দরজা খোলার আওয়াজ পেয়েই চট করে নেল পলিশের শিশিটা বালিশের তলায় লুকিয়ে ফেলল উমা। একহাতে দরজা ঠেলে আরেক হাতে ব্রেকফাস্টের ট্রে নিয়ে বর ঘরে ঢুকল। ফ্রেন্চ টোস্ট করার চেষ্টা করেছে আজ। ফ্রেন্চ টোস্ট খেতে উমা বড্ড ভালোবাসে। "কি গো শরীর কেমন লাগছে? জ্বরটা নামল? স্বাদ গন্ধ কিছু পাচ্ছো?" "না গো, এখনও তেমন কোনো পরিবর্তন নেই।" বউয়ের দিকে খানিক ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে "আচ্ছা তুমি খেয়ে নাও" বলে বেরিয়ে গেল। বেরোতেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল উমা। তবে একটু মায়াও হল। ভোলাভালা স্বামীটাকে বড্ড মুরগি করা হচ্ছে। কিন্তু কোভিডের নাম করে কদিন একটু শান্তিতে ' মি টাইম' কাটানোর লোভটা ছাড়তে পারল না উমা। সেই কোন কাল থেকে আদিশক্তি হয়ে সমস্ত সৃষ্টির ভার বহন করে চলেছে তবে থেকে একদিনের জন্যও বিশ্রাম পায় নি। এবার মর্ত্য থেকে ফেরার পথে হঠাৎ করেই এই দুষ্টু বুদ্ধিটা মাথায় খেলে গেছিল। বগলের তলায় পেঁয়াজ রেখে জ্বর আনতে খুব বেশি অসুবিধে হয় নি। সঙ্গে একটু খুক খুক আর স্বাদ, গন্ধ পাচ্ছি না বলা। ব্যস, কেল্লা ফতে। কি ভাগ্যিস বাড়িতে পালস্ অক্সিমিটার নেই। অবশ্য থাকলেও মহাদেবের ওসব মাথাতেও আসত না।
ছেলে মেয়েগুলোও এখন চোদ্দ দিন কোয়ারান্টাইন মেনটেন করছে, তাই ওদের সাহায্যও পাচ্ছেন না মহেশ্বর। একা বেচারি নাজেহাল হয়ে পড়ছেন কিন্তু এই পরিস্থিতিতে মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছেন না। নন্দী ভৃঙ্গী অবশ্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে বসকে সাহায্য করার। ওরা হাত না লাগালে কাউকে আর দুবেলা খেতে পেতে হত না। কিন্তু রান্নাঘরটার কি যে হাল করছে তিনজনে মিলে সেটা ভেবে উমার একটু দুশ্চিন্তাই হচ্ছে। যাকগে, এই কদিন সংসারের কোনো কথা ভাববে না ঠিক করেছে উমা। শুধু গল্পের বই পড়বে আর সিনেমা দেখবে। আর হ্যাঁ, খাবে আর ঘুমোবে। অবশ্য মুখে যাই বলুক, করোনা নিয়ে দুশ্চিন্তাটা কিন্তু যাচ্ছে না। মেয়েদের ঘরের দিকে গলা বাড়িয়ে একটু আগেই চেঁচিয়ে সরস্বতীকে বললেন "এই সরু, ওই যে পুতুর দেশের ভ্যাকসিনটা, কি যেন নাম স্পুটনিক না কি বা ওই কোভিশিল্ড কোনোটা একটা তাড়াতাড়ি বের করার ব্যবস্থা কর না। যা বুদ্ধি টুদ্ধি লাগে ওদের দিয়ে দে না বাবা।"
এইসবের মাঝে হঠাৎ হুলুস্থুল। "আমার বাঘছাল লাল কোত্থেকে হয়ে গেল?" "আরে কি হল চেঁচাচ্ছ কেন গাঁক গাঁক করে?" "দ্যাখো না, চান করে পড়তে গিয়ে দেখি আমার বাঘছালটা লাল হয়ে গেছে।" খানিক গবেষণা করে বোঝা গেল লক্ষ্মীর লাল সিল্কের শাড়ির সাথে একসঙ্গে ওয়াশিং মেশিনে কেচে এই কাণ্ডটি হয়েছে। কোনোদিন কি আর ভোলানাথ বাড়ির কাজ করেছেন যে এইসব জানবেন? "আচ্ছা, আমি তোমার জন্য আরো কতগুলো বাঘছাল অর্ডার দিয়ে দেব" বলে দুর্গা বরের দুঃখটা খানিক কম করার চেষ্টা করল। ওদিকে আবার কার্তিকের শার্টের কলার আর কাফ থেকে নাকি ময়লা ওঠে নি, সেই নিয়ে সেও খানিক গজগজ করছে। সেসব শুনে উমা মুচকি হেসে বলে "নে এবার বোঝ, মা কত কাজ করে। সারাদিন তো শুধু ফরমায়েশ আর বড় বড় কথা।"
দেবফ্লিসে একটা বেশ ভালো সিনেমা দেখছিল পার্বতী। হটাৎ দরজার বাইরে লক্ষ্মীর গলা "ও মা, শোনো। একটু সাজেশন দাও তো কি করি"। "কেন, তোর আবার কি হল?" "না, আমার কিছু হয়নি। আসলে কাল বাদ পরশুই তো মর্তে আমার পুজো। ওরা বার বার পিং করছে কখন আসছি জানার জন্য।" "না না, একবার গিয়ে শিক্ষা হয়নি তোমার? ওদের পরিষ্কার বলে দাও তুমি যেতে পারবে না। বলো ভার্চুয়াল পুজো করতে, তুমি অনলাইনেই আশীর্বাদ পাঠিয়ে দেবে। ওরা তো সবকিছুই এখন অনলাইন করছে, পুজোটাও অনলাইনই করুক। তাছাড়া এই তো সেদিন আমরা সবাই মিলেই ঘুরে এলাম। এবছর আর এত বাড়াবাড়ি করার প্রয়োজন নেই। " " আমিও তাইই ভাবছিলাম, তাও ভাবলাম তোমার সাথে একটু কনসালট করি।" "ও মায়ের এখনও প্রয়োজন আছে তাহলে?" "উফ মা, আবার শুরু করে দিলে? ডিসগাস্টিং " বলে লক্ষ্মী গটমটিয়ে চলে গেল। দুর্গাও আবার সিনেমায় মনোনিবেশ করল। মনটা তখন থেকে খাই খাই করছে। সিনেমা দেখতে দেখতে মুখ না চললে কি আর ভালো লাগে? স্টকে কিছু মুখরোচক খাবার দাবার তো ছিল কিন্তু এখন তো আর নিজে গিয়ে রান্নাঘর থেকে সেসব নেওয়া যাবে না। এইটাই একটু চাপ হয়ে গেছে। গণশাটাকেও বলা যাচ্ছে না, নইলে খাবার দাবার ও ঠিক খুঁজে আনতে পারতো।
ঘুমে চোখটা লেগে এসেছিল উমার। টিং টিং করে মেসেজ আসাতে ঘুম ঘুম চোখেই ফোনটা হাতে নিল। ও মা, এ তো তেনার মেসেজ। "মিস ইউ"। বাবাহ, ন্যাকামো দেখে আর বাঁচি না। বুড়ো বয়সে ভীমরতি? সেই কথাই লিখে দিল রিপ্লাইতে। উত্তরে কিছু ইমোজি এল। দুর্গার আর এসব আদিখ্যেতা করতে ভালো লাগল না। তাই আর রিপ্লাই না দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমটা ভাঙল মাঝরাতে। গাঁজার গন্ধে। বউ অন্য ঘরে, সেই সুযোগে এখন বেডরুমেই গাঁজা টানা শুরু হয়ে গেছে তাহলে। এই হল মিস ইউয়ের বহর। রাগে গাটা রি রি করে জ্বলে উঠল। দাড়াও, আর তো কটা দিন। সব সুধে আসুলে বার করব আমি, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল উমা। সারাজীবন কেটে গেল, কিন্তু কিছুতেই এই বাজে নেশাটা আর ছাড়াতে পারল না উমা। কত বড় বড় অসুরকে শায়েস্তা করে ফেলল, কিন্তু নিজের বরটাকেই আর সাইজ করতে পারল না। এটা ভাবলেই ভীষণ ডিপ্রেসিং লাগে দুর্গার। অবশ্য শুধু কি আর মহাদেব, করোনাকেও তো বধ করতে পারল কই? ব্যস, এই যে মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে গেল, এবার আর বাকি রাতটা ঘুম আসবে না। যতরাজ্যের নেগেটিভ চিন্তা মাথায় ঘুরবে। ছেলে মেয়েরা ঘুমোচ্ছে, এখন বরং উঠে ফ্রিজ থেকে চকোলেট বের করে খাওয়া যেতেই পারে। চকোলেট ভালো অ্যান্টি ডিপ্রেস্যান্ট।
পরদিন সকালে হই চই চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙল উমার। কান পেতে শোনার চেষ্টা করল কেসটা কি জানার জন্য। ব্যাপারটা যা বোঝা গেল তাদের বাবা খুব অ্যাম্বিশাস হয়ে লুচি আর সাদা আলুর চচ্চড়ি করতে গেছিল ব্রেকফাস্টে। খাবার মনোমত হয়নি, মায়ের মত হয়নি এসব বলে ছেলে মেয়েরা খুব বাওয়াল করছে। উনি তো এমনিতে শান্তই। গত কদিনে ছেলে মেয়েদের অনেক বাঁদরামি মুখ বুঁজে সহ্য করেছেন কিন্তু আজ আর নিতে পারলেন না। প্রচন্ড হুংকার দিয়ে বললেন যার যার না পোষাবে সে যেন নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নেয়। ব্যস, পিন ড্রপ সাইলেন্স। বাবাকে তো সচরাচর রাগতে দেখে না ওরা, তাই বাবাকে রাগতে দেখে ওরা বেশ ঘাবড়েই গেছে।
আর কোনো কথা না বলে চারজনেই নিঃশব্দে জলখাবার খাওয়া সেরে ফেলল। ওদিকে এসব দেখে শুনে উমা ও ভাবল নাহ আর বোধহয় এই নাটকটা টানা উচিত হবে না। এবার শিগগিরি যবনিকা টানতে হবে। মনে মনে ছক কশে নিয়ে বিকেলবেলা নিজেই ঘর থেকে বেরিয়ে ঘোষণা করল "ধনন্তরী রিপোর্টের সফট কপি মেল করে দিয়েছে, আমি এখন করোনা মুক্ত।" "ওফ, বাঁচালে" সবাই মিলে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল। "আজকে ডিনারে তাহলে কি মেনু?" প্রশ্নটা শুনেই দুর্গার মনে হল কি ভুলটাই না করল, আর কদিন কোভিড নাটকটা চালালেই হত।
সুচিন্তিত মতামত দিন