হাঁসুলির মতো সৈকত আর ফিরোজা রঙের সমুদ্রঃ
একা একটা সন্ধের পিঠে নেমে আসে গভীর রাত / অচেনা শহর,অচেনা মানুষ জুড়ে আছে ফুটপাথ। হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ফুচকা খেতে খেতে দেখছি মানুষের স্রোত। রাস্তার দু’ধারে বিভিন্ন জিনিসের দোকান, শপিংমল,ব্যাগের দোকান,ফুটপাথের গা-ঘেঁষে ঠেলায় বিক্রি হচ্ছে কাটাফল। লোভনীয় ভাবে সাজানো। ভাজা, চাউমিন সবই আছে। শহরের রাতগুলো এত কোলাহলেও আলোর রোশনায় বেশ মায়াবী সেজে থাকে। একঝলক চোখের স্বাদ মিটিয়ে ফেরার পথে একটা ঠেলায় কলা বিক্রি হতে দেখে এগিয়ে গেলাম ঐ দিকে। ঠেলার পাশে দাঁড়িয়ে একটা প্রায় বৃদ্ধ মানুষ ব্যস্ত হাতে ফল বেচে চলেছে। পরনে সাদা কাপড়ের লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি।চকচকে কালো ত্বক।
হিন্দিতে বললাম আটটা কলা দিতে।লোকটা সবেদা তুলে দেখাল। মাথা নেড়ে বললাম, ‘কেলা! তারপর বললাম বেনানা’। বুঝতে পারল না। বাংলায় বললাম, ‘ আটটা কলা দিন’। বলার সাথে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিতেই সে একটা আটটা কলা যুক্ত কাঁদির অংশ তুলে তার থেকে দুটো ভেঙে নিয়ে ছ’টা দিতে এল। বললাম, এইট...এইট। সে বুঝতে না পেরে নামিয়ে রেখে অন্য খদ্দেরকে ফল দিতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
বলেছিলাম না, বিশাখাপত্তনমে বিপত্তি? এর থেকে বড় বিপত্তি আর কী হবে? বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি কোনও ভাষাতেই বোঝাতে পারছি না কী চাই? আর ক’টা চাই। অগত্যা নিজেই হাতে তুলে বললাম, প্রাইস? এই শব্দটা বুঝতে পারলেন তিনি। এরপর আর কি, কলার প্যাকেট হাতে নিয়ে হোটেলে ফেরা। আর রাতের শেষে ভোরের অপেক্ষা করা।
একটা সুখ নিদ্রার পরই হুটোপুটি...ছোটাছুটি। স্নান, ব্রেকফাস্ট সেরে সোজা গাড়িতে আটঘন্টা হিসাবে ভাড়া। ড্রাইভার শ্রীযুক্ত গণেশ। তেলুগু মিশ্রিত হিন্দি অতি কষ্টে বলেন ও বোঝেন। মোটামুটি আমাদের অসুবিধা হবে না বুঝলাম। সোজা চলেছি সিমাচলম মন্দিরের পথে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০০ মিটার উচ্চতায় সিমাচলম পাহাড়ের উপর অবস্থিত এই মন্দির। বিষ্ণুর নৃসিংহ অবতার এখানে লক্ষ্মী বরাহ নরসীমা স্বামী নামে পূজিত হয়। ঐতিহাসিক ভাবে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা চালুক্য চোলরাজা কুলতুংগা, তবে এই মন্দিরের পৌরাণিক অস্তিত্বের কথাও এখানে লৌকিক ভাবে প্রচলিত আছে। হিরণ্যকশিপুরের পুত্র প্রহ্লাদ ছোট থেকেই ভগবান বিষ্ণুর ভক্ত ছিলেন। পিতা কশিপুর সেই কারণে বহুবার তার প্রাণ নাশের চেষ্টা করে ও প্রতিবার বিষ্ণু সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। শেষ পর্যন্ত নৃসিংহ রূপে বধ করে কশিপুরকে। পরবর্তী কালে ভক্ত প্রহ্লাদ বিষ্ণুর এই বরাহ নৃসিংহ রূপকে সিমাচলম পাহাড়ের উপর মন্দির গড়ে প্রতিষ্ঠা করেন। প্রহ্লাদের মৃত্যুর পর এই মন্দির জীর্ণ হয়ে পরিত্যক্ত হয়।
পরবর্তী সময়ে রাজা পুরুরাভা ব্রহ্মার কাছে বর স্বরূপ একটি পুষ্পরথ পেলে, সেই রথে চেপে ভ্রমণে বের হয়, এবং অপ্সরা ঊর্বসীর সাথে সাক্ষাৎ ঘটে ও প্রণয়াবদ্ধ হয়ে এই সিমাচলম পাহাড়ে এসে বসবাস শুরু করে। ঊর্বসী স্বপ্নে দেবতার প্রতিষ্ঠার আদেশ পান ও দুজনে মিলে প্রহ্লাদ নির্মিত মূর্তিটি নবনির্মান করে প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু একটা সমস্যা থেকেই যায়। পুরুরাভা শতচেষ্টা করেও দেবতার পা খুঁজে পান না, সেই সময় এক পবিত্র কন্ঠস্বর তাকে চিন্তিত হতে বারণ করে ও ঊর্বসীর স্বপ্নে এই সমস্যার সমাধান বলে দেন। ঊর্বশী আদেশ পান, মুর্তিটিকে সারাবছর চন্দন পাউডারের প্রলেপে ঢেকে রাখার। শুধু অক্ষয় তৃতীয়ার দিন বাদে। সেই থেকে মন্দিরে এই মূর্তি সারাবছর চন্দন পাউডারের প্রলেপে ঢাকা থাকে। বিষ্ণু এখানে নৃসিংহ রূপেই পূজিত হন। মূর্তিটির মুখ সিংহের আর দেহ মানুষের।
মন্দিরের নকশা এখানে কলিঙ্গ স্থাপত্যের আকারে নির্মিত। মন্দিরের খোদিত নকশায় দেখা যায় হাতি, ফুল-পাতা ইত্যাদির ছবি। পুরো মন্দিরের বিভিন্ন স্তম্ভের গায়ে খোদিত আছে ভগবান নরসীমার বিভিন্ন ভঙ্গির রূপ।
কাপ্পাস্তম্ভের আলিঙ্গনে মানুষের মনস্কামনা পূরণ হয়,এমনটাই এখানকার মানুষের বিশ্বাস। এমন কী শোনা যায় নিঃসন্তান দম্পতি এই স্তম্ভ জড়িয়ে মনের কামনা জানালে সেটাও পূরণ হয়। আর আছে একটি উষ্ণ প্রসবন। এই প্রসবনের উষ্ণ জলে স্নান করলে যেমন পাপমুক্তি ঘটে,তেমনই নাকি পরিত্রাণ পাওয়া যায় রোগ থেকেও। পাপমুক্তি ঘটে কিনা জানি না, তবে রোগ মুক্তি ঘটতেও পারে। কারণ প্রসবনের জলে উপস্থিত উপাদান হয়তো ব্যাধি উপশমে সাহায্য করে থাকে। একটা ব্যাতিক্রম বিষয় হল, মন্দিরের মুখ পূর্ব দিকে না হয়ে পশ্চিম দিকে স্থাপিত।
সারাদিন বিশাখাপত্তনমের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখব এমনটাই ঠিক আছে, তাই খুব বেশি সময় মন্দিরে না কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রুশিকোন্ডা সমুদ্র সৈকতের উদ্দেশ্যে। নীল সমুদ্রের সাথে বেশ অনেকটা সময় কাটাব, ভাবনাতেই বেশ পুলকিত হল মন। যে কোনও অজানার পথে ছুটতে বেশ ভালোই লাগে। পথ তার প্রকৃত দৈর্ঘ্যের থেকে বেশ খানিকটা দীর্ঘ হয়ে ওঠে। আসলে আমাদের অস্থিরতা পথের সীমা যেন বাড়িয়ে দেয়। বেশ সুন্দর একটা যাত্রা শেষে এসে পৌঁছালাম সীমাহীন নীল জলরাশির সামনে। সমুদ্রের রং এখানে টার্কিজ। হাঁসুলির মতো বেঁকে গিয়েছে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। তেলুগু ভাষায় পাহাড়কে কোন্ড বলে।তাই এই সমুদ্র সৈকতের নাম ঋষিকোন্ডা। হাঁসুলির বাঁকে রূপকথার মতো জেগে আছে মেছুয়া বস্তির গল্প। সমুদ্র এদের কাছে অকৃপণ। মূল সৈকত থেকে সে বস্তি দেখা যায় না। তবে গল্প এখানেও আছে। ছোটো ছোটো ঘুন্টির ছায়াতে বিশ্রাম নেওয়া মানুষের অজস্র গল্প যেমন আছে, গল্প আছে ঘুন্টির মালিকদেরও। তাদের জীবন যুদ্ধের গল্প। কেউ চা-দোকানে কোল্ডড্রিঙ্ক, বাচ্ছাদের খেলার বল বেচছে।কেউ সমুদ্রের মাছের দোকান দিয়েছে। কোথাও নকল বাহারি গয়নার দোকান।সমুদ্র স্নানের পোশাকের দোকান, আর একটা মিনি বাজারের মতো মুক্ত ও মুক্তজাত পণ্যের সাথে,বিভিন্ন পাথরের গয়না,গৃহশয্যার পণ্য সাজিয়ে বসেছে। বলছে সবাই আসল মুক্তা, কিনছেও সবাই। সবাই জানে এত কম দামে মুক্তা পাওয়া যায় না, সব চাষ করা,তবু কিনছে। কিসের আশায়! যদি হঠাৎ নকলের মাঝে একটা আসল খুঁজে পাওয়া যায়! আসলে অলীক এক খোঁজের পিছনে ছোটার মধ্যেও আনন্দ আছে। ঐ যে এক গামলা ঝুরো মুক্তার মাঝ থেকে বেঁছে বেঁছে ভালো মুক্তা খুঁজে চলার পিছনেও তো আছে অনাবিল আনন্দ। এই যে উন্মুক্ত আকাশের নীচে সমুদ্রের হাওয়ায় চুল উড়িয়ে পাগলি সাজার মধ্যে যে আনন্দ আছে,তা কি বাড়ির উঠোনে মেলে? এই যে নকল জেনেও অজস্র মুক্তকে নিজের হাতে ঘাঁটা, আহা! কি যে সুখ! এত বিবর্ণ জীবনে এভাবে টুকরো সুখ খুঁজে পেলে,এভাবেই তো লুটে নিতে হয়। দূরে দলব্দধ ভাবে অথবা একাকি একটি মানুষ বা সদ্য ঘরবাঁধা দুটি হাত সমুদ্রের সাথে নিবিঢ় খেলায় মত্ত, দেখার মধ্যেও তো সুখ আছে। এমন উন্মুক্ত নীল আকাশের নীচে,সামনে অনন্ত বিস্তৃত ফিরোজা রঙের জলরাশি জূড়ে যে আনন্দধারা অবিরাম বয়ে চলেছে,তাকে অনুভব করতে করতে কখন যে কেটে গেল তিনটি ঘন্টা, বুঝতেই পারলাম না! দু-মুঠো ভাত খেয়ে ছুটব আবার বৌদ্ধধ্বংস স্তূপ থোটলাকোন্ডার পথে। ...ক্রমশ
সুচিন্তিত মতামত দিন