এক-একদিন বিকেলবেলায় কলেজ থেকে ফিরে ঘোরের ভিতর লাইনের পর লাইন কবিতা লিখে যাই, সেই প্রথম কৈশোরে লেখা শুরুর দিনগুলোর মতো, আমার দমদমের একচক্ষু বিশাল দৈত্যের মতো ঠাকুর্দার তৈরি রংচটা হাভেলি, ছাদে দাঁড়ালে পুরো কালিন্দী হাউসিং দেখা যেত, আমাদের শেঠবাগান থেকে কালিন্দীর মাঝখানে চাষীপাড়ার মাঠ, ঝুপড়ি চায়ের দোকান, অচেনা গলিঘুঁজির ভিতর দিয়ে একেবেঁকে ছুটে চলা আমার একলা সাইকেল, পুরোনো শ্যাওলাধরা মসজিদ, ১৯৭১-এর এক রাতে সাতজন নকশাল যুবককে ওই মসজিদের দেয়ালে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারে সিআরপিএফ, আমার জন্মেরও আগের রূপকথার গল্প সেসব, গোটা পাড়া সন্ধের পর হয়ে উঠত "মুক্তাঞ্চল", রাতে মার্চ করত "রেড মিলিশিয়া", ওয়াগন ব্রেকারদের সাথে বোমাবাজি চলত, নামী ডাক্তাররাও ফিজ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল পাইপগান আর ওয়ান-শটারের ভয়ে, না, মুক্তির দশক আসেনি, আর জরুরি অবস্থা জারির বছর আমার জন্ম!!!
আমার সেভেন-এইটে পড়ার সময়েও অনেক পুরোনো বাড়ির দেয়ালে দেখেছি ৭০-এর লিখন: চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান, স্টেনসিলে আঁকা কবেকার মাও-এর মুখ, ব্রাত্যদার বাড়ির সামনে বিশাল মাঠ, সেভেন-এইটে পড়ার সময় চুটিয়ে ফুটবল খেলতাম সেই মাঠে, এদিকের এক কোণে অরুণ সেনের বাড়ি, অরুণদা আমার প্রথম গুচ্ছকবিতা ছাপেন শারদীয় প্রতিক্ষণ-এ, আমি তখন ক্লাস টেনের ছাত্র!!! বিশ্বায়ন আর মুক্ত পুঁজির গন্ধ বাতাসে, পূর্ব ইউরোপ টালমাটাল, সোভিয়েত ভাঙার প্রাকমুহূর্ত সেটা, টেলিভিশনে প্রণয় রায়ের "ওয়ার্ল্ড দিস উইক"-এ প্রত্যেক রাতে লেনিন মূর্তি উপড়ে ফেলার দৃশ্য, গড ওয়াকস ব্যাকওয়ার্ডস, ঈশ্বর উল্টোরথে হাঁটছেন!!!
পি-ব্লকে ছিল পৃথাদের ছোট্টো দোতলা বাড়ি, আমার সঙ্গে ভাস্করদার ক্লাসে ড্রয়িং শিখতে যেত পৃথা!!!
আজ স্মৃতির অতল থেকে ভেসে উঠছে আমার শৈশব, আমার কৈশোর, "২০ জুনের ডায়েরি" কাব্যগ্রন্থের ম্যানাসস্ক্রিপ্ট রেডি, পাবলিশার খুঁজতে হবে এইবার, "নীচু গিলোটিন"-এর কবিতাগুলো ঝড়ের গতিতে এগোচ্ছে, আর সামনের বছর বাঙালির যৌনতা-বিষয়ক আমার পূর্ণাঙ্গ থিসিসটা বই হয়ে বেরোবে, যদি পরিমার্জনা আর সংযোজনের কাজ শেষ করে ফেলতে পারি!
২।।
হ্যাঁ, গভীর রাতে তোমার হোয়াটসঅ্যাপ প্রোফাইল খুলে আমি দেখতে পাই এখনও অনলাইন তুমি, বুঝতে পারি কার সাথে কথা বলছ!
আমি নিঃশব্দে সরে আসি, দেখি তোমার ডিপি আবার বদলে গেছে, স্ট্যাটাসও হয়তো বদলে যাবে কাল অথবা পরশু!
আরও একটু পুরোনো হয়ে যাবে তুমি, বাসি জুঁই ফুলের মায়াবী গন্ধের মতো!
তোমার চুল, তোমার চোখের পলক, নোখের আদর, শরীরের তীব্র ভাষা, সব, সব কিছু মনে আছে, মনে থাকবে আমার!
আরও অনেক দিন পর, ফিকে হয়ে যাওয়া শেষ আকাশের তারার মতোই টের পাব তোমায়!
তোমার এই নেট প্যাক-টাও আমিই ভরে দিয়েছিলাম, এক মাসের ভ্যালিডিটি কথা রাখবে, জানি!
শুধু তুমি কথা রাখো নি, ফাঁকা হোয়াটসঅ্যাপের সাদা পৃষ্ঠায় সমস্ত মুছে যাওয়া অক্ষরের মৃতদেহে মাথা রেখে আরও একবার ঘুমিয়ে পড়ি আমি!
৩।।
এতক্ষণ পাশে বসে থাকার পর, আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে রাখার পর, পাশের মানুষটা যখন ট্যাক্সির দরজা খুলে দ্রুত নেমে যায়, আমি নেমে যাবার মুহূর্তে তার শরীরের ভাষা তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করি, দুটো দিন একসাথে প্রত্যেকটা ঘন্টা মিনিট কাটানোর পর কেউ যখন তীব্র পায়ে রাস্তা টপকে চলন্ত বাস বা মেট্রোর কামরায় উঠে পড়ে আর দরজা বন্ধ হয়ে যায়, আমি তার সেই পিছুটানহীন, মসৃণ, অতীতকে অস্বীকার করা ডিপার্চার লক্ষ করি, ভাবি "এগিয়ে যাওয়া ' শব্দটার মানে ঠিক কী!
"কেরিয়ার"?? জীবনের সবচেয়ে দামী, নিভৃত, সৎ মুহূর্তগুলোকে অস্বীকার করে??? নিজের ভিতরের "আমি"- টাকে এত বেশি নার্সিসাসের মতো সেলিব্রেট করে??? যেখানে অন্য মানুষের রক্ত, ঘাম, চোখের জলটাও নিমেষে "অতীত" হয়ে যায়, আর অনেক বছর ধরে অপেক্ষা করা মানুষটাও বোঝে না সে জাস্ট একটা কাঠপুতুলের ভূমিকায় অভিনয় করে গেছে! ইনফ্যাক্ট এই না বোঝাটাই তার ইউএসপি, তার অসহায়তার, সরে যেতে না পারার সরলতাটাই পাশের মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষার সিঁড়িকে মসৃণ করবে!
২০০০ সালে, আমাদের যে ডানা-গুটিয়ে-রাখা বাজপাখি "ছাত্র সংগ্রাম" কাগজে বুদ্ধ ভটচাযের ইন্টারভিউ নিয়েছিল, সে জানত কেরিয়ার কথাটার মানে, আমরাও জানতাম, কিন্তু অস্বীকার করতাম, আমরা নিশ্চয়ই নির্বোধ ছিলাম!
আসলে আমরা জানতাম প্রবীর দাশগুপ্ত হল কবি, অরূপরতন বসু আর বাসুদেব দাশগুপ্ত হল লেখক, একটা লোক "হলোগ্রাম" আর "ধ্বংসস্তূপ" লিখতে পারলেই এনাফ, "রন্ধনশালা" আর " হৃদয়পুর" লিখতে পারলেই সদর দফতরে কামান দাগা যায়, মালকানগিরি থেকে গড়চিরোলি রেড করিডর তৈরি হচ্ছে. নেপাল থেকে অস্ত্র আসছে, রূপকথা লেখার দিন দরজায় কড়া নাড়ল বলে!
আমি জানি, রূপকথা সত্যি নয়, আসল সত্যি রূপকথার নিষ্ঠুরতা, আরো বহু কিছু শিখছি, যে কোনো মানুষের কাছেই শেখা যায়, আর নতুন জেনারেশনের কাছ থেকেই তো শিখতে হয় সবচেয়ে বেশি!!! তারাই তো নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার বানিয়ে আবর্জনার ঝুড়িতে ফেলে দেবে আমাদের, অ্যাডজাস্ট অর পেরিশ! মাঝখানে কিছু নেই!
আমি শুধু একবারও পিছন না ফিরে ট্যাক্সি থেকে মসৃণ নেমে যাওয়া লক্ষ করি, আসলে আমি নিজে আজও ওইভাবে ল্যান্ড করা শিখিনি, শিখবও না, শুধু ওই নেমে যাওয়াটা শব্দে অনুবাদ করব!
কলম আর কি-প্যাডটাই একেফর্টিসেভেন, ১৯৬৭ মুছে যায়নি, জঙ্গল সাঁওতালের আত্মা আর বাবুলাল বিশ্বকর্মার ছায়া আজও কথা বলে!
কথা বলে বরানগর-কাশীপুরের অলিতে গলিতে মুখে আলকাতরা মাখিয়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া কয়েকশো যুবকের বোকা লাশ!
স্বপ্নে দোল খায় কানু সান্যালের অবসন্ন মৃতদেহ!
শুধু "অনলাইন" সিগন্যাল ভেসে থাকে, আর পাশের গোল ফ্রেমে তোমার মুখ, ওই ঠোঁটের প্রত্যেকটা অক্ষর আজও মুখস্থ আমার!
গোরাদা, বাপি, পকাইদা, বুয়াদা কেমন আছ তোমরা??? তোমাদের বাপ্পা বেঁচে আছে, আমার মেয়েকে দমদমের অলৌকিক গল্প শোনাই আমি, গল্পকথার মধ্য দিয়েই তো বেঁচে থাকবে ওই অবলুপ্ত জনপদ, আমাদের মধ্যেই একজন ইতালো কালভিনো লুকিয়ে আছে, সে লিখবে এই লুপ্ত ন্যাসপাতির গন্ধে ভরা আখ্যান!!
ইতিহাস শেষ অব্দি হাজার ছেঁড়া গল্পকথার বুনে চলা কাহন, আর কিছুই নয়...
সুচিন্তিত মতামত দিন