতার সময় থেকেই এই তত্ব রাজত্ব শুরু করে দিয়েছিল। স্বাধীনতার নাম দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের মূল শর্তগুলি কি ছিল। সেই বিষয়েও আমাদেরকে কিছুই না দেখার শাসনে বেঁধে রাখা হয়েছে সাত দশকের বেশি সময় ব্যাপী। এবং সেই ভিড়ের চাপের তত্বেই আমরা জানতে ও মানতে বাধ্য হয়েছি, স্বাধীনতা এসেছে অহিংস আন্দোলনের সাফল্যের হাত ধরেই। ভিড়ের চাপের তত্বের মহিমা এমনই অমোঘ ও সুদূর প্রসারী। এই ভিড়ের চাপের তত্ব ও কিছুই না দেখার শাসন চলছে আমার আপনার পাড়া থেকে শুরু করে আমাদের সমাজিক জীবনের প্রতিটি অলিগলি থেকে রাজপথে। এটাই আধুনিক ভারত। আধুনিক ভারতীয় ঐতিহ্য। প্রতিটি রাজনৈতিক শিবিরই সেই ঐতিহ্যের সার্থক উত্তরাধিকারী। কোন একটি বিশেষ রাজনৈতিক শক্তির দিকে আঙুল তুলে নিশ্চিন্তে বসে থাকার উপায় নাই। নতুনত্ব এইটিই যে, আজ সেই ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার আদালতের রায়ে স্বীকৃত হয়ে গেল। যার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।
সারা ভারতে একটি বাবরি মসজিদ থাকলো কি থাকলো না। একজন সাধারণ ভারতবাসীর তাতে বিশেষ কিছুই এসে যায় না। সেইখানে কয়টি রাম মন্দির গজিয়ে উঠবে কি উঠবে না। তাতেও সাধারণ ভারতবাসীর কিছুই এসে যায় না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য হাতের নাগালের বাইরে বেড়িয়ে যাওয়া। কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে আসতে থাকা। এবং অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের ঘনীভুত সঙ্কটের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয় বাবরি মসজিদ রামমন্দির। এবং নয় বলেই লক্ষ্য করে দেখতে হবে, ২০১৯ এর নভেম্বরে রামমন্দির নির্মাণের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কোন গণআন্দোলন সংঘটিত হয় নি। কিন্তু পরের মাসেই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে গোটা ভারত কেঁপে উঠেছিল স্বতঃস্ফূর্ত জনবিক্ষোভে। যেকোন শাসকের কাছেই এই বিষয়টি বিপদজনক। যে কোন শাসকই চাইবে এই বিপদ থেকে যে কোন উপায়ে নিজের গদি টিকিয়ে রাখতে। আর সেই গদি টিকিয়ে রাখার জন্য এই ভিড়ের চাপের তত্ব এবং আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি’র শাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুইটি হাতিয়ার। তাই বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলার এই রায় এতটা গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক। ঐতিহাসিক এই কারণেই যে শাসকের গদি রক্ষার অন্যতম একটি হাতিয়ার “ভিড়ের চাপ” -কেই আদালত আইনী স্বীকৃতি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করলো। ফলে, যে যেখানে শাসন ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত। আদালতের এই রায় তাদের কাছে অন্যতম রক্ষাকবচ হয়ে উঠবে। উঠলো। অর্থাৎ রাজনৈতিক মতাদর্শ রাজনৈতিক স্বার্থ ও উদ্দেশ্য নির্বিশেষে এই রায় ভারতবর্ষের প্রতিটি রাজনৈতিক শিবিরের কাছেই মেঘ না চাইতেই জলের মতোন এক অমোঘ আশীর্বাদ। ফলে আমাকে আপনাকে মাথা পেতে আদালতের রায়কে মেনে নিয়ে ভিড়ের চাপের তত্বকেও স্বীকার করে নিতে হবে। এবং কিছুই না দেখতে পাওয়ার শাসনকেও শিরোধার্য করে নিয়ে চাচা আপন প্রাণ বাঁচা তত্বকেই আঁকড়িয়ে ধরতে হবে। যস্মিন দেশে যদাচার কাছা খুলে নদী পার।
ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, কোন ঘটনাই শেষ কথা নয়। ভিড়ের চাপের এই তত্বের উপরেই বিশ্বের নানা প্রান্তের স্বৈরাচারী শক্তির উত্থান ঘটেছে। বারবার। ইতিহাসের অভিমুখে তাকালেই আমরা দেখতে পাবো সমস্ত স্বৈরতান্ত্রিক শক্তির আঁতুর ঘরই ছিল এই ভিড়ের চাপের তত্ব। এক এক দেশে এক এক সময়ে সুযোগ মতো সেই আঁতুর ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন এক একজন মুসোলিনী হিটলার প্রভৃতি। কিন্তু সেই ইতিহাসই সাক্ষ্য দেয়, প্রকৃত ভিড়ের চাপ কাকে বলে। সেই ইতিহাসই সাক্ষী, আর এক ভিড়ের চাপে মুসোলিনীর শেষ পরিণতি। সেই ভিড়ের চাপেই আফিমখোর চীনের ভাগ্য বদলিয়ে গিয়েছিল ঐতিহাসিক লংমার্চে। সেই ভিড়ের চাপেই সম্ভব হয়েছিল দুনিয়া কাঁপানো রুশ বিপ্লবের। তারও অনেক আগে সেই ভিড়ের চাপেই পতন হয়েছিল বাস্তিল দূর্গের।
না সেই ভিড়ের চাপকে ভয় করে না এমন কোন স্বৈরতান্ত্রিক শক্তির জন্ম হয় নি আজও। হয় নি বলেই সব স্বৈরতান্ত্রিক শক্তিকেই ভয় ভয় দিন কাটাতে হয়। প্রকৃত ভিড়ের চাপ যেন দানা না বাঁধতে পারে। প্রকৃত ভিড়ের চাপকে ঠেকিয়ে রাখার নামই আবার সংসদীয় রাজনীতি। গণতান্ত্রিক পরিসরে জনগণকে বিভ্রান্ত বিচ্ছিন্ন এবং বিকল করে রাখার জন্যই ‘আপনি কিন্তু কিছুই দেখেন নি’ এর কঠোর শাসন। আদালতের রায় দিয়েই হোক আর পুলিশ কিংবা মিলিটারীর বন্দুক দিয়েই হোক। নিদেন পক্ষে ভিড়ের চাপের তত্ব খাড়া করেই হোক। যে তত্বে বাবরি মসজিদ ধুলিস্মাৎ হয়ে যায়। দিল্লী জ্বলে ওঠে। তেলেনিপাড়া পুড়তে থাকে।
■ কপিরাইট লেখককর্তৃক সংরক্ষিত
সুচিন্তিত মতামত দিন