গতকাল বাড়ি ফিরে যখন শুনলাম প্রভাতদার আঠাশ বছরের ছেলেটা আত্মহত্যা করেছে, সত্যি বলতে কি মুহূর্তে পা এর নিচের মাটি নড়ে উঠেছিল । একটা ভয় আঁকড়ে ধরেছিল । কেন এমন করলো ? বাবা মা এর কথাটা একটু ভাবলো না ? এ সমস্ত প্রশ্ন মনে এল সাথে সাথে । আর তার পরেই মনে হল , আমার ছেলেটাও কখনো এমন কিছু করে বসবে না তো ? সারারাত ঘুম ও হল না ঠিক করে। দুঃস্বপ্ন দেখলাম, ছেলে বলছে, মা আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে, আমি আর বাঁচতে চাই না। ভয়ে ঘুম ভেঙে গেল। বাকি রাত বসে থাকলাম । আর প্রভাতদার মুখটা মনে পড়তে লাগল । কি দোষ করেছিল ওরা ? এত বড় শাস্তি কি ভাবে দিতে পারল ওদের ছেলে টা ? কিছুতেই উত্তর পেলাম না।
এই অবস্থায় পৃথিবী শেষ কবে পড়েছে আমার জানা নেই। আজ যারা পৃথিবীতে আছি, সম্ভবত তারা কেউই ঠিক এই রকম ভয়াবহ পরিস্থিতি আর কখনো দেখেননি। একদিকে প্রবল এক ভাইরাস এর পৃথিবী ব্যাপী আক্রমণ আর অন্য দিকে সেটা আটকাতে গিয়ে লকডাউনের ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষের রোজগার চলে যাওয়া । এর মাঝে ঘরবন্দি মানুষ, ছটফট করছে। বাঁচতে চেয়ে ও বাঁচতে পারছে না। বেছে নিচ্ছে আপাত সহজ এক পথ। জীবন শেষ করে দেবার পথ। কিন্তু কেন ?
লকডাউনের ফলে ভারতের মত দেশে বিরাট অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়ে গেছে। যেখানে নিরানব্বই শতাংশ ব্যবসা ক্ষুদ্র, লঘু বা মাঝারি শিল্পের আওতায় পড়ে, সেখানে এই লকডাউন বাধ্যতই অনেকের চাকুরি চলে যাবার কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে । মালিক মানে সবাই টাটা, বিড়লা বা আম্বানি নন। তাই দীর্ঘদিন বসিয়ে মাইনে দিতে পারছেন না অনেকেই। ফলতঃ, চাকরি থেকে বরখাস্ত । হঠাৎ চাকরি না থাকলে ঠিক কী রকম মানসিক পরিস্থিতি হয়, তা বোধকরি চাকরি থাকা মানুষ গুলো তেমন ভাবে বুঝবেন না। শ্রমের বিনিময়ে যে জীবন আমি পেয়েছি, তাতে নিজের মত করে সাজিয়ে নিয়েছি পসরা। হঠাৎ সেই সিস্টেম ভেঙে চুরমার হয়ে গেলে বাঁচার ইচ্ছে চলে যায় । এটাই হয়তো স্বাভাবিক ।
কিন্তু এই সময় লড়াইয়ের। লড়াই করে আবার জীবনের নৌকা কে ঠিক স্রোতে নিয়ে আসার মধ্যেই মানুষ হবার গর্ব লুকিয়ে আছে। হেরে যেতে তো আলাদা করে শ্রম দিতে হয় না। জীবনের যুদ্ধে জয়ী হবার জন্যই শ্রম দিতে হবে। তাই, শত বাধা , শত কষ্ট এলেও, প্রতিকূলতা কাটিয়ে আবার উঠে দাঁড়ানোর মধ্যেই সার্থকতা আছে। চুপ করে বাড়িতে বসে পড়বেন না, প্লিজ । চাকরি চলে যাওয়াটা নিজের কলঙ্ক, এটা ভাবা প্রথমে বন্ধ করুন । কেন আপনার চাকরি গেল, পাশের ডেস্ক এর লোকটার গেল না? আপনার কী ভুল হল , ইত্যাদি ভাবাটাও বন্ধ করুন । বরং ভাবুন ওটা আপনার জীবনের গল্পের একটা অধ্যায় ছিল । এবার নতুন অধ্যায় শুরু । নতুন ক্লাসে ওঠার মতো করে এই নতুন জীবনে শপথ নিন। নিশ্চয়ই আগের ক্লাসের থেকেও ভালো ফল করবো। মন তৈরি ? তাহলে নেমে পড়তে পারেন।
নেমে পড়তে বললে নেমে পড়া যায়? বলাটা যত সোজা করাটা ? হ্যাঁ, ততটাই সোজা। আপনাকে শুধু মাইন্ড সেট করতে হবে। চিন্তা করতে হবে সৎ ভাবে করলে, সব কাজই সমান সম্মানের । ছোটবেলা থেকে রক্ত মজ্জায় ঢুকে যাওয়া ধারণার বাইরে বের হতে হবে । চাষী ভাই, মেথর ভাই এর পাশে মনে মনে বসিয়ে নিন ডাক্তার ভাই, মোক্তার ভাই, অর্থাৎ সব পেশার সম্মান সমান। এরপর আপাতত একটা তাৎক্ষণিক রোজগার এর রাস্তা দরকার কিনা সেটা বিচার করুন । যদি দেখেন সঞ্চয় যা আছে তাতে তিন মাস চলে যাবে, তাহলে প্রথমেই দেখুন এলাকার মানুষ কী কী অসুবিধা ভোগ করছেন । এখানেই হয়তো লুকিয়ে আছে আপনার আগামী দিনের রোজগার এর চাবিকাঠি । বয়স্ক মানুষ রা ওষুধ পাচ্ছেন না, বাড়িতে কোন কিছু সারাবার মিস্ত্রি পাচ্ছেন না, ব্যাঙ্কের বা পোস্ট অফিসের কাজ করে দেবার লোক পাচ্ছেন না, ডাক্তার দেখাতে যেতে পারছেন না, আয়া পাচ্ছেন না, ইত্যাদি যে কোন অসুবিধাই আপনার কাছে নতুন কাজের দিক হয়ে উঠতে পারে। এই মুহূর্তে সার্ভিস এট হোম একটা জনপ্রিয় এবং সম্ভাবনাময় ক্ষুদ্র উদ্যোগ। আপনার একটা মোবাইল আর কিছু জনসংযোগ থাকলে ওপরের কাজ গুলো গুছিয়ে করে নিতে পারেন। অবশ্যই সার্ভিস চার্জ এর বদলে। আপনার ইউ এস পি হোক আপনার সততা আর কোয়ালিটি সার্ভিস ।
লকডাউনের সময় কারখানা গুলোর কাঁচামাল এর আমদানি বিরাট ধাক্কা খেয়েছে। সারা পৃথিবীতে লোকাল সোর্সিং আবার গুরুত্বপূর্ণ ভাবে ফিরে এসেছে। এটাই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য সুযোগ । কাঁচামাল তৈরি করে পাঠাতে পারেন কাছের কারখানা গুলো কে। আপনার কাছের কারখানায় দূর দূর থেকে কী কী আসতো তা জেনে , সেই কাঁচামাল বানান অথবা জোগান দিন।
যে কোন রাজ্যের ব্যবসা পরিস্থিতি অনেকটাই নির্ভর করে সেই রাজ্যের লজিস্টিকস এর ডেভেলপমেন্ট এর ওপর। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ও এর অভাব আছে। প্রতিটা শহরে , আপনি কী ভাবে এই ফাঁক পূরণের অংশীদার হতে পারেন , তা ভেবে দেখতে পারেন ।
এমনকি, বাড়ি বাড়ি স্যানিটাইজার ও মাস্ক পৌঁছে দেবার কাজটাও ভেবে দেখতে পারেন । কমিউনিটি স্প্রেড শুরু হলে বাড়ি বসে কোভিড টেস্ট করাতে আগ্রহী হতে পারেন অনেক গৃহস্থ । ভেবে দেখুন, আপনি কী ভাবে একে নিজের পেশা করতে পারেন ।
যদি বলেন কী কী করতে পারি ? তো বলব, করতে পারেন সেই সব কিছু, যা আপনি মন দিয়ে ভালবেসে, পরিশ্রম দিয়ে করতে চান। আপনার নিজের কোন গুণ গুলো আছে বলে আপনি মনে করেন, সেটা সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ । আর দরকার সেল্ফ কনফিডেন্স । আমি পারব, ঠিক পারবো। আমাকে পারতেই হবে। এই কথা নিজের মনে উচ্চারণ করুন প্রতিদিন । কাজ এ নেমে পড়ুন । সরকারী অফিসে যান। দেখুন, সেখানে কী কী সুযোগ সুবিধা আছে নতুন উদ্যোগ শুরু করবার জন্য । একটা কথা সত্যি , এই লকডাউনের সময়, আপনাকে চাকরি দিতে কেউ এগিয়ে আসবে, এ কথা ভাবলে হয়তো হতাশ হয়ে পড়বেন কিছু দিনের মধ্যেই । কারণ , বাজারে চাকরি নেই। তার চেয়ে আসুন না, নিজে কিছু শুরু করে আরও পাঁচজনকে কাজ দিন । হতাশা নয় আলোর রাস্তা দেখান। জীবনের শেষ না, নতুন জীবনের শুরুর অগ্রণী পথিক হন। কি , পারবেন না ?
সুচিন্তিত মতামত দিন