নন্দিনী চট্টোপাধ্যায়

নন্দিনী চট্টোপাধ্যায়

আজ সাতদিন যাবত স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় ছেলেটা একভাবে ফলো করে যাচ্ছে চিত্রাকে। প্রথম দু একদিন ফালতু উৎপাত ভেবে মাথায় নেয়নি সে । দু একবার মনে হয়েছে যে বাড়িতে ব্যাপারটা জানিয়ে রাখে। কিন্তু বড্ড বালখিল্যসুলভ হয়ে যাবে ভেবে ওসবের দিকে আর মন দেয়নি । কিন্তু তিন চারদিন হল ছেলেটা যেন বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি করছে। চিত্রাদের স্কুল শুরু হয় সকাল সাতটায় আর ছুটি হয় একটা নাগাদ। তখন আবার ঠা ঠা পড়া রোদ। একটা গলির মধ্যে দিয়ে গিয়ে বাস স্ট্যান্ডে বাস ধরতে হয়। ওই গলিটারই কোথাও একটা দাঁড়িয়ে থাকে ছেলেটা।চিত্রা গলির মধ্যে ঢুকতেই ছেলেটা পিছু নেয় তার।ভাল উৎপাত শুরু হয়েছে যা হোক।

চিত্রার বয়স চল্লিশের কোঠায় , সংসারে একটি নির্ঝঞ্ঝাট স্বামি ও একজন অতি বৃদ্ধা শাশুড়ি রয়েছেন। সে রাস সুন্দরী বালিকা বিদ্যালয়ের অঙ্কের দিদিমণি। বাড়ি সরশুনার বেশ একটু ভেতর দিকেই । ভোরে উঠে স্কুলে যেতে কষ্ট হয় বইকি কিন্তু কি আর করা । গরজ বড় বালাই। প্রতিদিন সকালে ঘেমে চুমে ছুটতে ছুটতে স্কুলে ঢোকে সে। এই চিত্রার বিগত পনেরো বছরের রুটিন। চিত্রা হাঁপাতে হাঁপাতে তার পনের বছরের কর্মস্থল  রাসসুন্দরী বালিকা বিদ্যালয়ে পৌঁছায় , প্রেয়ার লাইনে তার ফিটফাট কলিগদের পাশাপাশি সগর্বে দাঁড়িয়ে ছাত্রীদের প্রার্থনা হাসিমুখে শোনে , তারপর দিনের কাজ ঠিকঠাক শুরু করে। এখানকার বেশির ভাগ টিচার কাছাকাছি থাকেন। চিত্রার বাড়িই দূরে।  

সন্তান আসেনি চিত্রার কোলে কিন্তু তাতে কি? যে যাই বলুক না কেন রাসসুন্দরীর ছাত্রীরা কি চিত্রার সন্তানতুল্য নয় ? যতটা সময় স্কুলে থাকে ততটা সময় ওদের নিয়েই মেতে থাকে চিত্রা। দিদিমনিদের কতো জন তো ছাত্রীদের সামনে ভরসার কথা আশ্বাসের কথা বলেন আবার পিছনে তারাই সেইসব ছাত্রীদের নামে টিকা টিপ্পনী কাটেন।চিত্রার খারাপ লাগে। সে সরে আসে। গুটিয়ে নেয় নিজেকে। অবিশ্যি দীর্ঘদিন থেকেই সে গুটিয়ে থাকার অভ্যাস করে নিয়েছে।

কিন্তু  কথা  হচ্ছে এই অদ্ভুত ছেলেটা চিত্রাকে একেবারে আশ্চর্য করে দিয়েছে। কি চায় ও চিত্রার কাছে? কেমন যেন বেচারি বেচারি মুখ করে তাকিয়ে থাকে চিত্রার দিকে। আবার যেন একটু দুষ্টু দুষ্টু ফিচেল হাসি ঝুলে থাকে ওর ঠোঁটে। কিচ্ছু বলে না শুধু নিঃশব্দে চিত্রাকে অনুসরণ করে চলে সারা রাস্তা। বয়স পচিশ বা পয়তিরিশ যা খুশি হতে পারে। তবে সব কিছুর মধ্যে একটাই ব্যাপার সারাদিন ধরে চিত্রার মনে পড়ে সেটা হল ছেলেটার দু চোখের চাউনি। এমন মুগ্ধ বিহ্বল আত্মগত চাউনি যে একবার দেখবে সে কিছুতেই ভুলতে পারবে না। ছেলেটাকে কি  আগে দেখেছে সে ? মনে করতে পারে না। তবে একটু চেনা চেনাও যেন লাগে ছেলেটাকে। দুপুরবেলায় চিত্রা যখন ফেরে তখন রাস্তাটা মোটামুটি শুনশানই থাকে। একেবারে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছালে তবে কয়েকটা লোকের সাক্ষাৎ মেলে। চেনা এলাকা। রাস সুন্দরী স্কুলের দিদিমনিদের এলাকায় সকলেই চেনে। অতএব সে রকম ভয় ভীতির কিছু নেই। তবু সাবধানের মার নেই। । যা থাকে কপালে।ছেলেটা হয় পাগল নতুবা মতলবি যা হোক একটা তো হবেই। আজ ছেলেটাকে ধরে আচ্ছা করে কড়কাতে হবে । স্কুল থেকে বেরিয়ে প্রথম বাঁকটা ঘুরলেই সেই শুনশান গলিটা এসে পড়ে আর অবধারিত ভাবে প্রায় মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে সেই ছেলেটা। এই গলিটা পেরুলেই বাস রাস্তা। ঐখানে পৌঁছে গেলেই চিত্রা দেখেছে যে ছেলেটা প্রতিদিনই কেমন আবার ভোজবাজির মতো হারিয়ে যায়। স্কুলে চিত্রাকে অনেক দিদিমনিরা পছন্দ করেনা। ছেলেটার কথা শুনলে হয়তো ফালতু রসালো আলোচনা শুরু হয়ে যাবে। তাই স্কুলে কাউকেই বলেনি চিত্রা ব্যাপারটা।

 আজ যেই ছেলেটা পিছু নিয়েছে অমনি চিত্রা ঘুরে দাঁড়ালো।  যতটা রাশভারী হওয়া যায় ততটাই গম্ভীর গলায় বলল

-----কে আপনি? প্রতিদিনই দেখি আমাকে ফলো করছেন। কি চাই? পুলিশে খবর দেব? ভালো লাগবে তো তখন?

ছেলেটা একটু হকচকিয়ে গেলো। তারপর অনাবিল হাসিতে ভরে গেলো তার সেই দুষ্টু দুষ্টু মুখখানা।

------আমি তো সেই কবে থেকে বসে রয়েছি যে কবে তুমি আমাকে পুলিশে দেবে ।

নাহ এতো বদ্ধ উন্মাদ না হয়ে যায় না। চিত্রা গম্ভীর গলাটা একটু মোলায়েম করে বলল

------নাম কি আপনার? বাড়ি কোথায়?  মানে এদিকে কোথায় থাকেন ?

চিত্রা ভাবছিল যে যদি ছেলেটার বাড়িতে যোগাযোগ করে ব্যাপারটা বলা যায়। মাথার ওপর ঠা ঠা রোদ্দুর। এই রোদ্দুরে সবই যেন অস্পষ্ট লাগছে।  ছেলেটা কি চিত্রাকে চেনে ?  আবারও সেই ভাবনাটা ফিরে এল। হঠাৎ ছেলেটা মুখটা চিত্রার খুব কাছে নিয়ে এসে বলল

------ আমাকে চিনতে পারলে না  মিষ্টি দি ?

মিষ্টি দি ! চট করে চিত্রার চোখের ওপর থেকে একটা পাতলা পর্দা সরে গেলো যেন। চিত্রারা তখন  জিয়াগঞ্জে থাকতো। পাড়াতেই থাকতো একটি অত্যন্ত গরিব্ পরিবার। মূলত সকলের দয়া দাক্ষিণ্যেই চলতো ওদের। কাকু কাকিমার একটিই সন্তান ছিল প্রদীপ। কাকু ছিলেন দুরারোগ্য রোগে শয্যাশায়ী। কাকিমা আয়ার কাজ করে যা রোজগার করতেন সবটুকুই চলে যেতো কাকুর চিকিৎসাতে। এর পরেও আছে নিজেদের খাওয়া পরা আর প্রদীপের পড়াশুনার খরচ। চিত্রার বাবা মা দরিদ্র পরিবারটির জন্য খুব করতেন। প্রদীপের পড়াশুনায় তেমন মাথা ছিল না কিন্তু পাশ করার চেষ্টাটুকু ছিল। এটাই খুব ভালো লাগতো চিত্রার। আর প্রদীপও কেন কে জানে চিত্রাকে প্রায় চোখে হারাত। দিনের মধ্যে বেশির ভাগ সময় সে চিত্রাদের বাড়িতেই পড়ে থা্কত। একসঙ্গে খাওয়া শোয়া গল্প আড্ডা পড়াশুনা। চিত্রা প্রদীপের পড়াশুনায় সবসময় সাহায্য করতে চেষ্টা করতো। তবে প্রদীপ যত বড় হয়ে উঠছিল চিত্রা লক্ষ্য করছিলো যে বাড়ির লোকেরা ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে চিত্রা বেশি মেশামেশি করলেই প্রদীপ কেমন অভিমান করে। সে অভিমান এমন যে মাঝে মাঝে প্রদীপকে নিয়ে চিত্রার বন্ধুরা হাসাহাসি অবধি করতো। চিত্রার মজা লাগত। কিন্তু ঐ মজাটুকুই সব। এ নিয়ে কেউ আর কিছু ভাবেনি। অন্তত চিত্রা তো নয়ই। ভাবল সেদিন যেদিন চিত্রার বন্ধু রিনার দাদা অমিত বোনের সঙ্গে চিত্রাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হল। উদ্দেশ্য আর কিছুই না  চিত্রার সঙ্গে আলাপ করা। অমিত তখন ডবলু বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে আর চিত্রা সদ্যই ম্যাথ অনার্স পাশ করেছে। চিত্রা কি একটু টাইম দেবে অমিতকে? অমিত পারিশ্রমিক দিতে রাজি কিন্তু চিত্রা একটু সময় দিলে অমিত ধন্য হয়।

চিত্রা জিজ্ঞেস করেছিল

-----কোচিং ক্লাসগুলোতে গেলেন না কেন? ওরাই তো সঠিক গাইড করবে ।

অমিত লাজুক হেসে বলেছিল

----- হ্যাঁ তা করে ওরা কিন্তু ওদের গাইড লাইন ফলো করতে হয়। আমি একটু নিজের মতন এগুতে চাই। আমি খুব বেশি আসবো না। কখনও সখনও এসে হেল্প নিয়ে যাব।

চিত্রার মা আগ বাড়িয়ে বলেছিলেন

-----হ্যাঁ তুমি এসো বাবা। আমার মেয়ে তোমাকে দেখিয়ে শুনিয়ে দেবে।

প্রদীপ কোথা থেকে বেরিয়ে এসে বলেছিল

-----মিষ্টি দি আমার একার দিদিমনি। আমি দিদিমণির ভাগ অন্য কারো সঙ্গে করব না।

চিত্রার মা প্রদীপকে বকুনি দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আর চিত্রা ভেবেছিল প্রদীপটার কোন সহবত শিক্ষা হয়নি। বাইরের লোকের সামনে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়।

পরের দিন থেকে হপ্তায় একদিন করে আসতে শুরু করেছিলো অমিত। চিত্রার মায়ের মনে অন্য একটি ভাবনাও খেলা করছিল তখন। অমিত এলাকায় কৃতি ছাত্র হিসেবে পরিচিত। ভালো  পালটি ঘর। রীতিমতো সুদর্শন। ডবলু বিসি এস পরীক্ষায় সফল হওয়ার সম্ভাবনা ষোলআনা। কাজেই এরকম একটি ছেলের সঙ্গে তার মুখচোরা মেয়ে চিত্রার যদি একটু ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে তাহলে ক্ষতি কি? চিত্রার ভবিষ্যৎ সুপ্রশস্ত হবে তাহলে। চিত্রার মায়ের ধারণা খুব শিগগির সত্যি হয়েছিলো আর চিত্রা সবিস্ময়ে দেখেছিলো যে সে অমিতের সঙ্গে যত কথা বলে তত আর সে কারো সঙ্গে কক্ষনো বলেনি।  

তখন সে প্রদীপের  লেখাপড়ার ব্যাপারে ততটা সময় দিতে পারছিলনা।  ওর ব্যবহারও ক্যামন বদলে যাচ্ছিল। পড়াশুনা করে না। সবসময় কি যেন ভাবে।  কিন্তু ঐ  প্রদীপকে নিয়ে কেই বা ভাববে আর কেনই বা ভাববে ? বাড়িতে তখন অমিতকে নিয়ে মা বাবার মনে একটু আধটু স্বপ্ন বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। চিত্রা নিজে ঠিক বুঝতে পারছিলো না যে সে অমিতকে ভালবাসে কিনা। তবে মা বাবার দেখানো একটা মিষ্টি স্বপ্ন আর বন্ধুদের সঙ্গে অমিতকে নিয়ে ছোটোখাটো খুনসুটি , এসব নিয়ে দিব্যি ছিল চিত্রা।

একদিন সত্যি অন্যরকম কিছু হয়ে গেল। শুধু ভাবনাচিন্তার মধ্যে ব্যাপারটা  আর সীমাবদ্ধ রইল না। সেদিন ডবলু বিসি এসের রেজাল্ট বেরিয়েছে। ডবলু বিসি এস পরীক্ষায় দারুণ রেজাল্ট করে পাশ করেছে অমিত। সেদিনই ফোনে চিত্রাকে ধরল অমিত। চিত্রার মনে আলোছায়া খেলা করে বেড়াচ্ছিল।সে বলল

-----হ্যালো। কনগ্রাচুলেশন্স। আমার দিদিমণি গিরি সাকসেসফুল।

----এত সাকসেসফুল যখন , তখন ভাবছি দিদিমণি টিকে আর ছুটি দেবো না। একেবারে সারা জীবনের জন্য ছাত্র হয়ে থাকব।

চিত্রার বুকের মধ্যে সানাই বেজে উঠেছিল। সে বলেছিল

------  দিদিমণি কিন্তু প্রচুর ফিস নেবে। দিয়ে উঠতে পারবে না।

-----পারব না? দেখা যাক। শোন আজ বিকেলে একবার যাচ্ছি তোমাদের বাড়ী।

-----কেন? আমাদের বাড়ীতে আজ কেন?

------তুমি বুঝবে না। প্রপোজ করলাম। তারপর দিদিমণিটিকে একবার চাক্ষুষ না করলে চলে ?

চিত্রা হেসে ফোন রেখে দিয়েছিল।

প্রায় এক সেকেন্ডের মধ্যেই ঘরে ঢুকেছিল প্রদীপ। কেমন যেন অবিন্যস্ত ভঙ্গি। চিত্রার মনের মধ্যে তখন আনন্দের সুবাতাস বইছে। জিজ্ঞেস করল

-----কি হয়েছে রে ? কিছু বলবি?

-----হ্যাঁ বলবো। তারপর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করেই কোনোদিন যা করে না সেই কাজটা করেছিলো সে। আচমকা চিত্রার দু গালে দুটো চুমো খেয়েছিল ছেলেটা। কেমন যেন সর্বহারার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করেছিলো

------তুমি আমায় ঠিক ভালোবাসো তো মিষ্টি দি? বল?

চিত্রা হতচকিত হয়ে বলেছিল

------নিশ্চয়ই বাসি।তুই সেই কবে থেকে আমাদের ঘরের ছেলে হয়ে আছিস।

------আমিও বাসি। তোমাকে সবার চেয়ে বেশি ভালবাসি।

----সে আমি জানিরে।কিন্তু তোর কি হয়েছে বলতো?

-----জানো তুমি? জানো?

প্রদীপ উদ্ভ্রান্তের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেছিল। চিত্রা পাত্তাও দেয়নি গোটা ব্যাপারটাকে। প্রদীপের পাগলামি বলে ধরে নিয়েছিল সবটা।  বিকেলে অমিতের সঙ্গে কখন দেখা হবে এই চিন্তায় বুঁদ হয়ে আছে চিত্রা।

কিন্তু বিকেলে অমিত আসেনি। আর কোনোদিনই আসেনি অমিত। চিত্রাদের বাড়ি আসার পথে রেললাইনে কাটা পড়েছিল অমিত। সকলে ভেবেছিল চিত্রার সঙ্গে ঘর বাঁধার খুসিতে পাগল অমিত চূড়ান্ত অসাবধানী হয়ে পড়েছিল। আর তারই পরিণাম এই মর্মান্তিক মৃত্যু।

চিত্রা প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছিল। জিয়াগঞ্জের পরিবেশ সে আর সইতে পারছিলো না। এমনিতেই সে চুপচাপ। আরও গুটিয়ে গেছিলো নিজের মধ্যে। পারিবারিক চিকিৎসক পরামর্শ দিয়েছিলেন কলকাতায় গিয়ে মনো রোগ বিশেষজ্ঞের সঙগে  যোগাযোগ করতে। 

তারপর তো কত বছর কেটে গেল। জিয়াগঞ্জকে এক রকম ভুলতেই চেয়েছিল চিত্রা । তাই  জিয়াগঞ্জ ছেড়ে কলকাতাতেই স্থিতু হয়েছিল চিত্রারা। জি্য়াগঞ্জ হারিয়ে গিয়েছিল তার জীবন থেকে।

কিন্তু আজ এত বছর পরে প্রদীপকে দেখে সেই সব স্মৃতি কেমন টাটকা হয়ে উঠলো। কি যেন বলছিল প্রদীপ! চিত্রা প্রদীপকে পুলিশে দেবে কেন ? সে তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলো

------তুই তো প্রথমেই পরিচয় দিবি। ফলো করলি কেন ? তোর বাবা মা কেমন আছে?

-------বাবা অনেকদিন মারা গেছে মা মাস খানেক আগে মারা গেল। তারপরেই কলকাতায় এসে তোমাকে খুঁজে বের করেছি। তুমি এখন  পুলিশে দিতে পার আমাকে। 

প্রদীপের কথা বার্তায় উদ্ভ্রান্তির ছাপ স্পষ্ট। চিত্রা অপলকে তাকিয়ে ছিল প্রদীপের দিকে। মা মারা যাওয়ার পরে প্রদীপটা কি পুরোপুরি পাগল হয়ে গেলো? আগেও তো ছেলেটা একটু খ্যাপাটে প্রকৃতিরই ছিল। প্রদীপ চিত্রার দিকে তাকাচ্ছিল না। নিজের মনে বলে চলেছিল

---- সেদিন অমিতদা তোমাদের বাড়ি আসছিল। রেল লাইনের সামনে আমি দাঁড়িয়েছিলাম।  অমিতদাকে বললাম যে অনেকদিন যাবত তোমার আমার প্রেম চলছে। একসঙ্গে শুয়েছিও আমরা বহুবার। সেদিন আমি তোমাকে চুমু খেয়েছিলাম। সেটাও বললাম। অমিতদা দেখলাম তারপরেই কেমন যেন হয়ে গেল।  এক্সপ্রেস ট্রেন আসছিল। আমি অমিতদাকে হাল্কা করে একটু ঠেলে দিয়েছিলাম শুধু। ট্রেন চলে যাওয়ার পরে পাওয়া গেছিল শুধু একটা মাংসের দলা। আমি অন্যায় করেছিলাম মিষ্টি দি। খুব বড় অন্যায় করেছিলাম। তবে যা করেছিলাম সবই তোমাকে হারাবার ভয়ে করেছিলাম। কিন্তু আটকাতে পারিনি কিছুই। অমিতদা মারা যাওয়ার  দু সপ্তার মধ্যে তোমরা জি্য়াগঞ্জ ছাড়লে , এমনকি ঠিকানাটাও কাউকে দিয়ে এলেনা। খুঁজে খুঁজে পাগল হওয়ার দশা। কতবার কলকাতাতেও এসেছি আমি। যদি খুঁজে পাই তোমায়। কিন্তু ঐ খোঁজাই সার হয়েছে গো। আসল মানুষটাকে কোথাও পাইনি।

চিত্রার দু পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। কেবলই মনে হচ্ছিল যে সে আছড়ে পড়ে যাবে। তবু সে কোনমতে সর্বশক্তি এক করে প্রশ্ন করল

-----আজ কিকরে খুঁজে পেলি আর কিই বা  চাস তুই আমার কাছ থেকে?

প্রদীপ ম্লান হাসল।

------রাস সুন্দরী বালিকা বিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তির অনুষ্ঠানটা  টি ভি তে দেখিয়েছিল। ওখানেই দিদিমণিদের মধ্যে দেখি তোমাকে। তাই এসেছি তোমার কাছে। আমাকে পুলিশে দাও গো মিষ্টি দি। শাস্তি হোক আমার। আমি এখন বুঝেছি কত বড় অন্যায় আমি করেছি। অমিতদা না হলে অন্য কেউ  এসে ঠিক তোমাকে   নিয়ে যেত মিষ্টি দি। আমার কি আছে যে আমি তোমাকে আঁকড়ে রাখতে পারি! তুমি তো বরাবর প্রদীপ বলে একটা গরিব ছেলেকে দয়া করেছ একদিনের জন্যও ভালবাস নি। আর ঐ আঁকড়ে থাকা পাগলপারা ভালোবাসাটুকু ছাড়া সত্যিই তো আমার আর কিচ্ছু ছিল না মিষ্টি দি।

জনমানবহীন গলিটায় দাঁড়িয়ে ছেলেটা হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো। এত কান্না এত অশ্রু চিত্রা কোনোদিন কারো চোখে দেখেনি । যেন জন্মান্তরের অশ্রু নদীর উথাল পাথাল ঢেউয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে সনাতন কালের এক উন্মাদ।

চিত্রা ছেলেটাকে খুব আস্তে বলল

------- যা শেষ হয়ে গেছে তাকে আর খুঁড়িস না প্রদীপ। বাড়ি চলে যা। আর কোনদিন যেন আমার ধারেকাছে তোকে না দেখি। চলে যা তুই।

চিত্রা হনহন করে চলে যায়। কিছুটা দূর এসে একবার পিছু ফিরে দেখে। ছেলেটা তখনো একভাবে ঘাড় নিচু করে দাঁড়িয়ে। কাঁদছে ছেলেটা। ভিজে যাচ্ছে ময়লা শার্টের বুকের কাছটা। 

■ লেখক পরিচিতি

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.