নিশিত ছোটাছুটি করতে লাগলো বাসষ্ট্যান্ডে। এ বাস থেকে ওবাসে। কোনটা যে যাবে? পরিবহন ধর্মঘট চলছে, হাতেগোনা দুএকটা যাচ্ছে শুধু। খোঁজ পেলো একটা ; বিআরটিসি। সরকারী বাস জন্যই যাচ্ছে। তাও ভালো মানুষের দুর্ভোগ তো কমানোর চেষ্টা করছে। কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে জানলো টিকিট নেই, দাঁড়িয়ে যেতে পারলে যেতে বললো। যেতে তো হবেই তাই ঠেলাঠেলি করে দাঁড়ানোর জায়গা পেলো একটু। তিলধারনের জায়গা নেই বললেই চলে। রক্ষে যে বাসের মাঝের ষ্টিলের রডের সাথে হেলান দেয়ার সুযোগ পেলো। গন্তব্য অনেকটা। সিট পাওয়া প্রায় অসম্ভব! এটাই ভরসা। সাথের ব্যাগে আস্ত একটা টেডি বিয়ার, চকলেট -হাবিজাবি। আজ স্পেশাল কারো জন্মদিন, তাকে সারপ্রাইজ দিতেই যাচ্ছে ও। গাড়ি চলা শুরু হওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই যা হয় আর কি গুতোগুতি, চাপাচাপি নিয়ে একজন আরেকজনের সাথে অভিযোগের পসরা বসিয়ে নিলো ; ভাড়া নিয়ে ঝগড়া হলো। হরেক রকমের মানুষের হরেক রকম এজেন্ডা, মতবাদ ; নিশিত কানে হেডফোন গুজে রোমান্টিক মুডে বাইরে তাকানোর চেষ্টা করলো। বাস তখন নভেম্বরের হালকা কুয়াশার ধোঁয়া ভেদ করে হাইওয়ে ধরে দুরন্ত ছুটে চলছে, মিষ্টি রোদ রাস্তার পাশের ধানের ক্ষেত সোনার রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে যেনো। দিনটা সত্যি স্পেশাল।
বাসের ছোট্ট প্যাসেজে লোকের গাদাগাদিতে পরিস্হিতি বেগতিক, ভ্যাপসা গরমে সবাই অতিষ্ট। তারপরও লোক ওঠানো বন্ধ হচ্ছে কই? বাসে শেষ গন্তব্যের যাত্রীদের ওঠানো হচ্ছে যতটা সম্ভব। হেলপার দাঁড়ানো যাত্রীদের দুসারিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বিপরীত মুখ করে। বিআরটিসির বাসের প্যাসেজ গুলো তুলনামূলক বড় হওয়াতে দুপাশে দুটো লাইন বানানো যায়, আর ফাঁক গলে হেলপার-কন্ডেক্টার ঠেলেঠুলে যাতায়াত করছে। টিকিট চেক করতে আসলে নিশিত কন্ডাক্টারকে জিজ্ঞেস করলো -"সামনে কি সিট ফাঁকাটাকা হবে? "
সামান্য হেসে সে উত্তর দিলো " ভাই সিট থাকলে তো বসায় দিতাম! "
নিশিত ও হেসে জবাব দিলো "আপনি ভাই অনেক চালাক, আমার প্রশ্নের উত্তরটা কিন্তু এটা না "
"বোঝেনই তো " বলেই মাকলা হেসে সে বাকীদের টাকা তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
সামনে একটা ষ্টপ আসতেই ঠাসাঠাসি করে আরো কয়েকজন উঠলো। সাথে একটা কান্ড হয়ে গেলো। দুটো হিজরাও ওঠার জন্য ঠেলাঠেলি করতেই হেলপার ধাক্কা দিয়ে নামানোর চেষ্টা করলো। সে ওঠাবে না, স্বাভাবিক হিজরারা বাসে-ট্রেনে উঠে সবার সাথে অসভ্যতা করে টাকা তোলে ;বলা ভালো চাঁদাবাজি করে। তাদের কাজকর্ম কখনো কখনো মানুষকে ভীষন বিব্রত করে।
বাসের থেকেও কিছু যাত্রী চেঁচিয়ে উঠলো "একদম উঠতে দিও না, একদমই না ; ব্যাটারা সব বদমাইশ "। কিন্তু হিজরাদের দমানো কমবয়সী ওই হেলপারের সাধ্য না, ওরা ঠেলেঠুলে উঠেই পড়লো। কোন কোন যাত্রী নিজেদের অসন্তষ্টি প্রকাশ করলো, " সরকারী বাসেও দেখি রক্ষা নাই এসব থেকে ", " আরে ব্যাটা হেলপার তুমি গেট টা আগেই আটকে দিতে পারলা না " -এমন কথাবার্তা চলতেই থাকলে। নিশিত হিজরা দুটোকে অবজার্ভ করতে লাগলো। কটকটে হলুদ আর কমলা রঙের শাড়ী পরা দুজন, ঠোঁটে গাড় করে লাল লিপষ্টিক মাখা, চোখে টানা টানা কাজল দেয়া, মুখের অতিরিক্ত পাউডার ভেসে উঠেছে। মাথায় রঙীন ফিতে দিয়ে দুটো বেণি করা একজনের, আরেকজনের খোপা বাঁধা। মেয়েলি পোশাক পড়লেও নাকের নিচে গোঁফের বলিরেখা , শক্তপোক্ত চোয়াল, পুরুষালী কন্ঠ আর অদ্ভুত শারীরিক গঠন, হাবভাব অন্য দশটা স্বাভাবিক মানুষ থেকে এদেরকে আলাদা সৃষ্টিতে দেখতে বাধ্য করে। এরা আসলে হরমোন ক্রোমোজমাল ডিসঅর্ডারের কারনে সৃষ্ট প্রকৃতির অভাগা কিছু সন্তান। না ছেলে না মেয়ে। মানুষের জন্য এককথায় "হিজরা "।
পড়াশুনার জন্য নিশিতকে ভার্সিটি যেতে হতো ট্রেনে, আসতে হতো ট্রেনে। অনেকবারই হিজরাদের কবলে পড়তে হতো৷ কোন কোন হিজরাদের ব্যবহার ভালো ছিলো, কোনটার জঘন্য। যারকাছে যেমন পেতো টাকা তুলতো। কেউ এদের বিরুদ্ধে সহজে প্রতিবাদ করতো না কারন সবাই মানে " এদের নাকি বদ-দোয়া লাগলে সেটা ফলে!" হায়রে মানুষের অন্ধবিশ্বাস! যাইহোক নিশিতের জানতে ইচ্ছা করে হিজরাদের জীবনের লুকায়িত গল্পগুলো। কিভাবে এদের জীবনটা কাটে? কিন্তু কখনো কারো সাথে সেভাবে কথা বলা সম্ভব হয়নি!
হিজরা দুটো সকলকে ঠেলেঠেলে পিছনের দিকে চলে গেলো। " এই চিকনা টাকা দেনা, হ্যান্ডসাম টাকা দাও, ওগো আমার জানু " হাবিজাবি বলে টাকা তোলার চেষ্টা চালিয়ে গেলো। অনেকেই না করতে " কারো গাল টিপে ধরলো, পেটে খোঁচা মারলো , পায়ের থাই'য়ে চেপে ধরলো" ।
এক যাত্রী তো খেপে গেলেন "গায়ে হাত দিলে থাপরায় তোর দাঁত ফেলে দিবো "
একজন বললো "অসভ্যতা করিস না একদম "
ঠিকই তো এসব কারই বা পছন্দ।
টাকা তুলতে তুলতে ওরা নিশিতের ঠিক একদম পিছনে চলে এসেছে। একজন যাত্রীর সাথে জোরাজুরি করতেই তিনি রেগে গিয়ে বললেন "অসভ্যের জাত -দেখতেই মন চায় না"
খোঁপা বাধা হিজরা টা ট্যারা সুরে বলে উঠলো " তাহলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দাওনা আমাকে বাইরে, আমিও বাঁচি!"
হঠাৎই নিশিতের কোমড়ে আঙুলের খোঁচা পড়তেই ও বলে উঠলো " একদম গায়ে হাত দিবে না "
"তাহলে বিশটা টাকা দাও হ্যান্ডসাম "
"টাকা নেই "
"এত নায়ক সেজে বের হয়েছো আর টাকা নেই বললেই হলো "।
আবার কোমড়ে গুতো পড়লো নিশিতের৷ অগত্য টাকা বের করে দিয়ে দিলো ও। সামনে এগিয়ে গেলো হিজরারা। হাতে তালি দিয়ে রঙঢঙ করে টাকা তুলতে লাগলো ওদেরমত।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তো কাজ নেই তাই নিশিত হিজড়াদের নিয়ে ভাবতে লাগলো। ওদের ভার্সিটিতে একটা মেয়ে সুযোগ পেয়েছিলো। কিন্তু ভর্তির পর ছেলেমেয়েরা জেনে গেলো ও মেয়ে না, তৃতীয় লিঙ্গের। ব্যাস প্রতিদিন টিটকারী -অপমান কতই সহ্য করবে আর ; চলে গেলো ছেড়ে। সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ তাকে সহযোগীতা করতে পারলো কোথায়?
একটা মজার ব্যাপার হলো কোথাও নতুন বাচ্চার জন্ম হলেই কিভাবে যেনো হিজরারা জেনে যায় ; একদম বাসায় হাজির। এমনকি বিয়ের ব্যাপারের একই, কিভাবে কোথা থেকে যে খবর পায় কে জানে। পাড়ায় এমন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একদল হিজরা আসতো। তিন-চারজনের গ্রুপ৷ নিশিত তখন ছোট, স্কুলে পড়ে। ওরা আসতো নাচতো -গাইতো - টাকা নিয়ে চলে যেতো। টাকার পরিমান নিয়ে বচসা হতো। তবুও কোনদিন বাজে কথা বলতোনা, সব সময় হাসিমুখে ঠাট্টা মশকরা করে আবদার মিটিয়ে চলে যেতো৷ এলাকায় রটে গিয়েছিলো হিজরা গুলো মানুষ খারাপ না, ভদ্র আছে। সবার সাথে অলিখিত একটা বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক তৈরী হয়ে গিয়েছিলো।
একদিন এক চাচী জিজ্ঞেস করলো ওদের " কিরে তোরা পোলাপান হওয়ার খবর পাস কিভাবে রে? "
হিজরা দলের সবাই হাসে। একজন টিপ্পুটি কাটে "সেটা তোমাকে বলতে যাবো কেনো "।
আরেকজন বলে " যাদু জানি গো যাদু "......।।
সেই হিজরাদের সাথে একদিন কি জানি হলো কাদের। বেধরক মেরে নাক মুখ ফাটিয়ে দিলো উৎসুক জনতা৷ রাস্তায় হাত পা ছড়িয়ে বসে ছিলো ওরা। টপটপ করে মাথা ফেটে রক্ত পড়ছিলো। লোকজন ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলো ওদের। নিশিত মায়ের সাথে স্কুল থেকে ফিরছিলো, জটলার ভিতর দিয়ে দৃশ্যটা চোখে পড়ে ওর। হিজরাদের সর্দারনী তাকিয়ে ছিলো ওর দিকে , পরিচিত মুখ দেখে সে যেনো ভীষন লজ্জিত, বিব্রত......! ওই ঘটনার পর ওদের আর দেখা যায়নি।
হঠাৎই তীব্র ব্রেককষায় বাসের সবাই হুড়মুড়িয়ে একে অপরের গায়ে পড়ে, ধাক্কা খায়৷ বেপরোয়া ভাবে একটা ট্রাকটার পাশ কাটায়। বাসের ড্রাইভার গালি দিয়ে উঠে। যাত্রীরাও মন্ডুপাত করতে থাকে৷ নিশিতেরও ভাবনায় ছেদ পড়ে।
বেণি করা হিজরাটাও ব্রেকের বিপর্যয়ে একজনের গায়ে পড়েছিলো। লোকটা তিরস্কার করে উঠে " তোদের তো গায়ে পড়ার জন্য শুধু অযুহাত দরকার। একদম সোজা হয়ে ভদ্রভাবে থাক "।
বেণিকরাও উত্তর দেয় " যা বাব্বা আমি কি ইচ্ছে করে পড়লাম নাকি গো হ্যান্ডসাম? "
লোকটা রাগত চোখে শুধু হাত নেড়ে মুখটা ঘুরিয়ে নেয় " এদের সাথে কথা বলাই বেকার"।
ড্রাইভার বলে ওঠে "তুমি তো যথেষ্ট সুন্দরী আর বয়সও কম তাহলে কাজ করে খাও না কেন? "
মুখ ভেটকীয়ে উত্তর দেয় " হুহ্ কে কাজ দিবে আমাদের? আমাদের কেউ কাজ দেয় না "
"তুমি করবা নাকি বলো? "
" করবো। কি কাজ? "
"রান্না বান্না পারো তো নাকি? "
" পারি... কিন্তু আমাদের হাতের খাবার কেউ খাবে না বুঝলা "
" তোমার নাম্বার দিয়ে যেও "
"কেনো গো। প্রেম করবা নাকি? "
কথাটা শুনে বাসের যাত্রীরা হেসে ওঠে। ড্রাইভার যেনো একটু বিব্রত হয়।
বাস চলতে থাকে৷ ঢুলুনি চলে আসে চোখের পাতায়।
ত্রিশ-পয়ত্রিশ মিনিট পর একটা বাসস্টপ এলো। মোটামুটি যাত্রীরা নেমে যায়, অনেকে সিট পেয়ে বসে। নিশিত সিটের খোঁজে এদিক ওদিক তাকায়। সামনের একটা সিট ফাঁকা হয়। ও বসে পড়ে সেখানে, জানালার পাশে। হাফ ছেড়ে বাঁচে। বাস চলা শুরু করে। ওর পাশের সিট টাও ফাঁকা। কেউ বসে নি দেখে এবার খোপাবাঁধা হিজরাটা এসে বসে নিশিতের পাশে। কন্ডাক্টার খেয়াল করছিলো ব্যাপারটা। তেড়ে আসলো ; "সিটে বসা যাবে নাতো এমনিতেই ফ্রিতে যাচ্ছিস আবার সিটে বসা। না হবে না, ওঠ ওঠ "।
নিশিত তাকায় বিব্রত মানুষটার দিকে। " আরে কি ব্যাপার সিট তো খালি। যাত্রী উঠুক ছেড়ে দিবে। যান আপনি "।
নিশিতের গম্ভীর বলার ভঙ্গিতে অনিচ্ছা সত্বেও সরে যায় কন্ডাক্টার।কিছুক্ষন কেটে যায়। আধখোলা জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস লাগে। "থ্যাঙ্কু "
নিশিত পাশে বসা খোপাবাঁধার দিকে তাকায়।
"কেনো " প্রশ্ন করে ও।
"এমনি, সবাই তো তাড়ায় দেয় তুমি ভাই ওমন করলা না তাই " ।
নিশিত উত্তর দেয় না কিছু।
খোঁপাবাধা একাই কথা বলতে থাকে। "কপাল দেখো আমাদের, জন্ম তো নিছি মানুষ হিসেবেই কিন্তু সবাই কুকুর মনে করে। এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়? কি করবো আমরা টাকা না তুলে? আমাদের কি কেউ কাজ দেয়? সবাই শুধু মন্দ কথা বলে। আমরা যাবোটা কোথায়? "
নিশিতের উত্তর জানা নেই।খোপাবাঁধার নাম জিজ্ঞেস করে ও।
" আমার নাম? আমার নাম বিন্দু....."
"কোথায় যাচ্ছেন? " আবার জিজ্ঞেস করে নিশিত।
"কই আর যাবো, এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে আরেক জায়গায়৷ ঘুরে ঘুরে টাকা তুলি পেটের দায়ে "।
আরেকটা স্টপিস এসে যায়। যাত্রী নামে, যাত্রী ওঠে। বাস ভর্তি হয়ে ওঠে আবারো। বিন্দু আর ওর সঙ্গীও সক্রিয় হয়ে ওঠে। কয়েকমাস বয়সের শিশু সন্তান নিয়ে এক দম্পতি উঠেছিলো, ওরা দুজন পিচ্চিটাকে কোলে নিয়ে আদর করা শুরু করে। দুহাতে তালি মারতে মারতে গান ধরে
-" তোমার ছেলে আছে ভালো আমার নয়নও জুড়াইলো,
খোকা আছে ভালো আমার প্রাণও জুড়াইলো।
সন্ধ্যা দু'মণি আমার ছেলে আছে ভালো,
রাঙা হলুদ মাখা গা'য়ে, আঁধারে না পাওয়া যায়।
আল্লাহ মিলায় দিছে পূর্ণিমারই চাঁদ.........."
শিশুটা হাসি হাসি মুখে হাত-পা নাড়তে থাকে। বাস ভর্তি সবাই হাসি হাসি মুখে গানটাকে উপভোগ করে। একটু আগের বিরক্ত মানুষগুলোও নির্মল প্রার্থনায় অংশগ্রহন করে স্বাগত জানায়। বাস চলে আসে শেষ গন্তব্যে।
মানুষের একেকজনের বেঁচে থাকার গল্প একেকরকম। কেউ শুধু বাঁচার জন্য বাঁচে। কেউ জীবনকে রঙীন করে বাঁচে। তবুও সংগ্রামটা একই রকম। কিন্তু বেঁচে থাকার প্রক্রিয়া বড্ড কঠিন।
নিশিতের খুব ইচ্ছে করে সাথের চকলেট গুলো বিন্দুদের দিয়ে দিতে। ও পারেনা ; ভেতরের জড়তা-সংকোচ ওকে বেঁধে রাখে।
ভীড় ঠেলে এগিয়ে যায় ও । এবার নিশিতের নামার পালা............।।