ইন্দ্রাণী সমাদ্দার

এবছর উমারা কৈলাসেই রয়ে গেলো...​

প্রত্যেকবার পুজোর বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই বাড়ি ফেরার টিকিট কাটা হয়ে যায়। তাই উমার কাছে পুজো মানে শুধু শারোদোৎসব​ নয়, মাটির টানে বাড়ি ফেরার আনন্দ উৎসবের আনন্দকে কয়েক গুন বাড়িয়ে দেয়। দিল্লী শহরে মহাদেব রায়ের সঙ্গে​ বৈবাহিক সুত্রে উমার​ সাত বছর বাস। অফিসে যেতে -আসতে​ এতো বছরেও উমার শিউলি ফুল চোখে পড়েনি কিন্তু যমুনার ধারে সার- সার কাশফুল দেখেছে। কলকাতায় যাবার​ টিকিট কাটার পর পরবাসে​ চোখ বুজলেই সে দেখতে পায় কাশফুল কখনো শিউলি ফুল । মনের কোণে জমে আছে শিউলির গন্ধ। শিউলি​ ফুলের গন্ধে​ মন​ মম করে।​ মহালয়ায় যেমন দেবী পক্ষের সূচনা হয় ঠিক সেরকম​ বাড়ি ফেরার টিকিট কাটার পর বাতাসে শুধু পুজো পুজো গন্ধ ভাসে।​ ক্যালেন্ডারের​ তারিখগুলো যখন​ ছুটন্ত রাজধানীর মতো গাছপালা, জনবসতি ফেলে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলে তখন​ তার মন দৈনন্দিন কজের মধ্যেও গেয়ে ওঠে ‘বাজলো তোমার আলোর বেনু মাতলো যে ভুবন….. ’

উমা ল্যাপটপ শার্টডাউন​ করতে করতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবে এবছর তার বাড়ি যাওয়া হলো না। মহাদেব যেতেই বলেছিল কিন্তু সে ভরসা পেলোনা। মহাদেব ও উমার একমাত্র মেয়ে শ্রী। উমা শ্রীকে​ নিয়ে এই করোনা কালে ঘরের​ বাইরে যেতে চায় না। শুধু কী শ্রী, তার মা - বাবার বয়স হয়েছে। উমা সেই দিল্লি​ থেকে​ কলকাতায় উড়ে গিয়ে তাদের বিপদ বাড়াতে চায়না। তার থেকে এবছর আনন্দ, উৎসব, প্রিয়জনদের সান্নিধ্য বাদ থাক। পৃথিবীর অসুখ সেরে গেলে সামনে বছর সব হবে। শুধু সবাই সুস্থ থাকুক, ভালো​ থাকুক – এইটুকুই চাওয়া তবে সব চাওয়া কী মেটে! না শুনতে চাইলেও চেনা মানুষের প্রিয়জন হারানোর খবর মাঝে মাঝে​ হাওয়ায় খবর হয়ে ভেসে আসে। ভাবতে ভাবতে উমা রান্না বসিয়ে দেয়। বেশ​ কয়েক মাস হয়ে গেছে উমা কাজের মেয়েকে আসতে বারণ করেছে। অফিসের কাজ ওয়ার্ক ফ্রম হোম, শ্রীয়ের স্কুলের অনলাইন ক্লাস, বাড়ির এত্ত কাজ – সব মিলিয়ে উমার হিমসিম অবস্থা। মাঝে মাঝে ভাবে এযুগের উমাদের দশভূজের প্রয়োজন।​ আগে তাও মাঝে মাঝে রান্না বান্না না করে সুইগি অথবা জোমাটোয় খেয়ে নিতো আবার কখনো শ্রীকে সঙ্গে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যেত। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একথা​ ভাবাই যায় না।​ ডালে ফোঁড়ন দিতে দিতে নাকে লাইজলের গন্ধ আসে। মাথা ঘুরিয়ে দেখে মহাদেব মপ দিয়ে ঘর মুছছে। মাঝে মাঝে গঙ্গা জল​ ছেটানোর মতো লাইজল ছেটাচ্ছে। চোখাচুখি হতে মহাদেব​ উমাকে জিজ্জাসা করে-‘ রান্না কত দূর? পেটে ছুঁচো ছুটছে।’ উমা বলে-‘ ডাল হয়ে গেছে, আলু ভাজা প্রায় হয়ে এসেছে। আমি ডিম ভাজতে ভাজতে তুমি​ ফ্রিজে রাখা পনিরের তরকারি আর ডাইনিং টেবিলে রাখা ভাত​ চটপট মাইক্রোভেনে গরম করে নাও। আমার আবার দুপুর তিনটে থেকে জুমে মিটিং।’ ম্যা ম্যা শব্দে উমা পিছন ফিরে দেখে তার ছানা হাতে মোবাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে। এতোক্ষন মোবাইল ছিল তাই শব্দ শোনা যাচ্ছিল না। এবার কলকল করে তার কথা শুরু হয়। শ্রী এক নাগাড়ে বলে চলে –‘ মা তুমি যখন অফিস করবে আমি তখন কি করবো? আমি কি চকলেট খাবো? নাকি তুমি ছবি এঁকে দেবে​ আমি রং করবো ? ...’ মহাদেব মেয়েকে বলে –‘ আমি তোমায় গল্প শোনাবো।’​ ​ উমা ভাবে মহাদেবের আজ ঘুম হবে না। রাতে যখন সবাই ঘুমে কাদা তখন মহাদেব জেগে থাকে। অফিসের কাজ করে। সন্ধ্যে​ সাড়ে ছটা থেকে সেই ভোর তিনটে অব্ধি অফিসের কাজ চলে। আমেরিকার সময় অনুযায়ী​ মহাদেবের অফিসের সময়।

পুজো যতো​ এগিয়ে আসছে উমার মনের আকাশ তত গুমোট​ হচ্ছে। দমবন্ধ করা গুমোট জীবন যেন তার কাছে অসহ্য মনে হচ্ছে। প্রায় সাত মাস ভয় নিয়ে ঘর​ করা। কবে যে মা-বাবাকে দেখতে পাবে। পোড়া গন্ধে তাকিয়ে দেখে​ ডিম ভাজা পুড়ছে । কড়াই থেকে তাড়াতাড়ি পোড়া ডিম ভাজা নামিয়ে কড়াই ধুতে ধুতে ভাবে শুধু সে নয় কতো কতো​ উমা সারা বছর অপেক্ষায় থাকে নিজের বাড়ি নিজের মা-বাবা , প্রিয়জনের কাছে ফিরবে বলে​ তাদের এবছর আর বাড়ি ফেরা হলোনা​ । তারা কৈলাসেই রয়ে গেল।​ ​ ​ ​ ​

■ লেখক পরিচিতি


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

সুচিন্তিত মতামত দিন