■ কৃষ্ণা রায় / দ্বিশত বর্ষে নিঃসঙ্গ প্রমিথিউসঃ অক্ষয় কুমার দত্ত

কৃষ্ণা রায় / দ্বিশত বর্ষে নিঃসঙ্গ প্রমিথিউসঃ অক্ষয় কুমার দত্ত

দুহাজার উনিশ-কুড়ি সাল জুড়ে দ্বিশত বর্ষে পৌঁছেছে বাঙালির  কাছে রয়েছে এমন দুজন গর্ব করার মতন মানুষ। কিন্তু সেই লগ্নে এসে  সর্বগ্রাসী বিদ্যাসাগর চর্চায় হারিয়ে গেছে  উনিশ শতকের বাঙ্লার আরেক  নিঃসঙ্গ প্রমিথিউস। সেদিনের কুসংষ্কারাচ্ছন্ন বাঙালি সমাজে  বিদ্যাসাগরের মতই যুক্তির আলো দিয়ে অজস্র  জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন এই মানুষটি। বাঙালি তাঁকে  ধারাবাহিক উপেক্ষায় ভুলে গেছে, ভুলে যাওয়ার কারণে লজ্জিতও হয়নি । না হলে গত এক বছরের  সাহিত্য -সংস্কৃতির আড়ম্বর – আয়োজনে  কোথায় সেই ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কিংবদন্তীপ্রতিম অথচ প্রায়  বিস্মৃত পিতামহ অক্ষয় কুমার দত্ত? তাঁর কথা শুনেছেন হয়ত বাঙ্লা সাহিত্যের মুষ্টিমেয় ছাত্র।  এই শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক,  বিজ্ঞান –পাগল মানুষটির নামই বা এ কালে কজন শুনেছেন?   তাঁর যুক্তিবাদ , বিজ্ঞান- মনন  এই সময়ের  কালান্তক , অন্ধ ধর্ম- আশ্রিত সমাজ জীবনে কতটা প্রাসঙ্গিক,  সে কথা  তেমন করে প্রচার হয়নি।  তাঁকে অবশ্য নতুন করে চিনিয়েছেন এক বিশিষ্ট অক্ষয় গবেষক আশীষ লাহিড়ী । তাঁর জীবনী গ্রন্থে “ আঁধার রাতে একলা পথিক” শিরোনামের গ্রন্থটিতে  তুলে ধরেছেন অক্ষয়কুমার দত্তের  কর্মকান্ডের খুঁটিনাটি ।

সেই একলা পথিকের  কথা  দিয়েই  এই আলোচনা। বলা ভাল,  দেরিতে হলেও  পূর্বসূরীর জন্য এক ফালি শ্রদ্ধার্ঘ। 

বিদ্যাসাগরের মত তিনিও ছিলেন  দরিদ্র পরিবারের সন্তান,  জন্মেছিলেন ১৮২০ সালের ১৫ই জুলাই বর্ধমানের চুপি গ্রামে। তাঁর জীবনের চলার পথ  মসৃণ ছিলনা। বাবা পীতাম্বর দত্ত   ছিলেন কলকাতার  কুঁদ্ঘাট অঞ্চলে পুলিস অফিসারের ক্যাশিয়র। মা দয়াময়ী দেবী  অতি দয়ালু, পরোপকারী মহিলা।  হাতে -খড়ি পর্ব মিটিয়েও উপযুক্ত শিক্ষকের অভাবে পড়া  শুরু হয়নি। পরে  গ্রামের পাঠশালায় বছর তিন- চারেকের শিক্ষায়,  শিশু অক্ষয়  শিখলেন কিছুটা   সংস্কৃত ও ফার্সি ভাষা। দশ বছর বয়সে যুগের দাবি অনুযায়ী চাকরির সুবিধার কারণে ইংরাজি ভাষা শেখার কথা অভিভাবকেরা ভাবলেন।  তার  বাবার এক ভাইএর ছেলে হরমোহন দত্ত র সঙ্গে  দশ বছর বয়সের পর  কলকাতায় পা রাখলেন বালক অক্ষয়। খিদিরপুর অঞ্চলে হরমোহনের আস্তানা। সেকালের দুই   বিখ্যাত ইংরেজী শিক্ষক জয়কৃষ্ণ সরকার ও গংগা চরণ সরকারের  কাছে কিছুটা  ইংরেজির তালিম  নিলেন । কিন্তু বালক অক্ষয়ের তীব্র মেধার খিদে মেটাতে তারা পারলেন না। অক্ষয় তখন  এক পাদ্রির কাছে ইংরেজি পাঠ নিতে শুরু করলেন । কিন্তু পাদ্রীরা তো  বালকের ধর্ম ভাবনা বদলে দিতে পারে।  উদ্বিগ্ন হরমোহন তার  অফিসের এক করণিকের কাছে  অক্ষয়কে পাঠ নিতে পাঠালেন । কিন্তু বালক অক্ষয় অনুভব করে এভাবে তার পড়াশুনো এগোবেনা। সে ভর্তি হতে চায় সেকালের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ওরিয়েন্টাল আকাডেমিতে।  সেই মত অভিভাবক হরমোহন ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু বাসস্থান থেকে  স্কুলের দূরত্ব কিছুটা সমস্যা সৃষ্টি করল। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হল। হরমোহনের আত্মীয়ের দর্জি পাড়ার বাড়িতে  গ্রাসাচ্ছদন , আশ্রয়, পড়াশুনোর  ব্যবস্থা তার  হল। সেই স্কুলের অধ্যক্ষ হার্ডম্যান জেফ্রয়ের  তত্ত্বাবধানে শিখলেন  গ্রিক, ল্যাটিন, হিব্রু, জারমান ভাষার প্রাথমিক পাঠ। কঠোর অধ্যাবসায়ে আরো  শিখলেন বিজ্ঞান, গণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি, মনোবিজ্ঞান , পদার্থবিদ্যা । মাত্র আড়াই বছরের স্কুল শিক্ষায় তিনি  সেকালের  সপ্তম থেকে তৃতীয় শ্রেণির( নীচু থেকে উঁচু ক্লাসের )  পাঠ পেলেন। এই মেধা চর্চার কালেই অভিভাবকের  নির্দেশে পনেরো বছর বয়সে   তাকে বিয়ে করতে হল , যে বিবাহিত জীবন তার কাছে আদৌ সুখের হয়নি।  কিশোর অক্ষয় পড়লেন সাংসারিক অজস্র সমস্যায়। বাবা অবসর নিয়ে কাশীতে বাস করছেন , স্কুলের এক বছরের  মাইনে বাকি। তবুও স্কুলের তরফ থেকে অনুগ্রহ জুটল। কিন্তু শেষ রক্ষা হলনা। বাবা হঠাত মারা গেলেন । অতএব মায়ের  নির্দেশে তাকে চাকরি নিতে হবে।  দাদা হরমোহন চাইলেন ভাই যদি আইন নিয়ে পড়াশুনো করে এই ব্যবসায় মন দেয়, তবে অর্থ উপার্জন সহজ হয়।  অক্ষয় আইনের বই পত্র ঘেঁটে  হতাশ হলেন , “ যে বিষয় নিত্য পরিবর্তনীয় , তাহা শিক্ষা করিলে লাভ কি” ? 

স্কুল ছাড়লেও  বিজ্ঞান –আশ্রিত দার্শনিকতায় আচ্ছন্ন শিক্ষক  হার্ডম্যান জেফ্রয়ের   সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি অক্ষয়ের ।  তাঁর কাছে সে নিয়মিত পাঠ নেয় ফরাসী ভাষার, বীজগণিত, জ্যামিতি , ইলিয়ড ও ওডিশির।  এই মানুষটি তাকে উৎসাহিত করেন একটি বিশেষ বই পড়তে, তার নাম “  Scientific Dialogoues: Intended for the instructions and entertainment of young people”.  লন্ডনে পাঠ্য এই বইটি কলকাতার হিন্দু কলেজের সমকালীন  ছাত্রদের  মেধা মননে কতটা প্রভাব ফেলেছিল, সেটি জানা যায়না। কিন্তু  প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বঞ্চিত অক্ষয়ের মনোরাজ্যে এর থেকেই গড়ে উঠেছিল  এক বিজ্ঞান নির্ভর অধ্যয়ন স্পৃহা।  এই সময় তার দর্জি পাড়ার বাড়িতে  এক পুরোনো বই বিক্রেতার কাছে পেলেন কিছু দামী ও দুষ্প্রাপ্য বই । বই পিপাসু শোভাবাজারের রাজবাড়ির সংগ্রহ থেকে এ সব বই  খোয়া গেছে এমন ভাবনায়  তিনি রাজা রাধাকান্ত দেবের নাতি ও জামাই এর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। এঁরা দুজনেই ছিলেন গণিত-শাস্ত্রে সুপন্ডিত। অক্ষয়ের সততায় মুগ্ধ হয়ে তাকে রাজবাড়ির গ্রন্থাগার ব্যবহারের শুধু অনুমতি দিলেন না, তাকে গণিত- চর্চায় বিশেষ সহায়তা দিলেন ।  গণিত সম্পর্কে অক্ষয়ের দারুণ জিজ্ঞাসা ।  সে আবার জ্যামিতি  ও ত্রিকোণ-মিতির পাঠ নিতে শুরু করলেন আরেক গণিত বিশেষজ্ঞ অমৃতলাল মিত্রের কাছে।  শিখলেন উচ্চতর গণিতের ডিফারেন্সিয়াল ক্যাল্কুলাস।  এরপর তাঁর মন গেল পদার্থবিদ্যা ও ভুগোল পাঠে।  জ্ঞানের স্পৃহা সারাজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন । স্কুল  শিক্ষার চূড়ান্ত-পর্বে পৌঁছনো তাঁর হয়নি। তাই নিজেই একটি পাঠ্যবিষয়ের সিলেবাস তৈরি করে প্রতি নিয়ত নিজেকে শিক্ষিত করে গেছেন। এ বিষয়ে তিনি একটি স্বকীয় ধারণা পোষণ করতেন। শিশুর শিক্ষার প্রথম পর্বে ভার থাকবে একটি শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে, ২-৬ বছর  ধরে চলবে সেখানে পাঠদান। দ্বিতীয় পর্বের শিক্ষা হবে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে, ৬-৭ থেকে ১৪-১৫ বছর পর্যন্ত।    শেষ পর্বে ১৫-১৬ থেকে ২০-২২ বছর পর্যন্ত সময়ে চলতে পারে উচ্চ শিক্ষা , যার নাগাল পেতে পারে সেইসব শিক্ষার্থী , যাদের আর্থিক অবস্থা অনুকূল।  তাঁর নিজের জীবনে ১০ বছর  বয়স থেকে ১৬ বছর বয়স অবধি সময়  নষ্ট হয়েছিল  শুধুমাত্র অর্থের অভাবে,  আত্মীয়ের ওপর অনুগ্রহ,  নির্ভরতার কারণে।  প্রথাগত ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক  উচ্চশিক্ষায়  মন দেওয়ার সুযোগ তার হয়নি, রোজগার করতে হবে।  ১৮৩৮ সালে অক্ষয়  পরিচিত হলেন সেকালের বিখ্যাত  সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্তের  সঙ্গে । সম্পাদক মশাইয়ের মনে হল অক্ষয়ের  গদ্য লেখার হাত চমৎকার। তারই  সুত্র ধরে  পরিচয় হল  বয়সে সামান্য বড় জোড়াসাঁকোর জমিদার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। ১৮৩৯ সালের ডিসেম্বর মাসে   দেবেন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী সভার সভ্য হলেন অক্ষয়কুমার। পরের মাসে, ১৮৪০ সালের জানুয়ারিতে তিনি নির্বাচিত হলেন সভার সহকারী  সম্পাদক।  কয়েক মাস পর ১৮৪০ সালের জুন মাসে  দেবেন্দ্রনাথ  এই সভার উদ্যোগে একটি তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা  তৈরি করেন ,  যেখানে  দেশের ভাবী নাগরিকেরা  নিজেদের  ধর্ম-চর্চা,  ঈশ্বর- জ্ঞান ও বৈষয়িক  বিষয়ে   ধারণা  পাবে। সেই পাঠশালায় ভুগোল ও পদার্থ বিদ্যা পড়ানোর চাকরি পেলেন অক্ষয় কুমার,  মাস মাইনে হল ৮ টাকা। ক্রমে সেটি ১০  টাকা ও ১৪ টাকা পর্যন্ত হয়েছিল। পাঠশালায় পাঠ্য বইএর প্রকাশক ছিল তত্ত্ববোধিনী সভা। সে সময় উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক না থাকায় তিনি নিজেই লিখলেন ভূগোলের বই  আর অনেক  পরে পদার্থবিদ্যার বই ( যথাক্রমে ১৮৪১ ও ১৮৫৬ সালে)।  বাঙ্লা- ভাষায় বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের প্রথম গ্রন্থ হল এই পদার্থবিদ্যা। সে আমলে এটির যথেষ্ট জনপ্রিয়তা ছিল। প্রকাশ কাল থেকে তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত প্রায় ২২টির বেশি   সংস্করণ প্রকাশিত হয় ।  তিনি মান্যতা দিতেন মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের গুরুত্বকে।  নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত হয়ছিলেন বলেই জোর দিতেন  বিজ্ঞান  , দর্শন , সমাজতত্ত্বের বিভিন্ন বিষয় মাতৃভাষায় প্রচার করতে। আর সেই ভাবনা থেকেই তাঁর বাঙ্লায় বই লেখা। তাঁর লেখা  উল্লেখযোগ্য  আরও কিছু বই ---প্রাচীন হিন্দু দিগের সমুদ্রযাত্রা ও বাণিজ্য বিস্তার, ছাত্রদের পাঠ্য  চারুপাঠ ( ৩টি খন্ড), বাহ্য বস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার , ধর্মনীতি, ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় (২টি খন্ড) ইত্যাদি ।  ধর্ম নীতি বইটি তাঁর সমাজ ভাবনার ফসল, বহুবিবাহ , বাল্যবিবাহের  কুফল, বিধবা-বিবাহের অসবর্ণ বিবাহের আবশ্যিকতা  বিষয়ে তাঁর যুক্তিছিল শাণিত।   বিবাহিত স্ত্রী-র সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ে তাঁর ধারণা  ছিল যথেষ্ট আধুনিক, সে শুধু স্বামীর ইন্দ্রিয় সেবার জন্য বলিপ্রদত্ত নয়, শিক্ষার দ্বারা তার বুদ্ধি, প্রবৃত্তি, সংষ্কারকে মার্জিত করাও  সবামীর কর্তব্য ।  ছাত্রপাঠ্য চারুপাঠ বইটি ছিল প্রকৃত পক্ষে সহজ সরল ভাষায় লেখা একদিকে নীতিপাঠের বই, অন্যদিকে বিশ্বপ্রকৃতির  অনেক বিষয়ে একাধিক  বিজ্ঞান নির্ভর প্রবন্ধ। এর জন্য তাঁকে প্রচুর বাঙ্লা পরিভাষা তৈরি করতে হয়।   প্রচলিত হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস হারিয়ে ব্রাহ্ম হয়েছিলেন ১৮৪৩ সালে। অক্ষয়ের মেধায় মুগ্ধ দেবেন্দ্রনাথ তাকে  ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সহ সম্পাদক পদে  নিযুক্ত করলেন। কারণ তাঁর রচনা নাকি অতিশয় হৃদয়গ্রাহী ও মধুর।  এই পদে তিনি ছিলেন ১৮৪৩ থেকে ১৮৫৫ সাল অবধি। এই পত্রিকার মাধ্যমে সেকালে ইংরেজী-ভাষা প্রেমী বাঙ্গলা ভাষা বিমুখ  বাঙালি সমাজকে বিজ্ঞান, ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব বিষয়ে সচেতন করেছেন , পত্রিকাটিকে  এক বিশেষ উচ্চতায়  পৌঁছে দেওয়া তাঁর  জন্যই সম্ভব হয়েছিল।   এই পত্রিকায় সম্পাদক থাকার সময় তিনি নিজের আগ্রহে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে রসায়ন ও উদ্ভিদবিদ্যার নিয়মিত ক্লাস করতে যেতেন।  কিন্তু লেখালেখি নিয়ে দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রায়ই বিষয় ভিত্তিক সংঘাত হয়ে যেত । আসলে দেবেন্দ্রনাথ তাঁর এই পত্রিকার মাধ্যমে  মানুষের সঙ্গে  ব্রাহ্ম ধর্ম তথা ঐশ্বরিক সম্পর্কের প্রচারের কথা ভাবতেন, আর অক্ষয়কুমার খুঁজতেন যুক্তি, বিজ্ঞান, বাহ্য বস্তুর সঙ্গে মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ।  খুব সহজ ভাষায়  ব্রহ্মতত্ত্বের  চেয়ে ব্রহ্মাণ্ড-তত্ত্ব  তাঁর রচনায় ফুটত বেশি। এই পত্রিকার মাধ্যমেই সৌরজগত, সিন্ধুঘোটক, বন মানুষ জ্যোতিরবিদ্যা, প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন ।  তিনি মানতেন না  বেদ বা কোন ধর্মগ্রন্থ ঐশ্বরিক সৃষ্টি  হতে পারে বলে, এও মানতেন না বেদ অভ্রান্ত। সেই বিশ্বাস সঞ্চারিত করেছিলেন দেবেন্দ্রনাথের মধ্যেও। তিনি  এও মানতেন এই বিশ্ব প্রকৃতি আসলে ঈশ্বরেরই এক খোলা ধর্ম গ্রন্থ আর সেটি পাঠ করতে হয় জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে। তাই বিশুদ্ধ জ্ঞানই আমাদের  প্রকৃত আচার্য ।  তাঁর মত ছিল ব্রাহ্ম সমাজে উপাসনার ভাষা হওয়া উচিত বাঙ্লায়, সংস্কৃতে নয়।   বারো বছর  তত্ত্ববোধিনী  পত্রিকার সম্পাদনা করেও তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস –ধারণায় চিরকাল  অটল ছিলেন।  তাই দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে মতের মিল না হওয়ায় চাকরি ছেড়েছেন । প্রথম থেকেই অবশ্য  দুজনের  ভাবনার মধ্যে একটা  চোরা  বিচ্ছিন্নতা  ছিল। একজন মানতেন বেদ-বেদান্ত অভ্রান্ত, যুক্তিবাদ অসার, অন্যজনের মত ছিল  বেদ- বেদান্ত কিংবা শাস্ত্রীয়-বচন চির অভ্রান্ত  নয়, বরং যুক্তিবাদে বিশ্বাস রাখা শ্রেয় ।  

অক্ষয়কুমারের এই যুক্তিবাদের সমর্থন নিয়ত যুগিয়ে গেছেন বিদ্যাসাগর মশাই।  শেষ পর্যন্ত  তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার চাকরি ছেড়ে দেন ১৮৫৫ সালে,  কিন্তু  সারাজীবন চেয়েছেন সারস্বত চর্চায় লগ্ন থাকতে। ওই বছরই শিক্ষক প্রশিক্ষণের উদ্দেশে গঠিত  নরম্যাল স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদে যুক্ত হন বিদ্যাসাগরের সুপারিশে । তবে সে কাজ বেশিদিন করতে পারেন নি শারীরিক অসুস্থতার কারণে।  সম্ভবত খুব গুরুতর ধরণের এপিলেপ্সি রগের শিকার হয়ে ১৮৫৮ সালে চাকরি ছেড়ে দেন।   তাঁর শেষ জীবন কেটেছে এক বিশেষ গ্রন্থ রচনায়, ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়।  হোরেস হেম্যান উইলসনের “ A sketch on the religious sect of the Hindus”  পড়ার পর লিখলেন এই গবেষণা মুলক বইটি, যাতে রয়েছে হিন্দু ধর্মের অন্তর্গত অজস্র লৌকিক ধর্ম তথা সম্প্রদায়, বিচিত্র তাদের রীতি নীতি, পৌত্তলিকতার ধারণা অথবা নিরাকার  ঈশ্বরের সাধনার  আকাঙ্ক্ষা । কেউ কেউ জাতি –বর্ণ -ধর্মের  ঊরধে মানবতায় বিশ্বাসী । অল্প বয়সে জর্জ কুম্বের উনিশ শতকের সাড়া জাগানো বই ,  ১৮২৮ সালে লিখিত  “ Constitution of Man in relation to external objects”  পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন  অক্ষয়কুমার । সেই সুত্র ধরে লিখলেন  বাহ্য বস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার।    বস্তুত ডারুইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব, হাক্সলের জীবন দর্শনে প্রভাবিত অক্ষয়কুমার   জীবনের মধ্য পর্বের পর থেকে  ব্রাহ্মধর্মে আস্থা হারিয়ে সংশয়বাদী  হয়ে উঠেছিলেন। সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে অন্ত্যজদের সঙ্গে মিশতে তাঁর কোন দ্বিধা ছিলনা।  কৃষকদের , নীলচাষিদের দুর্দশা নিয়ে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়  শাণিত কলম ধরেছেন।  তাঁর যুক্তিবাদে অনেকটাই মিশে ছিল প্রকৃতিবাদ (naturalism). তাঁর কাছে প্রকৃতি ছিল সব এবং তার গাণিতিক ব্যাখা সম্ভব । বীজগণিতের সুত্র দিয়ে প্রমাণ  করলেন পরিশ্রম না করলে শস্য ফলানো যায়না, শুধু প্রার্থনার কোন ভুমিকা নেই এখানে।  পরিশ্রম=শস্য/ পরিশ্রম + প্রার্থনা =শস্য/ অতএব,  প্রার্থনা =০( শূন্য)  শেষ জীবন কেটেছে  হাওড়ার বালিতে গংগার ধারে একটি বাড়িতে নিঃসংগ অবস্থায়।  তাঁর পড়ার ঘরের  দেয়ালে ছিল পাঁচটি মানুষের ছবি, রাজা রামমোহন, আইজ্যাক নিউতন, জন স্টুয়ারট মিল, ্ টি এইচ হাক্সলি, ও চার্লস ডারুইন ।   উদ্যানপ্রেমী অক্ষয়কুমার বাড়ির চারপাশে  তৈরি করেছিলেন একটি বাগান ,  নাম শোভনোদ্যান । বাড়িতে ছিল একটি ভূতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা, সেখানে রেখেছিলেন বহু বিরল  প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণির খোলক, শংখ, শামুক, জীবের কংকাল। 

হাওড়ায় বালির বাস ভবনে নিঃসংগ অক্ষয়কুমারের মৃত্যু হয় ১৮৮৬ সালের ২৭শে মে।  কোন কৈশোরবেলায় পণ করেছিলেন সারাজীবন জ্ঞানের সাধনায় নিবেদন করবেন , মৃত্যুতেও  সে পণ  বজায় ছিল। সঞ্চিত অর্থের একটি অংশ দান করেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে,  আরেক অংশ  ইন্ডিয়ান  আসোসিয়েশন ফর কালটিভেশন অফ সায়েন্সেস এ। সারাজীবন প্রকৃত অর্থেই ছিলেন বিজ্ঞানের সেবক, চেয়েছিলেন বাঙালি সমাজ শাস্ত্র-বাক্যকে অভ্রান্ত বিবেচনা না করে অভিজ্ঞতার কষ্টি পাথরে সত্যাসত্যের বিচার করুক। উনিশ শতকের অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে বিজ্ঞান- সচেতনতার আলো জ্বেলেছিলেন এই স্বশিক্ষিত পন্ডিত মানুষটি ।  মৃত্যুর পর প্রার্থিত মর্যাদা পাননি  না তাঁর চেনা সমাজের পক্ষ থেকে, না  জীবনের বহুবছর , বহু শ্রমে উৎসর্গীকৃত সেকালের সম্ভ্রান্ত ঠাকুর পরিবারের  পরিশীলিত মানুষের কাছে।   বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগের সাহায্যে  মানুষের জীবনযাত্রার সামগ্রিক   উন্নতি সম্ভব- এমন    আলোর  পথ দেখানো  নিঃসংগ প্রমিথিউসের জন্য  এইটুকু  অন্তত স্মৃতি-তর্পণ  একালের  এক বংগ- তনয়ার থাকুক। 

তথ্যসুত্রঃ 

১। অক্ষয় কুমার দত্ত ,   বিজয় কুমার দত্ত, গ্রন্থ তীর্থ , কলকাতা ২০১০।

২। অক্ষয় কুমার দত্তঃ আঁধার রাতে একলা পথিক, আশীষ লাহিড়ি , দেজ পাব্লিসিং , কলকাতা। 

৩। উনিশ শতকে বাঙ্গলা ভাষার বিজ্ঞান চর্চা, বিনয়ভুষন রায়, নয়া  উদ্যোগ সংষ্করন , ২০০২। 

■ পরিচিতি

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
  1. কৃষ্ণা রায়ের নিঃসঙ্গ প্রমিথিউস খুব আগ্রহের সঙ্গে পড়লাম । ‘অখিল সংসারই আমাদের ধর্মশাস্ত্র। বিশুদ্ধ জ্ঞানই আমাদের আচার্য’ (The whole world is our scripture and pure rationalism is our teacher) । এ’কথা যিনি বলতে পারেন তাঁর বিজ্ঞানচেতনা ও যুক্তিবাদ সম্পর্কে কোন শংশয় থাকে না । এবং কখন বলেছিলেন ? বলেছিলেন উনিশ শতকের সেই পর্বে, যখন আধুনিক সমাজের নির্মাণ আর বুদ্ধির জাগরণ সবেমাত্র শুরু হয়েছে । তিনি অক্ষয়কুমার দত্ত - বাঙালির প্রথম বিজ্ঞানলেখক । এই জ্ঞানতাপসের দ্বিশত জন্মবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রকাশের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই ।

    উত্তরমুছুন

সুচিন্তিত মতামত দিন