শুনেছি ভগবান মানুষ বানান। কারোর রং কালো করে দেন। কারোর ফরসা। কাউকে লম্বা কাউকে মোটা। কারোর চুলের ঢাল কারোর পাতলা। কাউকে যমজ। তারপর তাদের টুপটুপ করে পৃথিবীতে ফেলে দেন। তারা বড় হয়। কেউ খুশী থাকে, কেউ দুখী থাকে। এটা তো সরল সমীকরন। এরপর কিছু মানুষ আছে যারা নিজেরাই নিজেদের এক বিরল প্রজাতির প্রাণী ভাবতে শুরু করেন। ভগবানের সাথে সরাসরি তারা ফোনে কথা বলে সৃষ্টিকর্তার থেকেও বেশি জেনে যায়। সমাজে তখন নিজেদের জ্ঞান বিতরণ করতে শুরু করে বিনা পয়সায়।
বিনা দায়িত্বে।( এখানে আবার সাধু বাবাদের ভেবে নেবেন না। এরা এক অদ্ভুত সম্প্রদায়।) এরা কোনো দায়িত্ব নেবেন না। কারণ তারা তো উচ্চ পর্যায়ের জীব তারা সাধারণ মানুষের দায়িত্ব নেবে কেন! অর্বাচীন সাধারণ পাল পাল মানুষ যত না থাকে ততই ভালো।সাধারণ মানুষ নিজের ভালো বোঝে,নিজের বুদ্ধি নামক এক গুণ দিয়ে দুধ জল আলাদা করতে পারে। সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বুঝতে পারে। এসব মানুষ যত কমে ততই বিরলদের মজা। নিজেদের রাজত্ব শক্ত হবে।
এমনভাবেই চলছিল। সাধারণ মানুষগুলো মানিয়ে নিয়েছিল এই আহাম্মকের দলকে। তারপর এলো পৃথিবী ব্যাপি এক মহা সংকট। প্রাকৃতিকভাবে তৈরী পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরলো মানুষের তৈরী অসুখ। মানুষের তৈরী বলছি কারন খবর টবরে তেমন পড়েছি। চীন দেশে যে সব মানুষদের মাথায় গিজগিজ আইডিয়া চালান করে টুপটুপ করে ফেলে দিয়েছিল ভগবান। সেসব মানুষ নাকি খোদার ওপর খোদগারী করে চুপচাপ করোনা ভাইরাস বানিয়ে ফেলেছে। তারপর আরকি দুগ্গা মায়ের অসুরের মতো বীজ থেকে জন্ম নিয়ে এক হাজার থেকে এক লাখ, এক লাখ থেকে এক কোটি.... এমনি করে অগুনিত হয়েছে। এই করোনা আবার তাদের সৃষ্টিকর্তাকেও বাঁশ দিয়েছেন। তাদেরও মারছে সারা পৃথিবীর মানুষও মারছে। করোনা নামক পিশাচটা সাধারণ অসাধারণ, বিরল আহাম্মক এসব বিচার করছে না। মুশকিল তো সেটা। অতিবোঝোনদার লোকগুলোকেও রেহাই দিচ্ছেনা। পৃথিবী ব্যাপি ত্রাহি ত্রাহি রব।অতিমারীর প্রকোপ।
এমন সময়ে বাংলার শরত ঋতু এসে গেল হাসি হাসি মুখ নিয়ে। আকাশ নীল ঝকঝকে। পেঁজা তুলো মেঘ ভেলার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে।শরত সুন্দরী কোনো কিছু না ভেবেই বাঙালী মনে সুড়সুড়ি দিয়ে দিলো। ব্যাস বাঙালী নেশা গ্রস্হ।মনটা উদাস হচ্ছে। পূজাসংখ্যা বেরিয়ে গেছে। পুজো পুজো ভাব পয়সার অভাব। এমন সময় প্রশ্ন উঠলো দুগ্গা পুজো কি হবে? হবে না পুজো? পুজো হবেনা? একদল লোক বলল পুজো না হওয়াই ভালো। সার্বজনীন উৎসব এই পুজো। একদিন একদিন বললাম কারণ আগেরদিন হলে গুনতি করে বলা যেত ৫ দিন পুজো।আজকাল তো একাদশী থেকেই মানুষের ঢল শুনেছি। সঠিক গোনাগুনতি দিন জানিনা।
দিনরাত এক করে মানুষ উৎসবে মাতেন। সামাজিক বা দৈহিক দূরত্ব না থাকলে সংক্রমণের আশঙ্কা বহুগুন। পুজোর উৎসবে সামিল হলে পুজোর পর সুনামির মতো করোনা অতিমারি গ্রাস করবে আমাদের রাজ্যকে। মৃত্যুর মিছিল। সব জায়গায় শুরু হবে শবের মিছিল। চিকিৎসার জায়গা থাকবে না। বেঘোরে প্রাণটি যাবে করোনা মামার থাবায়। তাই শুধু নয় যেহেতু এটি অদৃশ্য শত্রু তাই এক পাড়া থেকে আরেক পাড়া। এক শহর থেকে আরেক শহর। ক্রমে রাজ্য থেকে রাজ্য। তারপর পুরো দেশ... আর ভাবা যাচ্ছেনা। দুর্গা পুজো তো বাড়িতে মেয়ে আসা। তাকে একবছর কমই আপ্যায়ন করলাম। মনে মনে আহ্বান জানালাম। উৎসব করলাম না দশের স্বার্থে। এমন স্যানিটাইজড ভাবনা চলছিল। কিন্তু ঐ যে বিরল প্রজাতির অতিবোদ্ধা মানুষগুলো। তেড়েফুঁড়ে উঠলো। রে রে করে বলতে শুরু করলো পুজো না হলে কি কি ক্ষতি হবে। পুজো নির্ভর রোজগার বন্ধ হবে কিছু লোকের। তারা না খেতে পেয়ে মরবে। আরে বাবা না খেয়ে মরাটা অত সহজ নয় যতটা সহজ অতিমারিতে মরা। পুজো না করে টাকাগুলো দাওনা বাপু গরীবদের।কত মানুষ চাকরি খুইয়েছে। বাচ্চাদের পড়াশুনা করানোর পয়সা নেই। সরকার দায়িত্ব নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এক এক জন মানুষ এক একটা মানুষের দায়িত্ব নিলেই তো সমস্যা কমে যায়। বলবেন হয়তো তুমি কে নিধিরাম সর্দার এসব কথা বলার। তুমি নিজে করো বাপু।জ্ঞান দিওনা। আমি কেউ না জানি। আমি একজন সচেতন নাগরিক মাত্র। হ্যাঁ আমি এমন কাজ করছি। দেখেছি নিঃশব্দে সমস্যার সমাধান হয়েছে।
যাক সেসব কথা।পুজো এখন রাজনৈতিক উৎসব। বিরল প্রজাতিরা নিদান দিয়ে দিলো পুজো হবে। আরেক দল স্বঘোষিত ভগবানের দল আঁজলা ভরে পয়সা সাহায্য করতে থাকলো। বলল নাও পয়সা, পুজো করো। উৎসব করো। ঠাকুর দেখো। ফুচকা খাও। কিন্তু দূরত্ব বজায় রেখো। সোনার পাথরবাটি। পিলপিল করে কিছু মানুষ বেড়িয়ে পরলো নতুন জামা, নতুন জুতো কিনতে। ম্যাচিং মাস্ক কিনবে ঠিক করেছে। বাঁধ সাধছে লিপস্টিক। বাঁধা দিচ্ছে ফুচকা এগরোল চাউমিনের হাতছানি । পুজোর কদিন মায়ের নাম নিয়ে মাস্ক না পরলেও চলবে। এমনও ভেবে ফেলেছে। পুজোর কদিন লম্বা ছুটি। সপরিবারে আনন্দ। কব্জিডুবিয়ে খাওয়া এসব না হলে চলে! আজ আছি কাল নেই। জম্মের শোধের ফূর্তি করেনি আগে।
সামাজিক জীব আমরা। তবু বুঝছিনা সামাজিক সংক্রমণ হলে নেতা নেত্রী, পুজো, মানত কিছুই কাজ করবে না। বিশ্বযুদ্ধের সময় উৎসব অনুষ্ঠান কটা হয়েছিলো জানিনা।কিন্তু এখন উৎসব পেখম মেলবে বুঝতে পারছি।
এরপর আসি ডাক্তার স্বাস্থকর্মীদের কথায়।এদের তো সকলে রোবট ভাবছে।সামাজিক দায়িত্ব শুধু তাদেরই৷ তাদের পরিবার নেই। তাদের উৎসবে সামিল হতে হয়না। তাদের বিশ্রামের প্রয়োজন নেই। মোদ্দা কথা মানুষ হৈ হৈ করে নেমে পরেছেন এবং আরো নামবেন প্যান্ডেল হপিংয়ে। "বাপরে কি ডানপিটে ছেলের" মতো তারা মাছির বদলে টপাটপ করোনা ভাইরাস খাবেন। তাদের আটকানো বিষম কাজ। এরা সকলেই স্বাধীন দেশের নাগরিক। একটা স্বাধীন দেশের মানুষ এতো দায়িত্বহীন কি করে হয় কে জানে। স্বাধীনতা আসে কিছু দায়িত্বের সাথে। সেই নাগরিক দায়িত্ব পালনে অনীহা মানে তারা মূর্খ। দশের প্রতি, মানুষের প্রতি তাদের ভালবাসা, সহানুভূতি নেই। ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মীরা তো নাজেহাল হচ্ছেনই আর এরা বুঝছেনা যে অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি আরও হবে যদি বাধ্য হয়ে আবার লকডাউন করতে হয়। অর্থনৈতিক অবনতির থেকে উঠে দাঁড়ানো সহজ নয়। পৃথিবীব্যাপী মানুষ সংকটে। রাস্তায় ভীড় করে পুজোয় মেতে ওঠা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।যারা এসব না ভেবে রাড্তায় ফুর্তি করতে নামবেন সেসব বুদ্ধিহীন লোকদের সাথে দেখা হলে লজ্জা দেওয়া উচিত। প্রশ্ন করা উচিত কেন অন্য লোকের ক্ষতি করতে চান।কেন আরো মানুষ মারতে চান!
বাঁচতে চান তো আবেগ দিয়ে নয় মগজ দিয়ে ভাবুন। মাথার মধ্যে তো কম বেশি মগজ সকলেরই আছে। আমরা সকলে সব মানুষ হয়ে এক হতে চাই শব নয়।
সুচিন্তিত মতামত দিন