শুভজিৎ_চট্টোপাধ্যায়

তর্পণ

শরতের ভোরের সূর্য্যটা গঙ্গার জলকে রাঙিয়ে দিয়ে তখনো আলস্য ভাঙে নি। একটা মিঠে আলোয় চরাচর জুড়ে এক প্রশান্তি। আজ গঙ্গার ধারে অন্যান্যদিনের তুলনায় লোক অনেক বেশি। কেউ নিজের বাচ্চাকে নিয়ে এসেছে সাথে করে, সে অবাক চোখে সব দেখছে। তার কাছে ভোরের গঙ্গার এই রূপ অপরিচিত। কিছু চোদ্দ পনের বছরের ছেলে এসেছে সাইকেল নিয়ে। তারা নিজেদের মধ্যে হাসি ঠাট্টায় ব্যস্ত। কেউ কেউ মোবাইলে সূর্য্যের ছবি তোলায় ব্যস্ত।​

হঠাৎ এত লোকের আনাগোনায় আশপাশের গাছের পাখিগুলো ও যেন আজ একটু থমকে গেছে। হালকা শরতের হাওয়ায় নদীর ধারের কাশফুল গুলো অল্প অল্প দুলছে। আগে এখানে অনেক কাশফুলের ঝাড় হতো শরতে। এই মফঃস্বলে শহুরে হাওয়া লাগতে শুরু করায় প্রকৃতিও যেন একটু বদলাতে শুরু করেছে।

গঙ্গার ঘাটের পাশে রাধামাধব জীউয়ের মন্দিরে লাউড স্পিকারে হালকা আওয়াজে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া চলছে। যারা ভোরে উঠে রেডিওতে শুনতে পারেননি তারা শুনে নিচ্ছেন। কিছু বাচ্চা খেলা করছে। এত সকালেই অনেকে তর্পণ করতে গঙ্গায় নেমে গেছেন। কেউ কেউ সাথে তাদের স্ত্রীদের নিয়ে এসেছেন। রচনাও সেরকম এসেছে তার স্বামীর সাথে। খুব মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে রচনা। দুবছর হলো বিয়ে হয়েছে। স্বামীকে বন্ধু হিসেবে পাওয়ার স্বপ্ন দেখতো ছোটবেলা থেকে কিন্তু বিয়ে হয় ওর চেয়ে দশ বছরের বড়ো অনুভবের সাথে। স্বামীকে বন্ধু হিসেবে কখনোই পায়নি রচনা উল্টে স্বামীকে সে ভয়ই পায়। শ্বশুরবাড়িতে কোনো মেয়ের স্বামীর বা বাড়ির ছেলেদের মুখের উপর কিছু বলার কোনো অধিকার নেই। বিযের মাস চারেকের মধ্যে বাবাও এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। তারপর থেকে রচনা যেন আরো চুপচাপ হয়ে গেছে। আজ নদীর পাড়ে বসে এইসমস্ত কথা ভেবে মন খারাপ করে নদীর দিকে তাকিয়ে রচনা বসে আছে। তার স্বামী জলে নেমেছে পুরোহিতের সাথে তর্পণ করতে।

​চারদিকে ছড়ানো ছিটানো মানুষজন, তর্পণ করাতে নামা, ওঠা, মন্ত্রপাঠ সবকিছুর মধ্যে খুব অসামঞ্জস্য রেখে নদীতে নামলো এই এলাকায় সদ্য ট্রান্সফার হয়ে আসা ব্যাংককর্মী অমিতোষ ভট্টাচার্য্য আর তার স্ত্রী গার্গী। অতলোকের মধ্যে এদের দুজনকে কেউ সেভাবে খেয়াল করার প্রয়োজন বোধই করেনি। দুজনে সূর্য্যপ্রণাম সেরে শুরু করলেন তর্পণ করার তোড়জোড়।

- গার্গী শুরু করো। আমি প্রস্তুত।

উদাত্ত কণ্ঠে মন্ত্রপাঠ হচ্ছে
ওঁ নমঃ দেবা যক্ষাস্থতা নাগা গন্ধর্ববাপ্সরসোহসূরা .....

হঠাৎ আশেপাশের সমস্ত কাজে যেন এক অনুচ্চারিত বিরতি নেমে এলো। ঘটে উপস্থিত প্রত্যেকেই নিজের নিজের কাজ বন্ধ করে অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন ।

এক ত্রিশোর্ধ্ব , সুঠাম , সুপুরুষ যুবক জলে দাঁড়িয়ে তর্পণ করছেন এবং তার সাথে পুরোহিত হিসেবে মন্ত্রপাঠ করছেন একটি সধবা স্ত্রী!

অসামান্য তার উচ্চারণ। প্রতিটি নিয়ম খুঁটিয়ে পালন করছেন। তার মন্ত্রোচ্চারণ, নিয়মনিষ্ঠা দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নীচু হয়ে আসছে ঘাটে উপস্থিত প্রত্যেকের।​

- বন্ধ করো এ অনাচার।​

বজ্রকণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন এক বৃদ্ধ।

পাশের মন্দিরের বৃদ্ধ পুরোহিতের আওয়াজে সবার যেন সম্বিৎ ফিরলো।

- ছি, ছি। এ জল পূর্বপুরুষের মুখে পৌঁছবে না। একজন স্ত্রী হয়ে তর্পণ পৌরোহিত্য?

- কেন? বারণ আছে?

শান্ত ধীর কণ্ঠে জবাব দিলেন গার্গী।

- হ্যাঁ। গরুড় পুরাণে বলা আছে " পুত্র বিনা মুক্তি নেই" জলদান শুধু পুত্র করবে, বা পুত্রস্থানীয়। তোমার বোধ হয় তা জানা নেই।

- আপনি বিদগ্ধ পুরুষ। শাস্ত্রজ্ঞানী। আপনার শাস্ত্রজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলা আমার ধৃষ্টতা। কিন্তু আমার কিছু তুচ্ছ কথার উত্তর দিলে আমার মত অজ্ঞানীর জ্ঞানচক্ষু খুলে যায়।
- মস্করা করছো?
- একদম না। আমি সংস্কৃত নিয়ে মাস্টার ডিগ্রী পাশ করেছি। আমার বাবার থেকে শাস্ত্র এবং সংস্কৃতে আমার উৎসাহ। যদিও আপনার তুলনায় তা নিতান্তই কম। জ্ঞানার্জনের জন্যই বলুন বা ধারণা পরিষ্কার করার জন্যই বলুন আমার কিছু জানার আছে।​
- বলো।

উপস্থিত বাকি পুরোহিতেরা এসে ভিড় করলেন বৃদ্ধ পুরোহিতের পাশে। কিছু মানুষ মজা দেখার জন্য ভিড় করে দাঁড়িয়ে পড়লো। অনেকে এদিকে মন দিচ্ছে না দেখিয়েও অধীর আগ্রহে সেই কথোপকথনের দিকে কান পেতে আছে। বাচ্চাগুলো হঠাৎ এত লোকের ভিড় দেখে খেলা ছেড়ে মায়েদের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। এক অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠলো রচনার।

আত্মীবিশ্বাসী স্বরে গার্গী বলা শুরু করলেন-

- মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে যারা প্রতি বৎসর শ্রাদ্ধ কাজে অপরাগ তারা সর্বপিতৃ অমাবস্যা পালন করে পিতৃদায় থেকে মুক্ত হতে পারেন। মেয়েদের যদি শ্রাদ্ধের অধিকার থাকে তাহলে তর্পণ করার নয় কেন?​

- না বৈদিক মতে নারীদের তর্পণে অধিকার নেই !

কেবল স্বামীহীনা, বিধবা, নারীদের ক্ষেত্রে, যাদের পুত্র সন্তান বা পৌত্র নাই, তাঁরা, স্বামী, শ্বশুরমশাই এবং দাদাশ্বশুরের অর্থাৎ শ্বশুরমশাইয়ের পিতার তর্পণ পৌরাণিক শাস্ত্রবিধিঅনুসারে করতে পারেন।
পুত্র, পৌত্ররা যদি বেঁচে থাকে, তবে, নারীদের সেই অধিকার নেই।

- শাস্ত্র তৈরি হয়েছে কাল ও স্থানের প্রয়োজনের নিরিখে। তাই সামাজিক এবং সমসাময়িক পরিস্থিতি অনুযায়ী মেয়েদের উল্লেখ নেই।​

কিন্তু মহাভারতের স্ত্রী পর্বে, কৌরব রমণীদের তর্পণ করার উল্লেখ আছে।

তাছাড়া ভাবুন তর্পণে, জলদান দ্বারা, মৃত পূর্বপুরুষ এবং দেবতাদের তৃপ্তিসাধনের জন্য চেষ্টা করা হয় ! তাঁরা, প্রীত হবেন কিনা, তাঁদের তৃপ্তিসাধন হবে কিনা, এটা কিন্তু পুরোটাই বিশ্বাসের উপর !তর্পণ, মৃত পূর্বপুরুষের জন্য, জীবিত বংশধরের জলদান।এটা পিতৃযজ্ঞ। যাঁর তর্পণকরা হয়েছে,তিনি তো আর বেঁচে নেই ! জীবিত লোকের তর্পণ হয় না ! জীবিত থাকলে এমনি তাঁর হাতে এক গেলাস জল তুলে দেওয়া যায় ! তিনি পিপাসার্থ থাকলে, তাঁর তৃপ্তিসাধন, নিশ্চিতভাবে হবে। সেটা তো বাড়ির মহিলারাই দেন। তাহলে মরণোত্তর জলদান নয় কেন? আর যদি তর্কের খাতিরে বলেন তাহলে বলবো আমি তো মন্ত্র পড়ছি। জলদান তো আমি করছি না। উনি করছেন, আমার স্বামী, আমার জজমান। ওনার তো জলদানে অধিকার আছে।

- তোমরা আধুনিকা, তোমাদের আছে যুক্তি, আমাদের আছে সংস্কার, বিশ্বাস আর শাস্ত্রের বাণীর প্রতি অচল নিষ্ঠা। আমরা তার কারণ অনুসন্ধানে যাই না।​

উপস্থিত জনতা মানসিক ভাবে প্রায় দুভাগে বিভক্ত। অনেকেই গার্গীর মতের সাথে একমত কিন্তু এতদিনের সংস্কার ভেঙে তার পাশে যেতে পারছেন না। মন্দিরের শাস্ত্রজ্ঞ পুরোহিত মশাইয়ের বিরুদ্ধেই বা কিভানে যাবেন তারা। কিছু মানুষ আবার বৃদ্ধ পুরোহিতের সমর্থনে। ভিড়ের মধ্যে থেকে বিভিন্ন মন্তব্য উড়ে আসছে সেই গার্গীর দিকে। সামান্য হলেও কি বিচলিত দেখালো ওই দম্পতিকে।​

সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। ভিড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলেন রচনা।​

- প্রণাম পুরোহিত মশাই। আপনি শ্রদ্ধেয়। কিন্তু সত্যিই ভেবে দেখুন তো উনি কিছু ভুল বলেছেন কি? বাড়িতে সবার সেবা তো আমরাই করি। মন্দিরে ভগবানের সেবাও করি। ভগবান কে যদি জল দিতে পারি, বাড়িতে বাবা, মা, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি কে যদি জল দিতে পারি তাহলে তাঁদের মৃত্যুর পর পারবো না? আজ আমার বাবা নেই। আমার ভাই আমার বাপের বাড়ির ওখানে তর্পণ করছে। আমার বাবা আমায় খুব ভালোবাসতেন। কই আমি তো জল দিতে পারলাম না। সত্যি ই কি বাবা মা অতৃপ্ত হবেন মেয়ের হাতে জল পেলে।

উপস্থিত ভিড় যেন চুপ করে গেছে। পিন পড়লেও আওয়াজ হবে। রচনার স্বামী এগিয়ে আসছে রচনার দিকে। রচনার ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে রচনার স্বামী বললেন​

- তুমি আমায় গর্বিত করলে। আমি এভাবে কখনো ভাবতেই পারিনি। কি চূড়ান্ত সত্যি কি সহজভাবে বললে তুমি।

গার্গী এসে রচনার কাঁধে হাত রাখলো।

পুরো ভিড় অপেক্ষা করছে বৃদ্ধ পুরোহিতের উত্তরের জন্য।

- তোমরা দুজন আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। আমি শাস্ত্রজ্ঞানী হিসেবে গর্ব করি। তবে আজ তোমরা অনেক ছোট হয়েও অনেক বড়ো একটা প্রশ্ন আমার মনে তুলে দিয়ে গেলে মা। আমার শাস্ত্রজ্ঞান শুধু পুঁথিগত রয়ে গেছে আর তোমরা তা অনুভব করেছো নিজেদের সাধারণ বুদ্ধিতে। আশীর্ব্বাদ করি সুখী হও মা।

ভিড়ের সমবেত প্রশংসার মধ্যে গঙ্গার ঘাট থেকে উঠে আসছেন গার্গী আর রচনা।​

মন্দিরের লাউড স্পিকারে তখন বাজছে

" জাগো দুর্গা......."

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.