সেদিন ছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারি,ভালোবাসার এক পোশাকী দিন, রং তুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ঘরময়, ক্যানভাসটায় তখনও শেষ তুলির আঁচর দেওয়া বাকি, মেঝের ওপর ক্লান্ত শরীর এলিয়ে শুয়ে ছিল অখিলেশ ! মৃন্ময়ী হুড়মুড় করে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেই টেবিলের ওপর রাখা এইচ বি পেনসিলগুলো ছুঁড়ে ফেলেছিল বারান্দায় ,তার সারা শরীর যেন রাগে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল ৷
অখিলেশের ছবি আঁকার প্রতিটা সরঞ্জাম ছিল তার এক একটা সতীন,মৃন্ময়ীর থেকে যেন এরাই অখিলেশকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল !
কি এক মোহ জালে বাধা পড়ে অখিলেশ এই ছবিঘরে থেকে যেতো দিনরাত,রাতদিন !
মৃন্ময়ী একা থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছে কবেই ,তার দম বন্ধ হয়ে আসে !
অখিলেশের মদের নেশা তখনও সম্পূর্ন কাটেনি ,আধ বোজা চোখে তাকিয়ে ছিল মৃন্ময়ীর দিকে ফ্যালফ্যাল করে !এইসব রং তুলি তাকে আর ভাতের জোগান দিত না , সে কেবল নেশায় ডুবে থাকতো লাল,নীল,সবুজ রং এর বাক্সে.!
একটা সময় এই রং তুলি,ছবি আঁকা তার পেশা ছিল,বহু ছবির এক্সিবিশনও হয়েছিলো ,সে এক রমরমা বাজার!অটোগ্রাফ,ফটোগ্রাফ,আরও কত কি !!! কিন্তু জীবন শক্তি যখন কমে যায় তখন এভাবেই "পেশা বদলে হয় নেশা" ! প্রথমটায় বাধ্যবাধকতা থাকলেও দ্বিতীয়তায় অগাধ স্বাধীনতা,ইচ্ছে হলো তো লাগাও রং মনের রং এ !
আর একটু অতীতে যদি ফিরে যাওয়া যায় তাহলে বলা যায় এক সূক্ষ্ম প্রেমের কথা!! এই তো বছর খানেক আগের কথা, সেই আর্ট কলেজে পড়া অখিলেশ ছেলেটা মৃন্ময়ীর প্রেমে পড়ে সারাদিন তার মতো একটা প্রেমিকার ছবি এঁকেছে,যার কোমর অবধি ঘন চুল,একটা বড় টিপ কপালে আর পরনে সিফনের শাড়ি,আহা কি মনোরম সে ছবি,এখনো যত্নে ঝুলছে অখিলেশের ছবিঘরে !
তারপর তাদের প্রেমটা পরিনতি পেয়েছিল দুজনে যখন বিবাহ বন্ধনে অবদ্ধ হলো..
এত অবধি বেশ একটা ভালো রোমান্টিক ছবির মতোই দৃষ্টি নন্দন !
কিন্তু অখিলেশ আর মৃন্ময়ীর মধ্যে হঠাৎ বেনো জলের মতো অবাঞ্ছিত প্রবেশ ঘটেছিল তাদের দুজনেরই আর্ট কলেজের বন্ধু অরিন্দমের !!অরিন্দম তখন বড় কোম্পানির ডিজাইনিং আর্টিস্ট ,সুটেট বুটেট বাবু,বাড়ি গাড়ি সব কিছুই একটু বেশিই যথেষ্ট মৃন্ময়ীর মতো একটা লোভী,বেইমানকে আকর্ষণ করার জন্য !
বন্ধু অরিন্দম আর স্ত্রী মৃন্ময়ীর মধ্যে যে একটা সম্পর্ক শুরু হয়েছে আর তার জল কতদূর এগিয়েছে অখিলেশ সবটা বুঝেছিলো কিন্তু কাকে বলবে? শেষ অবধি নিজের সাথে নিজের লড়াই এ নামবে কি করে অখিলেশ ?কারন মৃন্ময়ী তো তার সাথেই মিশে আছে মনে -প্রানে,সারা শরীরে,অঙ্গ-প্রতঙ্গে !!!
যেদিন মৃন্ময়ী আর অরিন্দমের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের সবটা দেখেছিলো অখিলেশ নিজের চোখে ,সেদিন দিয়ে নিজের সব থেকে ভালো লাগার মানুষটাকে আর রং তুলির পেশাটাকে পর করে দিয়েছিলো,এখন যখন খেয়াল হতো তখন ইজেলের কাছে যেতো !!!!....
মৃন্ময়ী তো কবেই দূরে সরে গেছিলো তারপর যখন একটা দূর্ঘটনায় অরিন্দমের চোখ দুটো নষ্ট হয়ে গিয়ে সে অচল হয়ে পড়লো তখন আবার স্বার্থপরের মতো ধীরে ধীরে ফিরে এসেছিলো তার নিজের বাতিল করা অখিলের দরজায় !
তবে মৃন্ময়ীর প্রত্যাবর্তনের অস্তিত্ব অখিলেশকে আর নাড়া দিতো না,এই ঘরময় রং তুলি,সাদা ক্যানভাস,আর ওই কোনাতে পরে থাকা নেশার বোতলটা অখিলেশের বেশ লাগতো,দিন চলে যাচ্ছিলো ভালোই....
কিন্তু মৃন্ময়ীর তো এখন একটা শক্ত মাটি চাই আঁকড় ধরে বাঁচবার তাই সে উন্মাদ হয়ে উঠেছিল অখিল কে পাবার জন্য!কিন্তু অখিল যে বিশ্বাঘাতকের হাতে খুন হয়েছে অনেক দিন আগেই !!!সেটা কে বুঝবে !!!!!
আসলে মৃন্ময়ীর মতো মেয়েদের কাছে ভালোবাসার অনুপাত হেরে যায় টাকার অনুপাতের কাছে... !
সেদিন রাতের নেশাটা এতটাই চড়া হয়ে গেছিলো যে অখিলেশের আধ বোঝা চোখ আর খুললো না,আস্তে আস্তে সম্পূর্ন বন্ধ হয়ে গেল কেমন জানো...!!!
তখনও ক্যানভাসে আঁকা কাল্পনিক "কিউপিডের"( ভালোবাসার দেবতা) ছবিটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে ,ঠিক যেমন তার ভালোবাসাটাও অসম্পূর্ণ থেকে গেল !
মৃন্ময়ী, তাদের হাউস ফিজিসিয়ান ডঃ সেনগুপ্ত কে ফোন করলো ৷
অখিলেশের হৃদস্পন্দন চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছে বুঝতে পেরে তার দেহটিকে একটি চিকিৎসকের দলকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ডঃ সেনগুপ্ত তলব জানাল,মৃন্ময়ী অবশ্য এর কারন বুঝতেই পারেনি তখন ,তাহলে কি খুনের দায়ে তাকে জেলে যেতে হবে এই ভেবেই মৃন্ময়ীর সারা শরীর ঘেমে উঠেছিলো একপ্রকার !কিন্তু সে তো কিছুই করে নি,অতিরিক্ত মদ্যপান,আর হার্ট অ্যাটাকে তার দায় কোথায়! যদিও সত্যি কারের খুনী হয়তো মৃন্ময়ী ই ছিল ! ডঃ সেনগুপ্ত কে মৃন্ময়ী কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করলো ,বডি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন !!কিসের পোষ্টমর্টাম,আমাকে খুলে বলুন !! ডঃ সেনগুপ্ত একটাও উত্তর দেয়নি শুধু বলেছিলো, হসপিটালে গিয়ে একবার চক্ষুদানের কাগজপত্রটা দেখে আসবেন, দুর্ভাগ্যবশত সেই তো আপনিই এখনোও অখিলেশের লিগ্যাল ওয়াইফ!!
আজ অখিলেশ নেই প্রায় মাস চারেক হলো,না কথাটা ভুল, অখিলেশ আছে,অখিলেশই তো আছে,যেমন আছে তার ছবিঘর,রং,পেনসিল ,তুলি,প্যালেট আর সেই অসম্পূর্ণ কিউপিডের ছবিটা!ওই যে ,যে ছবিটায় ফাইনাল টাচটা বাকি ছিল,ওটাকে তো সম্পূর্ণ করতে হবে,অখিলেশ না শিল্পী,মনে প্রাণ শিল্পী ,আর একজন প্রকৃত শিল্পী তার কাজ শেষ না করে কখনো পালিয়ে যায় না আর অখিলেশকেও তো সেই শেষ তুলির টান টা দিতেই হতো,সৃষ্টি কে মাঝ পথে ছাড়তে নেই ! গরম আদা চায়ে চুমুক দিয়ে সবথেকে সরু তুলিতায় নীল রং মেখে কিউপিডের তীরটায় হাল্কা শেডটা দিলেই ব্যাস কাজ শেষ,কতদিনে ছবিটা এই একটু শেডের জন্য স্ট্যান্ডেই আটকে ছিল ভাবা যায় !!!!
আজ আর মৃন্ময়ীর চোখে রাগ নেই,হতাশা নেই,নেই লোভ,আছে শুধু অনুশোচনা আর একটা চোখের গভীরতায় মুগ্ধতা ,যে গভীরতায় একদিন সে সত্যিকারে হারিয়ে ফেলেছিলো নিজেকে !
এখন অরিন্দম যখন অখিলেশের চোখ দিয়ে কিউপিড বা অন্য কোন ছবি আঁকে তখন মৃন্ময়ী যেন স্পষ্ট দেখতে পায় সেই এক দুটো চোখ ,অখিলেশের সেই আদরমাখা চোখ ,যে চোখ মৃন্ময়ী কে দিয়ে যেন প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছে,আর কারো বিশ্বাস ভঙ্গ নয়,অরিন্দম কে যেন আমার মতো ......"একটা অসমাপ্ত কথা তবুও যেন সমাপ্ত" !অখিলেশ যেন অরিন্দমের মধ্যে দিয়ে তার ফেলে যাওয়া কাজ সম্পূর্ন করতে ফিরে এসেছে!
মৃন্ময়ী এখন বেশ বুঝতে পারে"মৃত্যুই শেষ নয়",মানুষ ফিরে আসার একটা না একটা পথ ঠিক খুঁজে রাখে সবার অলক্ষ্যে....... ....
সুচিন্তিত মতামত দিন