কোন রঞ্জন ? দক্ষিণারঞ্জন না বিয়োগ-রঞ্জন !
নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজ জানতো ‘রক্তকরবী’র রঞ্জন। দক্ষিণারঞ্জন জানতো ঠাকুমা-ঠাকুরদাদার ঝুলির সন্ধান। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় জানে কেচ্ছা-কাহিনির সন্ধান। তিন রঞ্জন নিয়েই আমাদের বাঁচা। যে যেমনভাবে বাঁচতে চায়। দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের সাহিত্যে কথকতা ছিল। ছিল রূপকথা, উপকথা, লোককথা। বহুবছর ধরে বাঙালি বহন করে চলেছে নিজের সংস্কৃতিকে। হ্যাঁ একে আমি কালচারই বলছি। শুধু বাঙালি নয় পৃথিবীর যেকোন জাতিরই এই কালচার ছিল। ধীরে ধীরে আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে উপড়ে ফেলতে চাইছি। এমনকি ফেলেওছি। টম জেরি, ছোটা ভীম, কি রূপকথা, লোককথা, উপকথারও উত্তর আধুনিক সংস্করণ নয় ? খাঁটিকে দূরে রেখে মেকিতে ভুলছি। খাঁটি দুধের কেইবা কোনদিন কদর করেছিল ! প্রসন্ন গোয়ালিনীরা তো খাঁটি দুধই বিক্রি করত। মঙ্গলাদের স্থান দখল করল অধিক দুগ্ধশীল গাভী। খাঁটি দুধ হারিয়ে গেল। কেউ কেউ দুধের স্বাদ গোরুর ছবি দেওয়া আমুল দুধে মেটাতে চাইল। বাজার দখল করল ট্রম জেরিরা। উত্তর আধুনিক যুগের ঠাকুমাদের দায়িত্বও ফুরিয়ে গেল। কিন্তু কেউ কেউ তো ঐতিহ্যের প্রতি দায়িত্বশীল। কিন্তু আজ কি আর রূপকথা লেখার প্রয়োজন আছে ? হ্যাঁ আছে। আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে ভুলে যাব কেন ! পীযূষ ভট্টাচার্যদের বেছে নিতে হয় উপন্যাসের ফর্ম।
গত শতকের আটের দশক থেকে মার্কেজের ‘One Hundred Years of Solitued ‘ বাংলা সাহিত্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করল। লেখকদের চিন্তা-চেতনাকে বেশ কিছুটা নাড়িয়ে দিয়ে গেল। না এভাবেও ভাবা যেতে পারে। লেখকরা আয়ত্ত করলেন নতুন কৌশল। জাদুবাস্তবতাকে কেউ কেউ কুহক বাস্তবতা বলতে চাইলেন। এ কৌশলের জন্য প্রয়োজন হল ভারতীয় রূপকথা, লোককথা। বাংলা পুরাণ ও মেথডোলজিকে নানা পরিসরে লেখকরা ব্যবহার করলেন। পীযূষ ভট্টাচার্য রূপকথা, উপকথা, লোককথা নিয়েই আঁকড়া বাস্তবতার সন্ধানে গেলেন। সেখানে প্রবেশ করে গেল নিজস্ব দর্শন ও রাজনৈতিক চেতনা। বঙ্গীয় ঐতিহ্য ও জনজীবনের ইতিহাস তো জানাই ছিল সঙ্গে যুক্ত হল আখ্যান কীভাবে পরিবেশিত হবে। নিছক বিনোদনের কাহিনি নয় পাঠকের মস্তিষ্ক, চিন্তা-চেতনাকে দংশন করতেই যেন আখ্যান লিখে বসেন। বলা ভালো এক ঘোর কুজ্ঝটিকা সৃষ্টি করেন, যার পরতে পরতে থাকে বিভ্রম। সে বিভ্রমকে অতিক্রম করেই বাস্তবতার সন্ধানে পৌঁছে যেতে হয়। এমনই এক উপন্যাস ‘তালপাতার ঠাকুমা’।
উপন্যাস শুরুই হয় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের খেলা দিয়ে। কেবল ঠাকুমাই বিশ্বাস করতেন। নইলে রূপকথা হয় না। বিশ্বাসের মধ্য দিয়েই বেঁচে থাকা যায়। অন্তত ঠাকুমারা তাই মনে করত। শুধু তিনি নিজেই বিশ্বাস করেননি, পুত্রবধূকেও বিশ্বাস করিয়েছেন। নবীন প্রজন্ম সহজেই বিশ্বাস করতে চায় না রূপকথার সত্যকে। সংগত কারণে নাতির মুখ দিয়ে কাহিনি এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। প্রয়োজন হয় নদীর। নদী পথের চিত্র আঁকতে হয়। নইলে রূপকথা বইবে কোন খাতে ! কিন্তু নদী মানেই তো বিপদের সংকেত। ঠাকুমা ও পুত্রবধূকে আতঙ্কের মধ্য দিয়ে দিন যাপন করতে হয়। এ যেন এক পাপবোধ, অপরাধ বোধ। যে বোধ ভয়ের জন্ম দেয়। ভয় না হলে রূপকথায় বিশ্বাসের জন্ম হয় না। ঠাকুমা ভয়ে নদীতে যান না। নদী ডুবিয়ে দেয়। নদীতে আছে স্রোত। স্রোতে সব ভেসে যায়। রূপকথা ভেসে যায়। পূর্বপুরুষ ছিল অত্যাচারী, হাতিকে নলের ভিতর দিয়ে ইঁদুর বানিয়ে দিয়েছিল। আপাত দৃষ্টিতে উদ্ভট মনে হলেও লুকিয়ে থাকে ভয়ংকর অত্যাচার। সামন্ততান্ত্রিক অত্যাচার। জমিদার সাধারণ মানুষকে ইঁদুরে পরিণত করেছিল। হাতিকে ভয় পায়। কিন্তু ইঁদুর ? সেও তো ফসল নষ্ট করে। তবে আড়ালে, পরিমাণে কম। বংশের ইতিবৃত্তের শুরু কবে থেকে ঠাকুমা বা মা কেউই জানেন না। ফলে মনে মনে একটা সময় পর্ব অনুমান করতে হয়। চলে যেতে হয় ইতিহাসের জগতে। আমাদের সভ্যতা তো নদীকেন্দ্রিক। নদীর মানচিত্র আঁকতে হয়। শাস্ত্রে নানা প্রায়শ্চিত্ত ও আত্মনির্যাতনের প্রসঙ্গ আছে। যিনি এসব করেছেন তিনি বীর। থাকে বীরের চিহ্ন নির্ণায়ক মাপকাঠি। রূপকথা এভাবে গড়ে ওঠে। অত্যাচারের বয়ান যেভাবে গড়ে ওঠে। অত্যাচারের স্থান মানুষ মনে না রাখলেও কাহিনি ছড়িয়ে যায়। কাহিনির রূপান্তর ঘটে যায়। শাখা-প্রশাখার জন্ম হয়। তবে অত্যাচারের ইতিবৃত্ত ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পরে। এমনকি ইউরোপ পর্যন্ত। আসলে রূপকথার রূপান্তর ঘটে। বঙ্গীয় রূপকথা ইউরোপে ছড়িয়ে গিয়েছিল। বিধবাদের গর্ভপাত বৈধ হলেও অসবর্ণ বিবাহ বৈধ নয়। লুকিয়ে থাকে যৌন হেনস্তার প্রসঙ্গ। ভোগের প্রসঙ্গ।
সেজোদাদু দুইজন-বড়, ছোটো। ছোটো সেজোদাদু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের সেনা বাহিনীতে যোগ দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। তিনি এক গ্রীক মহিলা বিবাহ করেন। গ্রীক তো রূপকথার দেশ। লেখকের অদ্ভুত বয়ান কৌশল। ভারত-ইউরোপ-গ্রীক। কীভাবে রূপকথা পরিক্রমা করে চলেছে অতীতে তা যেন লেখক আড়ালে বলে দেন। তবে দাদু বিবাহের জয়েন্ট ছবি পাঠায়নি। কেন পাঠায়নি তা আমরা জানি না। বিবাহ বৈধ না অবৈধ তাও জানি না। জানার প্রয়োজন হয় না। তিনি আর ফেরেননি। সম্পত্তি কথকের দাদুকে দেওয়া হচ্ছে। নিজের ভাইকে দেননি। তিনি ছিলেন নেতাজির সমর্থক। গ্রীক মহিলার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সকলে প্রকৃত তথ্য ভুলে যায়। যৌনতার ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সকলে স্ত্রীকে নিয়ে যৌনতায় মেতে ওঠে। নির্জন দুপুরে চলে যৌন সঙ্গম। দশমাস পরে সন্তান জন্ম নেয়। কথকই একমাত্র পুত্র সন্তান, বাকি বারোজন কন্যা সন্তান। দাদু ঠাকুমাকে জলপরি বানিয়ে দিয়েছিল। চলে সম্পত্তি উদ্ধারের চেষ্টা। দাদুকে অলক্ষ্যে রেখেই চলে ভাগ। এ যেন রূপকথা গড়েও গড়ে না। বাস্তব এসে যায়। পিকদানিতে পিক ফেলতে গিয়ে রক্ত ঝরে । শোষকের রক্ত। অত্যাচারের রক্ত পানের সঙ্গে মিশে থাকে। সিদ্ধান্ত হয় দাদুকে বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে। উঠে আসে দাঁত ব্যথার প্রসঙ্গ। দুধের দাঁত ওঠা ও গড়া। সিংহাসন ভাঙা-গড়া। জমিদারের শ্রেণি পরিবর্তন। কলিমুদ্দিন জলভর্তি গামলার সামনে হাঁ করে বসে মন্ত্র আওড়ায়। যা বোঝা যায় না। আখ্যানও যেন দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। রূপকথা তো মাঝে মাঝে দুর্বোধ্য হয়। সব অলীক, অলৌকিক হয়ে যায়। বালক রূপকুমারের দাঁত ওঠানো হবে। দাঁত ওঠানোর বিজ্ঞাপনে লেখা থাকে –‘রক্তপাতহীন দন্ত উৎপাটন’। ভাষাগত জটিলতায় পাবলিকের বুঝতে অসুবিধা হবে বলে সহজ করে দেওয়া হয় –‘এখানে বিনা যন্ত্রে রক্তপাতহীন দাঁত তোলা হয়’। কিন্তু দাঁত তুলতে কি রক্ত বের হবে না ? অবশ্যই। তখনই উঠে আসে লোকাচারের প্রসঙ্গ। বাচ্চাকালে বোধহয় দাঁত ইঁদুরের গর্তে ফেলা হয়নি। আছে হাটুরে দন্ত ব্যবসায়ী কলিমুদ্দিনের ব্যবসার প্রসারের কথা। আপাত এই অলৌকিকতার মধ্যেই প্রবেশ করে লৌকিক বয়ান। ভোটে ইঁদুর ও নৌকা মার্কায় ভোটে দাঁড়ানো। রূপকুমারের পিতা ইঁদুর মার্কা ত্যাগ করে হাতি মার্কা হয়েছে। অত্যাচারের বয়ান পাল্টে যায়। ক্ষমতার অন্দরমহল বড় হয়ে ওঠে। রাজনীতির দর্শন পাল্টিপুরাণে রূপান্তর হয়। দর্শন-ফর্শন বাজে কথা। আগে রক্তপাতহীন দন্ত উৎপাটন। কিন্তু দাঁত উৎপাটন কেন ? পোকায় ছিন্ন হয়েছে তাই। তবে পোকাকে নিমূল করলেই হয় ? তা হয় না। পোকা দ্বারা আরও দাঁত তো ছিন্ন হতে হবে। আখ্যান হয়ে ওঠে রাজনৈতিক। আমরা আমাদের সমস্যার ভিত্তিমূলে আঘাত করিনি। বর্জিতকে উৎপাটন করেছি। কেন বর্জিত হল সে প্রশ্ন করিনি। পোকারা দংশন চালায়। দাঁতের শ্রেণিচিত্র ধ্বংস হতে থাকে। রূপকুমার ছিন্ন দাঁত দেখতে চায়। কিন্তু দেখানো হয় না। কোথায় দংশন হচ্ছে, কে দংশন করছে তা জানার উপায় নেই। বেহুলার বাসরঘরের ছিদ্র খোঁজা হয় না। সর্প কেন প্রবেশ করল সে অনুসন্ধান নেই। বর্জিতকে শুধু ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
ভোট সত্যের খেলা, সিম্বল অর্ধসত্য, প্রার্থী বিকৃত সত্য, যেনতেন প্রকারে জয় প্রকৃত সত্য !
ঠাকুমারই একমাত্র পুত্র সন্তান। বাকিসব কন্যা। পুত্র সন্তান মানেই বংশের ঐতিহ্য। কৌশলে সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়া হয়। ঠাকুমা পুকুরে স্নান করে। নদীতে যেতে ভয় পান। নদী সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পুকুরে দেবী ভাসানের পর কাঠামো ডুবিয়ে রাখা হয়। পুকুরের জলে দেবীর স্পর্শ থাকে। এ জলে সুখ হয়। ধর্ম হয়। এ জলে স্নান করলে গর্ভে পুত্র সন্তান হয়। তবে ঠাকুমা এ তথ্য গোপন করে। বলে ভাগ্য। আসলে বাঙালি কালচার বড় হয়ে ওঠে। কথকের পিতা বনে পাগলা হাতিকে বশ করতে গেছে। এতে সরকারের সমর্থন আছে। পাগলা হাতিকে মেরে ফেলা যায় না। কেননা মাঝে মাঝে হাতি পূর্বজন্মের স্মৃতি ফিরে পায়। সেখানে লুকিয়ে থাকে ইতিহাস। শোষণের ইতিবৃত্ত। হাতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। থাকে ভোটের ইতিবৃত্ত। পাবলিক কৌশল বোঝে না। তেল দ্বারা স্মৃতি উধাও করে দেওয়া যায়। আসলে সব স্মৃতিহীন করে দেওয়া। স্মৃতিতে থাকে ইতিহাস, শোষণের ইতিবৃত্ত। এ ইতিবৃত্ত মনে রাখতে দেওয়া যাবে না। মন্ত্রপুত জল দিয়ে নাতির দাঁত তোলা হয়। দাদুর মতে এ জল নাগপাতালের জল। ঠাকুমা বিশ্বাস করে না। চলে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব। লোকাচার ব্যক্তিভেদে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। ঠাকুমা নিজেই লোকাচার পালন করে অথচ ঠাকুরদার লোকাচার মন্ত্রে অবিশ্বাস। ব্যক্তির মনস্তত্ত্ব এইভাবে ঘুরপাক খায়। পোকারা সমস্ত শস্য দংশন করে চলে। এমনকি দাঁতও। বুঝতে অসুবিধা হয় না লেখকের রাজনৈতিক ভাষ্য। শ্রেণিসংগ্রামের ইঙ্গিত থাকে। কিন্তু পাঠককে বুঝে নিতে হবে। তিনি কোন কিছু স্পষ্ট করেন না। চলে আলো-অন্ধকারের খেলা। নদীর চরায় যেন বালির খেলা। বালি সরিয়ে ভৌমজলের সন্ধান করতে হয় পাঠককে। যিনি পারেন না তার কাছে পীযূষ ভট্টাচার্যের আখ্যান জটিল হয়ে দাঁড়ায় বা উদ্ভট মনে হয়। পোকা দংশনের লীলা চলে অবিরত। এ পোকা দেখা যায় না। বেরিয়ে এসে উড়ে যায়। তবে ভাগ্য ভাল রং পাল্টায় না। এবারও দাঁত ইঁদুরের গর্তে ফেলা হয়। দাঁতের গোড়ায় ঠাণ্ডা জল দেওয়া হয়। এ হল রক্তপাতহীন দন্ত উৎপাটন। কিন্তু জল শেষ হলে শুরু হবে রক্ত। পাবলিক যখন ধন্দে থাকে তখন শাসন ব্যবস্থার ছিদ্র দেখতে পায় না। ধন্দ কেটে গেলেই সব দেখতে পায়। তখন চলে রক্তের খেলা। শ্রেণিকে ধ্বংসের খেলা। আজ শ্রেণি মিলিয়ে গেছে বিরোধীপক্ষে। বিরোধী মানেই রক্তের লীলা প্রবাহিত করা। অত্যাচারের সিস্টেম যেন বহমান থাকে। নইলে মস্তিষ্কে ঘুণ ধরে। চলছে ইঁদুরতন্ত্র। আসলে সবই অদৃষ্ট। ব্যর্থ মানুষ নিজের অদৃষ্টকে গাল দেয়।
একদিকে নরহত্যা, সামন্ততান্ত্রিক অত্যাচার অন্যদিকে দেবীর কাছে পশুবলি। আজ আর উপন্যাসে নিবিড় ডিটেলিং প্রয়োজন নেই। আধেয় থেকে আধারকে খুঁজে নিতে হবে পাঠককে। এই পশুবলিই যেন ইঙ্গিত বহন করে আনে। যার মধ্যে থাকে অত্যাচার। দেওয়ালে ছিল খড়গ। দীর্ঘদিন তা দেখা যায়নি। সে শূন্যতা ভরাট হয় ঠাকুমার তালপাখা দিয়ে। সেখান থেকে আসার সময় ঠাকুমা তালপাখাটি নিয়ে এসেছিল। আজও দেবীর হাতে খড়গের পরিবর্তে তালপাখা থাকে। প্রতি বছর মূর্তি বিসর্জিত হয়, নতুন দেবী আসে, কিন্তু তালপাখাটি থেকে যায়। পিসিরা খবর নেন নাতি কত বড় হল। এ ঘর ধেড়ে ইঁদুরের ঘর নয় নেংটি ইঁদুরের। তবে ধেড়ে ইঁদুর গেল কোথায় ? ঠাকুমা খোঁজ পাননি। ব্যথিত হন। ধীরে ধীরে শ্রেণির অবনমন ঘটে। ধেড়ে ইঁদুরের থেকে নেংটি ইঁদুর ক্ষমতায় ছোটো হলেও সংখ্যায় বেশি। আসলে বিপ্লব বা প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। প্রকাশ পায় পিসিদের অবদমিত যৌনতা। যৌনঅঙ্গের সঙ্গে নেংটি ইঁদুরের তুলনা আসে। বারোজন পিসি দেখতে একই। একই দেখতে বলে বিবাহ হয়নি। পাত্রপক্ষ সব গুলিয়ে ফেলে। লেখক অদ্ভুত ভাবে উপস্থাপন করেন। নারীরা একই রকম হওয়ার জন্য যেমন দায়ী তেমনি পুরুষরা সিদ্ধান্তহীনতার জন্য। পিসিদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ঠাকুমা নাতিকে নিয়ে বেরিয়ে যান। ঠাকুমা গল্প বলতে জানেন। গল্পের অসম্পূর্ণতা যেন না থাকে সেজন্য ধেড়ে ইঁদুরের গর্ত খুঁজতে হয়। তবে ইঁদুরের গর্তে তো সাপও থাকে। আসলে লেখক ইঙ্গিতধর্মী বাক্য লেখেন। অস্পষ্টের মাঝে ঝুলে থাকে ভাবনা বলয়। চলে আলো-ছায়ার খেলা। বিম্ব-প্রতিবিম্বের দ্বিধাচক্র। ঠাকুমার ছায়া গ্রাস করে নাতিকে। ছায়াও দ্বিধাবিভক্ত। একসময় ছায়াকে হাতি বলে মনে হয়। আসলে লড়াই চলতে থাকে। ছায়া সরতেই বিভ্রম ভেঙে যায়। বাস্তবের বিভ্রম দূর হয়ে স্বপ্নের বিভ্রম বড় হয়ে ওঠে। স্পষ্ট হয় অবয়বহীন ছায়া। সরকার বলেছে হাতি বশে আনতে। মরা হাতি যদি লাখ টাকা হয় তবে জীবিত হাতির মূল্য কত ? সরকার টাকার অঙ্ক বোঝে। এই সরকারকে একটা শ্রেণির প্রতিনিধি ভাবা যেতে পারে। জমিদার বা সামন্ত্রতান্ত্রিক প্রভুদের উত্তরপুরুষ এই সরকার। কাঠামো পাল্টেছে কিন্তু অত্যাচারের ধ্যান ধারণা একই। মরা হাতি লাখ টাকা- যেদিন এ প্রবাদের শুরু হয়েছিল সেদিন টাকার অঙ্ক কত ছিল ? আজ তবে কত ? মাঝে মাঝে ঠাকুমার বয়ান ভেঙে যায়। হাতি পালনের ক্ষমতা নেই বলেই কি ইঁদুরের গল্প ফাঁদা ? না অন্য কিছু। মনে আসে নদীর প্রতিবিম্বের কথা। তা পাপ খণ্ডনের বিধি না অন্য কিছু। হাতির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণি চরিত্রের রূপান্তর ঘটছে। ক্ষমতার রূপান্তর ঘটছে।
ঠাকুমা ভেসে যান অন্ধকারে। জলপথের যাত্রীরা বিশ্রাম নেন রাতে। অন্ধকারে ভালো ঘুম নয়। নৌ বহনের জন্য নিদ্রা আবশ্যক। রাতে জল ও দাড়ের খেলা বন্ধ থাকে। নীরবতা বিরাজ করে। নীরবতা ছাড়া ঘুম হয় না, স্বপ্ন আসে না। ঠাকুমাও স্বপ্নে জলপথের যাত্রী হন। হঠাৎই তন্দ্রা ভেঙে যায়। স্বপ্ন দুঃস্বপ্নের বার্তা নিয়ে আসে। বড়ো সেজো দাদুর মৃত্যুর খবর নিয়ে আসে জবা। হিন্দু লোকাচারে মুখাগ্নির জন্য সন্তান প্রয়োজন। নিজের না হলে বংশের সন্তান। পুরুষ বলতে নাতি রূপকুমার ও তাঁর পিতা। কিন্তু পিতা তো সরকারি কাজে বনে। এ ব্যস্ততা দাদু নিজেও জানতেন। তাই নাতিকেই মুখাগ্নির দায়িত্ব দিয়ে যান। তবুও পিতার খোঁজে জবা পিসি হাকিমের বাড়ি যান। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে যান। হাকিম পরীক্ষা করে নারী শরীর। মনে হয় প্রকাশিত ভেনাসের অংশত স্তনদ্বয়। জবা নিজেও ভুলে যান বাড়িতে মরা ফেলে এসেছে। সকালে জবা ফুল ফোটে। ফুল আসলে প্রবাহিত সময়ের বার্তা নিয়ে আসে। মৃত্যু-নদী-ফুল-সময় এক সরলরেখায় বয়ে যায়। মৃত দাহ হয়। কিন্তু দাঁত কি পুড়বে ? নাতির চিন্তা দাঁত গুলির কী হবে ! জবা পিসি নেংটি ইঁদুরের খোঁজে আজ আর প্যান্টের মধ্যে হাত দেয়নি। আজ আর যৌনতা নেই। মৃত্যু যৌনতাকে কেড়ে নিয়েছে। ঠাকুমার মতে প্রেমের সময়-অসময় নেই। বিফল হলে অসময়ই যেন সময়। ইচ্ছা হলে সময়ই যেন অসময়। দাদুর ছিল কিছু মন্ত্রপুত জল। ভাসুরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখলে মৃতদেহে পচন ধরবে না। কিন্তু জল শেষ হলেই সর্বনাশ। জল শেষ হলেই রক্তপাতহীন দন্ত উৎপাটন সমাপ্ত হবে। শুরু হবে রক্তপাত। কত দ্রুত হাতি বন থেকে এগিয়ে আসছে। সময়ের ইঙ্গিত বড় হয়ে ওঠে। কিন্তু নির্দিষ্ট কোন মাপকাঠি নেই। তাই ধরা হয় গতি ‘X’। সময়ের সঙ্গে অংকের সম্পর্ক। সময় মানেই বাস্তব। আর তা জানান দেয় বাস্তবের অংক। যে অংকে থাকে মুনাফা। তেমনি শোষণের পরিবর্তনের ইঙ্গিত।
শীতল বাতাসের সন্ধান ঠাকুমা জানে ? না তালপাখা জানে ? না সময় জানে !
কেউ জানে না। পাখার পরীক্ষা চলে। ঠাকুমা একসময় তালপাখা নামিয়ে আনেন। পুত্র তালপাখায় করে পিতার সন্ধানে যাত্রা করে। এ বাড়ির রীতি পুত্রই পিতার সন্ধানে যাবে। যেমন গিয়েছিল টেলেমেকাস পিতা অডিসিয়াসের সন্ধানে। এ যাত্রা বিচিত্র অভিজ্ঞতার। বিচিত্র অনুসন্ধানের। বিচিত্র রহস্যের। এ পথেই জীবনের সন্ধান করে নিতে হয়। নাতি তালপাখায় ভাসতে ভাসতে পিতার সন্ধান পায়। পুত্র আগে পিতা পরে আসে। পুত্রের যাত্রা তালপাখায়, পিতার যাত্রা হাতিতে। পড়শিরা ভেবেছিলেন মেয়েরাই মৃত দেহ বহন করবে। নিতম্বের ঝুলে চলা পাবলিক উপভোগ করবেন। কিন্তু তা হয় না। পাবলিকের নিতম্ব দর্শনে ছাই পরে। হাকিমই ব্যবস্থা করেন। মৃতদেহ নিজেই যেন চলার গতি পায়। হাঁটা নয় যেন দৌড়ানো। মৃতদেহ যেন শবযাত্রীদের তাড়া দিতে থাকে। তবে ঠাকুমা কিন্তু শ্মশানে যাননি। শ্মশানে যেতে নদী পার করতে হয়। নদীতে গেলেই অতীতের আতঙ্ক গ্রাস করে ঠাকুমাকে। তবে আতঙ্ক না পিসিদের মতব্বরে যাননি তা স্পষ্ট নয়। লেখকও স্পষ্ট করেননি। এ বৃত্তান্ত নাতি ঠাকুমার কাছে শুনেছে। আজ ঠাকুমা দিনেই স্বপ্ন দেখে। কিন্তু ঘুম ভেঙে যায়। মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। দিনের স্বপ্ন রাতে দেখবেন বলে মনস্থির করেন। কিন্তু রাতে নতুন স্বপ্ন এসে উপস্থিত হয়। দিনের স্বপ্ন বানচাল হয়ে যায়। ঘুম ভেঙে যায়। ঠাকুমা দীর্ঘদিন ধরে অনিদ্রা রোগে ভোগেন। তিনি প্রহর গুণে রাত পরিমাপ করেন। ঘুম ভেঙে গেলে কাকের ডাক শোনা যায়। অশুভের ইঙ্গিত বয়ে আনে। এই অনিদ্র রোগের সূচনা ভয় থেকে। মাতাও তেমনই বিশ্বাস করতেন। তবে সাধারণ মানুষ এসব বিশ্বাস করত না। এমনকি দিনে দেখা স্বপ্ন সাধারণ মানুষের কাছে অলীক মনে হয়। এইভাবে আখ্যান গড়ে ওঠে। কখনও স্মৃতিলোকে, কখনও স্বপ্নলোকে। অবাস্তবের ভিতর দিয়ে বাস্তব এগিয়ে যায়। বাক্য হ্যাঁ-না এর মাঝে অবস্থান করে। সৃষ্টি হয় রহস্যের। নির্মিত হয় উত্তর আধুনিক উপন্যাসের।
হাকিম অনিদ্রার জন্য বারোজন পিসিকে দায়ী করে। প্রত্যেকেই একই দেখতে। শুরু হয় জুয়াখেলা। পিসিদের নাম ফুলের নাম অনুসারে। এমনকি তাতে নম্বর দেওয়া হয়। কেউ জেতেনি খেলায়। এমনকি হাকিমও। বারবার পরাজিত হয়। বৃহস্পতিবার খেলা জমে ওঠে। লক্ষ্মীবার বলে কথা। কারও লক্ষ্মী কারও পকেটে ঢোকে। এদিন টিকিটের দাম বেশি। জুয়ার চাহিদাও চরমে ওঠে। সবাই ব্যর্থ হয়। হাকিম পায় তবে দুই নম্বরের বদলে এক নম্বর— টগরের বদলে জবা। হিসেবে ভুল হয়। তবুও হাকিমের মন রাখতে হয়। কেননা খেলা চালু রাখতে হবে। হাকিমের শর্ত পূরণ হয় কিন্তু একসঙ্গে বারোজন পিসিকে ভোগ করতে হবে। বিপদ ঘটে। পরিণাম যা হবার তাই ঘটে। যৌনবাসনা পূর্ণ হয় না। পিসিদের অতৃপ্ত কামনা বেরিয়ে আসে। কামনায় হাকিম নাজেহাল হয়। ড্রাইভার খবর দেয় ঠাকুমাকে। ঠাকুমা জানতে চায় কবে থেকে এ খেলা আরম্ভ হয়েছে। ঠাকুমা পিসিদের ছেনালি বলে সম্বোধন করে। পিসিরা উলটো কথা শুনিয়ে দেয়। নির্ধারিত হয় ছেনালির সংজ্ঞা। আসলে অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ হয়ে আসে। পিসিদের মতে ইহা ছেনালিপনা নয়। শরীরের চাহিদা পূরণের খেলা। কেনই বা করবেন না। এসব পুরুষের কেউই বিবাহ করেনি পিসিদের। অথচ অবৈধ সঙ্গমে রাজি। বাঙালি কালচারের ইহা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। বিবাহ নয় যৌন সংসর্গে বেশি দক্ষ। ঠাকুমার কথায় পিসিরা বাজি ধরতে বলে। ঠাকুমা হাতি বাজি ধরার কথা বলে কিন্তু পিসিরা রাজি হয় না। কেননা এক প্রদেশের ভোটে হাতি মার্কা লড়ছে। হাতি ফিরে আসার সময় নেই। বয়ান অবাস্তব থেকে বাস্তবে ফেরে। অবাস্তব থেকে রাজনীতির ভাষ্যে প্রবেশ করে যায়। পিসিরা তালপাখাকে বাজি ধরতে বলে। ঠাকুমা প্রশ্ন করে তালপাখা কেন ! পাখার জাদুগিরি প্রকাশ পায়। পাখার দুই পিঠে দুই রকম বাতাসে দুই রকম কাজ হয়। পিছিয়ে যাওয়া ও এগিয়ে আসা। বাতাসও তো সেই সিস্টেমে চলে। হাতি না তালপাখা কখনও ইঁদুর— এর মধ্যে লুকিয়ে থাকে শ্রেণির তত্ত্ব, সাম্যবাদের লড়াই ও ক্ষমতা কায়েমের একনায়কতন্ত্র। পিসিরা পাখা পেলেই বিপ্লব ঘটিয়ে দিতে পারে। পাগলদের গারদ থেকে মন্ত্রীর আসনে বসিয়ে দিতে পারে। লেখকের অদ্ভুত বয়ান কৌশল। আসলে মন্ত্রীরা বলদ বা পাগল। এ ব্যাখ্যান তিনি জানিয়ে দেন তালপাখার জাদুগিরিতে। ঠাকুমা জানতে চান তালপাখার ভবিষ্যত নিয়ে। কেননা খড়গের স্থানে এসেছে তালপাখা। খড়গ ছিল হিংসার প্রতীক। দেবীর খড়গ একসময় মানুষ নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করে। পৃথিবীতে হিংসা শুরু হয়। তালপাখা সেই হিংসাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। ঠাকুমার স্মৃতিতে আজ তা আবার ভেসে আসে –
‘’ঠাকুমা শুধু চোখবুজে বুঝে নিতে চাইলেন নিজেরই সৃষ্টি, তালপাখাটির ভবিষ্যৎ ! কেননা পৃথিবীর এই রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে নিজের দখলে থাকা তালপাখাটিকে রক্ষা না-করতে পারার সম্ভাবনা উপস্থিত তখনই সেই বিচারক অর্থাৎ সেই দেবীর কাছে অনুমতি চাইলেন— পুরোনো পৃথিবীর সেই দেবী যাঁর সম্মুখে বলির নিমিত্তে প্রয়োজন হয়েছিল একটি খড়গের – সেই খড়গও মানুষ নিজের প্রয়োজনে দখল করে নেয় একদিন— তালপাখাই বেশির ভাগ সময় ভুলিয়ে রাখত খড়গের হিংস্রতা। নতুন করে হিংস্রতার কথা উস্কে দিচ্ছে যখন তখন ঠাকুমা-র কিছুই করবার নেই, একে বিশৃঙ্খল করে দেবার পরিকল্পনার কথা শোনা ছাড়া। বলে উঠতে পারলেন না— এরকম করতে নেই। তিনি শুধু নিজেকেই প্রশ্ন করলেন— মানুষ যখন রিক্ত হয়ে যায় তখন কী করে ? পরক্ষণেই বলে উঠলেন নিজেকে— দেবতাই যখন সব হারিয়ে রিক্ত হয়েছেন তখন আমারই বা কী করবার আছে ?’’ ( তালপাতার ঠাকুমা, আখ্যান সমগ্র ১, প্রথম প্রকাশ ২০২০, একটি তৃতীয় পরিসর প্রকাশনা, পৃ. ৮৮)
ঠাকুমা নিজেও বিভ্রান্তিতে পড়েন। পিসিমাদের ঠিক চিনতে পারেন না। আসলে বিভ্রম। বিভ্রমের গোলকধাঁধা। এই গোলকধাঁধার মধ্যেই থাকে রহস্য। রহস্যের বীজ অতিক্রম করে ঘটমান বাস্তবে পৌঁছতে হয়। যেখানে লুকিয়ে থাকে সত্যের বীজ। বাস্তবের পারদস্তম্ভের জন্য এসব লেখক আয়ত্ত করেন। থাকে হামিকের প্রতি ঠাকুমার ভৎসনা-প্রথমে ম্যাদা, পরে ম্যাদামারানি। ঠাকুমা পিসিদের নতুন খেলা শিখিয়ে দেয় –‘স্বয়ম্বরের কানামাছি’। মেয়েরা চোখ বেঁধে যাকে মালা দেবে তার সঙ্গেই বিবাহ। এদিন কেউ আসে না। অবাস্তবের বয়ান থেকে ঘোর বাস্তব উঁকি দেয়। আসলে পুরুষরা আসে ছেনালিপনা নিমিত্তে। প্রেম ভালোবাসা বলে কিছু নেই। শেষ পর্যন্ত মালা দেওয়ালে থাকা পুরুষদের পড়িয়ে দেওয়া হয়। পরের দিন আর কিনে নয় ভাড়া মালা নিয়ে আসা হয়। তবুও কোন কাজ হয় না। শেষে শুরু হয় ফুলের গন্ধ শুকে নম্বর বলে দেওয়ার পালা। হাকিম ফুলের গন্ধের পরিবর্তে পায় নারী মাংসের গন্ধ। একসঙ্গে এতগুলি ফুলের গন্ধে ঠাকুমার ঘুম উড়ে যায় – অনিদ্রার এও এক কারণ। নারীরা এখানে নিছক সংখ্যামাত্র। যেমন যৌনব্যবসায়ীরা। লেখক কি তাদের কথাই বলতে চাইলেন সংখ্যা চিহ্ন দ্বারা ? সব ধোঁয়াশা। সবাই একই দেখতে। এখানে নারীর কোন ব্যক্তিত্ব নেই। নেই পৃথক সৌন্দর্যতত্ত্ব। পুরুষ এখানে এসে ধাঁধায় পরে। মনে হয় সব এক। কিসের ইঙ্গিত এসব ? ধাঁধা অতিক্রম করে যৌনব্যবসায়ীদের কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ওগো রূপকথা,ওগো তমাল তরু, ওগো বধূ প্রেয়সী !
ঠাকুমার ঘুম না হওয়ার জন্য খবর দেওয়া হয় পিতাকে। পিতা তেল পাঠিয়ে দেন। এ তেল দিয়ে ঘুম হবে। কিন্তু ঠাকুমা তো সব ইতিবৃত্ত জানেন। তেল মাখেন না। এমনকি এ তেল ঠাকুমাই পিতাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তবে এ তথ্য গোপন রাখেন। নইলে ব্যবসা চলবে না। বিরোধী পক্ষ বাঘ চিহ্নে ভোটে দাঁড়িয়েছে। তবে খাঁচা বন্দি বাঘ। হিংসার বিরুদ্ধে ডবল হিংসা জারি রাখতে হয়। নইলে ভোটে জেতা যাবে না। চলে বাঘ হাতির খেলা। মাঝে থেকে বলি হয় ভোটদাতা ছাগলরা। বলি না হলে গণতন্ত্রের সিস্টেম রক্ষা হয় না। ঠাকুমা ঘুমায় না। কেউ যেন অনিদ্রা নিয়ে বেশি মাথাব্যথা না করেন। ঠাকুমা অনিদ্রার প্রকৃত কারণ জানেন। কিন্তু গোপন রাখেন। নইলে রূপকথা হয় না। গল্পের মোহ থাকে না। মাথার ওপরে আকাশ। আকাশে তরবারি হাতে সপ্তর্ষিমণ্ডল। তরবারির নিচে মানুষের বসবাস। প্রতি মুহূর্তে বিপদ। যেন রেড জোন। রাষ্ট্র প্রতি মুহূর্তে মানুষকে ভয়ে রাখতে বাধ্য করে। ভোটে জেতার নামে চলে লুণ্ঠন। অপরকে পরাজিত করতে চলে হিংসার খেলা। রাজনীতিতে জয়ের একমাত্র কৌশল হিংসা। রাতে ঠাকুমার পাহারায় থাকে নাতি। মাতার সন্দেহ ছেলেরও অনিদ্রা রোগ হবে। ঠাকুমা হাকিমকে খবর দিতে বলে। নাতি তালপাখায় যেতে চায়। ঠাকুমা বাধা দেয়। সাইকলে যায়। হাকিম উপস্থিত হয়। ঠাকুমা জানায় জবা গর্ভবতী। পেটে হাকিমের সন্তান। হাকিমকে বিবাহের নির্দেশ দেয়। এবার স্পষ্ট হয়ে যায় ঠাকুমার অনিদ্রার কারণ। নারী হয়ে নারীর যন্ত্রণা উপলব্ধি করেন। এমনকি প্রতিকারের পথও আবিষ্কার করতে হয়।
ঠাকুমা প্রকৃত সত্য প্রকাশ করেই ঘুমিয়ে পড়েন। আজই পিতা ফিরে আসে। জানতে চায় ঠাকুমার কথা। কিন্তু আজই তো ঘুমালেন তাই জাগানো হয় না। পিতা হাতির বদলে গাড়ি নিয়ে এসেছেন। ভোটে হাতি পার্টি জয়লাভ করেছে। পার্টি গাড়ি উপহার দিয়েছে। জয়ের পর সারথিকে বড় গিফ্ট দেওয়া বিজয়ী পার্টির কর্তব্য। হাতি পার্টির কাছে বাঘ পার্টির পরাজয় হয়। সত্যি কি পরাজয়? না হারিয়ে দেওয়া হয় ! তেলের দ্বিবাচনিকতা উঠে আসে –পার্টি তেল। জনগণকে তেল দিয়ে জেতা। টুপি পড়িয়ে জেতানো। পুত্র পিতার কাছে বাঘের গল্প শুনতে চায়। গল্প না শুনে থামবে না। লেখককে তো গল্প বলতেই হবে। আরম্ভের ভিতর থেকে বাস্তব উঁকি দেয়। পিতার গল্প মাতাও মনোযোগ দিয়ে শোনে। বাঘ মার্কা হেরে গেল। পিতা বাঘের মাথায় তেল মাখিয়ে দিয়েছিল। বাঘ ঘুমিয়ে গেল। পশুপ্রেমীরা প্রশ্ন তুলল। নিরীহ বাঘের ওপর অত্যাচার হচ্ছে। সরকার বাঘ নিয়ে গেল। অবধারিত পরিণাম হল বাঘ পার্টির পরাজয়। বাবার জয়জয়াকার হল। বিরোধী পার্টি পিতার কাছে এসেছিল বাঘ জাগানোর জন্য। কিন্তু বলেননি। বললে মন্ত্রের রহস্য উধাও হয়ে যাবে। সিস্টেমের গোলকধাঁধা। পশু চিহ্ন নিয়ে ভোটে লড়াই শুরু হয়। ক্ষমতা হারিয়ে দেয়। কেউ প্রশ্ন তোলে না। আসলে ক্ষমতার রহস্য। বাঘের স্থান হল চিড়িয়াখানায়। পাবলিক টিকিট কেটে ঘুমন্ত বাঘ দেখে। আসলে পশুরা কীভাবে মৃতপ্রায় হয়ে যাচ্ছে। বিরোধীপক্ষ প্রচার করে বাঘ ঘুমিয়ে গেছে বলেই পরাজয়।ঠাকুমা কেন ঘুমিয়ে পড়ল নাতি না জানলেও মা জানে। কখনও মনে হয় ঘুমই বুঝি সমাপ্তি। কিন্তু নয়। কেন নয় আমাদেরও অজানা। তিনি এমন এক বয়ান নির্মাণ করেন একটি সত্য অনুমান করলে পরক্ষণেই তা ভেঙে যায়। দ্বিতীয় সত্য উঠে আসে। তবে সেটিও স্থির নয়। আসলে তাঁর আখ্যান অস্থির সময়ের। স্থবিরতা নয় ভাবনার এক চলমানতা এখানে নিত্য বিরাজ করে। আজ ঠাকুমা রাতে ঘুমাচ্ছে। নাতি জেগে থাকে। রাতেই রূপকথার জন্ম হয়। রূপকথার উত্তরাধিকার ঠাকুমা কি নাতিকেই দিয়ে যাচ্ছে ? ভোরের আকাশে নাতি অগস্ত্য খুঁজতে থাকে। ঠাকুমা অনিদ্রার সময়কালে পৃথিবীর দশদিকে প্রণাম করত। নাতিও করে। সেই যেন বহন করে যাচ্ছে ঠাকুমার সত্তা। ভগ্নাংশের মাধ্যমে আখ্যান এগিয়ে নিয়ে যান। রূপকথার আড়ালে গভীর সমাজ বাস্তবের আখ্যান গড়ে তোলা হয়। ঐতিহ্য থেকে বর্তমানে ফেরা। ঠাকুমা যেন এই সংযোগ সূত্রের দায়িত্বে থাকেন।
ঠাকুমার দুই সত্তার কথা ভাবা যেতে পারে। বলা ভালো ঠাকুমার মন্ত্রকে বহন করে চলেছে দুজন নাতি ও কাঞ্চনমালা। বৃষ্টির ফোঁটার ব্যাসার্ধ নির্ধারিত হয় না। বিন্দু বিন্দু বৃষ্টিতেই জলধারার সৃষ্টি হয়। জল মানেই ভেসে যাওয়া । কাহিনিও আশ্চর্য গতি পায়। দেখা যায় হাঁটুজল। আসলে বাস্তবের বিভ্রম। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ থেকে কাহিনি নাতি রূপকুমার ও কাঞ্চনমালাকে নিয়ে। কিন্তু কাঞ্চনমালার অনুরোধে একজন জাদুকরকে রাখতে হয়। সে নিজেই জাদুকরের সৃষ্টি। ভয়াবহ বন্যার হিসেব করতে বসেন ঠাকুমা। কিন্তু কিছুতেই স্মৃতিতে আসে না। বাস্তবের নদীর খোঁজে উঠে আসে পাতালের নদী। নাতির মনে হয় জাদু কি কেবলই বিভ্রমের সৃষ্টি করে ! কখনও অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। কাঞ্চনের থাকা ও উড়ে যাওয়া তাঁর কাছে জাদু ছাড়া অন্য কিছু নয়। ঠাকুমার মন্ত্র আদায় করেছে কাঞ্চন। মন্ত্রের মধ্যে কিছুটা জাদু থেকে যায়। সমস্ত কিছুর জন্যই একটা প্রস্তুতির প্রয়োজন। এমনকি মৃত্যুরও। আত্মহত্যার জন্যও প্রস্তুতি দরকার। কাঞ্চন অর্ধমৃত হয়েও বেঁচে যায়। সে মৃত্যু বা অর্ধমৃতের মধ্য দিয়ে জীবন উপলব্ধি করে। কাঞ্চনমালা হঠাৎ হঠাৎ হারিয়ে যায়। রূপকথার জাদুর মতো উধাও হয়ে যায়। অস্তিত্ব বিলোপ হয়। রাত হয়ে ওঠে স্বপ্নহীন। অন্ধকারের স্বপ্ন হয়ে ওঠে দুঃস্বপ্ন। মাঝে মাঝে কাঞ্চনের কোলে থাকে খরগোশ। কখনও খরগোশ দেহের অঙ্গ হয়ে ওঠে। খরগোশ এলে চাঁদ এসে উপস্থিত হয়। চাঁদ এলে কল্পনা ডানা মেলে। কল্পনায় প্রবেশ করে বিভ্রম। নাতি কাঞ্চনকে মন্ত্র শিখিয়েছিল। রীতি অনুসারে সে নিজেই মন্ত্র ভুলে যায়। ভুলে না গেলে গল্প হয় না। সবাই মনে রাখলে গল্প শুনবে কে ? কথকের জন্মবৃত্তান্ত শোনায় কাঞ্চন।
কাঞ্চনমালার স্বামী হুজুর মাহাতো। রূপকুমারের তালপাতার আঘাতে মৃত হন হুজুর মাহাতো। তালপাখা রূপান্তরিত হয় খড়গে। কাঞ্চনকে রেখেই রূপকুমার পালায়। ঠাকুমার নির্দেশে তালপাখায় ফিরিয়ে আনে কাঞ্চনকে। এসব অবাস্তবের মধ্যে ভয়ংকর বাস্তব উঁকি দেয়। শূন্য নদী থেকে বালি চুরি হয়ে যায়। নদী কোনদিন পাতালে মিলিয়ে যাবে কেউ জানে না। অথবা বালি তুলতে তুলতে কোনদিন পাতাল থেকেই নদী বেরিয়ে আসবে জানা নেই। এই পর্যন্ত একটি বিষয় লক্ষ্য করার –নারী যখন অপমানিত হচ্ছেন তখনই ঠাকুমা তালপাখা ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। একটা প্রতীক হিসেবে ভাবা যেতে পারে। যেন নারীর রক্ষাকবচ। তবে আখ্যানের শেষ পর্যায়ে তালপাখা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয় ইঁদুর দ্বারা। আসলে তালপাখা তো খড়গের উত্তরাধিকারী। সেখানে ঐতিহ্যের রক্তপাত লেগে থাকে। ঠাকুমা তা ব্যবহার করেছেন নিজের প্রয়োজনে বলা নারীদের রক্ষার প্রয়োজনে। কিন্তু সমগ্রের বিচারে সেখানে রক্তের ক্ষত, শোষণের অত্যাচার লুকিয়ে থাকা। তাই ইঁদুর শ্রেণিরা ধ্বংস করে দেয়। সামন্ততান্ত্রিক অত্যাচারের অবসান ঘটিয়ে দেয়।
বেহুলা কান্দে, লখিন্দর কান্দে, কাঁদে অলীক মানুষ
সর্প দংশনে ক্ষত ব্যক্তিকে রাতে ঘুমতে দেওয়া যায় না। ঘুমে জ্ঞান হারায়। এ যেন কালঘুম। লখিন্দরের মৃত্যু এভাবেই ঘটেছিল। কাঞ্চনকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়। ভর্তির জটিলতা বড় হয়ে ওঠে। কর্তৃপক্ষ জানতে চায় পেশেন্ট কীভাবে এল। অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ কই ? শব্দহীন হিসেবে আসা ব্যক্তি যেন মৃত হতে পারে না। শব্দ করতে করতে আসাই যেন ইমারজেন্সির লক্ষণ। হসপিটালের সিস্টেম প্রসঙ্গ উঠে আসে। পরিস্থিতি কীভাবে জটিল করে তোলা হয়। কাঞ্চনের সমস্ত রক্ত ঝরে যাচ্ছে। তখন ওয়ার্ডের টিভিতে অরণ্য দৃশ্য ফুটে ওঠে। সব নীল হয়ে যায়। রক্ত যেন আলোকরশ্মিতে হারিয়ে যায়। টিভিতে চলে অ্যানিমেল প্ল্যানেটের খেলা। হিংসা, যৌনতা, প্রেম-ভালোবাসার শৃঙ্খলের খেলা চলে। বনের পশুদের দৃশ্য মিলে যায় মনুষ্যরূপ পশুর সঙ্গে। এমনকি নির্মমতার মানুষ বনের পশুর থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে। সমাজে চলে মনুষ্যরূপ পশুদের যৌন নির্যাতন। হসপিটাল মানেই জন্ম-মৃত্যুর খেলা। মাঝে আছে আরগ্যের ক্ষণিক বিচ্ছুরণ। নিরাময় পর্বের ক্ষণিক উপশম। এ যেন কিছুটা বিশ্রামের পালা। একবারে তো সবাইকে মারা যায় না। একটা সিস্টেম অনুসারে মৃত্যুকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নইলে ইমারজেন্সি পরিকাঠামো ভেঙে যাবে। ধর্ষণের অত্যাচার কাঞ্চন দিনে কিছু বলে না কিন্তু রাতে ঘুমের মধ্যে বহু কিছু বলে যায়। কিন্তু স্বপ্নের বয়ানকে বাস্তব বয়ান হিসেবে ধরা হয় না। কেননা স্বপ্ন অলীক। বাস্তব বৃত্তান্তই যে স্বপ্নে উঠে আসে তা পুলিশ মানতে চায় না। আইনি জটিলতা সৃষ্টি হয়। শেষে স্বপ্নের বয়ান লিখে নিয়েই দিনের বয়ান বলে চালানো হয়। নারীর স্বাভাবিক লজ্জা। সজ্ঞানে মুখ থেকে কিছু প্রকাশ হয় না। অথচ রাতে স্বপ্নের মধ্যে অনর্গল তথ্য বেরিয়ে আসে। টিভিতে বনের পশুরা সিস্টেমেটিক যৌনক্রিয়া করে। পশুরা যেন সিম্বলিক হয়ে ওঠে। কিন্তু মানব সমাজে আইন শৃঙ্খলা নেই। যৌনতার নির্দিষ্ট রীতি পদ্ধতি নেই।
কাঞ্চনমালা ছিল পঞ্চায়ত প্রধান। নদী থেকে ক্রমাগত বালি চুরি হয়ে যাচ্ছে। বালি চুরির প্রধান পাণ্ডা স্বামী হুজুর মাহাতো। এভাবেই চলছে আমাদের উন্নয়ন। উন্নয়নের নামে ধাপ্পাবাজির লুকোচুরি খেলা। সব বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সমস্ত বিক্রিই ক্ষমতার প্রধান অঙ্গ হয়ে মাথা তুলেছে। ‘চৌষট্টি কলার মধ্যে বেচকলাই’ আজ প্রধান। আখ্যান অবাস্তব থেকে বাস্তবে প্রবেশ করে। প্রধান প্রতিবাদ করলে স্বামী কাগজপত্র ও নদীর মানচিত্র স্ত্রীর যৌনঅঙ্গে ঢুকিয়ে দেয়। নদী থেকে পূর্ণপাত্র শূন্য গাড়িতে পূর্ণ হয়ে আবার শূন্য হয়। কাঞ্চন হসপিটালের ফর্মে স্বামীকে জীবিত বয়ান দেয়। কাঞ্চনমালাকে থিয়েটারে প্রবেশ করানোর পর বলা হয় রক্ত প্রয়োজন। রক্তের প্রসঙ্গ আসতেই তালপাখাতে রক্ত লেগে থাকার কথা মনে আসে। মনে ভয় হয়। কিন্তু পুলিশি সনাক্তকরণ অসম্ভব। হুজুর মাহাতো ও কাঞ্চনের রক্ত মিশে গেছে তালপাখায়। পুলিশ কুকুরের সনাক্তকরণ সম্ভব নয়। টিভিতে নেকড়ে-খরগোশের খেলা চলে নীরবে। পশুর উল্লাস দেখে মানুষ আনন্দ পায়। উল্লাসে মেতে ওঠে। হুজুর মাহাতোর ছবি আঁকা হয়। বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। খোঁজ পেলে পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। ঠাকুমা হাতি থেকে ধেড়ে ইঁদুরে গিয়েছিল। মা ইঁদুর ছেড়ে হাতিতেই থাকতে চায়। পিসি হাতি মার্কা রাজ্যে ভ্রমণে যান। আকাশে হাতি মার্কা পতাকা উড়তে থাকে। এসবই রাজনৈতিক ভাষ্য। ভোটে জিতে এক সরকার হাতির মূর্তি স্থাপন করেছে গোটা রাজ্যে। পরবর্তীতে আবার তা ভাঙাও হয়েছে। এ আখ্যান যখন লেখা হয় তখনও হাতির মূর্তি ভাঙার রাজনীতি আসেনি। এটাই কালের নিয়ম। একদল গড়বে, অন্যদল ভাঙবে। নইলে কনস্ট্রাকশন রাজ হয় না, ট্রেন্ডার হয় না। এরাই তো সরকার চালায়।
বৃহস্পতিবার পিসিদের খেলাকে আইনসম্মত করার চেষ্টা চলে। সরকার ট্যাক্স বসাতে চায়। প্রমোদ ট্যাক্স। বেশ্যাবৃত্তি নিষিদ্ধ। লটারি, সাট্টা, অনলাইন লটারি নিষিদ্ধ। কিন্তু গোপনে চলবে। এগুলো স্রেফ জুয়াখেলা। এগুলো থেকে ইতিমধ্যেই ট্যাক্স আদায় হয়। বাবা তিন তাসের প্রসঙ্গ তোলেন। আখ্যান অবাস্তব থেকে বাস্তবে প্রবেশ করে। জুয়া তাস থেকে সরকারের রোজগার হয়। অথচ এগুলো সরকার লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে চায়। জনপ্রিয়তা যখন শীর্ষে ওঠে সরকার তখন অধিগ্রহণ করে। সরকার গ্রীসের সঙ্গে মউ সাক্ষর করে। এগারোজন পিসিকে ওদেশে পাঠানো হয় পরীক্ষার জন্য। অনুসন্ধানের বিষয় ওদেশের মহিলাদের মতো এই মহিলারা কেন ? আসলে সরকার বেশ কিছু বিষয় লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে কিছু বিষয় হাইলাইট করে। দর্শকরূপী জনগণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে চায়। সমস্ত দেবালয়েই ধর্মের নামে চলে যুদ্ধ। সাধারণ মানুষকে ঠকানোর লড়াই। হসপিটাল থেকে কাঞ্চন নিজেই ছুটি নেয়। টিভিতে চলে নেকড়ে ও খরগোশের খেলা। মাঝেমাঝে রিপিট হয়। পাল্টে যায় অত্যাচারের বয়ান। শোষণ ও শোষিত ক্রমাগতই চলতে থাকে। চলে আলো-অন্ধকারের খেলা। অন্ধকার বড় মায়াময়। রূপকুমার নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। তা আরও বড় নিঃসঙ্গ হয়ে যায় বৃষ্টিতে। সব রহস্য। কাঞ্চনের আসা-উবে যাওয়া। কেন আসা ? উত্তর নেই ? নিজের থেকেই কি মুক্তি না অন্যকিছু। কাঞ্চন এসেছে কিন্তু বৃষ্টিতে ভেজেনি। অথচ বৃষ্টি পড়ছে। প্রবল অন্ধকার। তবুও দেখা যাচ্ছে। বাস্তবের বিভ্রম। কখনও বিভ্রমের বাস্তব। প্রবল অন্ধকারে কাঞ্চন আলোর মতো দেখতে পাচ্ছে। যেন সমুদ্রযাত্রার অন্ধকার। একজন অন্ধকারে অন্ধ। অন্যজন অন্ধকারে সব দেখতে পায়। ঘুমের ভিতরেও তো অন্ধকার। তবুও স্বপ্নে সব দেখতে পাওয়া যায় কেন ? মাতৃগর্ভে তো অন্ধকারেই জন্ম। অন্ধকারে খেলা করে খরগোশ। জীবনের এপিট-ওপিট। চলে আলো-অন্ধকারের মেলবন্ধন –
‘’তার চেয়েও আশ্চর্যের বিষয়— অন্ধকারের মধ্যে পরস্পর পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছিলাম দিনের আলোর মতন স্পষ্ট। কিন্তু একে যেন কোথায় দেখেছি ? কোথায় ? ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেল যেসব পুরুষ দেবতাদের পুজো করা হয়— বিশেষত প্যান্ডলে মূর্তি বানিয়ে, সেই সব মুখের আদলে তৈরি মানুষটি। নিশ্চিন্ত হয়ে যাই এ আমাকে ধরিয়ে দিতে আসেনি। কেননা দেবতাদের সৌম্য মুখে যে বিষণ্ণতার ঝিলিক থাকে তা এরও আছে। এরকম বৃষ্টির মধ্যে না-ভিজে আসাতে ধরে নেওয়া উচিত এ হয় দেবতা না-হয় কাঞ্চনমালার জাদুকর।’’ ( তদেব, পৃ. ১০৭ )
লেখক বড় অদ্ভুত কৌশলে আখ্যান নির্মাণ করেন। কাঞ্চন হয়ে যায় খরগোশ। খরগোশ থেকে পুতুল। কাঞ্চনের পুতুল খেলার সখ। জাদুকর সে সখ মেটাতে চেয়েছে। রূপকুমারের সঙ্গে মেলাও যেন এক পুতুল খেলা। রূপকুমার উষ্ণতা পায়। খরগোশকে আদর করে আরাম পায়। খরগোশের ভিতর লুকিয়ে থাকে কাঞ্চন। কাঞ্চনের গর্ভের সন্তানকে রূপকুমার নিজের সন্তান ভাবে। খরগোশ মোমবাতি উলটিয়ে দেয়। অন্ধকার বিরাজ করে। জাদুকর আর্তনাদ করে ওঠে। টিভিতে মৃত নেকড়ে ও খরগোশ পাশপাশি শুয়ে থাকে। রূপকুমারের মনে হয় সেই খরগোশই বুঝি এই খরগোশ। রূপকুমারকে খরগোশ দাঁত বসিয়ে দেয়। তাঁর মনে হয় এ বুঝি কাঞ্চনমালার আদর। প্রতিটি মেয়ে মানুষের আদরের ভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন রকম। আবার মনে হয় নিজে গবেট। সব অলীক। ক্রুদ্ধ হয় জাদুকর। জাদু বশ হয় না। আঘাত করতে কোন কোন সময় মনে হয় জাদু ব্যর্থ হচ্ছে। চরম হতাশায় ভোগেন জাদুকর। কাঞ্চন নিজের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। আলো থাকলেই খরগোশ নেই। অন্ধকারে দাপিয়ে বেরায়। রূপকুমারের মনে হয় ওটা খরগোশ নয় কাঞ্চন। এমন হওয়া কি সম্ভব ? মস্তিষ্ককে নিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়। জাদুবিশ্বাস এলোমেলো হয়ে যায়। এক কাঞ্চনকে ভ্যানিশ করলে অন্য কাঞ্চন তৈরি হয় না। থাকে সময়পর্ব নিয়ে স্টেটমেন্ট। সময় স্রোত কোনদিন একখাতে প্রবাহিত হবে না। সম্ভব নয়। কাঞ্চনকে হসপিটাল থেকে নিয়ে গিয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়েছে। রক্তের প্রয়োজন। রক্তের বাজার অর্থনীতি জানে না রূপকুমার। রক্ত নিয়েও যে রাজনীতি চলে তা সাধারণ মানুষের লোকচক্ষুর বাইরে থাকে। হজুর মাহাতোর খুন হওয়া ও লাশ নিখোঁজ হওয়া খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়। এক সত্য খুঁজতে গিয়ে উঠে আসে ভিন্ন সত্য। মৃতনদীর প্রসঙ্গ সাধারণ মানুষ জানতে পারে। এই ল্যান্ড নিয়েই ভারতে যত কোরাপশন। অথচ সরকার এ সমস্যার সমাধান করবে না। সরকারের একটা বড় অংশের রাজস্ব আসে ভূমিরাজস্ব বিভাগ থেকে। জমির পরিমাণ তো বৃদ্ধি পায়নি। পাবেও না কোনদিন। শুধু হস্তান্তরিত হবে। হস্তান্তরের মধ্যেই সরকার রাজস্ব নেবে। আসলে চলে ক্ষমতার রাজনীতি। ক্ষমতা মানুষকে নিখোঁজ করে দেয়। ব্যক্তি মানুষের নিখোঁজ হওয়ায় রাষ্ট্রের বড় লাভ। নিখোঁজ মানুষ মৃত নয়। চলে অবিরাম খোঁজা। সময়ের সঙ্গে মানুষের মুখমণ্ডলে পরিবর্তন আসে। আর খুঁজে পাওয়া যায় না। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একটা পথ চলা। এ পথ ক্ষণিক। কিন্তু বড় নির্মম। একবলমাত্র রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই এ নির্মমতাকে অতিক্রম করে যায়—
‘’কী নিখঁত, নিরাপদ পরিকল্পনা ! কেবলমাত্র নিখোঁজ শব্দটি নামের আগে বসাতে পারলেই হল। শব্দটির মধ্যে হিংস্রতা নেই— উদাসীন এক তত্ত্বের দিকে কেবলই ঝোঁক। যে হারিয়ে যায় তাকে কেউ মৃত না-বলে অপেক্ষা করে যতক্ষণ পর্যন্ত এই অপেক্ষা আইনসিদ্ধ না-হয় ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা। নিখোঁজ হবার সময় কেমন দেখতে ছিল ? এখন দেখতে কেমন হত ? এই প্রশ্নের মীমাংসা হবার আগে ভুলে যায় যে-কোনো একদিন নিখোঁজ হয়েছিল কেউ ! একসময় সবকিছু মুছে যায় !” ( তদেব, পৃ. ১১১ )
উবে যাওয়ার মন্ত্র আছে কিন্তু ফিরিয়ে আনার মন্ত্র নেই। সে মন্ত্র শিখে নিতে হবে ঠাকুমার কাছ থেকে। কাঞ্চনের অন্তর্ধানের মধ্যে রয়েছে প্রতীকী যৌনতা। রূপকুমারের যৌনতা। পুরুষ যে দৃষ্টি নিয়ে নারীর প্রতি ধাবিত হয়। শারীরিক মিলন প্রত্যাশা করে। পুরুষ যৌনতার গন্ধ পায়। শারীরিক ভাষা বোঝে। আখ্যানও জটিল হয়ে ওঠে। পৃথিবীর সব দেশই ক্ষমতা দখল করতে চায় কিন্তু রক্তের দাগ রাখতে চায় না। প্রত্যেক রাষ্ট্রই নদী দখল করতে চায়। রণনীতিতে রক্তের দাগ থাকলে তা নদীর জলে ধুয়ে শুদ্ধ করে নিতে চায়। সময়স্রোত নদীর মতো। তার গতি অতি দ্রুত। অতীতকে পিছনে ফেলে সদা এগিয়ে যায়। কিন্তু কেউ কেউ প্রবলভাবে ধরে রাখতে চায়। রক্ত গণতন্ত্রের পক্ষে বিপদ। ফলে দাগ মুছে ফেলতে হয়। কিন্তু কুলু ধোপার বউ তা পারে না। রক্তের দাগ মুছতে গিয়ে নদীর জলই শেষ করে ফেলে। ঠাকুমার মতে এ দাগ ইতিহাসের দাগ। এ দাগ লুপ্ত হবে না। আসলে পুরুষতান্ত্রিক পরিবার। চিরজীবন নারী শোষণ করে গেছে। ফলে ক্ষত থেকে গেছে। এ দাগ শত চেষ্টাতেও মুছবে না।
রণরক্তই সত্য- শেষ সত্য, বাকি সব মিথ্যা –
ঠাকুমার বয়ানে দাগ মুছতে হলে পাতালের নদীতে যেতে হবে। রূপকুমার তাই রক্তের দাগের প্রসঙ্গ কৌশলে এড়িয়ে যায়। তালপাখা যে কখনও কখনও হিংস্র হয়ে ওঠে তা একমাত্র ঠাকুমাই জানেন। রূপকুমার ঘটা ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নয়। সে নিজস্ব ইতিহাস তৈরি করে। আসলে ইতিহাস তো ঘটাতে হয়। ঘটমান বর্তমানই ভবিষ্যতে ইতিহাস হয়ে যায়। বিরাজ করে মাফিয়ারাজ। যারা নিত্য ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে। ধ্বংসকে বিনোদন মনে করে। হাতি মারা যায়। হাতি বশ করতে পারলেও মৃত হাতিকে জীবন্ত করতে পারে না। ফলে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। হাতি মৃত হওয়ায় পার্টি বিপন্ন। যদিও বাঘ ঘুমিয়ে থাকে। পার্টি পিসিদের বেশ্যাগিরির সমস্ত অর্থই নিয়ে নেয়। কিছু অর্থ পার্টি ফান্ডে কিছু অর্থ নেতার পকেটে। রূপকুমারের পিতা পূর্বের পেশায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়। আগে যাত্রায় দেশনেতা সাজতো। কিন্তু পাবলিক তা খায় না। ছদ্ম দেশনেতার পাঠ ভালোবাসে না। পাবলিক চায় যৌনতা। যাত্রায় শেষে মেয়ে মানুষ সাজতে হয়। কখনও রাস্তায় দেবী সাজে দাঁড়িয়ে থাকে। লিঙ্গ লুকিয়ে কালী সেজে থাকে। উচ্চ বক্ষ দেখে পাবলিক পয়সা ছুড়ে মারে। পাবলিক মজা পায়। বিনোদন হয়। রাষ্ট্র এর মধ্যে সব গ্রাস করে নেয়। জীবন-মৃত্যুর খেলা চলে। গানম্যান বারবার টার্গেট করে। মিস হয়ে যায়। অপর প্রান্তে থাকা মানুষ হাসে। চলে আলো-আঁধারের খেলা। রাষ্ট্র-মানুষের বাঘবন্দি খেলা। এনকাউন্টার-মিস এনকাউন্টারের এক্কা দোক্কা বা ছু কিত কিত খেলা।
পীযূষ ভট্টাচার্যের আখ্যান সরল রেখা বা জটিল রেখা নয় একটা বৃত্ত। সে বৃত্তে তিনি সব প্রবেশ করিয়ে দেন। সব তালগোলা হয়ে যায়। সেখান থেকে পাঠ আবিষ্কার করে এগিয়ে যেতে হয়। কাঞ্চন রাতে জেগে থাকে। ফোনে কথা হয়, সব জানতে চায়। রূপকুমারের সব অবাস্তব মনে হয়। সে মৃত নেকড়ে ও ইঁদুরের দৃশ্য আবার দেখতে চায়। বারবার একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটে। কাহিনিও ফিরে ফিরে আসে। প্রবল বৃষ্টি হয়। জমা জলে মরা নদী জেগে ওঠে। বৃষ্টির শব্দে বাবা মা ফিরে আসে। খরগোশের পরিবর্তে টিভিতে শুরু হয় জলাশয়ে কুমির আটকে যাবার প্রসঙ্গ। সব শুকিয়ে যাচ্ছে। ঠাকুমা বাঁচা ও মানুষের চেহারা ফিরে পাবার মন্ত্র কাঞ্চনকে শিখিয়ে দিয়েছে। এখানেই রূপকথা শেষ হতে পারত কিন্তু হয় না। কেননা আরও পথ বাকি আছে। রূপকুমারের সন্তান জন্ম দিতে হবে। আখ্যান এগিয়ে চলে রূপকথার ভঙ্গিতে। বর্তমানে কাঞ্চনের ঝুলিতে বাঁচা ও উবে যাওয়ার মন্ত্র উভয়ই আছে। এর ফলেই অনিশ্চিয়তার জন্ম হয়। অনিশ্চিয়তা গর্ভের সন্তানের জন্ম নিয়ে। শুরু হবে আরেক পর্ব। ঠাকুমা বুঝি বিদায় নিলেন ! সব দিয়ে গেলেন কাঞ্চনকে, নাতি রূপকুমারকে নয়। এখান থেকেই নারী প্রগতির চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঠাকুমা জানতেন পুরুষতান্ত্রিক শোষণের কথা। খড়গ বা তালপাখা ঠাকুমা তো এজন্যই রেখেছিলেন। রূপকুমাররা হয়ত বেঁচে যাবে কিন্তু কাঞ্চনকে বাঁচাবে কে ? রূপকুমারের অত শক্তি আছে কি ? কাঞ্চন না থাকলে ভবিষ্যৎ হয় না। উত্তরাধিকারীর জন্ম হয় না। মন্ত্র শিখিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন ঠাকুমা। আসলে মন্ত্রের এটাই তো নিয়ম ছিল। এভাবেই আখ্যান অবাস্তব থেকে বাস্তবে প্রবেশ করে। রূপকথার মোড়ক খুলে জটিল জীবনের আভাস দিয়ে যায়। যে জীবনে নারী প্রতিমুহূর্তে অত্যাচারিত। একা সংগ্রাম করে গেছেন ঠাকুমা। কিন্তু বয়স তো শেষ। উত্তরাধিকারীর হাতে সব তুলে দিয়ে বিদায় নেন। ঠাকুমার মধ্যে পাওয়া যেতে পারে রানি রাসমনি ও সারদার ভাবাদর্শ বা জীবনচেতনা।
এর পরের খেলা ঠাকুমার মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থা নিয়ে। যেখানে চলবে রাজনীতির অস্থিরতা ও শাসন ব্যবস্থার দুর্নীতি। স্বভাবতই পরিচ্ছেদের নাম হয় ‘তীর্থযাত্রা পথে কিছু লিলিপুট’। এ তীর্থস্থান ঠাকুমার কবরস্থান। নদীতে জল নেই। বজরা আটকে গেছে। এ গ্রাম ঠাকুমার শ্বশুরবাড়ির দেশ। শূন্য গ্রাম। শূন্য মানুষ। কেবল ঠাকুমার বাড়ির মানুষরা জেগে আছে। বজরা থেকে নামা মানুষটি ঠাকুমার পরিচিত। সে পৌঁছতে চায় শৈশবে। চলে শৈশবের খেলা। পরস্পর পরস্পরকে আড়াল করবার খেলা। কাহিনি শুরু হয়ে আশ্চর্যভাবে। মাঝ নদীতে জল নেই। কবে বৃষ্টি হবে তারপর বজরা চলবে। মানুষ তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। ঠাকুমার নাম ছিল ধলি। অতুল পণ্ডিতের ছেলের সঙ্গে ঠাকুমার সম্পর্ক ছিল। এসব ইতিবৃত্ত বহু বছর আগের। প্রায় পাঁচশো বছর তো হবেই। রূপকথা যেভাবে গড়ে ওঠে। সময়ের ব্যবধানে কেউ কেউ মনে রেখেছে। তবে সবাই নয়। মনের স্মৃতিতেও পলি জমেছে। ধীরে ধীরে সব পাল্টে যায়। এই যে শুনে শুনে মনে রাখা এর মধ্যে কোন গোপন অভিসার বা অভিসন্ধি ছিল। তবে তা স্পষ্ট নয়। ঠাকুমা এসব জানেন। আসলে লোকায়ত ঐতিহ্য এভাবেই গড়ে ওঠে। রূপকথা গড়ে ওঠে। শূন্যে পাখির বাসা থাকে। লেখক শূন্যের দর্শন গড়ে তুলতে চান। শূন্যে পাখির বাসা স্থির। চারদিকের কোন বাতাসেই নড়ে না। শূন্য একটা ধারণা। একটা অবয়ব। একে কল্পনা করে নিতে হয়। এ কল্পনা যেন নিরুদ্দেশের লাশকে সনাক্তকরণ স্বরূপ। কিন্তু চেহারার বর্ণনা তো স্মৃতি থেকে লুপ্ত। মানব কল্পনা দিগন্তব্যাপি প্রসারিত। তার আকাশ পাতাল নেই। এ কল্পনা শুরু হোক একটি নির্দিষ্ট বিন্দু থেকে। তা নির্দিষ্ট অবয়বে অনেক সময় পৌঁছতে পারে না। সম্ভব নয়। তবুও লক্ষ্যে পৌঁছবার একটা অভিপ্রায় থাকে –
‘’এখন আর বুঝতে অসুবিধে হয় না শূন্যে পাখির বাসা দেখলেই বুঝতে পারি তার উপস্থিতি। অবশ্য এখানে এসে দাঁড়ালেই এমন এসে দাঁড়ালেই এমন হয় অন্যসময় এসবের অস্তিত্বই নেই। কেবলই মনে হয় পাখির বাসাটি শূন্যে বিন্দুর মতন স্থির। যেন কোনো অদৃশ্য কিছুর উপর বাসাটি রাখা এবং তাকে আগলানোও হচ্ছে, না-হলে হাওয়ায় দুলত, পৃথিবীর দশদিক থেকে যে-কোনো একদিকে হাওয়া তো উঠছেই সবসময় তবুও বাসাটি দুলে ওঠে না। শূন্যতার মধ্যে অবিচল এক বিন্দুই হয়ে আছে। এমনই এক বিন্দু যে, মানুষের পক্ষে অতিক্রম অসম্ভব।’’ ( তদেব, পৃ. ১১৯ )
শূন্যে পাখির বাসা থাকে। মনে হয় কেউ অলক্ষ্য থেকে সামলাচ্ছে। ঠাকুমা এসব লক্ষ্য রাখতেন। তালগাছের ছায়া এসে মানুষকে ঢেকে দেয়। মানুষ আসে বলেই ছায়ার উপস্থিতি জানা যায়। ছায়াই যেন মানুষের উপস্থিত জানান দেয়। মানুষের চেতনা উপলব্ধি হয়। গল্পের প্রাণ ফিরে পায়। এভাবেই ঠাকুমা বেঁচে উঠতেন। নারী মাংসের গন্ধে পুরুষ ফিরে আসে। নারী মাংস বড় লোভনীয়। পুরুষ সর্বদা তার পিছনে হরিণের মতো ছুটে চলে। লেখক যান ইতিহাসের জগতে। সেখানে যুক্ত করে দেন মার্কসবাদী দর্শন। আসে কিউবিয়ান হামিংবার্ডের প্রসঙ্গ। ওদেশের রাজনৈতিক দর্শন এদেশের মানুষ গ্রহণ করছে। ব্যক্তির মুক্তি ঘটাতে চাইছে। মানুষও আশ্রয় চায়। যেন নিজের মনেই বাসা বানিয়ে নিয়ে নিচ্ছে। আসলে রূপকথা গড়ে উঠছে। তবে কল্পিত রূপকথা। লেখক রূপকথার বিনির্মাণ ঘটাচ্ছেন। এর মধ্যে ভয়ংকর বাস্তব লুকিয়ে থাকে। এ আখ্যান বড় মায়াময়। পাখি পিছন দিক করে উড়ে যায়। তা কি সম্ভব ? সবই অদ্ভুত। বিভ্রমের বাস্তব নিয়ে লেখক ঘোরাফেরা করেন। পুরোপুরি বাস্তব নিয়ে উপন্যাস লেখার দিন শেষ। ক্রমাগত চলছে উপন্যাসের পরীক্ষা নিরীক্ষা। লেখক বিভ্রমকেই যেন উপন্যাসের আখ্যান হিসেবে বেছে নিলেন। তার মধ্যে বাস্তবকে প্রবেশ করান। পাঠককে সে বাস্তব আবিষ্কার করতে হয়। উপন্যাস পাঠও তো এক অচিন দেশ আবিষ্কার। ধারণাগত বয়ানকে ভেঙে দিতেই একজন লেখক বুঝি কলম ধরেন। আখ্যান রচনা করেন। সচেতন ভাবেই পৃথক পথে যেতে হয়। আয়ত্ত করতে হয় দর্শনকে।
রূপকুমার কিউবা বলতে বোঝে শুধু চে গুয়াভাকে। ভাষা স্প্যানিশ বলে টুপি পরা ব্যক্তির ছবিতে কি লেখা ছিল বোঝা যায়নি। তবে বিপদ ঘটে। জড়িয়ে ধরতে গিয়েই এক উপলব্ধিতে পৌঁছায়। এরপর থেকে পকেটে যৌন নিয়ন্ত্রণ টেবলেট রাখে। পৃথিবীর ছোটো পাখি হামিংবার্ড। এ পাখি বারবার সূর্যস্নাত হতে চায়। অনন্ত পণ্ডিতের ছেলে এসব উপলব্ধি করে। বিভ্রান্তি ঘটে। কে কাকে স্নান করাচ্ছে বোঝা যায় না। পাখি না অনন্ত পণ্ডিতের ছেলে ? ধারণা দোল খায়। যে বিন্দু কিছুক্ষণ আগে ছিল শূন্যে এখন তা পরিকাঠামোর মধ্যে স্থির। পিছনের ছায়া এক অবয়ব সৃষ্টি করে। চলে আলো ছায়ার খেলা। লেখক বারবার ছায়ার ধারণা নিয়ে আসেন। আলোর ধারণা স্পষ্ট করতেই বুঝি ছায়াকে উপস্থিত করতে হয়। তবে আলোর বদলে আখ্যান আরও অন্ধকারে ডুবে যায়। আখ্যান জটিল হয়ে যায়। লেখক পাঠককে ভাবনার রসাতলে ডুবিয়ে দেন। আলোর প্রতিবিম্ব খুঁজতে হয়। কথার পিঠে কথা আসে। স্বপ্নের বিভ্রান্তি ঘটে। অদৃশ্যলোকে কাহিনি এগিয়ে যায়। অদৃশ্য লোকে গেলেই ঠাকুমার লাভ। লোকালয়ে মানুষ শূন্য হতেই পাখিরা চলে যায়। শূন্য থেকে উঠে আসে শব্দ। লেখক পাঠকের দিকে মন্তব্য ছুড়ে দেয়। যেন পাঠককেরও কিছুটা দায় থেকে যায় –‘’মূল গল্প যে রকমই হোক, যে তার ভিতর ঢুকবে সে তার নিজের মতনই পথ তৈরি করে নেবে। সত্যিই তো এমনও ঘটতেই পারত।” (তদেব, পৃ. ১২২ ) অনন্ত পণ্ডিতের ছেলে বহুদিন আগেই মৃত হয়েছে। তবে ঠাকুমার মনে হয় বুঝি বেঁচে আছে। আসলে ভালোবাসা ছিল। জটপাকানো পাঁচমিশালি গন্ধ বিভ্রম সৃষ্টি করে। তবুও মৃত ফিরে আসে। আখ্যানের প্রয়োজনে ফিরিয়ে আনতে হয়। ঠাকুমা নিজের যৌনজীবন সম্পর্কে সচেতন হয়। ঘরে স্বামী ন্যাংটো করতে চায়। ঠাকুমা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। ঠাকুমার মধ্যে নারীচেতনার একটা ধারণা পাওয়া যাবে। অনন্ত পণ্ডিতের ছেলে ঠাকুমার কিশোরী রূপে মুগ্ধ ছিল যৌবনে নয়। যৌবনের মহিলারা তার কাছে সবাই সমান। হিরণ্যপ্রভা নদীতে স্নানে গিয়ে পোর্তুগিজ জলদস্যুদের হাতে পরেছিল। কিন্তু হিরণ্যপ্রভাকে দেখেই ক্যাপ্টেন গনেরিয়ার যন্ত্রণা শুরু হয়। তাই ছেড়ে দেয়। হিরণ্যপ্রভা হয় বর্জিত মানুষ। সমাজে পোর্তুগিজ জলদস্যু ছোওয়া মহিলার কোন দাম নেই। এমনকি বেশ্যাপল্লিতেও। সে হয়ে যায় পতিত। কিন্তু এ তো নারী শরীর। শরীরই সম্পদ তা হিরণ্যপ্রভা বুঝেছিল। শরীরকেই সে কাজে লাগাতে চায়। উঠে আসে নারীর সচেতন আত্মপ্রত্যয়। টিকে থাকার কৌশল আয়ত্ত করতে হয়।
পাপ-আদিপাপ-মহাপাপ গঙ্গায় ধুয়ে যায় না !
ঠাকুমা অলৌকিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। দেহে অসীম শক্তি ধরে। নারীমূর্তির প্রতীক হয়ে ওঠে। তিন পুরুষকে উরুতে চেপে দিতে পারে। আসে পাপ সম্পর্কে বয়ান। আদিপাপ ও মহাপাপ। সবাই সমান অপরাধী নয়। মূল পাণ্ডার সঙ্গে থাকতে থাকতে অপরাধী হয়ে যায়। তবে অপরাধের হেরফের আছে। আখ্যানের সর্বত্র স্পষ্ট হয় না। সেজন্য আখ্যান বুঝতে অসুবিধা হয় না। কান্না চলতে থাকে। সব যেন নিয়তি। নিয়তিই সব ঘটায়। ভবিতব্যই সব ঘটিয়ে চলছে। কান্না চিরদিনের মতন থেমে যাওয়াতেই শান্তি। আবার বিস্মরণও ঘটে। জলদস্যুদের মনে হয় অনন্ত পণ্ডিতের ছেলের মতো। স্মৃতিতে জটেলা বাধে। মনে হয় সব ধোঁয়াশা। মনে হয় এই বুঝি প্রতিশোধের উপযুক্ত সময়। ঠাকুমা বুঝিয়ে দিতে চায় নারী শক্তি কত প্রবল। তিনজনের রক্তে ঠাকুমার শরীর দুলে ওঠে। শরীরের কম্পনে মেদিনী কেপে ওঠে। ভূমিকম্প মনে হয়। নারীর অত্যাচারে পাতালগর্ভের দেবীও বুঝি ক্ষিপ্ত হন। আখ্যানের সূচনায় যে খড়গ বা তালপাখা পেয়েছিলাম তা স্পষ্ট হয়। ঠাকুমার হাতিয়ার। এ দেশ নারী লুণ্ঠনের দেশ। নারী মাংসে বড় লোভ। তা থেকে রক্ষার কৌশল আয়ত্ত করেছিল ঠাকুমা। ঠাকুমা নিজেই হয়ে ওঠে বিদ্রোহের প্রতীক। তিনজন পুরুষকে ঠাকুমা একাই লোপাট করে দেয়। এ ইতিবৃত্ত ঘুরবে পাঁচশো বছর ধরে। নারী যেন রণনীতির এক মাধ্যম। আগে নারীকে ধ্বংস করা সিস্টেম। জুয়ার হাতিয়ার জুয়ার তাস। জীবন তো ঘটনার ইতিবৃত্ত। নারী জীবন এ ইতিবৃত্তের পটভূমিতে দাঁড়ানো। জীবনের মানে খোঁজা। ঠাকুমার মনে হয়েছে নিজেই যেন রণভূমিতে পৌঁছেছে। পুরুষ বোঝে যুদ্ধের রণনীতি। পুরুষ বোঝে ধর্ষণ। সেখানে নারীর কিশোরী-মহিলা-বৃদ্ধা কোন পৃথক সত্তা নেই। শুধু স্ত্রী অঙ্গ ধ্বংস করে দাও। নারীই যে পুরুষ জন্মের ইতিবৃত্ত তা বোঝে না। পুরুষকে বোঝানো যায় না। জীবন হয়ে যায় রণক্লান্ত। এখানে জীবন যাপনের অর্থ কী ? উপন্যাস যত পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় ঠাকুমার প্রতিবাদী সত্তা তীব্র হতে থাকে। বেঁচে থাকার মন্ত্র তিনি কাঞ্চনমালাকে শিখিয়ে দিয়েছেন। রূপকুমারকে কেন নয় ? সেও তো পুরুষতন্ত্রের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। ঠাকুমা জানেন পুরুষতন্ত্রের ইতিবৃত্ত। মৃত ঠাকুমাকে দেওয়া হবে বীরাঙ্গনা উপাধি। এজন্য রূপকুমারের উপস্থিতি প্রয়োজন। কেননা সেই ঠাকুমার বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারী। তাঁর উপস্থিতিতেই সরকার ঠাকুমাকে বীরাঙ্গনা উপাধি দিতে চেয়েছে। ঠাকুমা মৃত হয়েছে না করে দেওয়া হয়েছে তার কোন সূত্র নেই। মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়। যথারীতি মৃতদেহ নিয়ে শুরু হয় রাজনীতি। সরকার প্রতিবার বয়ান পাল্টে ফেলে। বিডিও সাহেবের বারবার পরিবর্তনে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি কেন কবর দেওয়া হল হিন্দু মহিলাকে। জানা যায় দহনে এক বন কাঠ প্রয়োজন ছিল। পরিবেশ বাঁচাও কর্মীরা তা নিয়ে আন্দোলন করতে পারত। কিন্তু বয়ান বারবার পাল্টে যায়। নারী শোষণের চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
লৌকিক বিশ্বাস যে তালগাছ বোনে সে তাল খেতে পারে না। আগেই মৃত হন বা তাল ধরতে দেরি হয়। অর্থাৎ ফল অপেক্ষা ছায়া বিস্তার করাই প্রকৃত উদ্দেশ্য। ঠাকুমা যেখানে কবরস্থ হয়েছেন সেখানে বহু তাল গাছ হয়েছে। সবাই এসে তাড়ি খায়। কিন্তু তাল কেউ খায় না। তাল পরে নতুন একটি গাছের জন্ম হয়। ঠাকুমার নারীচেতনা যেন প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে। এখানে সবাই গল্প শোনে। ঠাকুমার কথা ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। নারীর প্রতিবাদী সত্তা বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে। এখানে রূপকুমার আসে। হোটেল মালিকরা ভেবেছে সেই বুঝি তদন্তকারীদের কেউ? সেও প্রথমে পরিচয় দেয়নি। এখানে দিনের সূচনা ডাউন ট্রেন ছেড়ে যাবার পর থেকে। অর্থাৎ রাত থেকে। বড় মায়াময় এ সময়ের চলমান। সময় চলমান হলেই জীবন চলমান। তবে বিপন্ন বিস্ময় আছে। জীবনের বিপন্নতা। কথকের মতে জীবন-মৃত্যুর কোন একটিকে বেছে নিতে হবে। কিন্তু কোনটিই জানেন না। ওপারের সময়কে জানতে চান। ঠাকুমার মৃত্যুকে বলে হয় এক ধরণের সুইসাইড। সত্যি কি তাই ? না অন্য কিছু ? স্পষ্ট করার কোন দায়িত্ব লেখকের নেই। অর্ধসত্যকে সামনে রেখেই পাঠককে এগিয়ে যেতে হবে। অনন্ত পণ্ডিতের ছেলে নেই। ফলে বয়ান শোনার কোন তথ্য নেই। অথচ বয়ান চলতেই থাকবে। অত্যাচার চলবে। প্রতিবাদও চলবে। দুই জগত পাশাপাশি অবস্থান করে। উড়ানের মধ্যে থেকে যায় রহস্য। সময়ের পুনর্জন্ম ঘটে।
একসময় অনন্ত পণ্ডিতের ছেলেকে বিদায় দেওয়া হয়। কে বিদায় দেবে ? ঠাকুমা তো নেই। তালগাছের ছায়ারা সারিবদ্ধ ভাবে বিদায় জানায়। রাত্রির স্পন্দন ব্যক্তিকে নিয়ে যায় অতীতে। অতীতের ভেতরই থাকে ভবিষ্যতের বীজ। চলে জীবন মৃত্যুর খেলা। একে অপরের এপিট-ওপিট। যেন দুজন প্রতিদ্বন্দ্বী। দুজন দুজনকে পরাজিত করতে চায়। যেকোন একটাকে বেছে নিতে হবে। ঠাকুমা বলেছিল মৃত্যুকেই বেছে নিতে। নারী তো মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করে। লেখকের মৃত্যু দর্শন প্রাধান্য পায়। ঠাকুমা নাতিকে উবে যাওয়ার মন্ত্র শিখিয়ে দিয়ে নিজে ভুলে যান। ঠাকুমা বুঝেছিলেন সময় শেষ। উত্তরপ্রজন্মকে প্রতিরক্ষার হাতিয়ার দিয়ে যান। অদৃশ্য সময়কেই ফিরিয়ে আনা যায় মন্ত্র বলে। ঠাকুমা নাতিকে বলেছিলেন আত্মরক্ষার জন্য যদি বিশেষ প্রয়োজন হয় তবে আসতে। রূপকুমার আজ এসেছে মৃত ঠাকুমার কাছে। আছে লেখকের রাজনৈতিক দর্শন। বলা ভালো লেখক মার্কসবাদী চেতনায় বিশ্বাসী। রূপকুমারের মাথার দাম নির্দিষ্ট করেছে সরকার। ফিরে আসে মাওবাদী ধারণা। ঠাকুমার সন্ধানে এসে একাধিক কাহিনির ভেতর প্রবেশ করা যেতে পারে। এভাবেই রূপকথার জন্ম হয়। ঠাকুমার কবরস্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিনোদনের বিপণন। আছে ধর্ষণের মনস্তত্ত্ব। কটেজগুলোতে চলে বেশ্যাদের খেলা। তবে বেশ্যার সঙ্গে ধর্ষণের পার্থক্য আছে। ধর্ষণ একবারই। এটাই যেন ভবিতব্য। সহ্য করাই যেন নিয়তি। হোটেল মালিকের কোন স্বাগতম আহ্বান নেই। মনে হয় নতুন যুগের জন্ম হবে বুঝি !
বৃত্তশেষ না শেষবৃত্ত, আসলে সবই গোলার্ধ ...কবরস্থানকে কেন্দ্র করে চলে হোটেল ব্যবসা। হোটেলে স্থাপত্য আছে, দেবী আছে। বাথরুম থেকে কৌশলে জায়গা চুরি করে দেবী স্থাপিত হয়েছে। নইলে ঘর কমে যাবে। ঘর কম হলে রোজগার কমে যাবে। অথচ কালচার বোঝাতে হবে। ড্রাইভার বসে বসে ঝিমতে থাকে। ঝিমুনির মধ্যে জীবনের গতি সঞ্চিত হয়। গাড়ি চললেই তা বেগ পায়। তিনজন মানুষ হোটেলে আসে। কথকের বিভ্রান্তি ঘটে। মনে হয় একজনের পদশব্দ। এমনকি পদশব্দে সংখ্যা মিলিয়ে যায়। পরে বোঝেন এরা মিলিটারিম্যান। সরকারি নীতিতে চোরাকারবারি প্রকাশ্যে এনে দেন। গাড়ির ড্রাইভার দুই ধরণের বিছানায় শোয়। গাড়ির সীটে নয় মেয়ে মানুষের সঙ্গে বিছানায়। সবাই এখানে এসে হোটেলের খাতায় ‘কেন এসেছিল’ এর স্থানে নানা কথা লিখলেও মিলিটারিরা লেখে –‘ড্রিঙ্কিং হোলি তাড়ি’। সত্য বয়ান। কিন্তু হোটেলে সব ক্ষেত্রে সত্য বয়ান লেখা হয় না। এটাই রীতি। লেখক সময়ের গভীরে প্রবেশ করেন। সবকিছু রহস্যময় হয়ে ওঠে। কথককে হোটেল মালিক ভাবে তদন্ত অফিসার। সরকারি সমস্ত কাজে চলে চুরি। অথচ তদন্ত কমিশন বসে। সিস্টেমে গন্ডোগোল চলে। ঠাকুমার কবরে সবাই টাকা চুরি করেছে। মাটি কাটা থেকে শাড়ি কেনা, শামিয়ানা খাটানো ও ঠাকুমার উরু থেকে লাশ বের করার কন্ট্রাক্টে চুরি। কোন প্রতিকার নেই। সমস্ত অফিসারই চেন অনুসারে টাকা রোজগার করে। সমস্ত সিস্টেমটাই ভেঙে গেছে। একটি ঘটনার তদন্ত হতে দীর্ঘদিন চলে যায়। আইন নিজেই বড় জটিল ধাঁধা রচনা করে। পাবলিক কোন বিচার পায় না। ঠাকুমার উরু থেকে তিনজনকে কীভাবে বের করা হয়েছিল তা নিয়ে রহস্য দানা বাঁধে। কেউ বলে সুড়সুড়ি দিয়ে ! কিন্তু কীভাবে ? কে দেবে সুড়সুড়ি ? পুরুষ না মহিলা। নানা জটিলতা প্রাধান্য পায়। শেষে ঠাকুমাকে বলা হয় লেসবিয়ান। স্টেশনে ট্রেন আসে। মালিক বাদে কেউ ট্রেনের শব্দ শুনতে পায় না। যেন এক রহস্যপুরী। মালিক বলেন সবাইকে ধরিয়ে দিতে কিন্তু ব্যবসা তো লাটে উঠবে। কিন্তু ঠাকুমাকে তো ফাঁসানো হচ্ছে না। ফলে ব্যবসা চলবে। অদ্ভুত বয়ান। কীভাবে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠে। বিনোদনের আখড়া স্থাপিত হয়। অথচ প্রকৃত ইতিহাস চাপা পরে যায়। বলা ভালো চাপা দেওয়া হয়। নইলে ব্যবসা হয় না। তদন্ত কমিশন বসানো হয়। বছরের পর বছর ধরে তদন্ত চলে। কিন্তু বিচারের রায় দান হবে না। ঠাকুমারা ন্যায় বিচার পায় না। এদেশের নারীরা ধর্ষিত হয়। লাঞ্ছিত হয়। হারিয়ে যায়।
রাতের তালবন বড় বিস্ময়। মনে হয় সব কিছুতেই ঠাকুমার নজরদারি আছে। কাঞ্চনের প্রসঙ্গ এখানে গোপন থাকে। সবাই জানে কথক তদন্ত কমিশনের লোক। কিন্তু প্রকৃত সত্য ভিন্ন। হুজুর মাহাতোর খুনি হিসেবে চিহ্নিত কথক। তাই এখানে পলায়ন। ধীরে ধীরে সব রহস্য উন্মোচিত হতে থাকে। ঠাকুমাই ধরিয়ে দিতে চেয়েছে। তাহলে সরকারি অর্থ অন্যের হাতে যাবে না। পঞ্চাশ হাজার জেল থেকে ফিরে আসার পর এক লাখ হবে। ঠাকুমা জানেন এ কেসে ফাঁসি হবে না। কেউ বিশ্বাস করবে না তালপাখা কীভাবে খড়গ হল। এমনকি কাঞ্চন বয়ান দিলেও মিথ্যে প্রমাণিত হবে। তালপাখা আর নেই। ইঁদুর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এরমধ্যে থাকে শ্রেণি সংগ্রামের ইঙ্গিত। শ্রেণি শত্রুকে ধ্বংসের বার্তা। দুই নারী-ঠাকুমা ও কাঞ্চনমালা। দুই যুগ। দুই সত্তা। দুজনেই রূপকুমারকে রক্ষা করতে চেয়েছে। অথচ রূপকুমার অত্যাচারিত পুরুষতন্ত্রের রক্ত বহন করে চলেছে। প্রশ্ন হল ঠাকুমা কেন এই প্রজন্মকে রক্ষা করতে চাইলেন ? পুরুষ ছাড়া নারীর যে মুক্তি নেই। আর আখ্যানে রূপকুমারের তেমন কোন প্রোটাগনিস্ট ক্যারেক্টার ফুটে ওঠেনি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতেই ঠাকুমা বেঁচে থাকার মন্ত্র কাঞ্চনকে দিয়ে যান। মিলিটারিদের মনে হয় দেবদূত। এঁরাই দেশের শান্তি রক্ষার দায়িত্বে থাকেন। অথচ এরাই সীমান্তে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণে যুক্ত থাকে। রক্ষক হয় ভক্ষক। যুদ্ধেও ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষত বিক্ষত হতে হয় নারীদের। মৃত্যুভয়ে যখন শরীর বিলিয়ে দেয় তখন যৌনতা থাকে না। ধর্ষণের পর নারী বাঁচে না। বাঁচা যায় না। এসময় নারীর পুনর্জন্ম হয় না। এজন্যই ঠাকুমা বাঁচার মন্ত্র কাঞ্চনকে দিয়েছিলেন। এখানে চলে বেশ্যাবৃত্তি। পরিবার অথর্ব বলেই একাজ করতে হয়। বংশের বৃদ্ধির জন্য এ পথে নামতে হয়। মিলিটারিরা হয়ে যায় স্বঘোষিত দেবদূত। অথর্ব মানুষটি ঘোষণা করেনি দলপতি কে হবে। মৃত্যুকালে ঘোষণা করবে। আরও বেঁচে থাকতে চায়। জীবনের রসদ কুড়তে চায়। মিলিটারিরা ড্রাইভারকেও অফার দিয়েছিল যৌনসুখ উপভোগ করার। কিন্তু সে সুযোগ নেয়নি। মিলিটারিদের মনে হয়েছে ড্রাইভার সারাজীবন ক্রীতদাস থেকে গেল। সবাই একই চরিত্রের হবে না। চরিত্রের অধঃপতনের জন্য ধনী-দরিদ্র্যের প্রভেদ নেই। ড্রাইভার ট্রাইভাল সম্প্রদায়ের মানুষ। সে সোজা গাড়ি নিয়ে এখানে চলে আসে। যেন এক অভিযান। প্রথমে আসতে চায়নি। কিন্তু প্রভুদের কথায় আসতে বাধ্য হয়েছে। মনে মনে অভিমান জমা হয়। কথক প্রশ্ন করে ড্রাইভার কেন তাড়ি খাচ্ছে না। সে জানায় নারকেলের মালাই করে তাড়ি খাবে। এখানে বিনোদনের সব ব্যবস্থা আছে। চলে আসে নারীরা। তবে যৌনতা হবে না। ঠাকুমার অভিশাপ। পুরুষ ধর্ষণ বা জোর করে যৌনসঙ্গম করতে চাইলে পুরুষের যৌন অঙ্গই লুপ্ত হয়ে যাবে। ট্রাইবাল মহিলারা জীবিকার সন্ধানে এ পথে এসেছে কিন্তু সচেতন ব্যক্তিত্ব। বড় সচেতন ভাবে লেখক এ আখ্যান গড়ে তুলেছেন। ঠাকুমা জানতেন নারীদের রক্ষা করতে হবে। অথচ কর্ম ছাড়া এ নারীদের পরিত্রাণ নেই। নিজেই হয়ে ওঠেন অভিশাপের দেবতা। তবে সব পুরুষকে অভিশাপ নয়। নারীকে আঘাত করলেই অভিশাপ।
অনবরত চলছে মদ্যপান। তালবনে চড়াই-উৎরাইয়ের খেলা। মনে হয় কথক ঠাকুমার গর্ভের ওপরে দাঁড়িয়ে। না উরু সন্ধিক্ষণে ! অবিশ্বাস। এই প্রথম ঠাকুমার কেঁদে উঠতে ইচ্ছা করে। চলার গতি মন্থর হয়ে যায়। অন্ধকারে তালগাছকে রক্তাক্ত মনে হয়। মনে হয় এ বুঝি রক্তাক্ত যাত্রা। ওপারে পৌঁছে মনে হয় তালপাখা ইঁদুরে কেটে কুচিকুচি করেছে। কিন্তু কেন করেছে ? মনে হয় অলৌকিক। কিন্তু সত্যি কি অলৌকিক ? আসলে ঠাকুমা নেই। তাই রক্ষা কবচ রাখার প্রয়োজন হয়নি বা ঠাকুমার সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রও বিদায় নিয়েছে। বিচ্ছিন্ন চিন্তা প্রাধান্য পায়। তালপাখা নেই, ঠাকুমা নেই, কাঞ্চনমালা নেই। তালবনের ছায়া এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর গড়ে তুলেছে। যেন সব শেষ। আখ্যানও পরিণতির পথে। কয়েকটি নদী চলেছে সমুদ্রযাত্রায়। এক নির্জনতা চারিদিকে বিরাজ করে। বাতিল রাইফেল। বাতিল মানুষ। নির্জনতা, অন্ধকার। কিসের ইঙ্গিত এসব ? বহুদিন রাইফেলে তেল দেওয়া হয়নি। শূন্যে গুলি ছোড়া হয়। পরবর্তী টার্গেট মানুষ। শূন্যে গুলি ছুড়ে পরবর্তী নিক্ষেপের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। ওয়াচম্যান নীলকণ্ঠ সরকারের পায়ে কুষ্ঠ রোগ। সে আর পুলিশ লাইনে থাকেনি। স্ত্রীও চলে গেছে। এমনকি অবসর নিতেও বাধ্য হয়েছে। কিন্তু স্বল্প দিনের চাকরিতে তো পেনশন হবে না। আবার ওয়াচ টাওয়ারে পাহারাদার নিয়োগ নিয়েও সমস্যা। শেষে নীলকণ্ঠকেই নিয়োগ করা হয়। বড় সাহেব চলে গেছে। শুধু নীলকণ্ঠের খাবার আসে। ড্রাইভারের কথায় প্রকাশ পায় ভয়ংকর তথ্য। এ নির্জন দ্বীপে, ঠাকুমার আবাসভূমিতে ধর্ষিত নারীরা আত্মহত্যা করতে আসে। নারীরা ন্যায় বিচার পায় না। আদালতে প্রশ্ন তোলা হয় কেন প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি বলে স্পষ্ট হয় মত ছিল। লজ্জায় নারী বেঁচে থাকার কথা ভুলে যায়। মানব সভ্যতা থেকে বিদায় নেয়। ঠাকুমার আবাসভূমিকেই গন্তব্য মনে করে—
‘’জিপে আসবার সময় ড্রাইভারই খোলসা করে বলে দেয় এইসব আত্মঘাতী মহিলারা সকলে ধর্ষিতা। এরা কেউ আদালতে জেরার উত্তরে বলতে পারেনি ধর্ষণের সময় কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। বাধা দেওয়া হয়নি বলে প্রমাণ হয়ে যায় তাদের সম্মতি থাকলেও থাকতে পারে। অসহায়ত্বের জন্য যেন কোনো জুৎসই যুক্তিই আবিষ্কার হয়নি এখনও। ধর্ষকের চোখের সামনে বেঁচে থাকার চেয়ে এখানে চলে আসে। ঠাকুমার তীর্থক্ষেত্রে এরা আত্মঘাতী হতে চায়— আত্মহত্যার জন্য নরকবাস থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে।‘’ (তদেব, পৃ. ১৪৬ )
ধর্ষণের অবসাদ অতিক্রম করতে সরকার স্বেচ্ছাসেবী হোমের ব্যবস্থা করেছিল। এখানেও লেখক সমান্তরাল আখ্যান ভেঙে দেন। চলে লিঙ্গ নিয়ে খেলা। লিঙ্গ রাজনীতি তো কম বড় খেলা নয় ! এ যেন অবসাদ ভুলে থাকার কৌশল। কিন্তু সবাই ভোলে না। তবে অভিশাপ আছে। একজন অভিশাপ দিয়েছিল-‘’তুই যাকে জন্ম দিবি সে জন্মও অভিশাপ্ত।‘’ পুরুষতন্ত্রের অত্যাচারের বিরুদ্ধে অভিশাপ বর্ষিত হয়। নির্জন দ্বীপে যাত্রা করে নারীরা। যাত্রা করতে বাধ্য হয়। জন্মই যেন মৃত্যুর বার্তা বহন করে আনে। এ পৃথিবী যেন মৃত্যুপুরী। আগুনের শিখা যেন বারবার ডাকে। পুড়িয়ে মারবার মধ্যে যেন তৃপ্তি পায়। এও এক প্রতিবাদ। শ্রেণি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সিস্টেমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। শেষে কথককে আত্মপরিচয় দিতেই হয়। আসে বিভিন্ন তেলের প্রসঙ্গ। রাইফেলের তেল। যেন মানুষ মারার তেল। আছে যৌনবর্ধক তেলের ইঙ্গিত। রাইফেলের তেল এখানে এসে ধন্বন্তরি ঔষুধ হয়ে যায়। সব ইঙ্গিতধর্মী বাক্য। পাঠককে রহস্য উদ্ধার করতে হয়। সাত নদী এসে মোহনায় মিশেছে। নদীর উৎস জানা নেই। তাই ‘পাতাল নদী মোহনা’। আসলে নদী মরে গেলে সভ্যতা পাল্টে যায়। সভ্যতার বিবর্তন ঘটে যায়। শূন্য চরে নির্জনতা বিরাজ করে। এইসব নির্জনতা নীরবতার জন্ম দেয়। সব অদৃশ্য হয়ে যায়। নাতি এসেছে ঠাকুমার খোঁজে। নদীতীরে আছে ঠাকুমার বংশধররা। পিতৃপুরুষের সন্ধান। পুরুষতান্ত্রিকতার সন্ধান। সেও তো এই বংশের সন্তান। ফলে পুরুষতান্ত্রিকতার শেকড় উপরে ফেলে সম্ভব নয়। কথক অপেক্ষা করে। অপেক্ষায় সব হয়। জোয়ার আসে। ডিঙি নৌকা ভেসে যায়। কাঞ্চনের দেখা মেলে। নাতি ছিল না বলে ঠাকুমাকে বীরাঙ্গনা উপাধি দেওয়া হয়নি। নাতি এসব প্রসঙ্গ এড়াতে চায়। নিজের ভবিষ্যতের কথা শুনতে চায়। সন্তান পেটে ধরেছে কাঞ্চন। সন্তান প্রসব হলেই সব মন্ত্র ফিরিয়ে দেবে তালগাছকে। উত্তরাধিকারের জন্ম দিয়েই মন্ত্র ভুলে যাবে। চলে জন্ম-মৃত্যুর দ্বন্দ্ব। একদিকে বংশের প্রদীপ জ্বালানো অন্যদিকে বিস্মৃত হওয়া। কাঞ্চন মন্ত্র আয়ত্ত করে রেখেছে ঠাকুমার উত্তরাধিকারীর জন্ম দেবার জন্যই। তবে সে সন্তান –পুত্র না কন্যা ! জানি না আমরা। ভবিষ্যৎ জানে। হয়ত পুত্র সন্তানই হবে। সেজন্যই কাঞ্চন মন্ত্র ফেরত দিতে চেয়েছে। কন্যা সন্তান হলে তো ফেরত দেওয়া যাবে না, কন্যাকেই দিয়ে যেতে হবে আত্মরক্ষার কবচ হিসেবে।
এ আখ্যান নারীর প্রতিবাদের আখ্যান। আত্মযন্ত্রণা ও আত্মরক্ষার ভাষ্য। ঠাকুমার মতো কাঞ্চনমালারাও হয়ত হারিয়ে যাবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ থেকে কাঞ্চনদের মুক্তি নেই। নাতি উদ্ধার করেছিল কাঞ্চনকে। নারীকে উদ্ধার নিজেকে বাজি রেখে। এ শিক্ষা পেল কোথায় ? ঠাকুমার অদৃশ্য শিক্ষা। ঠাকুমা নারীদের পরিণাম জানতেন। তাই নাতি রূপকুমারকে সেভাবে গড়ে তুলেছেন। রূপকুমার হয়ত নিজের সন্তানের মধ্যে সে চেতনা সঞ্চার করে যাবেন। তালপাতায় ঠাকুমা বাতাস ছড়িয়েছেন। নারীর প্রতিবাদ বাতাস আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। তা হয়ত সম্ভব নয়। তবুও চেষ্টা আছে। চেষ্টার আড়ালে মহৎ উদ্দেশ্য আছে। সে উদ্দেশ্যের জন্য লেখককে বন্ধন জাল গড়ে তুলতে হয়েছে। ‘কুহক বাস্তবতা’, অলৌকিকতা, রূপকথার টেকনিক ব্যবহার করতে হয়েছে।
সুচিন্তিত মতামত দিন