"হ.......সিং ........হ ....... সিংহ ......প্রদোষবাবু, সিংহ"
চিৎকার করতে লাগলাম। প্রদোষবাবুরা শুনতেই পেলেন না, আমার বুকে বেঁধা ছুরিটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কি মুশকিল মরে তো গেছিই, খারাপ তো সবচেয়ে বেশি আমারই লাগছে, কিন্তু বুড়োকর্ত্তাবাবু প্রিয় গনেশটা হারিয়ে প্রচন্ড ভেঙে পড়বেন। আশ্চর্য, আমি এতো চেঁচাচ্ছি কেউ শুনতে পাচ্ছেনা!
ইস, ছুরিটা কি বাজেভাবে বিঁধেছে দেখো! রুপুবাবুর মতন করতে বলতে ইচ্ছে করছে - গ্যালগ্যাল করে রক্ত বেরোচ্ছে! রুকুবাবুটা দেখতে একদম ছোট্ট মিষ্টি একটা প্রাণী, কিন্তু আসলে ধানিলঙ্কা। ঠাকুর বানানোটা মন দিয়ে দেখলো এবারে, একটু হাতেপায়ে বেড়েছে তো! গতবছরই তো প্রদীপের তেল উল্টে সেই তেল হাতেপায়ে মেখে "রঘু ডাকাত" সাজার চেষ্টা করছিলো। দাদাবাবু বড্ড বকেছিলেন ওকে! দাদাবাবুকেও দোষ দেওয়া যায় না, ঐরকম দস্যি ছেলে নিয়ে নাজেহাল!
কিন্তু প্রদোষবাবু, সিংহটার কথা কিকরে বোঝাই বলুন দেখি আপনাকে! আপনাকে তো বেশ বুদ্ধিমান বলেই মনে হয়! সিংটুকু বলতে পেরে দমটা বেরিয়ে গেলো। হ-টাও বললাম, কিন্তু ছুরিটা এতো বিচ্ছিরি জায়গায় বিঁধেছে, হ-টা বুঝতে পারলেন না মশাই!
আচ্ছা আমার এখন কি করা উচিত? আমার শরীরটা একদম রাস্তায়, নোংরায় পড়ে আছে! কাল থেকে পুজো। উফ কি যে বেয়াক্কেলে খুনী, পুজোটা পার করে খুনটা করতে পারতো! তবে ভাগ্যিস এ বছর অবধি আমার ঠাকুর-গড়াটা হয়ে গেছে! সারাজীবনের সম্পর্ক ও বাড়ীর পুজোর সাথে, কাজটা শেষ না করতে পারলে বড় কষ্ট হতো!
যাই, ওই বাড়িতেই যাই। ক্লান্ত লাগছিলো বলেই বাড়ি আসছিলাম। এখন তো আর ঘুম নেই, ক্লান্তি নেই, ঠাকুরকেই দেখি। জলে ভাসালেই তো সব শেষ! এ বাবা! জলে ভাসালে গণেশও তো জলে ভেসে যাবে! উফ সত্যি বাবা, এই রুপুবাবুর কীর্তিকলাপ! ইশ কেন যে বেঁচে থাকতে গনেশটা সরিয়ে নিলাম না! এখন তো ভূত হয়ে গেছি, মায়ের গায়ে কি হাত দিতে পারবো? আর পারলেও কি হাত দেওয়া উচিত হবে? বরং আমি বসে পাহারা দিইগে! যাতে আর কেউ নিতে না পারে!
প্রদোষবাবু, আপনার দিকে যে ওই ঘুলঘুলির আড়ালে বন্দুক তাক করা আছে, দেখতে পাচ্ছেন না! অবশ্য দেখবেনই বা কিকরে? মগনলালের ওই ঠান্ডা ছুরির মতন হাসি, আমি ভূত হয়েও ভয় পাচ্ছি। অর্জুনের খেলা কিন্তু সাংঘাতিক! একবার বুড়োকর্ত্তাবাবুর সারা পরিবারের সাথে মহারাজের সার্কাস দেখতে গেছিলাম, তখনও অর্জুন মগনলালের কাছে আসেনি। কি যে সুন্দর মেয়েটা, আহা গরীবঘরের ছেলেমানুষ মেয়ে নিশ্চয় - তার দিকে অর্জুন ছুরি মারছিলো। কি বলবো আর, যা ভয় পেয়েছিলাম! আপনি মানুষটা সাহসী, কিন্তু আসলে ভালো। আর লালমোহনবাবু তো নিরীহ-গোবেচারা। তপেশভাই কোনো কাজের নয়, অবশ্য মগনলালের পোষা গুন্ডার সামনে কে আর কি কাজ করবে?
যাই, আমি বরং ঘুলঘুলির মধ্যে বসে থাকি, লোকটা আপনার দিকে গুলি ছুঁড়লে আমি বন্দুকের নলাটা ঘুরিয়ে দেব, যাতে আপনাদের গায়ে না লাগে!
আচ্ছা, এতো বুদ্ধি আপনার, বিকাশবাবুকে আপনার সন্দেহ হয়না! বিকাশবাবুর পদবী তো সিংহ! বিকাশবাবুকে নিয়ে একটু ভাবলেও আপনি গনেশটা পেয়ে যেতেন! বুঝি আপনি আমার হত্যাকারীকেও খুঁজছেন, কিন্তু সত্যিই আর আমার কিছু যায় আসে না। আমার হত্যাকারী শাস্তি পেলেও আমি তো বেঁচে ফিরবো না।
ও হরি! বুড়োকর্ত্তাবাবু নিজেই সব জানেন! রুকুবাবুর সাথে তলেতলে এতো সাঁট? যাক বাবা, নিশ্চিন্ত হওয়া গেলো। আমি যা ভয় পাচ্ছিলাম! গণেশ বুঝি চলেই যাবে! তবে এই বিকাশবাবুটার ওপর আমার বড্ডো রাগ হচ্ছে! লোকটা কি বেঈমান! এ বাড়ির খাস-পরিস আবার এ বাড়িতেই গত্ত খুঁড়িস? নাঃ ওকে একটু সাজা না দিতে পারলে খুব মুশকিল। কি করি .......কি করি....... কি করি! হ্যাঁ, পেয়েছি - আমি বরং রেডিওটা চালিয়ে রাখি, আওয়াজটা কম করে। আপনার বুদ্ধির ওপরে আমার আস্থা বাড়ছে প্রদোষবাবু, আমার বিশ্বাস আপনি ঠিক খুঁজে পাবেন এই সূত্রটা!
ধন্যি বুড়োকর্ত্তাবাবু, নকল গণেশ নিয়ে আপনি নাতির সাথে এতবড় খেলাটা খেললেন! আপনার বুদ্ধির সত্যিই কোনো তুলনা নেই। তবে প্রদোষবাবু একালের ছোঁড়া হয়েও কিন্তু ধরে ফেললো! তবে যাবার আগে আপনাকে এটুকু জানাতে খুব ইচ্ছে করছে। আপনার খামখেয়ালি বুদ্ধির শিকার কিন্তু এই নিরপরাধ আমি হলাম। নাঃ, আপনাকে দোষ দিয়ে, খুনীকে শাস্তি দিয়ে আমি তো আর ফিরবো না! অভিযোগ নেই কিচ্ছু। আমাকে আপনারা সারাজীবন অনেক জায়গা দিয়েছেন। আমি মরেছিও কাশীর মাটিতেই, তাই এমনিতেও আমার কোনো অভিযোগ নেই! আমার এবাড়িতে কাজ শেষ। আজ থেকে আমি চললাম মণিকর্ণিকাতে। অপঘাতে মৃত্যু বলে মুক্তি পেতে দেরী হবে, তবে সারাজীবন পাপ করিনি বলে আমার কোনো যন্ত্রণাও নেই। রুকুরা আজ ফিরে গেলো। আসছে বছর পুজোর আগে আবার আসবো এবাড়ির পুজো দেখতে, নতুন কুমোরের কাজ দেখতে, রুকুবাবুকে দেখতে। ততদিন আপনারা সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
সুচিন্তিত মতামত দিন