■ শ্রীশুভ্র / বাঙালির বিদ্যাসাগর

বাঙালির বিদ্যাসাগর


বিদ্যাসাগরের জন্মের পর ঠিক দুইশত বছর অতিক্রান্ত হলো। সেই উপলক্ষ্যে অনেকেই পুলকিত। স্মরণে বরণে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে সামান্য টানাটানি শুরু করেছেন। বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ার ওয়ালজুড়ে। বিগত দুইশত বছরে আমরা এই সামান্য মানুষটিকে নিয়ে কি করেছি। তাঁর অসামান্য কীর্তির কতটুকু ধারণ করতে সক্ষম হয়েছি। আর কতখানি কীর্তির নির্যাসকে সযত্নে পরিহার করেছি। সে আলোচনা পরে। আগে বরং একটা ঐতিহাসিক সত্যকে স্বীকার করে নেওয়া যাক। বিদ্যাসাগরের জন্মের সময় বাঙালি যতটা বাঙালি ছিল, আজ এই মানুষটির জন্মের পর অতিক্রান্ত দুইশত বছর পার করে বাঙালি আর ততটা বাঙালি নাই। বাঙালি এখন অনেক বেশি হিন্দু হয়ে উঠেছে। মুসলিম হয়ে উঠেছে। এবং বাঙালির কেউ এখন ভারতীয় নাগরিক। কেউ বাংলাদেশী নাগরিক। বিদ্যাসাগরের জন্মের সময়েও বাঙালি ব্রিটিশের অধীনস্ত থাকলেও বাংলার নাগরিকই ছিল। এক বিস্তৃত অখণ্ড বাংলাই ছিল তার স্বদেশ। এবং একমাত্র বাংলাভাষাই ছিল আপামর বাঙালির মাতৃভাষা। ১৮২০ সালেও বাংলার একটি অখণ্ড সংস্কৃতি ছিল। যে সংস্কৃতির মূল্যে বিশ্বের আর যে কোন জাতির সাথে তাঁর সগৌরব স্বাতন্ত্র্য ছিল একটি। কিন্তু আজ আর আপামর বাঙালি নিজেকে স্বতন্ত্র একটি জাতি বলে স্বীকার করতে রাজি নয়। এবং বিশ্বের মানচিত্রেও অখণ্ড বাংলার আজ আর কোন অস্তিত্বও নাই। শুধু বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রেই নয়। আপামর বাঙালির হৃদয়ের মানচিত্রেও হারিয়ে গিয়েছে অখণ্ড বাংলার মানচিত্র। নষ্ট হয়ে গিয়েছে বাঙালিয়ানার জাতিগত সংস্কৃতি। বদলে জন্ম নিয়েছে টুকরে টুকরো বাংলা। টুকরো টুকরো বাঙালিয়ানা। যা পরস্পর পরস্পরের থেকে সর্বদাই আলাদা থাকার সাধনায় মগ্ন। একাধিক বাঙালি সংস্কৃতির ভিতর বিভাজিত আজ আপামর বাঙালি। পশ্চিমবাংলার বাঙালির সাথে বিহার ও ঝাড়ঘণ্ডে বিলীন হয়ে যাওয়া বাংলার বিস্তৃত ভুখণ্ডের বাঙালির সংস্কৃতির পুরোপুরি মিল নাই। ঠিক তেমনই আসামে বিলীন হয়ে যাওয়া বাংলার বিস্তৃত ভুখণ্ডের বাঙালির সাথেও পশ্চিমবঙ্গের বা বিহার ও ঝাড়খণ্ডের বাঙালির সংস্কৃতির পুরোপুরি মিল নাই। এরই সাথে ত্রিপুরার বাঙালির সংস্কৃতির পার্থক্যও অনেক। এবং ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের বাঙালির সংস্কৃতিও বয়ে চলেছে ভিন্নতর খাতে। বিশ্বের সকল উন্নত জাতিসমূহ ঠিক যে পথে এগিয়ে চলেছে শতকের পর শতক ধরে। আমরা বাঙালিরা শত ভাগে বিভক্ত হয়ে ঠিক তার উল্টো অভিমুখে পিছিয়ে চলেছি দশকের পর দশক ধরে। এখানেই আমাদের অনন্যতা। 

পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটতেই পারে। বিদ্যাসাগরের সাথে শতটুকরো বাংলা ও বাঙালিয়ানার কি সম্পর্ক? সম্পর্কের হিসাব পরে হবে। আগে দেখা যাক। আধুনিক বাংলার রূপকার বলতে ঠিক কাদের মুখগুলি ভেসে ওঠে? অন্তত ওঠার কথা?। রাজা রামমোহন রায়। বিদ্যাসাগর। এবং রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল ইসলাম। এঁদের কেউই শতটুকরো বাংলা ও বাঙালিয়ানার সাধনায় জীবন উৎসর্গ করে ছিলেন না। কিন্তু আমরা করেছি। আমরা মিলনের বিপরীতে এগিয়ে বিচ্ছেদের সংস্কৃতিকে আমদানী করে বাংলা ও বাঙালিকে হীনবল করেছি। আর এঁরা বাংলা ও বাঙালিকে শক্তি জোগানোর সাধায় ব্যপৃত ছিলন আজীবন। তাঁদের কোন একটি কর্ম বা কীর্তি বাংলা ও বাঙালিয়ানাকে দূর্বল করে তোলার সাধনায় নিয়োজিত ছিল না। আর আমদের সকল কর্ম ও কীর্তির মূল লক্ষ্যই হলো বিভেদের চর্চা। বিচ্ছেদের সংস্কৃতি ও বিদ্বেষের রাজনীতি। 


ফলে বিদ্যাসাগরের জন্মের দুইশত বছর অতিক্রমের স্মরণে আমাদের এই অসাধারণ অর্জনকে বিস্মৃত হলে চলবে না। বিদ্যাসাগরের অতুলনীয় কীর্তিসমূহের স্মরণ করতে হলে আমাদের এই অর্জনগুলির বিস্তৃত প্রেক্ষিতেই সেই স্মরণ করতে হবে। ভুমিকা যতই দীর্ঘ হোক, আমাদের বর্তমানের প্রকৃত অবস্থানকে অস্বীকার করে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া নেহাতই নিরর্থক। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা বিদ্যাসাগরের জন্মের দইশত বছর যেভাবেই স্মরণ করি না কেন, বিগত দুইশত বছরে বাঙালির সামগ্রিক ও সার্বিক অধঃপতনের ভিতে দাঁড়িয়েই সেই স্মরণ করা উচিত। না হলে তা নেহাতই লোকঠকানো কার্জক্রমের অন্তর্গত উদ্দেশ্য মাত্র। তার বেশি কিছু নয়। 


আলোচনার মূল পর্বে প্রবেশ করা যাক বরং বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের হাত ধরেই। বাঙালির ঘরে ঘরে শিক্ষার প্রথম আলো হাতে করে পৌছিয়ে দিতেই তাঁর এই অনন্যকীর্তি। শিক্ষার আলো যে মাধম্যে সবচেয়ে কার্যকর করে পৌঁছিয়ে দেওয়া যায়, সম্ভব। সেটি হলো মাতৃভাষা। লক্ষ্য করে দেখতে হবে সামান্য এই মানুষটি কিন্তু সেদিন বর্ণপরিচয় লিখেছিলেন বাংলাতেই। বাংলার ঘরে ঘরে আবোধ শিশুরা তাদের বোধের প্রথম উন্মেষ ঘটাবে বাংলা স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণের হাত ধরেই। ঠিক যেমন ইউরোপের স্বাধীন ও উন্নত জাতিসমূহ, নিজ নিজ মাতৃভাষায় সগৌরবে আপন শিশুকে প্রথম হাতেখড়ি দেয় শিক্ষার। ভুলেও কোন বিদেশী ভাষায় সেই কাজ করতে যায় না কালিদাসদের মতো। কিন্তু সম্মানীয় পাঠকবর্গ! মুখ আয়নায় আসুন একবার নিজেদের সেই বীভৎস মুখগুলি’র দিকে তাকিয়ে দেখি বরং। সেই সব নির্লজ্জ মুখচ্ছবিগুলি। অভিভাবক রূপে টলমল পায়ে হাঁটা দুধের শিশুদের যখন আমরা ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ইংলিশ মিডিয়ামের খোঁয়ারে বেঁধে দিয়ে আসি। কোথায় থাকেন তখন আমাদের দুইশত বছরের প্রাজ্ঞ অভিজ্ঞ বিদ্যাসাগর। আর তার বর্ণপরিচয়? বাড়িতে প্লাস্টিকের ইংলিশ আলফাবেট কিনে এনে আপন সন্তানদের বিদেশী আলফাবেটের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় কে? আমার আপনার বংশগত কোন শত্রু? নিশ্চয় নয়। বরং পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় পরিজনের সামনে কথা না ফোটা আপন শিশু যখন ‘হোয়্যার ইজ ইয়োর আইজ’ শুনে চোখে হাত দেয়, তখন কোন বাঙালি বাবা মায়ের গর্বে বুক ফুলে ওঠে না? কোথায় থাকেন তখন আমাদের সাধের বিদ্যাসাগর মহাশয়? এইসব মহামূর্খ বাবা মা তথা অভিভাবকমণ্ডলীর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য, যে কি অপরিসীম মূর্খতার চর্চা করে চলেছে বাঙালি? কোথায় রাখি আমরা তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি সেই বর্ণপরিচয়কে? না না, তার জন্য লজ্জিত হতে কোন বাঙালি আসে নাই অবনী তো পরে। 


এবারে আমাদের উচিৎ একবার চোখ খুলে দেখা। আজকের শিক্ষিত বাঙালি সমাজের বেআব্রু রূপটা। কাঁটাতারের উভয় পারেই যেখানেই বাংলা বা অন্যান্য জাতি সমূহের মানচিত্রে বিলীন বাংলার ভুখণ্ড। সেখানেই চিত্রটা কিন্ত এক ও অভিন্ন। শিক্ষিত বাঙালির ঘরে বর্ণপরিচয়ের আজ আর কোন অস্তিত্ব নাই। এমনকি অনেক পরিবারই আছে। বংশ পরম্পরায় বাংলার ভুখণ্ডে থেকেও যে পরিবারের কিশোর কিশোরীরা তরুণ তরুণীরা আজ আর বাংলা বর্ণমালার সাথে পরিচিত নয়। এক পাতা বাংলা পড়ার শিক্ষা অর্জন করে নি। কিন্তু নানান বিষয়ে নানান ডিগ্রী অর্জন করে ফেলেছে বিদেশী ভাষার টেক্সট মুখস্থ করে করে। সেই সব পরিবারে বংশে আজ আর বিদ্যাসাগর নাই। হাজার খুঁজেও উদ্ধার করা যাবে না একপাতার বর্ণপরিচয়। সদ্যজাত সন্তানের জন্য অভিভাবকরা ইংলিশ আলফাবেটের পিছনে ছুটবে। কিন্তু ভুলেও বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ে হাত লাগাবে না। না, মহাপণ্ডিত বিদ্যাসাগর স্বয়ংও এই পরিণতি আন্দাজ করে যেতে পারেন নি। যে জাতিকে নিজের পায়ে দৃঢ় চিত্তে দাঁড় করিয়ে দিতে ব্যয় করে ছিলেন সমগ্র জীবনকে, সেই জাতি যে আজ এই ভাবে বিদেশী ভাষার দাসে পরিণত হয়ে যাবে, এটা বিদ্যাসাগরের চিন্তার অতীত ছিল। 


সকলেই জানেন বিদ্যাসাগর অত্যন্ত সচেতন প্রয়াসে বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণে ইংরেজিকে বরণ করে নিয়েছিলেন। তিনিই হয়তো সর্বপ্রথম বাঙালি যিনি স্পষ্ট অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে ইতিহাস ভুগোল সাহিত্য দর্শন ধর্ম চর্চায় বাঙালির কোন ভবিষ্যৎ নাই। আর সেই সময়ে  অর্থাৎ আজ থেকে দুইশত বছর পূর্বে উচ্চতর এবং আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারেনি বাংলাভাষাও। তাই সেই সময়ের প্রেক্ষিতে ইংরেজিকে দূরে ঠেলে রেখে দিলে বাংলা ও বাঙালিকে চিরকাল পিছিয়েই পড়ে থাকতে হতো। এই সত্যটুকু উপলব্ধি করেছিলেন এই জ্ঞানতাপস। ঠিক যে সত্যটুকু উপলব্ধি করতে প্রায় এক শতাব্দী দেরী হয়ে গিয়েছিল বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠীর। ততদিনে তাঁরা জীবনের প্রায় সকল বিষয়ে পিছিয়ে পড়েছিল অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের থেকে। বিদ্যাসাগর অত্যন্ত সঠিক ভাবেই বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন, প্রায় এক সহস্রাব্দ সময় ব্যাপী আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থেকে সংস্কৃত ভাষা তার সমগ্র অতীত ঐতিহ্য ও জ্ঞানভাণ্ডার নিয়ে স্তব্ধ ও অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে রয়েছিল। অপর দিকে জনসাধারণের মুখের ভাষা না হওয়ার কারণে, সংস্কৃত একটি সমাজবিচ্ছিন্ন ভাষায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল। সেইরকম একটি ভাষা তার অতীত শ্রেষ্ঠত্বের সার্বিক অর্জন সাপেক্ষেও আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান শিল্প সংস্কৃতি সাহিত্য চর্চার পরিসরে প্রায় মৃত ও অকর্মণ্য একটি ভাষা। সেই ভাষাকে আঁকড়িয়ে ধরে রাখলে বাঙালির সলিল সমাধি অনিবার্য। ঠিক এই কারণেই বাংলায় বাঙালির উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর একেবারে সঠিক সময় মতোই ইংরেজিকে বরণ করে নিয়ে ছিলেন। এটিকে তাঁর ব্রিটিশ ভক্তি বা বিদেশী শক্তির গোলামী বলে যাঁরা ভাবেন, ভেবেছেন এতদিন। দুঃখের সাথেই বলতে হচ্ছে তাঁদের বর্ণপরিচয় পড়া বা ইংলিশ আলফাবেট মুখস্থ করে উচ্চতর ডিগ্রী লাভ সকলই বৃথা হয়ে গিয়েছে। স্বাধীন ও মৌলিক বুদ্ধিবৃদ্ধি ঘটে নি। খোলেনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তিও। অর্জিত হয় নি সত্যকে গভীর ভাবে উপলব্ধি করার সামর্থ্যও।


বিদ্যাসাগর অত্যন্ত সঠিক ভাবেই চেয়েছিলেন ইংরেজিকে বরণ করে নিয়ে, আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের শক্তিকে অর্জন করে নিতে হবে। এবং সেই শক্তির আলোতেই সমগ্র বাংলায় বাংলাভাষাকে নিজের পায়ে এমন ভাবেই দাঁড় করিয়ে দিতে হবে যে, সামগ্রিক ভাবে বাঙালি অচিরেই বাংলা ভাষাতেই আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা শুরু করে দিতে পারে। এবং আধুনিক ইউরোপীয় ভাষাগুলির মতো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু মানুষটি কল্পনাও করতে পারেনি, বাঙালি মাতৃভাষাকেই কোনঠাসা করে জীবনের মূল স্রোতে ব্রাত্য করে রেখে বিদেশী ইংরেজিকেই জীবন জীবিকার একমাত্র মাধ্যম করে নেবে। এবং পরবর্তীতে হিন্দীকেও সেই বিষয়ে বরণ করে নেবে। এই দূরদৃষ্টি থাকলে তিনি কষ্ট করে বর্ণপরিচয় ব্যকরণ কৌমুদী রচনা করা থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলাভাষার রূপরেখা তৈরীতে জীবনপাত করতেন কিনা সন্দেহ। আজীবন স্বাধীনচেতা এই মানুষটি নিশ্চিত রূপেই ইংরেজি ভাষার দাসত্বে বাঙালিকে এগিয়ে দিয়ে যেতে চাননি। চাননি বলেই আধুনিক কালের উপযুক্ত করে বাংলাভাষাকে দাঁড় করানোর প্রয়াস ছিল তাঁর। একথা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথাও নয়, বিদ্যাসাগরের মতো দৃঢ়চেতা স্বাধীন মনোবৃত্তির মানুষ বৈদেশিক ভাষা সংস্কৃতির গোলামী করাকে আধুনিকতা বলে মেনে নেওয়ার মতো নির্বোধ মানুষ ছিলেন না নিশ্চয়। ছিলেন না যে, সে তার আপন পোশাক পরিচ্ছদ আচার আচরণ কর্ম ও সাধনার দিকে লক্ষ্য রাখলেই সুস্পষ্ট বুঝতে পারা যায়। বুঝতে পারার কথা। যদি আমাদের ন্যূনতম বুদ্ধিবৃত্তি অবশিষ্ট থাকে। কিন্তু বাংলার সমাজ বাস্তবতায় সমগ্র বাঙালি জাতি বিগত দুইশত বছর ব্যাপী সময়সীমায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সেই কথা বুঝেও বুঝতে চায় নি। চোখ বন্ধ করে বিদেশী ভাষার দাসত্ব করে গিয়েছে। ও পরবর্তী প্রজন্মকে সেই দাসত্বের খোঁয়াড়ে জুড়ে দিয়ে গিয়েছে। এবং বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণী প্রয়োজনে বিদ্যাসাগের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে সুকৌশলে প্রচার করে গিয়েছে, বিদ্যাসাগর নাকি তাঁর দূরদৃষ্টিতে বুঝতে পেরেছিলেন ইংরেজি ছাড়া বাঙালির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সেই কারণেই তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে ইংরেজির ব্যাপক প্রচলনের সূত্রপাত করার চেষ্টা করে গিয়েছিলেন। এঁরাই মানুষকে দুই শতাব্দী ব্যাপী ভুল বুঝিয়ে এসেছে এই বলে যে, এই কারণেই আমাদের উন্নতি নির্ভর করছে ঘরে ঘরে ইংরেজি পৌঁছিয়ে দেওয়ার উপরেই। ইংরেজি শিখতে পারলেই বাঙালির উন্নতি। না পারলেই অধঃপতন। সত্যকে কিভাবে বিকৃত করে পরিবেশন করা যায়, ও তার সফল প্রচারে একটি গোটা জাতিকে কিভাবে চিরকালের জন্য শিরদাঁড়াহীন করে দূর্বল অপুষ্ট পরনির্ভর আত্মপ্রত্যয়হীন করে বিদেশী ভাষা ও সংস্কৃতির দাসত্বে বেঁধে রাখার বন্দোবস্ত করা যায়, তার এহেন দৃষ্টান্ত জগতে বিরল। বিদ্যাসাগরের সমগ্র প্রচেষ্টাকেই এইভাবে সম্পূ্র্ণ ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে। অত্যন্ত সফল ভাবে। আজ বিদ্যাসাগরের দুইশত বছর আসলে সেই সাফল্যেরই উদযাপনের উৎসব মাত্র।


পরাধীন বাংলায় জন্মে স্বাধীন ও অকুতভয় যে মানুষটি চিরদিন জাতির অন্তরে স্বাধীন মনোবৃত্তির উন্মেষের শক্তি জোগানোর জন্যে কালাতিপাত করেছিলেন। আজ তাঁর জন্মের দুইশত বছর বাদেও সেই জাতির অন্তরে কোন রকম স্বাধীন মনোবৃত্তির শক্তি সঞ্চারিত হয়ে ওঠে নি। 



সেই জাতি নিরন্তর অধিকতর শক্তিশালী জাতি সমূহের ভাষা আদবকায়দা পোশাক পরিচ্ছদ শিক্ষা ধর্ম ও সংস্কৃতিকে আপন করে নেওয়ার প্রাণান্তকর প্রয়াসে সামিল। এখানেই বাঙালির বিশেষত্ব। সে বাঙালি হয়ে উঠতে চায় না। সে অন্য জাতির নকল করে জাতে উঠতে চায়। এই জাতে ওঠার উদগ্র বাসনা। এবং সেই সাথে বাঙালি হয়ে থাকলে জাত খোয়ানোর ভয়, এই মনোবৃত্তিই বিগত দুইশ বছর বাঙালিকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। এখানেই বাংলায় বিদ্যাসাগরের প্রকৃত অবস্থান। কি অবিশ্বাস্য না? আমাদের এই মনোবৃত্তি এই প্রকৃতির জন্যেই বিশ্বকবিও আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করো নি’। এবং আমরা এতটাই বেহায়া, তারপরেও আমরা এমনভাবেই অধিকতর শক্তিশালী জাতির অনুকরণ প্রিয় নকলনবিশ রয়ে গেলাম। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি পোশাক পরিচ্ছদ ও আদব কায়দার নকল নবিশি করতেই আমাদের যাবতীয় উদ্যোম ও উদ্যোগ। বাঙালির এই মজ্জাগত প্রবৃত্তি নিয়ে আমরা বাঙালিই রয়ে গেলাম আজও। মানুষ হলাম না। তাই আজ একুশ শতকের গোড়ায় এসে আমরা ইংরেজির দাসত্ব করার সাথে সাথে সাধ করে হিন্দীর’ও দাসত্ব করতে গলা বাড়িয়ে দিয়ে হিন্দী হিন্দু হিন্দুস্তানের জন্য গলা ফাটাচ্ছি। ভাবতেই লজ্জা লাগে এইরকম দাস মনোবৃত্তির একটি জাতিতেই বিদ্যাসাগরের মতোন স্বাধীনচেতা বীরপুরুষের আবির্ভাব হয়ে ছিল স্মরণ করে। 


১৮৫৬ সালের ২৬শে জুলাই বিধবা বিবাহ আইন পাশ হল। আইনত স্বীকৃতি পেল বিধবা বিবাহ। তার পর কেটে গিয়েছে। ১৬৪ বছর। খুব কম সময় নয়। বাংলার সমাজে আজও কি বিধবা বিবাহ সর্বজনীন হয়ে উঠতে পেরেছে? আইনী স্বীকৃতি পাওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ। সফল আন্দোলনের মাধ্যমেও সেটি অর্জন করা যায়। রামমোহন বিদ্যাসাগর সেটি করে দেখিয়েছিলন। কিন্তু সামাজিক স্বীকৃতি অত সহজে মেলে না। বিশেষ করে বিধবা বিবাহের মতো একটি বিষয়। এখনো আমাদের অনেক পথ পারি দিতে হবে। বিদ্যাসাগর শুধুই যে বিধবা বিবাহের জন্য লড়াই করেছিলেন। তাও নয়। তিনিই প্রথম নারী শিক্ষার ভিত প্রস্তুত করেন। নারী শিক্ষার ভিত প্রস্তুতের প্রধান উদ্দেশ্য কিন্তু নারীর স্বনির্ভর হয়ে ওঠা। বিগত দেড়শো বছরেও সেটি কতটুকু সম্ভব হয়েছে, সেটি কারুর জানা বাকি নাই। নারীর স্বনির্ভরতার বিষয়টির ভিতরে অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল নারীপুরুষ সমানাধিকার। হ্যাঁ আইনত আজ তাইই। কিন্তু সমাজ বাস্তবতায় এই সমানাধিকার কতটা অর্জিত হয়েছে, আর কতখানি অর্জিত হয় নি, সেই বিষয়েও বিতর্কের অবকাশ নাই। বিদ্যাসাগরের কর্মজীবনকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অকুতভয় এই মানুষটি গোটা সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সমাজের অটল অনড় অন্যায্য প্রথাগুলির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর হিম্মত রাখতেন। কিন্তু আজ এই একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকে দাঁড়িয়ে কজন বাঙালির এমন অকুতভয় সাহস রয়েছে? না, একজন বাঙালিকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সম্ভবই নয়। এইযুগে রাজনীতির পরিসরের বাইরে, রাজনৈতিক শক্তির আশীর্বাদ ছাড়া কোন আন্দোলন সম্ভবই নয়। ফলে ব্যক্তিগত পরিসরে কোন বুদ্ধিজীবীই প্রয়োজনে সমগ্র সমাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর হিম্মত রাখেন না। কিন্তু বিদ্যাসাগর সেই হিম্মৎ রাখতেন। হয়তো পূর্বসুরী রাজা রামমোহন রায়ের কর্ম জীবনই ছিল তাঁর কাছে এই বিষয়ে প্রেরণা স্বরূপ। কিন্তু অকুতভয় সৎসাহস ছিল তাঁর একান্ত নিজস্ব অর্জন। বর্তমানের বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর ভিতরে এই রকম সবল মেরুদণ্ড আর দেখা যায় না। উল্টে গতানুগতিক গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে কেবলমাত্র ক্ষমতাসীন শক্তির কৃপাধন্য হয়ে পরজীবীর মতো বেঁচে থাকার ভিতরেই বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর যাবতীয় বুৎপত্তি। বিদ্যাসাগরের একেবারে উল্টোপুরাণ!


পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে অকুতোভয় এই মানুষটি যে কোন অন্যায় প্রথার বিরুদ্ধে প্রয়োজনে সমগ্র সমাজের বিরুদ্ধে হলেও রুখে দাঁড়ানোর হিম্মত রাখতেন। রাখতেন বলেই বিধবা বিবাহ আইন পাশ সম্ভব হয়েছিল। আজ থেকে সেই ১৬৪ বছর আগেই। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে বাঙালি হিসাবে আমরা এই শক্তি অর্জন করতে পারলাম না কেন?


 আজও তো বাংলার সমাজ ব্যবস্থায় কত রকমের অন্যায় প্রথার প্রচলন রয়েছে। বিগত দেড়শো বছরে সেইগুলি দূর করে বাঙালির সমাজকে সুস্থ সবল মানবিক করে তুলতে পারলাম না কেন আমরা? না, এই সব প্রশ্নের সম্মুখীন হতেও রাজি নই আমরা আজও। আজও আমাদের সমাজে শ্রেণীভেদ প্রথার মতো একটি চুড়ান্ত অমানবিক প্রথা বিদ্যমান। কোন দেশের কোন উন্নত সমাজে এই রকম ভাবে জাতপাতের উপর নির্ভর করে শ্রেণীভেদ প্রথা বিদ্যমান? ইউরোপ আমেরিকার উন্নত বিশ্বের দেশগুলির দিকে তাকিয়ে কোন একটি নির্দিষ্ট দেশের দিকে নির্দেশ করা সম্ভব হবে এই বিষয়ে? যেখানে সকল মানুষ সকল মানুষের সাথে একসাথে খেতে বসার আগে দশবার ভাবে। সমজাতের মানুষ তো সকলে? যেখানে পাত্রপাত্রীর বিবাহে সমজাতের পাত্রপাত্রী’র খোঁজ পরে সকলের আগে? যেখানে বিশেষ বিশেষ কাজ বিশেষ বিশেষ নীচু জাতের জন্য আজও নির্দিষ্ট থাকে? যেখানে দেশের মানুষের মূল পরিচয় নির্ধারিত হয় উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণের ভেদাভেদে? আমাদের বঙ্গসমাজে আজও এইসকল ভেদাভেদ বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। আজও আমরা মানুষের পেশা দিয়ে মানুষের বিচার করে থাকি। কে উচ্চ কে নীচ। কে সম্মানীয় কে নয়। কাকে তুই বলে সম্বধন করা যায়, কাকে যায় না। অথচ সেই আমরাই বিদ্যাসাগরের জীবনী লিখতে বসলে আহ্লাদে গদগদ হয়ে সেই ঘটনাটির উল্লেখ করতে ভুলি না। যেখানে রেলস্টশনে কুলির অভাবে সামান্য হাত ব্যাগ বহন করতে লজ্জিত বঙ্গতনয়ের হাতব্যাগ বহন করে দিয়েছিলেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয়। যিনি কোন কাজকেই ছোট মনে করতে পারেননি। পারেননি তাঁর জীবনবোধে। কিন্তু আমরা আজও ছোট কাজ বড়ো কাজের প্রভেদ করে চলি। নীচু জাত উঁচু জাতের বিভেদ করে চলি। এবং সেই মতো কাউকে বসতে আসন দিই। আর কাউকে দাঁড় করিয়ে রাখি। এমনই আমাদের শিক্ষার বহর। 


এবং শিক্ষাদীক্ষার এই মান নিয়ে, আমদের ভিতর একদল এই দেশে সাম্যবাদের স্বপ্ন দেখতেনও এককালে। ইউরোপের সাম্যবাদী তত্ব মুখস্থ করে। যে সমাজ জাতপাতের মজ্জাগত সংস্কৃতিতে শত ভাগে বিভক্ত। তারপরে সাম্প্রদায়িক কারণে বিভিন্ন ধর্মে বিভক্ত। এবং পরস্পরকে দাবিয়ে রেখে দমিয়ে রাখার চেষ্টায় উদগ্র সবসময়। সেই সমাজে ইউরোপীয়ান সাম্যবাদী তত্ব যে বিফল হতে বাধ্য, এই সামান্য জ্ঞানটুকুও আমাদের আজও হলো না। না হওয়ার কারণ সেই একটি জায়গাতেই বাঁধা। আমাদের যাবতীয় শিক্ষাদীক্ষা সেই বিদেশী আলফাবেট মুখস্থ করেই। বিদেশী ভাষার পাঠ্যপুস্তক মুখস্থ করে পরীক্ষায় বিস্তর নম্বর তুলে ডিগ্রী লাভ সহজ। কিন্তু স্বাধীন ও মৌলিক বুদ্ধিবৃত্তি এবং সুস্পষ্ট জ্ঞানার্জন অসম্ভব। তাই আমরা সকলেই ইংরেজি শিখে পণ্ডিতমূর্খ হয়েই রয়ে গেলাম। আর সেই কারণেই আমাদের পক্ষে অনুধাবন করা অসম্ভব যে বিদেশী সাম্যবাদী অর্থনৈতিক তত্ব স্বদেশী সমাজের উপরে চাপিয়ে দিলেই সমাজে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। আমাদের সমাজের সমস্যা ইউরোপের ঊনবিংশ শতকের সমাজের সম্যস্যার জেরক্স কপি নয়। তাই রুশ বিপ্লব এই বাংলায় সম্ভব নয়। আমাদের ভিতর এক দঙ্গল ইংরেজি ভাষায় পণ্ডিতপ্রবর সেই অসম্ভব কাজ করতে গিয়ে নিজেদের মূল্যবান জীবন ধ্বংস করে গিয়েছে। আর একদল সুবিধাবাদী শ্রেণীর মানুষ দাস ক্যাপিটাল হাতে করেই সমাজে কেস্টবিষ্টু হয়ে আখের গুছিয়ে নেওয়ার কাজ করে গিয়েছে। কিন্তু কেউই উপলব্ধি করতে পারে নি, সকলের আগে দরকার ছিল সমাজসংস্কারের। রাজ রামমহোন রায় আর বিদ্যাসাগর যে কাজের শুরুটুকুই করেছিলেন। তারপর আমরা আর সেই কাজে হাত লাগাই নি কোনভাবে। জাতপাতে বিভক্ত একটি সমাজ। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে জর্জরিত একটি সমাজ। উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণে পরস্পর দূরবর্তী একটি সমাজ। এবং ধনী দরিদ্রে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণে ন্যুব্জ একটি সমাজ। সেই সমাজের একেবারে অভ্যন্তর থেকে সমাজসংস্কারের কাজ শুরু করা ছাড়া বাইরের দেশ কালের রাজনৈতিক দর্শন ও অর্থনৈতিক তত্বের লেজুর ধরে সেই সমাজের বদল ঘটানো সম্ভব নয়। আমরা সেই কথা বুঝতে পারতাম। যদি আমাদের শিক্ষা স্বদেশী ভাষায় গড়ে উঠতো। যদি আমরা কোন নির্দিষ্ট বিদেশী ভাষার গোলামী না করতাম। তাই আমরা রামমোহন বিদ্যাসাগরের কাজকে আর একচুলও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারিনি। বা বলা ভাল, চাই নি। সমাজকে নানান ভাবে অবরুদ্ধ করে রেখে, বিদেশী ভাষা মুখস্থ করে ব্যক্তিগত জীবনের আখের গুছিয়ে নেওয়ার উপযুক্ত একটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি সফল ভাবে। না বিদ্যাসাগর এই শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করে জাননি। কিন্তু শিক্ষাক্রমে তাঁর ইংরেজি ভাষার উপর গুরুত্ব দেওয়াকে ছুতো করে আমরা সেই ফাঁক দিয়ে গলে বেড়িয়ে এসেছি। এসে গোটা জাতি ও সমাজকে ইংরেজি ভাষার গোলামীতে জুড়ে দিয়েছি। তাই কোথায় কোথায় সমাজসংস্কার করার দরকার ছিল। সেই মহামূল্যবান বিষয়গুলি উপলব্ধি করার শক্তি ও সামর্থ্য জন্মায়নি আমাদের। আমাদের সমাজিক পরিসরে আমরা গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসার কৌশলকেই বুদ্ধিমত্তা বলে প্রচার করে এসেছি সাফল্যের সাথে্। তাই প্রচলিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মতো বিদ্যাসাগরীয় মেধা ও মেরুদণ্ড তৈরীর কোন পরিসরই আর অবশিষ্ট রাখিনি আমরা। 


ফলে আজকের যুগে এই শতকে দাঁড়িয়ে কেউ আর সমাজসংস্কারের স্বপ্ন দেখে না। অন্যায় প্রথা ও কর্মের বিরুদ্ধে সরাসরি রুখে দাঁড়াতে পারে না। সকলেই আপনি বাঁচলে বাপের নাম বিশ্বাস করে গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে আত্মরক্ষার উপায় খোঁজে। আজকের বঙ্গসমাজের কোথাও বিদ্যাসাগরের কোন রকম প্রাসঙ্গিকতা আর অবশিষ্ট নাই। কোন বাবা মা’ই চান না, তাঁর সন্তান বিদ্যাসাগরের মতোন মহৎ হোক। অকুতোভয়ে সকল প্রকার অসাম্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াক। গোট সমাজটাকে সজোরে একটা ঝাঁকুনি দিক। সকল অভিভাবকই চান। বাছা আমার এ বি সি ডি মুখস্থ করে গ্রীনকার্ডের অধিকারী হোক। এই হলো আমাদের বঙ্গসমাজে বিদ্যাসাগরের উত্তরাধিকার। কি অসীম মূল্যেই না আমরা তাঁর শ্রাদ্ধ সমাপন করে আবক্ষ মূর্তি বসিয়ে পিণ্ডদান সম্পূর্ণ করেছি। 


না তাই বলে আজও যে তাঁর কার্যকারিতা সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছে তাও নয় কিন্তু। স্বঘোষিত বিশ্বের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের প্রদেশিক নেতার কথায় বিদ্যাসাগর এখন সহজপাঠ লিখছেন। রাজ্যের প্রধানের কথায় তিনি পথ হাঁটছেন মাইল আবিষ্কার করতে। রাজ্য নির্বাচনের বৈতরণী পার করতে তাঁর মূর্তি ভাঙতে হচ্ছে। একদলকে প্রচার করতে হচ্ছে বিদ্যাগরের তৈরী সনাতনী বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশী ভাষার থেকে রক্ষা করার জন্য হিন্দুসংহতি গড়ে তোলা আশু প্রয়োজন। কেউ আবার শোনাচ্ছেন বিদ্যাসাগরের বঙ্গলিপি আবিষ্কারের কথা। ফলে কেউ বসে নাই। কেউই ঘুমিয়েও নাই। সকলে জেগে আছেন। সজ্ঞানে আছেন। এবং অনেকেই আছেন দুইশত বছরের পুরানো বিদ্যাসাগরকে নিয়েই। নানা রকম স্বার্থের সাথে জড়িয়ে গিয়ে ১২৯ বছর আগে মৃত মানুষটি যেন জন্মের দুইশত বছর পূর্তীতে নতুন করে নবজন্ম লাভ করছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরের আঁতুর ঘরে। সকলেরই বক্তব্য যেন এক। বিদ্যাসাগরের স্মরণে জয়যুক্ত করুন অমুক চিহ্নের প্রার্থীকে। না, এমন স্লোগান এখনও কোথাও দেওয়াল লিখন হয়ে আত্মপ্রকাশ করে নি। কিন্তু কখনোই করবে না, বলা যায় না তেমনটি। 


আর আমরা সাধারণ মানুষ? আমাদের দৈনন্দিন আমোদের এত সব আয়োজনে আমরাও খুব খুশি। আমরাও দলে দলে সেই সব নেতানেত্রী, রাজনৈতিক শিবিরের চারপাশে ঘুরঘুর করছি। ভিড় করছি তাদের মিটিং মিছিলে। কে বলতে পারে বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে আরও নতুন নতুম চমকপ্রদ নানান রকমের টক ঝাল মিষ্টি তথ্যের উদয় হবে না সুউচ্চ মঞ্চ থেকে? আমাদের একঘেয়ে জীবনের স্বাদে এমন চানাচুর বিতরণের মতো আমোদের সুবন্দোবস্ত করছেন যাঁরা, তাঁদের প্রতিও তো আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত নাকি? দুইশত বছরের প্রাচীন ও বাতিল একটি মানুষকে ভুলে যাওয়ার থেকে এইভাবে স্মরণ করাই বা কম কি? রাজনীতিই করুন আর যাই করুন। তবু তো এনাদের হাতেই বেঁচে উঠলেন মৃত বিদ্যাসাগর। 


২৭শে সেপটেম্বর’ ২০২০

কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.