অদিতি ঘোষদস্তিদার

বিউটিশিয়ান

বেশ ক'দিন পর আজ দুপুরে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজগুলো দেখছে মানসী। ভাতঘুম দিচ্ছে বাড়ির বাকি সদস্যরা। মানসীর কোনোদিনই দুপুরে ঘুমের অভ্যেস নেই। 

লকডাউনে ঘরবন্দী হবার পর আর ফোন চেক করতে ভালো লাগে না। অথচ আগে সারাটা দিন চোখ থাকত ফোনে। বিরক্ত হয়ে অম্লান বলতো, “কাজটা তোমার নেশা হয়েছে। সবসময় শুধু কাস্টমারের চিন্তা।”

নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে মানসী। কোনরকমে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে ভেবেছিল আর পড়াশোনায় কাজ নেই। কলেজে পড়ার তো অনেক খরচ। ভাইটা পড়াশোনায় ভালো। চার পাঁচ বছর পর কলেজ যাবে। ওর পেছনে পয়সা ঢাললে বরং লাভ আছে। বাবা মা অবশ্য আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু সংসারের অবস্থা তো আর অজানা নয়। বাবার কতটুকুই বা আয়! মাথায় তখন একটাই চিন্তা কি করে দুটো পয়সা সংসারে আনা যায়। শুরু করলো কিছু সেলাই ফোঁড়াই আর কাপড়ে ফলস পিকোর কাজ। এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে নিয়ে নিলো পাড়ারই একটা পার্লারে সস্তা বিউটিশিয়ান কোর্সও। যদি কখনো কাজে লাগে।  

আগে পিছে তেমন কিছু না ভেবেই নিতে গেছিলো কোর্সটা। কিন্তু ট্রেনিংয়ের সময় দেখলো কাজটা বেশ ইন্টারেস্টিং। কাউকে ঠিকমত সাজিয়ে একদম ভোল বদলে দেওয়া যায় দেখে ভারী উৎসাহ হল। আরো একটা মজা হলো। বাড়ি বা স্কুলে আল্পনা দেওয়ার কাজে বরাবরই নাম ছিল মানসীর। সেই বিদ্যেই লেগে গেলো চন্দন পরানোর কাজে।

মন দিয়ে নিল কোর্সটা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কাজ জুটে গেলো ছোটখাটো একটা বিউটিপার্লারে।

মন্দ চলছিল না। বছর তিনেক বেশ কেটে গেলো।

এর মধ্যে ঘটলো একটা ঘটনা।

স্কুলে পড়ার সময় ইংরাজীর কোচিংক্লাসে মানসীর আলাপ হয়েছিল অম্লানের সাথে। আলাপ থেকে প্রেম, ঘর বাঁধবার স্বপ্ন।

অম্লান বি-কম পাশ করে অম্লান চাকরি বাকরির চেষ্টা করছিলো। কিছু চাকরির পরীক্ষার পড়াশোনার প্ল্যানও করছিলো। এমন সময় অম্লানের বাবা সতীশবাবু হয়ে গেলেন ভীষণ অসুস্থ। দুরারোগ্য ব্যাধি, ক্যান্সার।

সতীশবাবুর একটা বই, খাতাপত্রের দোকান ছিল স্কুলের কাছেই। মোটামুটি ভালোই চলতো। কিন্তু শরীর আর দিচ্ছিলো না ভদ্রলোকের। কড়া কড়া ওষুধ আর কেমোথেরাপির চাপ। দোকান খোলাই হয় না। সংসার চলে দোকানের আয়েই। তাই বাধ্য হয়েই অম্লানকে দোকানে বসতে হলো। অল্পবয়েসী অম্লানকে পছন্দ হল ছাত্রছাত্রীদের। ওরা কি চায় বলার আগেই যেন বুঝে নেয় অম্লান। নতুন নতুন জিনিস এনে নিজের হাতে ঢেলে সাজালো । ঘুরে দাঁড়াল দোকানটা আবার। 

সতীশবাবুর অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছিল। একটাই ছেলে অম্লান। বাবা থাকতে থাকতে বিয়েটা হয়ে গেলে ভালো হয়। সন্ধ্যা মানে অম্লানের মা এসে কথা পাড়লেন মানসীর বাবা মাকে। 

হয়ে গেলো বিয়ে। তার বছর দুয়েকের মধ্যেই সতীশবাবু চলে গেলেন।

এই দু'বছর কেটেছে বড্ড টানাপোড়েনের মধ্যে। যেখানে যা একটু আধটু সঞ্চয় ছিল চিকিৎসায় সবই গেছে! তবে এর মধ্যেও অম্লানের কঠোর পরিশ্রমে দোকানটা আগের থেকে ভালো চলতে শুরু করেছে। আর মানসী পুরোনো কাজ ছেড়ে একটা নামকরা বিউটিপার্লারে ঢুকেছে।

নতুন পার্লারে পয়সা যে খুব একটা বেড়েছে তা নয়, কিন্তু কাজের সুনাম হয়েছে খুব। ব্র্যান্ডের যুগ এখন। নামি দোকান, তাই ভিড়ও বেশি। কাস্টমারদের মন জিতে নিল হাতের গুণ আর মিষ্টি ব্যবহার।  কনেকে চন্দন পরানো আর থ্রেডিংয়ে ভ্রু প্লাক- এই দুই কাজে মানসীর নাম ছড়িয়ে গেলো মুখে মুখে চারদিকে। 

প্রাইভেট কাজ আসতে শুরু করলো অনেক। 

কেটে গেল বেশ কয়েক বছর। এখন মানসীর কাছে আইব্রাও ঠিক করার জন্যে লোকে লাইন দেয়। বিয়ের মরশুমে চন্দন পরানোর কাজও কম আসে না। ছুটির দিনেও একটু বিশ্রাম নেই। ছোটে ফ্ল্যাটবাড়ির দিদি, বৌদি, কাকিমা, মাসিমাদের ভুরু ঠিকঠাক করতে। লোকে বলে মানসী ভুরু ঠিক করার সময় না কি টেরও পাওয়া যায় না, এতো ভালো হাত ওর।

মানসী নিজের কপালকে ধন্যবাদই দেয়। তার মতো অতি সাধারণ মেয়ে যে বেশ করেকর্মে খাচ্ছে এটা রীতিমত সৌভাগ্যের ব্যাপার। তার ওপর শাশুড়ি মায়ের তুলনাই নেই। সংসারের রান্না বান্না, পাঁচ বছরের নাতনি টুকটুকির ঝামেলা সামলানো সব নিয়েছেন নিজের কাঁধে। মানসীকে ভালোও বাসেন খুব। বলেন বাড়ির লক্ষী। এলোমেলো অগোছালো সংসারটা আজ গুছোনো মানসীর গুণেই। সংসারের ব্যাপারে একপ্রকার নিশ্চিন্ত হয়েই মানসী তাই পুরোপুরি মন দিয়েছে কাজে।

চলছিল ভালোই। কিন্তু সারা পৃথিবী জুড়ে যে এমন শনির দশা লাগবে তা তো আর ভাবা যায় নি ক'দিন আগে পর্যন্ত।

আজ প্রায় দু'মাস হতে চললো বইয়ের দোকান, বিউটি পার্লার সব বন্ধ। টুকটাক যা এদিক ওদিক পয়সাকড়ি ছিল তাতেই কিছুদিন সংসার কোনোমতে টেনেটুনে চলেছে। গত সপ্তাহ থেকে অম্লান বাড়িতে বাড়িতে সবজি বিক্রি করছে। পুরোনো সেলাইবিদ্যে কাজে লাগিয়ে মানসী তৈরী করছে মাস্ক। অম্লান সবজির সঙ্গে মাস্কও বেচছে।  

জানা নেই যে কবে আবার সব ঠিক হবে বা আদৌ হবে কিনা।

হোয়াটসঅ্যাপের নানান গ্ৰুপে মানসীকে যুক্ত করে নিয়েছিল কাস্টমারেরা। এক এক ফ্ল্যাট বাড়ির বৌদি, দিদি, মাসিমাদের এক এক গ্রুপ। "সারদা', "উপাসনা" এই সব নাম সে সব গ্ৰুপের। দোকানের সময়টা ছাড়া সারাদিন প্রায় মানসী ব্যস্ত থাকতো কাস্টমারদের সামলাতে। 

সে সব সুখের দিন কোথায় চলে গেলো। আজকাল আর মেসেজ দেখতেও ইচ্ছে করে না। দিদি, বৌদি, মাসিমারা নিজেদের গল্প করেন, ওতে মানসীর আগ্রহ নেই। তবে গ্ৰুপ থেকে বেরিয়ে আসতেও ভরসা পায় না, সুদিন এলে তো এদেরই আবার লাগবে।

কি মনে হতে আজ আবার একটু দেখছে মেসেজ। কে জানে সামনে মাস থেকে নেট কার্ড ভরাবার পয়সাও থাকবে কিনা। দেখি একটু, এই ভেবে মানসী বসলো। বেশ কিছু জোকস দেখে হাসলো। তারপর এটা ওটা। হঠাৎ নজর পড়লো একটা ছবিতে। কে যেন শেয়ার করেছে দুটো চোখের  ছবি। তবে চোখের ওপরে ভুরুর বদলে ঘন জঙ্গল। তলায় লেখা, ‘লকডাউনের পর আমার মুখে যা দেখতে পাবে’।

দেখেই হাসি পেলো। পরক্ষণেই মুখটা ম্লান হয়ে গেলো। মন খারাপ অবশ্য কাস্টমারদেরও। পোস্টটার তলায় কত যে দুঃখী দুঃখী কমেন্ট আর ইমোজি।।

মনে পড়লো গত দু 'মাসে সে একটাও থ্রেডিং করেনি। আগে দিনে যা নয় নয় করে গোটা কুড়ি হতো। ভেবেই হঠাৎ মানসীর কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগলো। 

‘লকডাউন শেষ হয়ে সব স্বাভাবিক হবার পর যদি আমার আগের মতো হাত না থাকে! লোকে যে বলে মানসীর ভুরু তোলা কাস্টমার বোঝার আগেই হয়ে যায়, তা যদি নষ্ট হয়ে যায়!’

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মানসীর হাত নিসপিস করতে লাগলো।  

‘ইস, কাউকে যদি পেতাম! পরীক্ষা করে দেখতাম সত্যি আমি আর সেরকম পারি কিনা!’

ভাবতে ভাবতে চোখ গেলো পাশেই তক্তপোশে ঘুমন্ত শাশুড়ির ওপর। প্রবল ইচ্ছে হল একবার পরীক্ষা করার।

কেমন যেন একটা ঝোঁকের বশেই ঘুমন্ত শাশুড়ির কপালে হাত রাখলো মানসী। হাতে থ্রেডিংয়ের সুতো। সন্ধ্যার সামান্য তন্দ্রা এসেছিলো। কপালে ঠান্ডা ছোঁয়া পেতেই চটকাটা ভেঙে গেলো। তাকিয়েই মানসীকে ওভাবে মাথার কাছে বসে থাকতে দেখে ধড়মড় করে উঠে বসলেন তিনি। 

ভালো করে তাকিয়ে দেখতে গিয়েই সন্ধ্যার নজরে পড়লো মানসী মাথার কাছে বসে ছোট্ট টুলে। হাতে থ্রেডিংএর সুতো। পাশে সেই বাক্স যা ওর সারাক্ষণের সঙ্গী ছিল মাস দু’য়েক আগে পর্যন্ত। 

"কি হয়েছে রে মা?" উদ্বিগ্ন গলা সন্ধ্যার। 

মানসীর চোখে জল টলমল করছিলো। ভাবছিলো, 'তাহলে কি লোকে বানিয়ে বানিয়ে বলে! কেউ নাকি টেরও পায় না আমি থ্রেডিং করলে! সব মিথ্যে কথা! মা তো কপালে হাত রাখতেই উঠে পড়লো! না কি আমি সব ভুলে গেছি!'

মাথার মধ্যে কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছিলো। ঠিক ভুল চিন্তা করার শক্তিটাও বোধহয় হারিয়ে গেছে!

সন্ধ্যার কোলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো মানসী। সন্ধ্যার বুকটাও তোলপাড় হচ্ছিলো। একটিও কথা না বলে তিনি মানসীর মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছিলেন। বুঝতে পারছিলেন বুকে জমে থাকা ব্যথাটার বাঁধ ভেঙে গেছে আজ। যে মেয়ে শত বিপদ ঠেলেছে এ সংসারে আসা থেকে, নিজের অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে সবাইকে ভালো রাখতে তার চোখের জল সন্ধ্যার ভেতরটা ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছিলো।

সে ভাবটা কিন্তু একটুও বুঝতে না দিয়ে সন্ধ্যা বলে উঠলেন, "ওরে দুষ্টু মেয়ে! আমার ঘুমোনোর মধ্যে তাল করে ছিলে আমার ওপর দিয়ে হাত ঝালানোর! তা এতে এতো লুকোচুরির কি আছে রে! দাঁড়া, আমি একটু মুখে চোখে জল দিয়ে আসি, তারপর সুন্দর করে আমার ভুরু দুটো প্লাক করে দে দেখি!"

মানসী এখন একটু ধাতস্থ হয়েছে। এদিকে পাশের তক্তপোশের বাপ বেটিও ঘুম থেকে উঠে পড়েছে কান্না আর কথাবার্তার আওয়াজে।

টুকটুকির চোখ বিস্ফারিত। বিস্মিত অম্লানও কম নয়!

"ঠামি তুমিও মায়ের কাছে সাজবে!"

চোখের জলটল মুছে মানসী এখন আবার আগের ফর্মে।  

"না সাজার কি আছে? মা তো এখনো কত সুন্দর! সাজে না তাই! মায়ের থেকে কত বুড়ি বুড়ি মহিলাদের সাজিয়ে দিই! তোর বাবারও ভ্রু প্লাক করে দিতে পারি! কি গো দেব নাকি!'’

অম্লানও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার সুযোগ ছাড়লো না!

হেসে বলে উঠলো, “হ্যাঁ! তাহলে আমাকে দেখার জন্যেই সব্বাই সবজি কিনবে কাল!"

" ধুস! কেউ বুঝবে না! 

 অনেক দিনের পরে আবার মানসীর আত্মপ্রচার। 

"দেখবে আমার হাতের কাজ! ভুরু তোলার পর আবার ঠিক এমনি আগের মত করে দেব যে লোকে ধরতেই পারবে না! এই কাজই তো আমার! তোমার ধারণাই নেই আমার এই বাক্সে কি কি আছে! মুখের, গালের, চোখের, ঠোঁটের কত কত খুঁত যে ঢাকি আমি রোজ! ভোল বদলে দিই মানুষের ...."

একটানা কত কথাই না বলে চলছিল মানসী। অম্লানের কানে সবটুকু আর ঢুকছিল না... ও ভাবছিলো সত্যি সত্যিই কি বাক্সে এমন জিনিস আছে যাতে সমাজের মুখটার উঁচু নিচু সব খুঁত ঢেকে ভোল এক্কেবারে পালটে দেওয়া যায়!



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.