পিয়ালী গাঙ্গুলি

পিয়ালী গাঙ্গুলি

"কি দাদা, বাজাবেন?" রতন গোছগাছ করছিল। আজ সন্ধ্যের ট্রেনে বাড়ি ফিরে যাবে। চতুর্থী থেকে প্রতিবারের মত শিয়ালদহ স্টেশনের বাইরে বসে আছে। অন্যান্যবার পঞ্চমীর মধ্যেই বায়না হয়ে যায়। এবছর করোনার জন্য অনেক পুজো হচ্ছে না। তাই বাজার খারাপ। আর বড় বড় নামকরা পুজোর নির্দিষ্ট ঢাকি থাকে। মুখ তুলে দেখল দুই কম বয়সী ভদ্রলোক। পাশে দাঁড়ানো গাড়িটা থেকে নেমেছেন বোঝা গেল। "আমাদের ছোট বাড়ির পুজো, নির্দিষ্ট ঢাকিও আছে। কিন্তু আজ সকালে সে খবর পাঠিয়েছে সে করোনায় আক্রান্ত, আসতে পারবে না।তাই এখানে ছুটে আসতে হল। " ওনার কথাগুলো শুনতে শুনতে গলায় ঢাকটা ঝুলিয়ে নিয়েছে রতন। কথা শেষ হতেই হাত চলতে শুরু করল। আজ তিনদিন ধরে এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। রতনকে বাজাতে দেখে বাকিরাও চেগে উঠে বাজাতে শুরু করল। বাজনা থামতে এবার টাকা পয়সার কথা। বারোয়ারী পুজোর মত টাকা তো পাওয়া যাবে না বাড়ির পুজোয়, তবুও শুণ্যহাতে বাড়ি ফেরার চেয়ে তো ভালো। দর দস্তুর করতে করতে রতনের চোখ পড়ল গাড়ির দিকে। পেছনের সিটে একটা বাচ্চা ছেলে আশা ভরা চোখ নিয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে। বয়েস ওর ছেলের কাছাকাছিই হবে।

আজকাল এমনিতেও ঢাকিদের বাজার আগের মত নেই। অনেক পুজো কমিটিই খরচ বাঁচাতে ঢাকের রেকর্ড বাজায়। বছরের এইকটা দিনই যা রোজগার হত, তাও আর হয় না। অনেকেই বাধ্য হয়ে অন্য জীবিকা বেছে নিয়েছে। রতন পারে নি। বড্ড ভালোবাসে ও ঢাক বাজাতে। দাদু, বাবা কাকার এই পরম্পরা কে এত সহজে ছেড়ে দিতে রাজি নয়। গাড়ি এসে থামল দক্ষিণ কলকাতার এক বড় গেটওয়ালা বাড়ির সামনে। সুন্দর সাজানো সাদা ধবধবে পুরনো দিনের বাড়ি। ঠাকুর দালানে বাড়ির মহিলারা তখন পুজোর জোগাড়ে ব্যস্ত। আর খানিক বাদেই বোধন শুরু হবে। দুর্গাপুজোর প্রতিটা আচার অনুষ্ঠানের জন্য ঢাকের বাজনা আলাদা অনেকেই তা জানেন না। বাপ ঠাকুরদার থেকে রতন এই খুঁটিনাটি গুলো খুব মন দিয়ে শিখেছিল। আর আজও সেই ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করে। রতন বাজানো শুরু করতেই বাড়ির কচিকাঁচার দল এসে নাচতে শুরু করে দিয়েছে। সবার মুখে হাঁসি ফুটেছে। ঢাকের আওয়াজ ছাড়া এতক্ষণ পুজো পুজো মনেই হচ্ছিল না।

#

মায়ের অপারেশনের টাকাটা আর জোগাড় হবে না রাজু বুঝেই গেছিল। চ্ন্দননগরের আলোর কাজের ব্যবসায় এবারে মন্দা। করোনা র প্রকোপে সারা রাজ্যেই পুজোর সংখ্যা কম, তাই আলোর চাহিদাও কম। জুন মাসে সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্মহত্যার পর পর সারা দেশ যখন তোলপাড়, তখনই রাজু ভেবে নিয়েছিল এবার দুর্গাপুজোর জন্য বানাতে হবে সুশান্ত সিংএর মুখ। এছাড়াও করোনা ভাইরাস, ডাক্তার, নার্স, পুলিশের মত কোভিড যোদ্ধাদের চেহারা, কোভিড সচেতনতার বার্তা সবরকমের পসরা সাজিয়ে রেখেছিল নিজের ছোট্ট দোকানে। কিন্তু এই মন্দার বাজারে ছোটখাটো কারিগরের কাজে কে আর আগ্রহ দেখাবে? মায়ের হার্টের অবস্থাটা একেবারেই ভালো নয়। ডাক্তার অপারেশনের জন্য তাড়া দিচ্ছেন। তাড়াতাড়ি করাতে না পারলে বিপদ আছে। জমানো যা ছিল সব মিলিয়ে আর মায়ের গয়না বিক্রি করেও এখনও অনেকগুলো টাকার অভাব।

মাকে নিয়ে রাজুর এই দুশ্চিন্তা বোধহয় আরেক মায়ের মনকে বিশেষ নাড়া দিয়েছিল। পাশের নামকরা বড় দোকান মল্লিক ইলেকট্রিকাল বন্ধ থাকায় কলকাতার এক বড় পার্টি ফিরেই যাচ্ছিল সেদিন। গাড়িতে উঠতে উঠতে এক ক্লাবকর্তা নেহাতই অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে ছিলেন পাশের দোকানটার দিকে। সুশান্ত সিং আর রিয়া চ্ক্রবর্তীর মুখের ওরকম অসাধারণ প্রতিচ্ছবি দেখে থমকে গেলেন। ইশারায় গাড়ি থেকে ডেকে নিলেন বাকিদের। শুধু টাকার জোগাড়ই হল না, বাড়তি মুনাফা হল মায়ের অপারেশনের খরচে ডিসকাউন্ট। কথা প্রসঙ্গে রাজুর মায়ের ব্যাপারটা জানতে পেরে ক্লাবের এক কর্তা বলেছিলেন ওই হাসপাতালের ম্যানেজমেন্টে ওনার বিশেষ জানাশোনা আছে, উনি চেষ্টা করবেন যতটা সম্ভব ডিসকাউন্ট করিয়ে দেওয়ার। আজ ষষ্ঠীর দিন কলকাতায় গিয়ে রাজু হাসপাতালে সব কথা ফাইনাল করে এসেছে। পুজো মিটলেই অপারেশন।

#

দেখতে দেখতে চারটে দিন কেটে গেল। রতনের ঢাকে এখন বিসর্জনের সুর। সিঁদুর খেলা, বরণ, গঙ্গার ঘাটে গিয়ে প্রতিমা নিরঞ্জন সব মিটিয়ে বাড়ি ফিরে বিজয়ার মিষ্টিমুখ। রতনের পারিশ্রমিক সকলেই মিটিয়ে দিয়েছেন এনারা। এই চারদিনে রতন বুঝে গেছে এরা খুব ভালো মানুষ। বনেদী পরিবার, যথেষ্ট অর্থবল আছে কিন্তু সকলেই খুব ভদ্র, মার্জিত, আচার ব্যবহারে কোনরকম অহংকার নেই। আজ রাতটা এখানে কাটিয়ে কাল সকালে বাড়ি ফিরবে রতন। ফেরার পথে ছেলের জন্য একটা জিন্সের প্যান্ট কিনে নিয়ে যাবে। অনেকদিন ধরে বায়না করছে। আম্ফানে বাড়ি ঘরের যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তা সারাতে মহাজনের কাছে ধার করতে হয়েছিল। সে টাকা এখনও শোধ করতে পারে নি। বৃষ্টির জন্য এবছর চাষবাসেরও প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে বাড়ির ছোট বউ রতনের হাতে একটা বড় মিষ্টির বাক্স আর একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন। "মিষ্টিগুলো আপনার বাড়ির সকলের জন্য আর প্যাকেটে একটা সামান্য জামা প্যান্ট আছে। শুনলাম আপনার ছেলে আমার ছেলেরই বয়েসী। আশাকরি এই সাইজটা ওর ঠিকই হবে।" বৌদি চলে যেতে রতন প্যাকেটটা খুলল। খুলতেই ছেলের মুখটা মনে করে রতনের চোখের কোলে জল চিক চিক করে উঠল। লাল টুকটুকে জামা আর জিন্সের ফুল প্যান্ট। মা দুর্গা এভাবেই তুমি সবসময় পাশে থেকো মা।

◆ লেখক পরিচিতি


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.