21/03/2020
আজ পিপলির আসার কথা ছিল দিদিভাইকে নিয়ে। কিন্তু কী যে করোনার প্রকোপ এল, আসতেই পারল না ওরা। সুদূর জার্মানীতে ওরা এখন ঘরবন্দী। এখানকার মত এমন খোলামেলা বাড়ি তো নয় ওখানে। একুশ তলার ওপর ফ্ল্যাট ওদের। একুশ তলা ভাবতেই কেমন যেন লাগে। পৃথিবী ছাড়িয়ে সে তো প্রায় আকাশে পৌঁছে যাওয়া। পিপলি অবশ্য আমার কথা শুনে হাসে। মানুষ নাকি এখন ওপর তলাতেই থাকতে ভালোবাসে। ওখানে নাকি দূষণটা অনেক কম। বাব্বা অত ওপরে কী করে যে থাকে মানুষ কে জানে! আমার তো রোজ একবার বাড়ির বাগানটুকুতেও না ঘুরলে মনটা যেন কেমন করে। পিপলি তো ছোট থেকে মাটির কাছাকাছি মানুষ, অমন উচুঁতে ও কেমন করে থাকে কে জানে! বোধহয় কষ্ট হয় মেয়েটার।
আজ পিপলির জন্য ভীষণ মনখারাপ করছে। তার থেকেও বেশি মনখারাপ বোধহয় দিদিভাইয়ের জন্য। আসলের থেকে সুদ সবসময় বেশি মিষ্টি হয়। সেই দুবছর আগে এসেছিল, দিদিভাই তখন এই এত্তোটুকু ছিল। এখন কেমন পটরপটর করে ইংরাজীতে কথা বলে। কী যে বলে অর্ধেক তো বুঝতেই পারি না, তবু শুনলে মন ভরে যায়।
ওরা এলে কত কী করব ভেবে রেখেছিলাম, কিছুই হল না। বুড়ো বুড়ি দুটো মানুষে থাকতে থাকতে জীবনটাই কেমন বিস্বাদ হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। পিপলির বাবা তো নিজেকে পড়াশুনো নিয়ে দিব্যি আছে। আমার যে সময় কাটতেই চায় না, সে কথাটুকু আর কে বোঝে! মানুষটা কোনদিনও কী আমাকে বোঝার চেষ্টা করেছে যে আজ বুঝবে! সব কথা মনে পড়লে আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না।
আজকাল আবার শরীরেও হাজারো সমস্যা। কাজের লোক নির্ভর হয়ে সংসার চলছে। এবার ভালোয় ভালোয় ওপাড়ের টিকিটটা পেয়ে গেলেই ভাল। এরপর অথর্ব হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলে কে যে দেখবে কে জানে!
কাল আবার প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সারাদিন "জনতা কার্ফু"। বিনিতা কাজ করতে আসবে না বলে গেছে। ভোলার মা রান্না করতে আসবে কী আসবে না বলে যায়নি। যদি না আসে সব কাজ আমাকেই করতে হবে। ঠাকুর শরীরটা ভালো রেখো। যেন মানুষটাকে দুটো রেঁধেবেড়ে দিতে পারি।
24/03/2020
সারা দেশ জুড়ে লকডাউন। এমন শব্দ তো এই সাতষট্টি বছরের জীবনে কোনদিনও শুনিনি। ভাইরাসের জোট বাঁধা ভাঙতে মানুষকে ঘরবন্দী থাকতে হবে এখন দশদিন। বিনিতা তো সেই রবিবার থেকেই কাজে আসা বন্ধ করেছে। ভোলার মা তাও দুবেলা রান্নাটা করতে আসছিল। রোজ দশটাকা করে আলাদা দিলে বাসী কাজটাও ও সেরে দিচ্ছিল।
পিপলি আর ওর বাবার খুঁতখুঁতুনির জন্য মাস না ফুরোতেই পুরো মাইনে দিয়ে ওকেও কাল থেকে আসতে বারণ করে দিতে হল কাল থেকে। বাপ-বেটি তো আদেশ করে খালাস। উনি তো সংসারের কুটোটি নেড়ে দুটো করবেন না। সব সেই আমাকেই সামলাতে হবে। বাতের সমস্যাটা তো সবসময়েই ভোগায়, তাতে আবার কালকে অমাবস্যা। হাঁটু নিয়ে তো দাঁড়াতেই পারছি না ভাল করে, কী করে যে কী করব কে জানে!
টিভিতে খবরে তো সবসময় বলছে, বিদেশ থেকে আসা মানুষ থেকে রোগটা ছড়াচ্ছে। ভোলার মা তো সামনের পাড়ায় থাকে। গরবীবের পাড়ায় আর বিদেশী মানুষ আসবে কোথা থেকে! তবু সাবধানের মার নেই বাপু। সকাল থেকে আপনা হাত জগন্নাথ।
26/03/2020
পিপলির বাবার আবার গতকাল থেকে জ্বর, সঙ্গে কাশি। এই বসন্তকালে এমনটা তো প্রতি বছরই হয়। পিপলিটা ছোট থেকেই বাবার ভীষণ নেওটা। বাবার জ্বর শুনে থেকেই আতঙ্কে সারা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের বাড়িতে তো বাইরের কোন মানুষই আসে না ওই বিনিতা আর ভোলার মা ছাড়া। তাও আজ সন্ধেতে ফোন করে ওদের খোঁজ নিলাম। ওরা সবাই ভালো আছে। ওদের থেকে কোন জীবাণু এলে তো ওরা আগে অসুস্থ হত। তাহলে এটা মনে হয় এমনিই সিজন চেঞ্জের সর্দিজ্বর।
এই ধরনের জ্বরে মুখের স্বাদ চলে যায়। ওনার মুখে দুদিন ধরে সবকিছুই বিস্বাদ লাগছে। আজ হাঁটুর ব্যথা নিয়ে মরতে মরতেও কাবলি ছোলার ঘুঘনি আর লুচি করেছিলাম। তাও একটুও খেতে পারল না। না রেঁধে রেঁধে আমার রাঁধার হাতটাই নাকি নষ্ট হয়ে গেছে। ভোলার মা এর থেকে অনেক ভালো রাঁধে। সবই আমার কপাল!
এতবছর একসঙ্গে থেকেও মানুষটা সেই এক থেকে গেল। কুকুর বিড়াল পুষলে তার প্রতিও একটু মায়া জন্মায় মানুষের। আমার প্রতি সেটুকু টানও নেই মানুষটার।
28/03/2020
দুটে দিন যে কোথা দিয়ে কেটে গেল যেন জানতেও পারলাম না।
জীবনটা যেন বিনা নোটিশেই হঠাৎ করেই থমকে গেল। এমনটা যে হতে পারে কখনও দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।
জ্বর-কাশি-খেতে না পারা-বুকের মধ্যে কেমন একটা চাপ চাপ ভাব লাগলেও ডাক্তারখানা যেতে চাইছিল না। শেষ অবধি মেয়ে-জামাইয়ের বকুনি খেয়ে লকডাউনের মধ্যেই পাড়ার ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম বুড়োবুড়িতে। অনেক সময়েই জ্বরজ্বালা সারতে অ্যান্টিবায়োটিক লাগে, তেমনি কিছু লাগবে। দিন তিন-চারে সুস্থ হয়ে যাবে। আমারও গাটা একটু যেন ছ্যাঁকছ্যাঁক করছিল, সময় থাকতে একটু ওষুধ নিয়ে নেব ভেবেছিলাম। সারা সংসারের দায় তো আমার কাঁধে। সবার ছুটি হলেও আমার তো ছুটি নেই।
তখনও জানতাম না ছুটির দিন এত কাছেই অপেক্ষা করছে। ডাক্তারবাবু তো ওঁকে দেখেই সঙ্গে সঙ্গে নিজেই অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করে দুজনকেই পাঠিয়ে দিলেন হাসপাতালে। একবার বাড়ি এসে সবকিছু গুছিয়ে যাওয়ারও সময় পেলাম না। এবার আর কোন অ্যান্টিবায়োটিক নয়, এবার সেরে উঠতে লাগবে অ্যান্টি ভাইরাস। কিন্তু করোনা ভাইরাসকে জব্দ করার মত অ্যান্টি ভাইরাস এখনও আবিষ্কার হয়নি পৃথিবী। তাই এখন সে একছত্র অধিপতিত্ব চালাচ্ছে পৃথিবী জুড়ে।
রাতে রুটি করার জন্য আটা মাখা ছিল, শোয়ার ঘরের জানলাগুলো খোলা ছিল, জামাকাপড়গুলো ছাদ থেকে তুলে এনে গোছানোও হয়নি আলনাতে। বহুবার অনুরোধ করেও অগোছালো সংসারটাতে অল্প সময়ের জন্যও ফিরতে পেলাম না। আমরা এখন সমাজের জন্য ক্ষতিকর। আমাদের থেকে নাকি বহুজনের রোগ ছড়াতে পারে। আমাদের লালারস পরীক্ষার জন্য নিয়ে গেছে। যতক্ষণ না পরীক্ষার ফলাফল জানা যাবে আমরা হাসপাতালের বন্ধ ঘরে বন্দী।
পিপলির সঙ্গে ফোনে কথা হল একটু আগে। ভীষণ কান্নাকাটি করছিল। কিন্তু এখন তো এক দেশের সঙ্গে আর এক দেশের সব যোগাযোগ বন্ধ। ইচ্ছা করলেও ওদের এখানে আসার কোন উপায় নেই।
30/03/2020
পিপলির বাবার গতরাত থেকে ভীষণ শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায়, তাকে আলাদা জায়গায় নিয়ে গেছে। আমার সেখানে যাওয়ারও অধিকার নেই। আজ সকাল থেকে আমার জ্বরটাও কোন ওষুধেই যেন কমতে চাইছে না। ডাক্তারবাবুর আশঙ্কা সত্যি হল। রিপোর্ট এসে গেছে। করোনা ভাইরাস আমাদের শরীরে বাসা বেঁধেছে। ডাক্তারবাবুরা বারবার জানতে চাইছেন আমরা শেষ সাত-দশদিনে কার কার সংস্পর্শে এসেছি। যাদের কথা বলেছি, ডাক্তারবাবুরা খোঁজ নিয়েছেন তারা সবাই সুস্থ। রোগটা আমাদের শরীরে যে কোথা থেকে এল বুঝতে পারছেন না ডাক্তারবাবুরা।
আমরা দুজনেই কি মরে যাব তাহলে! ডাক্তারবাবুরা অবশ্য আশ্বস্ত করছেন, এই রোগ থেকেও সেরে ওঠা যায়।
31/03/2020
আজ সকাল থেকে ওঁর একটা খবরও পাইনি। দুজন নার্স আলোচনা করছিল, আজ নাকি একজন পেশেন্ট মারা গেছেন এই হাসপাতালেই। কথাটা শুনে থেকে মনটা কু ডাকছে। বারবার জিজ্ঞাসা করলেও কিছুতেই কিছু বলছে না। ওদের কথাতেই জানতে পারলাম, আজ নতুন একজন রুগীর এসেছে এই এক রোগ নিয়ে। ইলেকট্রিক মিটারের রিডিং নিতে বহু মানুষের বাড়ি বাড়ি যেতে হয়েছে। কোন বাড়িতেই হয়ত কোন রোগাক্রান্ত বিদেশীর সংস্পর্শে এসেছিল সে। কিন্তু তার থেকে না জানি আরও কতজনের মধ্যে রোগটা ছড়িয়ে পড়েছে সেটা নিয়েই চিন্তিত সবাই।
দিন সাতেক আগে আমাদের বাড়িতেও তো রিডিং নিতে এসেছিল একজন। প্রতিবার অবশ্য সেই নিতে আসে। খুব ভালো ব্যবহার ছেলেটার। এবার এসে জল খেতে চেয়েছিল। পিপলিরা আসবে বলে নারকেল নাড়ু বানিয়েছিলাম। চারটে নাড়ু আর একগ্লাস জল দিয়েছিলাম ছেলেটাকে। বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে, এই কী সেই ছেলেটা?
একজন নার্সকে বলতেই হাসপাতাল জুড়ে হৈচৈ পড়ে যায়। ছুটে আসেন ডাক্তারবাবুরা। মোবাইলে ছবি তুলে আনে তার। অক্সিজেন চলছে ছেলেটার। তবু ওকে চিনতে কোন অসুবিধা হয় না আমার। এই তো সেই ছেলেটা!
সংক্রমণের ভয়ে কাজের লোকদের ছাড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু তার আগে যে অজান্তেই রোগের আদানপ্রদান ঘটে গেছে টেরও পাইনি।
জ্বরে যেন পুড়ে যাচ্ছে শরীর। মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়বে মনে হচ্ছে। আর লিখতে ইচ্ছা করছে না। এটা কি মৃত্যুর পূর্বাভাস? এতদিন মনে হত মরে গেলেই শান্তি, কিন্তু আজ যেন ভীষণ বাঁচতে ইচ্ছা করছে.....
সুচিন্তিত মতামত দিন