রুমকি রায় দত্ত

রুমকি রায় দত্ত

থোটলাকোন্ডায় কিছুক্ষণঃ

হঠাৎ যদি চোখ খুলে দেখি, ২০০০ হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাসের এক পৌরাণিক মানুষ হয়ে গিয়েছি আমি,আর বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের সঙ্গে এক সরু পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে দলবেঁধে হেঁটে চলেছি,তবে ঠিক কেমন অনুভব হত,গাড়ির পিছনের সিটে বসে চোখ বন্ধ করে সেটাই ভাবছিলাম। ডানদিকে ফিরোজা রঙের সমুদ্র আমাদের সাথেই চলেছে। চোখ খুলে ঐ সমুদের গভীর বাঁকা তটরেখার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন শিহরণ অনুভব করলাম। একটু আগেই যে জল ছুঁয়েছি, সে জল তো জানে ২০০০ বছরের পুরোনো সেই গল্প। এই জলই তো তাঁরাও ছুঁয়েছিল, সেই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা,যাঁরা ঐ পাহাড় চূড়ায় স্থাপন করেছিল বৌদ্ধ বিহার। 


ভাইজ্যাক থেকে মাত্র ১৫ কিমি দূরে ভিমুনিপত্তনম পাহাড়ের কাছে কোনও এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে সিদ্ধান্ত হয়েছিল সুন্দর স্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেনাগিরি পাহাড়ের উপর এই বৌদ্ধবিহার স্থাপনের। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৪২০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত থোটলাকোন্ডা বৌদ্ধস্তূপ দেখতে ছুটে চলেছি। একটা প্রকান্ড গেট পেরিয়ে এক জনশূন্য নির্জন প্রান্তে গাড়ি থামতেই দেখতে পেলাম একদা ১০০ জন বৌদ্ধ ভিক্ষুর আবাসস্থল কেমন ইতিহাস হয়ে শুয়ে আছে। আসলে সময় এভাবেই ইতিহাস গড়ে। কলিঙ্গ রাজ্যের সুপরিচিত এই বৌদ্ধবিহারটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ‘হীনযান’ শাখার। একদা এই বিহারই শ্রীলঙ্কা থেকে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় এই ধর্মের বিস্তারের পথকে সুদৃঢ় করেছিল।


গভির তটরেখা নৌ-ঘাঁটির সুউপযুক্ত হওয়ায় ইন্ডিয়ান নেভি এখানে নৌ-ঘাঁটি তৈরি করার সময় এই বৌদ্ধ স্থাপত্য আবিষ্কার করে। এরপর ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত অন্ধ্রপ্রদেশ আর্কিওলজি দপ্তর এখানে খননকার্য করে প্রচুর প্রাচীন নজির আবিষ্কার করে। খননে এখানে সাতবাহন রাজত্যের নমুনা সহ বহু কিছু পাওয়া যায়। রোমান রূপোর কয়েন দেখে অনুমান করা হয়,এখানে একসময় বৈদেশিক বাণিজ্যও চলত। এছাড়াও টেরাকোটার নিদর্শন, পাথরের তৈরি ছোট স্তুপের মডেল, প্রভৃতি নিদর্শনও পাওয়া যায়। একটা ভগ্ন জলাধার জীবনের কথা বলার জন্য হাজার হাজার বছর ধরে মাথা তুলে রয়েছে। ভাবতেই অবাক লাগে কোনও এক সময় এখানে এক চলমান জীবন ছিল। হঠাৎ মনে হল, আমিও কি একদিন এমন ইতিহাস হয়ে যাব? এজীবনে কীই বা খোদাই করলাম, যা ইতিহাস হয়ে মাথা তুলে রইবে! হঠাৎ মনে হল, হয়তো হাজার বছর আগের আমিকেই দেখছি এখন, হয়তো হাজার বছর পরে এভাবেই ফিরে আসব এখানে, আজ যেমন দাঁড়িয়ে। ঘুরতে ঘুরতে একটা বিস্মৃত ইতিহাসের অতলে হারিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু সময় তো থেমে থাকার নয়,এখনও অনেক কিছু দেখার বাকি।

এখান থেকে সোজা ফেরার পথে কৈলাশগিরি। একটা বিনোদন পার্ক,পাহাড়ের মাথার উপর। রোপে চেপে পৌঁছে গেলাম। এক ঝলমলে পার্ক। টয়ট্রেনে পুরো পাহাড়ের চূড়া থেকে অপরূপ সমুদ্রের দৃশ্য দেখার আনন্দই আলাদা। প্রায় সন্ধের পথে, পাহাড় থেকে নেমে বসলাম গাড়িতে।পথেই আছে সাবমেরিন মিউজিয়াম। গাড়ি ফিরতি পথের ঠিকানায় ছুটছে।বাঁদিকে টানা সমুদ্র,ভারি,গম্ভীর একটানা আওয়াজ শুনতে শুনতে ছুটে চলেছি আমরা। রাস্তার পাশে বাঁধানো রেলিং –এর ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সান্ধ্যভ্রমণে বেরোনো স্থানীয় মানুষ। সমুদ্রের নোনা হাওয়ায়,কালো আকাশে একথালা সুপারির মতো সাজানো নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে হয়তো তারা ক্লান্তি ধুয়ে নিচ্ছে। মনে পড়ে গেল ফেলে আসা পুরোনো স্মৃতি। জন্মের পর থেকেই গঙ্গানদী দেখতে দেখতে, গঙ্গার কোলেই বড়ো হয়েছি। এমন কত সন্ধ্যা কাটিয়েছি নদীর পাড়ে।ঝিমঝিমে সন্ধ্যা নেমে আসতেই রাস্তার আলো গুলো জোনাকির মতো জ্বলে উঠত। বসার বেঞ্চে বসে নীলচে ধূসর জল কেমন যেন অদৃশ্য হয়ে যেত সন্ধের কোলে,শুধু জেগে থাকত ঢেউয়ের ডাক। ঢালের গা-বেয়ে সাজানো বোলডারের ঢালু বাঁধের গা দিয়ে ছুটে যেত লালচোখের শেয়াল। একটা রহস্যময় প্রকৃতি জেগে উঠত চোখের সামনে। সাবমেরিন মিউজিয়ামে ঢোকার লাইনে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের জলের ছিটে নিতে নিতে মনে পড়ে যাচ্ছিল,সেইসব ফেলে আসা দিন। 


সাবমেরিন মিউজিয়াম দেখে ফেরার পথে রামকৃষ্ণমিশনের আশ্রমে একবার ঘুরে এলাম। এমন শান্ত নিরিবিলিতে দু-দন্ড জিরোনার ইচ্ছা থাকলেও শরীর তখন হাল ছেড়েছে। সারাদিনের ক্লান্তি, তাছাড়া আটঘন্টা হিসাবে গাড়িভাড়া দশ ঘন্টায় ঠেকেছে। মিটার এমনিতেই চড়েছে। কাজেই হোটেলে ফিরে, বিশ্রাম নিতান্তই প্রয়োজন তখন। পরেরদিন সন্ধেতে ট্রেন। ফেরার দিনটা আর কোথাও নয়,হোটালেই বিশ্রাম। দুপুরে একবার স্থানীয় বাজার ঘুরে স্মৃতিস্বরূপ কেনাকাটা। 

একই পথে ফেরা, শুধু সেদিন পথটা দেখেছিলাম দিনের আলোয়, আর ফিরিতি পথে রাতের অন্ধকার। বেশ নির্জন পথ!  

■ পরিচিতি

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.