■ জয়তী রায় মুনিয়া / বিষকন্যা: শরীরে বিষ। মনে অশ্রু

বিষকন্যা: শরীরে বিষ। মনে অশ্রু


১:

____মহারাজ । একটা প্রশ্ন।​

____নির্ভয়ে করো মহামন্ত্রী।​

____কন্যাটি কে?​

____কন্যাটি মহারানীর সখী এখন। বিগত যুদ্ধে লিচ্ছবি রাজ্য জয় করে, লুঠ করে আনা হয়েছে পরম রূপবতী কিছু নারী। তার মধ্যে শ্রেষ্ঠা হল এটি। রূপ নৃত্য লাস্য__জুড়ি নেই!​

___মহারাজ। প্রাচীন ভারতের তিন চিকিৎসক চরক, সুশ্রুত ও ভাগবতের বর্ণনা অনুযায়ী__কন্যাটি বিষকন্যা।​

____মহামন্ত্রী!​

___মুখচোখের অশ্লীল ভাব ভঙ্গিমা, মাটিতে পা আঁচড়ানো, নিজের চুলকে হাত দিয়ে বার বার স্পর্শ করা, অকারণ হাসা, পিছু ফিরে ফিরে দেখা___মহারাজ! এ বিষকন্যা না হয়ে যায় না।​

___এ ত লাবন্যময়ী। নিষ্পাপ চোখ। তোমার ভুল হচ্ছে না তো?​

___পুরাণে আছে এদের কথা। কল্কি পুরাণ, শুকসপ্ততা, এবং চাণক্য রচিত অর্থশাস্ত্র__একাধিকবার এসেছে বিষকন্যার কথা। গন্ধর্ব চিত্রগ্ৰীবার স্ত্রী সুলোচনা নিজে ছিল এক বিষকন্যা।​

___আমার দুঃখ হচ্ছে মহামন্ত্রী। ফুলের মত কন্যাটির শরীর বিষময়! এর সঙ্গে সঙ্গম অর্থাৎ নির্ঘাত মৃত্যু। এমন হল কি করে? এ ও সম্ভব?

উপরের কথপোকথন কাল্পনিক। তথ্যগুলি সত্য। কথপোকথন থেকে​ অনুমান করা যায়, বিষকন্যা বাস্তবে ছিল। প্রাচীন ইতিহাস থেকে এর সমর্থন মেলে। নানা লোককথা। লোকগান। পুরাণ। লোকমুখে ফিরে ফিরে এসেছে রহস্যময় নারীদের কথা! গল্পে গল্পে পাখা মেলে কাহিনী। লোক অবাক হয়ে শোনে অপরূপ সুন্দরী কন্যা, সে যদি চোখ মেলে তাকায়, পুরুষ তার থেকে চোখ সরাতে পারে না। মোহগ্রস্ত সে, পিছন পিছন চলতে থাকে। আর যদি​ কন্যার আলিঙ্গনে ধরা পড়ে, পরেরদিন নির্জন প্রান্তরে পড়ে থাকে , পুরুষটির মৃতদেহ।​ প্রাচীন থেকে আধুনিক সাহিত্য, চলচ্চিত্র__বিষকন্যা নিয়ে নানা মিথ, নানা কাহিনী। নানা গল্প।​ শরীরে বিষ নিয়ে বড় হয কিছু নারী। ভিতরে কালনাগিনী। বাইরে সুহাসিনী। সরলা। যাঁদের সংস্পর্শে মৃত্যু অনিবার্য। অথচ , এমন তীব্র এঁদের শরীরী আকর্ষণ যে, রাজা থেকে ফকির__নিস্তার নেই কারো!​

এমন তথ্য বিশ্বাস করা কঠিন বইকি। প্রাণঘাতী বিষ মানবশরীরের রক্তে বয়ে চলেছে__একে নিছক গালগল্প বললে মানায় ভালো। ইতিহাস তেমন প্রামাণ্য তথ্য দেয়নি।​ ​ রাজনৈতিক চাপের কারণে, ইতিহাস মাথা নত করলেও, লোক মুখে মুখে যে সব ঘটনা আকার পায়, সেগুলো সত্য বইকি। সেই সত্য আমরা খুঁজে পাই সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় " নাগিনী কন্যার কাহিনী "র মধ্যে। লৌকিক কাহানীর মধ্যে দেখি, মা মনসার কথা। সাক্ষাৎ বিষহরি রূপ। অজগরের কুণ্ডলী পাকান আসনে বসে আছেন। সর্বাঙ্গে সাপের অলংকার। চারিদিকে বইছে বিষের বাতাস। নাগিনী কন্যার কাহিনী র নায়িকা, বেদের মেয়ে।​ বিষ নিয়ে খেলতে ভালোবাসে তাঁরা। বিষ লাগা জায়গায়, অক্লেশে ডুবিয়ে দিতে পারে ঠোঁট। তুলে আনতে পারে বিষ। পৃথিবীর প্রাচীন লোকগাথা গুলি বেশিরভাগ সাপ এবং বিষ নিয়ে তৈরি । বলা যায় , বিষয়টি জনপ্রিয়। আধুনিক কালেও, নাটক, সিরিয়াল, সিনেমাতেও বিষয়টি গুরত্ব পেয়েছে।​

২ : বিষ করে বিষক্ষয় :

বিষ___শব্দটির মধ্যে আছে রহস্য। আছে মৃত্যু। সত্য মিথ্যা মেশান নানান গল্প। মানুষের জীবন ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, মৃত্যুর এই বার্তাবাহক। সক্রেটিসের পান করা হেমলক থেকে শুরু করে রূপকথার স্নো হোয়াইটের খাওয়া আপেল__সব কিছুই আমাদের একই শিক্ষা দেয়, আর সেটা হল বিষ মানেই বিপদ।

​এই বিপদ সঙ্গে করেই আদিম মানুষের পথ চলা শুরু। পৃথিবীর আদিম কাল থেকেই বিষ , মানুষের সঙ্গী। আদিম মানব বাস করত গভীর অরণ্যে। প্রকৃতির সঙ্গে মিলে মিশে , অরণ্যের জীব জন্তু, পাহাড় নদীর মতই বেড়ে উঠত মানবশিশু। খাদ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে, পর্বত গুহায় নিজের বাসস্থান__সবকিছুর জন্য চলত লড়াই। শুধু কি তাই? খাবার সংগ্রহ করে পরখ করতে হত, কোনটি আহারের যোগ্য, কোনটি বিষাক্ত! ছিল না ল্যাবরেটরি। ছিলনা প্রতিষেধক। মানবের ' শরীর ' ছিল তাঁর অস্ত্র। তার পরীক্ষাগার। প্রতিষেধক। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ__প্রতিটি অঙ্গ ছিল সজাগ। সতর্ক। বিপদের খবর পেত আগাম। নিবিড় অরণ্যের লতাপাতা, পোকামাকড়, এমন কি ফুল ফলের মধ্যে ছড়িয়ে থাকত বিষ। সুস্থ ফল , বিষাক্ত ফল থাকত পাশাপাশি। চেনা মুশকিল হত। ঘনঘোর সূর্যালোকহীন অরণ্যের মাটিতে ঘুরে বেড়াত বিষাক্ত পোকামাকড়। গাছের উপর অথবা মাটিতে শুয়ে থাকা__মানুষের শরীরে বিঁধিয়ে দিত তীক্ষ্ম হুল। ছড়িয়ে পড়ত তীব্র বিষ।​

​নিত্যকার বিষাক্ত আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য , মানুষ আবিষ্কার করল অভিনব উপায়ের। খুব অল্প পরিমাণ বিষ প্রয়োগ করত নিজেদের শরীরে।​ বিষে বিষক্ষয়__এই পদ্ধতি অনুসরণ করল। যার ফলে , বিষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের​ প্রতিষেধক শরীরে তৈরি হল। শোনা যায়, শঙ্খচূড় সাপের বিষ পরিমিত মাত্রায় সেবন করে, শূন্য ডিগ্রি তাপমাত্রায় বরফের মধ্যে ধ্যান করত ঋষিরা।​

​শরীরে বিষ ধারণ করার এই উপায়টির নাম __ মিথ্রিডেটিজম।​

। Mithridatism কথাটা এসেছে, পন্টাসের রাজা মিথ্রিডেটস Vi থেকে। তিনি ভীত ছিলেন এই ভেবে যে, তাঁর নিজের মা , তাঁকে বিষ দিয়ে হত্যা করবে! এই ভয়ে তিনি পালিয়ে যান গভীর জঙ্গলে। সেখানে গিয়ে বনচরদের কাছ থেকে শেখেন , কিভাবে অল্প পরিমাণ বিষাক্ত পদার্থ শরীরে প্রবেশ করিয়ে বিষক্রিয়া প্রতিরোধ করা যায়।​

বিষ প্রতিরোধের এমন অদ্ভুত ক্রিয়া কাজে লাগান হতে লাগল রাজ্য__রাজনীতির নানা প্রয়োজনে।​ ৩৪০ খ্রীষ্টপূর্ব থেকে ২১৩ খীষ্ট্রপূর্ব মধ্যবর্তী সময়ে মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের গুরু ও অন্যতম প্রধান উপদেষ্টা চাণক্য , চন্দ্রগুপ্ত কে বিষের হাত থেকে সুরক্ষিত রাখতে তাঁকে রোজ খাবারে অল্প পরিমাণ বিষ মিশিয়ে খাওয়াতেন। এর ফলে চন্দ্রগুপ্তের শরীর বিষের প্রতি সহনশীল হয়ে উঠেছিল।​

​৩​ : সুন্দরের পিছনে অ_ সুন্দর কাহিনী:

উপরের আলোচনাটি নিছক পটভূমি। এক ভয়ংকর​ ঘৃণিত কাহিনীর পটভূমি। ইতিহাস যাদের কথা বলতে বলতে থেমে গেছে। কান পাতলে এখনো শোনা যায় গুমরে ওঠা কান্না। অসহায় কান্না। মুক্তির জন্য কান্না। রাজনীতির ঘৃণ্য পাশাখেলায় যাঁরা শরীরে বহন করেছে প্রাণঘাতী বিষ। মিথ্রিডেটিজম পদ্ধতিতে, সাধারণ নারী থেকে ক্রমশঃ হয়ে উঠেছে বিষকন্যা!​

​কিন্তু কেন? এমন মানব হাতিয়ার প্রয়োজন ছিল কেন?​ জানতে হলে একটু ইতিহাস পর্যালোচনা করতে হবে।

​রাজ্য রাজনীতিতে " নারী" একটি সুদক্ষ সুলভ অস্ত্র।​ পুরুষের কাম চরিতার্থ করার নিপুণ খেলায় অভিজ্ঞা নারীর সুকৌশলী শরীরী তীরের আঘাতে , প্রকাশ পায় সমস্ত গোপণ তথ্য।​ প্রাচীন যুগ থেকে আজকের আধুনিক যুগ__নারী শরীর ব্যবহার করা হয়, কাজ উদ্ধারের জন্য। সম্ভবত ব্যবসার বাজারে নারী একমাত্র পণ্য , যা চিত্তাকর্ষক বটে, সব জায়গায় ব্যবহার যোগ্য।

নারী এবং বিষ __দুটিই তীব্র। দুটিই কাজ করে নিঃশব্দে। এবং অব্যর্থ। খাবার বা পানীয়তে বিষ মেশানোর কাজ সহজ হতনা অনেক সময়। রাজাদের জন্য পরিবেশিত খাবার আগে , অন্য লোককে খেতে হত।​ তবে উপায়?​

চতুর কূটনীতিক , নিজেদের মাথা খাটিয়ে তৈরি করলেন বিষকন্যা বাহিনী।​

বিষকন্যা তৈরি করা? অবশ্যই।​ তৈরি করতে হত। শরীরে বিষ নিয়ে জন্ম হয় না কোনো মানবীর। সুন্দর পৃথিবীতে সকলে বাঁচতে চায়। " মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে"

__আকাঙ্খা এমন থাকলেও, দুর্বল অসহায়দের জীবন নিজের হাতে থাকে না।​ রাজ্য খুঁজে নিয়ে আসা হত ছোট ছোট বালিকাদের।​ নিখুঁত সুন্দরী তারা। অপহরণ করে অথবা জোর করে তুলে আনা হত।​

​অভিজ্ঞ বৈদ্য ও মনোচিকিৎসক জানতেন, যে, মারাত্মক বিষ সরাসরি শরীরে প্রবেশ করলে জ্বলে যাবে খাদ্যনালী ও শিরা ধমনী। তাই বিষের গুঁড়ো তৈরি করা হত। নরম পুতুলের মত কচি মেয়েগুলির , প্রতিদিনের খাবারের সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে , সইয়ে​ সইয়ে​ বিষ দেওয়া হত ।​ সকলে নিতে পারত না। চিৎকার করত। খিঁচুনির পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত। আবার কেউ কেউ বেঁচে যেত। প্রতি দশজনের মধ্যে তিনজন। অনুমান এমনই বলে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের শরীর সেই বিষের প্রতি সহনশীল হয়ে উঠত। এরপর সরাসরি বিষ গ্রহণে কোনো অসুবিধে হতনা। এমনকি, নিয়মিত বিষ না খেলে ভালো করে ঘুমোতে পারত না তাঁরা।​

​হাহাকারের লিখিত বর্ণনা দেওয়া যায়? যন্ত্রণার ভাষা শব্দে ফুটিয়ে তুলতে পারে কেউ? নাহ্। অনুমান পযর্ন্ত করা সম্ভব না, সে ই তীব্র তীক্ষ্ম বেদনার! যাদের জন্মই হল, মৃত্যুর জন্য__সে মৃত্যু নিজের এবং অপরের__তাঁরা নিজেদের নিয়ে কি ভাবত? কেমন করে কাটত দিনগুলি? ইতিহাস মাথা ঘামায়নি নগন্যদের নিয়ে।​

৪ : শত্রু দমনে বিষকন্যা:

বিষ হজম করে বড় হতে থাকা কন্যা গুলির উপর চলত বিশেষ প্রশিক্ষণ।​ রাজ্যের বিশিষ্ট গণিকা, নর্তকী, বিদুষী শিক্ষিতা নারীদের তত্ত্বাবধানে চলত এঁদের শিক্ষা।​ প্রতিটি অঙ্গের ব্যবহার সুচারু ভাবে করতে জানা, সেই সঙ্গে মোহময় বাক্যজাল বিস্তার, এক কথায়__পুরুষকে আকর্ষণ করার সমস্ত ছলাকলা শিখে, তেরো চৌদ্দ বছর বয়সের মধ্যে রূপে গুণে হয়ে উঠত অতুলনীয়া। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আঠার ঘণ্টা চলত কঠোর অনুশীলন। ছদ্মবেশ ধারণ করা শিখতে হত। শিখতে হত কিছু যাদু বিদ্যা। এবং কাম কলা। তাদের চলন বলন কটাক্ষ শরীরের প্রতিটি মুদ্রায় যেন ছলকে পড়ে যৌনতা। সে যৌনতা , উত্তাল সাগরের মত। প্রতিপক্ষ চাইলেও ত্রাণ পাবে না। খড়কুটোর মত তলিয়ে যাবে বিষকন্যার অতল যৌবনের প্লাবনে। সেই সঙ্গে শিখতে হত কূটনৈতিক রাজনৈতিক বিদ্যা। নিপুণ অস্ত্র চালনা। বিদ্যুতের গতিতে প্রতিপক্ষের বুকে বসিয়ে দিত তীক্ষ্ণ ছুরিকা। নির্ভুল নিশানা। সেই সঙ্গে, শরীরে বহন করত মারাত্মক বিষ। সঙ্গমের ফলে ,বিষ ঢুকে যেত পুরুষের শরীরে। মৃত্যু ছিল অবধারিত।​

​শত্রুরাজ্যে বিষকন্যার সফল অভিযান, ঘুরিয়ে দিতে পারত ভাগ্যের চাকা। তারপর সেই মেয়ের পরিণতি কেমন হত, সেকথা বলেনি কেউ।

৫​ : পুরুষতন্ত্রের বলি নারী:

​নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার , কেন নাহি দিবে অধিকার__ কবির এই আর্তি কানে ধ্বনিত হয়।​ পুরুষতন্ত্রের প্রথম সুবিধাভোগী হল পুরুষ, যে নিজের প্রয়োজনে পুরুষতন্ত্রকে দীর্ঘজীবী করে। নারীকে সম্পূর্ণ বন্দী করতে না পারলে, ধ্বংস হবার যে ভয় পুরুষের রয়েছে সেই ভয় থেকে পুরুষ গড়ে তুলেছে পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতা। যার সব কেন্দ্রেই নিজের অবস্থান প্রধান করেছে পুরুষ। প্রাচীন থেকে আধুনিক__সমস্ত যুগেই নারী , সম্মাজনক পরিস্থিতিতে ছিল না। যদিও, প্রথমদিকে দেখা যায়, অপালা,বিশ্ববারার মত নারীরা বৈদিক শ্লোক রচনা করেছিলেন। উপনিষদের যুগে গার্গীর মত দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটেছিল। উচ্চবর্ণের মহিলারা তাঁদের স্বামীর সঙ্গে যাগযজ্ঞে অংশগ্রহণ করতেন, সম্পত্তির অধিকারীও ছিলেন। কিন্তু , ক্রমে শূদ্র ও নারীদের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছিল। পুরুষের সুবিধাজনক আচরণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানবরচিত শাস্ত্র , নারীদের করে তুলেছে ভোগের উপকরণ। দেবতার নাম করে শোষণ চলত নির্বিচারে।

​এই প্রসঙ্গে প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক জীবন এক নজরে দেখে নেওয়া যাক। কারণ, যে কোনো শোষণ নির্ভর করে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকাঠামোর উপর। কৃষি প্রধান সভ্যতা ছিল সেই সময়। মৌর্য যুগ, গুপ্ত ও তৎপরবর্তী যুগে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম ছিল। জমির দখল নিয়ে , রাজাদের মধ্যে বিবাদ লেগে থাকত। রাজাদের সঙ্গে সঙ্গে সমান ভাবে ক্ষমতায় থাকতেন, ভূস্বামী বা জমিদার।​ পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীলতা এই​ সমাজব্যবস্থার​ অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। স্তরে স্তরে বিভক্ত এই সমাজের একেবারে উপরে থাকতেন রাজা, আর একেবারে নীচে থাকত ভূমিদাস বা জমিতে আবদ্ধ পরাধীন কৃষকরা। রাজার সঙ্গে নয়, ভূমিদাসের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল, ভূস্বামী বা জমিদারদের। এই সম্পর্ক সহযোগিতার ছিলনা। ছিল শোষণ বা অত্যাচারের। ক্রমে ক্রমে ভূস্বামীরা প্রবল পরাক্রমশালী হয়ে ওঠে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে , সাধারণ মানুষকে নানারকম দৈবভয়, অভিশাপের ভয় ইত্যাদি দেখিয়ে শোষণ করা হত। অবধারিত সবচাইতে লাঞ্ছনার শিকার হত দরিদ্র পরিবারের কুমারী কন্যা। কখনো নগরপালিকা, কখনো নর্তকী, কখনো গণিকা, কখনো দেবদাসী কখনো বা বিষকন্যা!​ ক্ষমতাবান পুরুষের সমস্ত রকম প্রয়োজন মেটাতে হত, সামাজিক অবস্থার বলি, এই সব অসহায় মেয়েদের।

​​৬​ : শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনের প্রশিক্ষণ:

এমন একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ নিখুঁত জীবন্ত যন্ত্র তৈরি করতে যেটা সবচেয়ে প্রয়োজন ,সেটা হল তাঁদের চিন্তার গঠনের বদল ঘটান।​ মনে রাখতে হবে, বিষকন্যা কিন্তু নিছক গণিকা নয়। তাঁদের কাজ অনেক কঠিন। রাজার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন এবং তাঁর হত্যা__ধরা পড়লে , কন্যাকে কেটে টুকরো করে পুড়িয়ে দেওয়া হবে। এতটুকু ভুল হলে তার মাশুল হবে গুরুতর। সেজন্য এঁদের তৈরি করা হত ইঞ্চি মেপে।​

​মনোবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় , মগজ ধোলাই।

Brainwashing: ( also known as mind control , menticide, coercive persuasion, thought control, thought reform and re_education) is the concept that the human mind can be altered or controlled by certain psychological techniques. Brainwashing is said to reduce its subject s ability to think critically or independently.​ কন্যাটির চিন্তা, ভাবনা এবং ব্যক্তিত্ব __পুরোটাই যাতে রাষ্ট্রের কাজে লাগে, তার বাইরে সে যেন কিছু​ ভাবতে​ না চায়, সেই হিসেব করে, তার ব্যক্তিত্বের উপর সম্পূর্ণ প্রভাব বিস্তার করা হত। স্নায়বিক ভাঙ্গন __যেমন , সে কে? তার সঙ্গে ঠিক কি ঘটছে বা ঘটতে চলেছে, সে সম্পর্কে তার কোনো স্পষ্ট বোধ আর থাকবে না। আত্মঘাতী বিশ্বাসে বিশ্বাসী হতে হত। সেটা যেমন: পরোক্ষ হুমকি, পরিবারগত হুমকি এবং অন্যান্য আরো অনেক চাপের সামনে নতি স্বীকার করতে বাধ্য ক

​অনেকে মনে করেন , বিষকন্যা একটি মিথ মাত্র। কল্পনা। তবে, সব কল্পনার বাস্তব ভিত থাকে। প্রাচীন মন্দিরের প্রাচীরে, যেসব যৌবনবতী রমনী অলংকৃত হতে দেখি, তাঁরা কারা? রাজা রাজড়ার ইতিহাস লেখা হয়, ইতিহাস লেখা হয়, যুদ্ধের। কে মনে রেখেছে , সেই সব যুদ্ধে ব্যবহৃত নারী অস্ত্রকে? নারী কিন্তু আজকের যুগেও সমান ভাবে ব্যবহৃত। ঠিক ঐ কাল্পনিক বিষকন্যা র মত!​

​যুগ বদলায়। প্রয়োজন বদলায় না।​ শিল্প বাণিজ্য রাজনীতি__প্রায় সব জায়গায় নারী শরীর কাজে লাগান হয়। কারণ, প্রাচীন কাল থেকে এই অস্ত্রটির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ক্ষমতাবান শোষকের চেহারা যেমন পরিবর্তন হয় না, পরিবর্তন নেই শোষিতের পরিস্থিতির।

​নদী আর মন __দুটিকেই বাঁধ দেবার চেষ্টা বৃথা। প্রবল বন্যা এলে, সব বাঁধ ভেঙ্গে নদী এগিয়ে চলে। তেমনি কখনো কখনো কন্যার​ মনের ভিতর ঢুকে পড়ে প্রেমের প্রবল ঝড়োবাতাস।​ ঝড়ের মুখে উড়ে যায় সমস্ত ভয়। চতুর উদ্দেশ্য। বাইরে __ভিতরের বিপরীত মুখী সংকট।​ ​ নারী হয়ে ওঠে প্রস্ফুটিত সূর্যমুখীর মত একমুখী প্রেমিকা! সেখানেও মৃত্যু তার ভবিতব্য । কিন্তু,​ সে মরণ তখন " শ্যাম সমান!"​ ​

​প্রখ্যাত কথাসহিত্যিক শ্রী শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের " বিষকন্যা" নামক গল্পটি আজকের আলোচ্য বিষয়ের সার্থক উদাহরণ। প্রেম আর বিষের মন্থনে ভেসে যায় বিষ। উঠে আসে অমৃত। সেখানে যাকে হত্যা করতে​ আগমণ, তাঁর প্রেমেই আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে নিজের প্রাণ বিসর্জন দেয় বিষকন্যা উল্কা। গল্পটির একটি ছোট অংশ তুলে দেবার লোভ সামলাতে পারছিনা। পাখির আক্রমণে মহারাজের বক্ষের কিছু অংশ কেটে, রক্তপাত হচ্ছিল। উল্কার ধারণা , পাখির নখে বিষ থাকে। সে চকিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাজার বুকে। দুই ঠোঁট দিয়ে টেনে নিল রক্তের বিষ। এই কাহিনী পড়লে , বোঝা যায়__একজন নারীর ভিতর যখন প্রেম জাগে, তখন হাজার প্রশিক্ষণ​ তুচ্ছ হয়ে যায়। কাহিনীর শেষে, উল্কা আত্মহত্যা করে।

​ " সেনজিৎ তাহাকে বক্ষে তুলিয়া লইয়া বলিলেন__

​ ​ ​ ​ ​কিন্তু কেন __কেন উল্কা? কেন এমন করিলে?"

উল্কার মুখের হাসি ক্রমশঃ নিস্তেজ হইয়া আসিল, চোখ দিয়া দুই বিন্দু জল গড়াইয়া পড়িল। সে অতি ক্ষীণ নির্বাপিত স্বরে বলিল___" প্রাণাধিক, আমি বিষকন্যা___'

কি মর্মান্তিক এই বাক্য! সে প্রেয়সী হতে পারবে না!​ স্ত্রী হতে পারবে না! জননী হতে তো পারবেই না! মৃত্যুর আকাশে তাঁর উড়ান। তাঁর মুক্তি। কারণ: সে বিষকন্যা।।


​ ■ পরিচিতি

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.