মা যতক্ষণ মামাবাড়িতে থাকত বুনো ফুলের হাসির মত আলো ছেয়ে থাকত মায়ের মুখটিতে । তখন বাস থেকে নেমে অনেকটা পথ হেঁটে আসতে হত মামাবাড়ি । আলপথ ছেড়ে দুপুরের নিদ্রামগ্ন পাড়া পেরিয়ে আর এক মাঠের রাস্তা ধরতাম । শিরশিরে হাওয়ায় ধান গাছ গুলো নুয়ে নুয়ে পড়ছে । দুএকটা বড় গাছের পাতাগুলো শিম শিম বাতাসে কাঁপছে । খাঁ খাঁ দুপুর । রোদের তাপে মুখ লাল আমাদের । কাঁচা রাস্তার পাশে দীঘির শান্ত জলে মেঘের ছায়া । এই রাস্তা দিয়ে গেলেই পাকা সুপুরির মত হলুদ রঙ ধরত আমার মনে ।
মামাবাড়ির বাগানটা ছিল এক মুক্ত দুনিয়া ।ফুলকপি,পালংশাক ,বেগুন ,আলুর চাষ হত এক দিকে । অনাথমামা তাদের যতন করত খুব । বাগানের অন্য দিক খোলা । চরাচরের সাথে নিজের সীমানা বিছিয়ে দিয়েছিল । এদিকটা আমার বেশি ভাল লাগত । অনাদরে বেড়ে ওঠা বেশ কিছু গাছ । আগাছা । ছোট একটা জলার মত পুকুর ,যার বেশির ভাগ পানাতে ঢাকা, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে শুয়ে থাকত আকাশের নিচে । অনেক গাছের ভিড়ে সেই কলকে ফুলের গাছটা ছিল । কাজল মাইমা বলেছিল , “কলকে ফলে বিষ থাকে । খেলেই সাক্ষাৎ মৃত্যু ।”
বিষ কেন খায় লোকে ?
পেখম বলেছিল, “দুঃখে !”
পেখম ছিল আমার উড়ু উড়ু বন্ধু । লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা ওর কটা চুল । চোখও কটা । চুল আর চোখের অমন রঙের জন্য সাধারণের থেকে আলাদা লাগত ওকে । যেন অনেক দূরের । ডোবার পারে ব্যাঁকা তালগাছে বসে কাঁচা কুল খেতে খেতে পেখমকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম , “দুঃখ আছে তোর ?”
পেখমের গলার নিচে কালশিটে । সৎ মায়ের মারের দাগ। তবু পেখম ঠোঁট উল্টে বলেছিল , “দূর ,দুঃখ কোথায় ?”
আমি বললাম , “তোর সৎ মা যে মারে তোকে ! সেটা বুঝি দুঃখ নয় !”
পেখম বলল , “কিন্তু মরে যাবার মত দুঃখ তো নয় !”
আমি ঘাড় নেড়ে বললাম , “সেটা ঠিক ,সৎ মায়ের মারের জন্য মরবিই বা কেন !”
ইঁটের পাঁচিল থেকে লাফিয়ে নামি দুজনে ।
---“চল খুঁজি ভাল দুঃখ ।”
পাঁচিলের গোঁড়াতে সাদা ঝুমঝুমি ফুলের ভেতরটা ম্যাজেন্টা ---“সেটা কি ফুলের দুঃখ ?”
একটা লাউ গোল না হয়ে কেমন ঢোলের মত লম্বাটে । অনাথমামার বাগানে বেগুন ,ঝিঙে, আলুও কেমন তেবড়ে রয়েছে দুঃখে । চুক চুক করতে করতে মুখ ব্যাথা হয়ে গেল আমাদের । সারা বাগানের দুঃখ দেখে সবে দুটো পেয়ারা নিয়ে বসেছি দেখলাম পুকুর ঘাটের বউদের মত গাছেরা হাওয়াতে দুলে দুলে পড়ছে এ ওর গায়ে । পেখম হেসে বলল, “এদের দুঃখ নেই রে ! এরা বেশ সুখেই আছে ।”
সন্ধ্যে হয়ে আসছিল । আমি বললাম , “কাল দুঃখ খুঁজে আনবো রে পেখম । তুইও খুঁজিস । ভাল দুঃখ পেলেই খাব কলকে ফল ।”
কলকে ফলের গায়ে হাত বুলিয়ে ঘরে ফিরলাম দুজনে । পরেরদিন সকাল থেকে ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টি । একটা মাত্র জানলা মামাবাড়ির দোতালার কোঠা ঘরে । নিচে নামতে গেলেই শুনতে হচ্ছে, “সর্দি লাগিয়েছিস তো দেখাব মজা!”
অগত্যা সারাদিন সেই এক রত্তি জানালার সামনে বসে কাটানো । পুতুলগুলোও নেই যে খেলব । জানলা দিয়ে সারাদিন দেখছি । বৃষ্টিতে ভিজছে উঠোনে মেলা চন্দনামাসির সবুজ শাড়ি । দুটো কাক চুপচুপে ভিজে গা ঝাড়ছে নিম গাছের ডালে । বাগানের সব গাছ বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে নাচছে । একটু দূরে ক্ষেতে জল জমেছে । সাদা বৃষ্টি গেরুয়া রঙের জল হয়ে যাচ্ছে ক্ষেতে পড়েই । অনাথমামা ভিজে ভিজে গরুগুলো কে গোয়ালে ঢোকাচ্ছে । মা আর ফুলিমাসি বৃষ্টির ছাটে ভিজে রান্নাঘর থেকে দালানে আঁচল ঢাকা দিয়ে কাঁসার থালায় ঠাকুরের ভোগ নিয়ে আসছে । ভোরে থেমে গেছে বৃষ্টি । ঘুমন্ত মাসিকে ডিঙিয়ে বাইরে আসি । পেখম ছিল বাগানেই । পেখমের ঘরে কোন দোতালা নেই । কোঠা ঘর নেই । পেখম শুধু উঠোনে বৃষ্টি দেখেছে । মারও খেয়েছে । চোখের নিচ ফুলে নীল হয়ে আছে । তবু কলকে ফল হাতে নিয়ে পেখম বলল , “তোর কোঠা ঘরের উপর থেকে বৃষ্টির গল্প শুনে মনে আর দুঃখ নাই রে সাগর । তাছাড়া বাপ কাল বিকেলে এক জোড়া গোলাপি হাওয়াই চটি এনে দিয়েছে !”
গোলাপি হাওয়াই চটির আনন্দ চেপে রাখতে পারছে না পেখম । ফিকফিকে হাসি তার রোগা মুখে । আমি রাগে অন্য দিকে মুখ ফেরালাম । পেখম হাত চেপে বলল , “তুই রাগ করিস না । পরের বার ঠিক দুঃখ পেয়ে যাব ।”
পরের বার যখন মামা বাড়ি গেলাম পেখমের চেহারা দেখে আমি অবাক । তার রুক্ষ কিশোরী চুলের সিঁথিতে এক মাথা মেটে সিঁদুর !
--- “তোর বিয়ে হয়ে গেছে পেখম ?”
ঝলমল করে হেসে উঠল পেখম , “হ্যাঁ । নতুন শাড়ি পেয়েছি আমি । ”
আমি ম্লান হেসে বললাম , “তবে তো ভাল ,তোকে আর ইস্কুল যেতে হয় না ।”
পেখম বলল , “না ,আমি আর ইস্কুল যাই না ।”
আমি ফিসফিসে গলায় জিজ্ঞাসা করলাম , “বর তোকে ভালবাসে পেখম ?”
পেখম ঘাড় বেঁকিয়ে বলল , “না । মারে ।”
আমি ভয়ার্ত গলায় বললাম , “মারে ! তোর বর তোকে মারে পেখম ?”
--- “হু – ”
---“কেন রে ?কেন মারে তোকে ?”
--- “সন্দেহ করে । ”
--- “ছি ছি । কি বাজে লোক ।”
--- “খুব খারাপ লোক । অনেক বড় আমার থেকে ।”
---“আয় পেখম আয় ,কলকে গাছের ফল খাবি আয় ।”
দুজনে মিলে আলপথ দিয়ে ছুটতে থাকি । লাল ধুলো ওড়ে । পেখমের ডুরে শাড়ির আঁচল ওড়ে । পাশের ধান ক্ষেতের সরু সবুজ পাতা ঝাঁপটা মারে আমাদের মুখে চোখে । কলকে ফল খাবার জন্য যেন তর সইছে না । কিন্তু বাগানের পাঁচিলের তলায় এসে দেখি কে যেন কেটে দিয়েছে কলকে ফুলের গাছটা । পেখম হাসল ।
---“আমি মরলে সে বড় কাঁদবে রে সাগর ।”
---“সে কে ?”
---“যার সাথে বর সন্ধ করে সে । দীনবন্ধু দাদা । ভৈরবের থানে খঞ্জানি বাজিয়ে গান গায় । একটা পা খোঁড়া । ছোট বেলায় পোলিও হয়েছিল কি না ।”
---“তুই কি তার কাছে রোজ যাস ?”
---“রোজ কোথায় ! মাসে দুদিন যাই । যেদিন বৃষ্টি পড়ে, আর যেদিন বৃষ্টি পড়ে না ।” পেখমের মুখে দুষ্টুমির হাসি ।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হাসতে হাসতে শুয়ে পড়লাম । পেখমও শুয়ে পড়েছে আমার পাশে । চোখের সামনে নীল আকাশ । সাদা ফিনফিনে মেঘ ভাসছে তার উপর । দুএকটা চিল উড়ছে অনেক উপরে । এক ঝাঁক লক্কা পায়রা উড়ে গেল রূপের গুমোর ছেটাতে ছেটাতে । আমরা দুজন শুয়ে আছি মাঠের শেষ প্রান্তে । পিঠের নিচে শুকনো খড় ,নরম ঘাস ।
পেখম ডাকল ,“সাগর ?”
---“বল !”
পেখম বলল, “চল বাড়ি যাই । আরও কিছুদিন দুঃখে থাকি । দেখি যদি পুষতে পারি ।”
---“তোর রকম সকম আমার ভাল লাগছে না পেখম ।”
---“কেন রে সাগর ,তুই কি রাগ করলি ?”
আমি উঠে বসলাম । পাশে পড়ে আছে মেলা থেকে কেনা আমাদের মাটির খেলনা বাটি । পেখমের আর ওসবে মন নেই । পেখম উঠে বসে হাঁটুতে চিবুক ঠেকিয়ে বলে ,“চোখ বন্ধ করলেই দীনবন্ধু দাদার মুখ ! কি সুখ !”
---“কেন সে মুখে এমন কি আছে ?” আমি ঝাঁজিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম । পেখম উত্তর না দিয়ে আগাছার মাঝে ফুটা চন্দ্রমল্লিকা ফুলের দিকে তাকিয়ে রইল ।
#
পরের বার মামাবাড়ি গিয়ে পেখমকে আর পেলাম না । দীনবন্ধুদাদাকে নিয়ে কোথায় যেন চলে গেছে সে । সারা গ্রামে সে নিয়ে চর্চা চলছে । সব থেকে রেগে গেছে পেখমের সৎমা । দুলালমামা নাকি দেখেছে পেখম আর দীনুমামাকে । হেতমপুরে রক্ষাকালী মন্দিরের পাশেই ওদের ছোট্ট টালির ঘর । দুলালমামা মাকে বলেছিল পেখম খুব ভাল আছে । পেখম হারিয়ে যাবার পর খুব অভিমান হয়েছিল । কথা ছিল এক সাথে কলকে ফল খাব । অথচ পেখম একটাও দুঃখ পুষতে শিখল না । “সারা জীবন পাখা মেলে উড়ে উড়ে বেড়ালি পেখম ! সব সময় তোর খিলখিলিয়ে হাসি বন্ধ কর । এত রকমের দুঃখ আছে জগতে ,তুই একটাও আপন করতে পারলি না । অথচ আমি দ্যাখ, কত দুঃখ পুষতে শিখেছি ।”
প্রাচীন ইঁটের ভাঙা শিবমন্দিরে বসে আমি একা একা মনে মনে ঝগড়া করি পেখমের সাথে ।
খুব সুন্দর গল্প। যেমন ভাবনা তেমনি চিত্রকল্প। খুব ভালো লেগেছে। অভিনন্দন
উত্তরমুছুনসুচিন্তিত মতামত দিন