খুশি ট্রাম্প সাহেব নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন বলেই। মনোনয়ণেই এত আনন্দ। পুরস্কার বিজয়ী হলে নিশ্চয় এঁদেরও জীবন সার্থক হবে শান্তি পুরস্কারের আনন্দে। হওয়ারই কথা। আমাদের ভারতে ট্রাম্পের ভক্ত কম নয়। অনেকেই ট্রাম্প সাহেবের মার্কীণমুলুককে ভারতের অভিভাবক রূপে দেখতে চান। অনেকেরই বিশ্বাস প্রয়োজন পড়লে এই মার্কীণশক্তিই ভারতকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে। এই বিশ্বাস অনেকটা ঈশ্বর বিশ্বাসের সমতুল্য অনেকের কাছেই। তাঁরাই রীতিমত যাগযজ্ঞ করে নিয়মিত ট্রাম্প পুজোয় শান্তি পান। পুত্র কন্যাদের মার্কীন দেশের নাগরিকত্ব অর্জন এনাদের কাছে জীবনের সর্বোত্তম আনন্দ। এবং পরম গর্বের বিষয়। সেই আনন্দ ও গর্বে আরও একটি নতুন পালক যুক্ত হবে, যদি সত্যই ট্রাম্পসাহেব নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভুষিত হন।
খবরে প্রকাশ, গত আগস্টে ইজরায়েল ও সংযুক্ত আরব আমীরশাহী’র ভিতর স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তির জন্যেই ট্রাম্প সাহেবের নোবেল শান্তি পুরস্কারের এই মনোনয়ণ। এই চুক্তির ফলে, মিশর ও জর্ডনের পর সংযুক্ত আরব আমীরশাহী তৃতীয় আরব দেশ হিসাবে ইজরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করলো। এবং প্রতিদান স্বরূপ মার্কীণমুলুক থেকে আরও আরও বিলিয়ন ডলার সমরাস্ত্র কেনার অধিকারী হলো। আগস্টে এই দুই দেশের ভিতর স্বাক্ষরিত হওয়া চুক্তির কারণেই ট্রাম্প সাহেবের নোবেল শান্তি পুরস্কারের এই মনোনয়ন। কথায় বলে বাহবা নন্দলাল!
সবচেয়ে মজার বিষয়, সদ্য স্বাক্ষরিক দ্বিপাক্ষিক একটি চুক্তির বলেই এই মনোনয়ণ। চুক্তির রূপায়ণ ও তার সাফল্যের ভিত্তিতে নয়। কারণ তার জন্য পাঁচ দশ বছর সময় লাগার কথা। কিন্তু ট্রাম্প সাহেবের হাতে অত সময় তো আর নাই। সামনেই নির্বাচন। নির্বাচনের আগে একটি দুটি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়ে গেলেই কেল্লাফতে। না পেলেও মনোনয়ণের প্রভাবও কম হবে না। এবং সেই অধরা শান্তি পুরস্কারকে হাতে ধরার সম্ভাবনাকে আরও মজবুত করতেই, আরও একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো সম্প্রতি। ইজরায়েল সংযুক্ত আরব আমীরশাহী ও বাহারিনের ভিতরে। মধ্যপ্রাচ্যের এই সব তথাকথিত মার্কীণ ও ইজরায়েলের স্বার্থ সুরক্ষিত করা চুক্তির ভিত্তিতেই ট্রাম্প সাহেব নোবেল শান্তি পুরস্কারের হাত ধরে আসন্ন নির্বাচনের বৈতরণী পার করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। গত বছর ইউক্রেনের রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে তাঁর গোপন ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর, হয়তো এটাই তার শেষ উপায় ছিল। এখন দেখার, সত্যই সেই অধরা নোবেল শান্তি পুরস্কার হাতে হাসতে হাসতে আসন্ন নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে পারেন কিনা তিনি।
নোবেল শান্তি পুরস্কার যে ঠিক শান্তি বিস্তারের স্বীকৃতি স্বরূপই দেওয়া হয় তাও নয়। পূর্বে, এই পুরস্কারের একশ ঊনিশ বছরের ইতিহাসে বহুবার দেখা গিয়েছে যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে এবং বিশেষ করে ইজরায়লে ও মার্কিণশক্তির স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতেই এই পুরস্কার প্রদত্ত হয়েছে একাধিকবার। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন ইজরায়েলী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সিমোন পেরজের নেতৃত্বে ইজরায়েলী সামরিক বাহিনীর হাতে ১৫৪ জন নিরস্ত লেবানিজ সাধারণ জনসাধারণের মৃত্যু হয়। সাংঘাতিক ভাবে আহত হন ৩৫১ জন। অনেকেরই ধারণা পরবর্তী নির্বাচনে জিততে নিজের শক্তি প্রদর্শনের জন্যেই সিমোন পেরেজের এই নরঘাতী প্রকল্প ছিল। এই প্রকল্পেই রাষ্ট্রপুঞ্জের আশ্রয় শিবিরে বোমা ফেলে ১০৬ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়। তৎকালীন সামরিক আধিকারিকরা টেলিভেশনে একথাও বলেন যে তারা এই ঘটনার জন্য আদৌ অনুতপ্ত্ নন। এক দঙ্গল আরবের মৃত্যুতে কিছু এসে যায় না। এবং প্রধানমন্ত্রী সিমোন পেরেজ বলেছিলেন, ““Everything was done according to clear logic and in a responsible way. I am at peace.” (তথ্যসূত্র) এটাই ইহুদী সংস্কৃতি। এই ঘটনার ঠিক দুই বছর আগেই নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়ে বিশ্ববাসীকে ধন্য করেছিলেন সিমোন পেরেজ।
এমনই মহিমা এই নোবেল শান্তি পুরস্কারের। সিমোন পেরেজের মতোই আরও দুই ইজরায়েলী রাষ্ট্র প্রধানকেও নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। ইৎজহাক রাবিন, যারা নেতৃত্বে ১৯৬৭ সালে প্রায় একহাজার মিশরীয় নাগরিককে হত্যা করা হয়েছিল যুদ্ধবন্দী হিসাবে। এবং মেনাহেম বেগিন ১৯৭৮ সালে। এঁরা তিনজনেই মধ্যপ্রাচ্যে ইজরায়েলী হত্যালীলা চালানো ও সাম্রাজ্যবাদী দখলদারী সামরিক অভিযান চালিয়ে যাওয়ার পুরস্কার স্বরূপই লাভ করেন নোবেল শান্তি পুরস্কার।
২০০৯ সালে সদ্য নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে মার্কীণ রাষ্ট্রপ্রধানের চেয়ারে বসেছেন বারাক ওবামা। সকলকে হতবাক করে দিয়ে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভুষিত হয়ে গেলেন বারাক ওবামা। কারণ হিসাবে নোবেল কমিটি থেকে বলা হলো, ওবামা বিশ্ব থেকে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মূল করবেন। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন। বিশ্ব পরিবেশ পরিবর্তন সমালিয়ে নেবেন। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার আরও সুদৃঢ় হবে তাঁর কার্যকালে। অর্থাৎ সবটিই ভবিষ্যতের আশা। তারই ভিত্তিতে নোবেল শান্তি পুরস্কারের ঘোষণা। এই শান্তি পুরস্কার প্রদানের পর বিগত ১১ বছরে কয়টি পরমাণু অস্ত্র নির্মূল করে গিয়েছেন বারাক ওবামা? হ্যাঁ নির্বাচনের প্রক্কালে তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলির উপরেই নির্ভর করে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল তাকে। শান্তি পুরস্কার বগলদাবা করে ওবামা বিশ্বজুড়ে মার্কীণ সামরিক শক্তি বৃদ্ধির কাজে সাফল্যের সাথে এগিয়ে গিয়ে লাগাতার সাতটি দেশে বোমাবর্ষণ করে গিয়েছিলেন। যাতে প্রায় ৯০% সাধারণ মানুষের প্রাণ চলে গিয়েছিল। (তথ্যসূত্র) নোবেল শান্তি পুরস্কারের কি অপার মহিমা।
নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপকদের এই নামের তালিকায় সবচেয়ে বরেণ্য শান্তিকামী মানুষটির নাম বোধহয় মার্কীণ সামারিক যুদ্ধের বিশিষ্ট রূপকার হেনরি কিসিংগার। এই মহাশয় ব্যক্তির বিশিষ্ট ভুমিকা ছিল ষাট সত্তরের দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের ইতিহাসে। কুখ্যাত কম্বোডিয়ান বোমাবর্ষণের ঘটনাও তৎকালীন মার্কীণ রাষ্ট্রপ্রধান রিচার্ড নিক্সন ও এনারই নির্দেশে ঘটেছিল। ইন্দোনেশীয়ার পূর্ব টিমরে গণহত্যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সমর্থক এই কিসিংগারই ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান প্রতিবন্ধক। এনার পরিকল্পনাতেই মার্কীণ সপ্তম নৌবহর এগিয়ে আসতে শুরু করেছিল বঙ্গোপসাগরের অভিমুখে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের নিউক্লিয়ার সাবমেরিন মোতায়েন থাকায় সেই নৌবহর আর বেশিদূর এগোতে পারেনি। স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। নয়ত বাংলাদেশের দশা হতে পারতো আজকের প্যালেস্টাইনের মতোই। এই বরেণ্য ব্যক্তির পরিকল্পনা মাফিকই চিলিতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে গণতন্ত্রকে প্রতিরোধ করা হয়েছিল সফল ভাবে। মসনদে বসানো হয়েছিল স্বৈরাচারী শাসককে।
এবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের পালা। যিনি এই দিক কয়েক আগেই একটি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ২০১৭’তেই তিনি সিরিয়ার রাষ্ট্র প্রধান বাশার আসাদকে (পৃথিবী থেকে) সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। (তথ্যসূত্র) কিন্তু তৎকালীন মার্কিণ ডিফেন্স সচীব জেমস মাটিসের জন্য পারেননি। “I would have rather taken [Assad] out,” ট্রাম্প সাহেব ফক্স চ্যনেলকে এক মঙ্গলবার বলেন, “I had him all set,” but “Mattis didn’t want to do it.” কি অসামান্য স্বীকারোক্তি! এই সেই ট্রাম্প সাহেব যাঁর সরাসরি নির্দেশে ইরানের সামরিক বাহিনীর অন্যতম বিশিষ্ট মেজর জেনারেল কাসেম সেলেইমানিকে হত্যা করা হয় প্রকাশ্য দিবালোকে। ঠিক একই কাজ ইরান বা রাশিয়া চীন কি উত্তর কোরিয়া কোন মার্কীণ সমারিক আধিকারিকের ক্ষেত্রে করলে বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় বয়ে যেত। তুলনা করা হতো হিটলার কিংবা মুসোলিনীর সাথে। মার্কীণ বোমারু বিমান আর মিসাইল বর্ষণে ধ্বংসলীলা হত্যালীলা শুরু হয়ে যেত সংশ্লিষ্ট দেশে। শুরু হয়ে যেতে পারতো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আমাদের মার্কিণপন্থী ভারতীয় জনগণের যে অংশ ট্রাম্প সাহেবের পুজোয় মগ্ন। তাদের অবশ্য এতসব হিসাবের দরকার নাই। তারা শুধু দেখেছেন, তাদের প্রিয় নেতার গলা জড়িয়ে ধরে ট্রাম্প সাহেব কি রকম সুখ্যাতি করে থাকেন কারণে অকারণে। সাম্প্রতিক দিল্লীর দাঙ্গার সময়ে এহেন ট্রাম্প সাহেব তাদের প্রিয় নেতার সাথে যেভাবে আড্ডায় মশগুল ছিলেন, তাতেই তাদের ট্রাম্পভক্তি শতগুণ বৃদ্ধি পেয়ে গিয়েছে।
এখন আসন্ন নির্বাচনে বিজয়ী হতে মরিয়া ট্রাম্প সাহেব পারলে খড়কুটো ধরতে ছোটেন। তাই এই মনোনয়ণ তার কাছে এতটাই জরুরী ছিল। অনেকেই বলবেন। ট্রাম্প সাহেবের মনোনয়ণ তো কোন মার্কিণ নাগরিক করেন নি। করে নি কোন মার্কিণ প্রতিষ্ঠান। ঠিক কথা। কিন্তু মনোনয়ণকারী নরোওয়ের সেই সাংসদ যেভাবে আসন্ন নির্বাচনের আগে ট্রাম্পের হাত মজবুত করতে এগিয়ে এলেন। এই ঘটনার সাথে সাদৃশ্য পাওয়া যাবে। পুলওয়ামায় আত্মঘাতী সন্ত্রাসী হামলার সেই সন্ত্রাসীর। যার একটি হামলায় মাস কয়েক বাদে নির্বাচনে বিপুল আসনে জিতে ফিরে এলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। কি আশ্চর্য মিল। সব ঘটনাগুলিই ঘটে নির্বাচনের প্রাক্কালে।
ট্রাম্প সাহেব নোবেল শান্তি পুরস্কার পান আর নাই পান। আসন্ন নির্বাচনে এই মনোনয়ণ তাঁকে যে বেশ কিছুটা হলেও রাজনৈতিক সুবিধা দেবে, সন্দেহ নাই সেই বিষয়ে। আর পুরস্কার পেয়ে গেলে তো কথাই নাই। একবার নির্বাচনে জিতে ফিরতে পারলেই পরবর্তী টার্গেট হতে পারে ইরান। গোটা মধ্যপ্রাচ্যে এই একটিই পথের কাঁটা রয়ে গিয়েছে এখনও। বাকিটা বোঝা যাবে অদূর ভবিষ্যতেই।
সুচিন্তিত মতামত দিন