পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিবেশ ও সংস্কৃতির একটা বড়ো পরিবর্তন সূচীত হয়েছিল ২০১১ সালে। নির্বাচনী ফলাফলের হাত ধরে সরকার বদলের ভিতর দিয়ে। তারপর সারদা নারদা। এবং ২০১৬’র নির্বাচনের পরপর হিন্দুত্ববাদী শক্তির আত্মপ্রকাশের পর পরই দুই রাজনৈতিক শিবিরের পারস্পরিক যুদ্ধ। ক্ষমতার আস্ফালন। পেশি শক্তির প্রদর্শন। ২০১৯’এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের হাত ধরে বেলাগাম রাজনৈতিক পেশি শক্তির আস্ফালন লাগামছাড়া ভাবে বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে চলেছে রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের অনৈতিক হুঙ্কারের সদম্ভ আস্ফালন। কে কত খারাপ ভাষা প্রয়োগে সিদ্ধহস্ত। শুরু হয়েছে তারই প্রতিযোগিতা। কে কত নৃশংস মনোবৃত্তির ধারক ও বাহক, চলছে তারই বেআব্রু প্রদর্শনী। এই আবহে নতুন একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরী হয়ে গিয়েছে। রাজনীতি করে দাঁড়াতে গেলে আগে অসভ্য হতে হবে। অসৎ হতে হবে। নৃশংস হতে হবে। এই তিনটি বদদোষ না থাকলে, এরাজ্যের রাজনীতিতে কল্কে পাওয়া যাবে না। বিগত শতক থেকে ক্রমাগত রাজনৈতিক সংস্কৃতির অধঃপতন শুরু হলেও অবস্থা এতটা ভয়াবহ ছিল না। হাতে গোনা কয়েকজনের ভিতর এইসব বদ দোষের সমাহার দেখা গেলেও সার্বিক রাজনৈতিক পরিবেশের পরিসর এতটা কলুষিত ছিল না। কিন্তু সাড়ে তিন দশকের বাম শাসনের অবসানের হাত ধরে। এবং ভারতবর্ষে চরম হিন্দুত্ববাদী ক্ষমতালোভী শক্তির দ্রুত উত্থানের ভিতর দিয়ে এক নতুন রাজনৈতিক সংগা তৈরী হয়ে চলেছে।
আমরা একথা বলতে পারি না, এই শতকের আগে রাজ্য রাজনীতিতে অসভ্য অসৎ নৃশংস নেতানেত্রী ছিল না। কিন্তু সেই সংখ্যাটি সংখ্যাগুরু ছিল না। সার্বিক ভাবে একটা আড়াল ছিল। এই শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে সেই আড়ালটুকু সম্পূর্ণ খসে গিয়ে সংখ্যালঘু কদর্য সংস্কৃতিটিই সংখ্যাগুরুর সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরও একটি ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ করতে গেলে নতুন একটি মাপকাঠি তৈরী হয়েছে। সেটি হলো রাজনীতিতে প্রবেশ করতে হলে আগে অশিক্ষিত হতে হবে। শিক্ষিত হলে, তাঁর রাজনৈতিক নেতা হওয়ার যোগ্যতা থাকবে না। অসৎ অসভ্য এমন কি নৃশংস হলেই হবে না। সবার আগে অশিক্ষিত হতে হবে। আবার শুধু অশিক্ষিত হলেই হবে না। রাজনৈতিক ভাষণে। সাংবাদিক সম্মেলনে। নির্বাচনী বক্তৃতায় এবং আইন সভায়, সর্বত্র নিজের অশিক্ষিত পরিচয় রাখতে হবে। যে রাজনৈতিক নেতা যত বেশি অশিক্ষিত হবে, তার রাজনৈতিক শক্তি তত বেশি হবে।
আবার ভারতবর্ষের সাথে সাথে আমাদের এক টুকরো বাংলাতেও রাজনৈতিক সংস্কৃতির নতুন একটি অভিমুখ খুলে গিয়েছে। সেই অভিমুখে যে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে যতগুলি ফৌজদারী মামলা ঝুলতে থাকবে, তার নির্বাচনে জেতা তত বেশি নিশ্চিত হবে। এই ধরণের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভারতের অন্যান্য অংশে যতটা ব্যাপক ছিল। আমাদের রাজ্যে ততটা ব্যাপক ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকে সেই রোগ এই বাংলাকেও গ্রাস করে ফেলেছে প্রায়। এখন আসুন আর একবার দেখে নেওয়া যাক। এই রাজ্যেও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো রাজনৈতিক নেতা হতে গেলে কি কি যোগ্যতা লাগে। প্রথম যোগ্যতা প্রকৃত অশিক্ষিত হতে হবে। দ্বিতীয় যোগ্যতা পুরোপুরি অসৎ হতে হবে। তৃতীয় যোগ্যতা অসভ্য হতে হবে। চতুর্থ যোগ্যতা মিথ্যাবাদী হতে হবে। পঞ্চম যোগ্যতা নৃশংস হতে হবে। এবং ফৌজদারী মামলায় অভিযুক্ত হলে সোনায় সোহাগা। নির্বাচনে দলের হয়ে নিশ্চিত আসন জেতা প্রার্থী হিসাবে বিবেচিত হতে গেলে এই সকল বদ দোষ থাকা একান্ত জরুরী।
না এটা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ছিল না। ২০১১’র আগে থেকেই রাজ্য রাজনীতির পরিসর কলুষিত হতে শুরু করলেও, অবস্থা এতটা ভয়াবহ ছিল না। অনেক সংখ্যক শিক্ষিত সুসভ্য সৎ এবং শান্তিকামী রাজনৈতিক নেতানেত্রীর দেখা পাওয়া যেত। রাজনৈতিক মতাদর্শগত একটা অভিজাত্যও বর্তমান ছিল অনেকের ভিতরে। কিন্তু ২০১১’র পরিবর্তন ও ২০১৪’র ভারতব্যাপী হিন্দুত্ববাদী উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের ফলে এই রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রায় একশো আশি ডিগ্রী বদলিয়ে গিয়েছে।
এর একটি চমকপ্রদ প্রভাব পড়েছে রাজ্যবাসীর উপরে। আগে কল্পনা করা যেত না, অন ক্যামেরা ঘুষ নেওয়া কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারবেন। ২০১৬’র নির্বাচনে সেই অভাবিত ঘটনাও স্বাভাবিক হয়ে দেখা দিল। একই দলের এক ডজন নেতানেত্রীকে অন ক্যামেরা ঘুষ খেতে দেখেও রাজ্যবাসী সেই দলকেই ঐতিহাসিক ফলাফলে বিজয়ী করে নিয়ে আসলো। এর ফল কিন্তু মারাত্মক। রাজনৈতিক নেতৃবর্গ দেখে নিল, সারদা নারদা করেও হেসে খেলে ভোটে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতা ধরে রাখা যায়। তাই প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শিবির স্পষ্ট বুঝতে পারলো এই রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে গেলে সারদা নারদা ঘুষকাণ্ড কাটমানি রাজনৈতিক অসততা এইগুলিকে ইস্যু করে কোন লাভ নাই। জনগণ এইসব ইস্যুর বিরুদ্ধে নয়। উল্টে জনতা সেই দলকেই বেশি ভোটে নির্বাচিত করবে যে রাজনৈতিক দল এইসব অনৈতিক কাণ্ডে যত বেশি মদত দেবে। তাই তাদের হাতে পড়ে থাকলো বিভাজনের রাজনীতির এক একটি তুরুপের তাস। সাম্প্রদায়িক বিভাজন। অনুপ্রবেশের রাজনীতি। ধর্মীয় উন্মাদনা। রামমন্দির। গোরক্ষা। গোমূত্র সেবন ইত্যাদি। ফলে এই সকল নন ইস্যুগুলিকে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করতে গেলে লাগাতার মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যেতে হবে। প্রয়োজনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতে হবে। এবং অনুপ্রবেশের রাজনীতির ভিতর দিয়ে মিথ্যা নাগরিকত্ব প্রদানের আশ্বাস দিয়ে জনতাকে বিভ্রান্ত করতে হবে। জনতা যত বেশি বিভ্রান্ত হবে। তত বেশি ভোট ঝুলিতে পড়তে থাকবে। আর জনতাকে বিভ্রান্ত করতে মিথ্যা প্রচারের সাথে আরও একটা কাজ করে যেতে হবে। সেটি হলো অসংলগ্ন যুক্তিহীন কথাবার্তাকে রাজনৈতিক ভাষণ বলে প্রচার করা। কুরুচিকর মন্তব্য ও অশালীন আচরণকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে সমার্থক করে তোলা। এবং বেআব্রু পেশি শক্তির লাগাতার আস্ফালন চালিয়ে যাওয়া।
জনগণ অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী দুর্বৃত্তদের আশ্রয়ে থাকাই আজকাল বেশি নিরাপদ বলে মনে করে। এই সোজা কথাটুকু রাজ্যের প্রধান দুই রাজনৈতিক শিবির স্পষ্ট করে বুঝে গিয়েছে। আর তার ফলেই রাজ্যব্যাপী সহিংস রাজনীতির রমরমা শুরু হয়ে গিয়েছে কাকদ্বীপ থেলে কালিঙপং অব্দি। পুরুলিয়া থেকে আলিপুরদূয়ার অব্দি। কে কার থেকে বড়ো দুর্বৃত্ত। কে কার থেকে বেশি খারাপ। কে কার থেকে আরও ভয়ানক। সেই ভয়ভীতি প্রদর্শনের রাজনীতিই এখন রাজ্য রাজনীতির মূলধারার সংস্কৃতি।
সকাল থেকে সন্ধ্যা প্রধান দুই রাজনৈতিক শিবিরের নেতানেত্রীর মুখনিঃসৃত বাণীগুলি পরপর বাঁধিয়ে রাখলেই এই নব্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির সুস্পষ্ট ছবি ধরা পড়বে। দিনভর ঘটে চলা রাজনৈতিক সহিংসতার ছবিগুলি পরপর ধরে রাখলেই এই নব্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির ছবি বেআব্রু হবে। তাতে যাই হোক, সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতানেত্রী আদৌ লজ্জিত হন না। এবং সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলি একে অপরের বিরুদ্ধে কাদা ছোঁড়াছঁরি করে দায় সারে। সবচেয়ে মজার কথা হলো। সাধারণ জনতার তাতে কোন রকম হেলদোল দেখা যায় না। জনতার চিন্তাধারায়, এটাই সঠিক রাজনৈতিক আবহ। জনতার ধারণায়, রাজনৈতিক নেতা মাত্রেই অশিক্ষিত অসৎ অসভ্য মিথ্যাবাদী ও নৃশংস। তাই নেতানেত্রীরা যাই করুন না কেন, সেটি তাদের রাজনৈতিক ধর্ম ও প্রকৃতি। স্বভাব ও চরিত্র। তার বাইরে তাঁদের কোন অস্তিত নাই। থাকতেই পারে না। এবং জনতা খুব ভালো করেই জানে। এইসব অসাধু ব্যক্তিবর্গকে ক্ষমতায় পৌঁছিয়ে দিতে পারলেই আখেরে নানান ধরণের অনৈতিক সুযোগ সুবিধা আদায় করে নেওয়া সহজ হবে। তাই জনতার একটা বড়ো অংশই এই অসৎ রাজনীতির চারপাশে ঘুরঘুর করে। অসাধু নেতামন্ত্রীদের জনসভায় ভিড় বাড়ায়।
ফলে রাজ্য রাজনীতির পরিসরে রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক নেতানেত্রী, ও সংখ্যাগুরু ভোটার সকলেই এই রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই সপক্ষে দাঁড়িয়ে। এর বাইরে যাঁরা, তারাই প্রকৃত সংখ্যালঘু। তারা নিরব। নির্বাক। ছত্রভঙ্গ। তাদের একত্র করার মতো কোন নেতা বা পথ নাই। তাদের ভোটের কোন মূল্যও নাই। তাঁরা অধিকাংশই ভোটযন্ত্রের থেকে দূরে থাকাই শ্রেয় বলে মনে করেন। যার ফলে সম্পূর্ণ ফাঁকা মাঠে এক পক্ষের রাজনৈতিক সংস্কৃতিই বাজিমাত করে চলেছে বছরের পর বছর ধরে। সামনে পড়ে রয়েছে আরও আরও বাজিমাতের বছর।
১১ই সেপটেম্বর ২০২০
সুচিন্তিত মতামত দিন