আরাকুর একটা দিন
স্তরে স্তরে যখন জমে যায় কথারা, তখন গড়ে উঠে পাহাড়। পূর্বঘাট পর্বতমালার শরীরে সর্পিলাকারে যে ধাতব পথরেখা, তার উপর দিয়ে ছুটে চলেছে একটা ছোট্ট ট্রেন। তারই গর্ভগৃহে নিজস্ব কুপে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতে দেখতে মনে হল, প্রকৃতির বুকে কত কথা জমলে এমন বিস্তৃত, সুউচ্চ পর্বতশ্রেণি তৈরি হতে পারে! চলেছি আরাকুর পথে। প্রকৃতির বুকে একবার কান রাখব,যদি সে সুযোগ দেয়। আগের দিনই হাইদ্রাবাদ থেকে পৌঁছেছি সোজা বিশাখাপত্তনম। একটা দিন পুরো বিশ্রামের পর আবার এই পথ চলা। আমরা চলেছি ট্রেনে আর আমাদের ভাড়াকরা গাড়ি চলেছে পাহাড়ি সড়ক পথে। জানি বিষয়টা ঠিক বোধগম্য হবে না সবার। তবে খুলেই বলি। আসলে বিশাখাপত্তনম থেকে গাড়িতে সড়ক পথে যেমন আরাকুভ্যালি যাওয়া যায়, তেমনই ট্রেনেও যাওয়া যায়, কিন্তু আমরা ট্রেনে যাচ্ছি আর ফিরব গাড়িতে। আমাদের গাড়ি বোরাকেভ স্টেশন থেকে আমাদের তুলে নেবে, তারপর আমরা পুরো আরাকু দেখে সড়কপথে ফিরব, এমনটাই কথা হয়ে আছে। আসলে ফেরার পথে শেষ ট্রেন ধরতে গেলে পুরো আরাকুটা আমাদের ভালো করে দেখা হবে না, তাই এমন ব্যবস্থা। বসে আছি ট্রেনের প্রথমশ্রেণির কক্ষে। শিমলায় দেখেছিলাম প্রথমশ্রেণির ট্রয়ট্রেনের ঝাঁ চকচকে রূপ। ভেবেছিলাম এটাও বুঝি তেমন। কিন্তু আশাভঙ্গ হল। এই ট্রেনে প্রথমশ্রেণি বলতে একটা বদ্ধ ধাতব গন্ধযুক্ত অন্ধকার কুপ, যার দরজা বন্ধ করে দিলে শুধুমাত্র একটা অন্তরাল পাওয়া সম্ভব।
চলেছি বিস্ময় নিয়ে, কে যেন বলেছিল এই যাত্রাপথে কোনো এক জায়গা থেকে নাকি পাহাড়ের কোলে সমুদ্র দেখা যায়। মনে মনে সে এক বিচিত্র সৌন্দর্যের ছবি নিয়ে বিস্ময়মাখা চোখে তাকিয়ে আছি অনন্তবিস্তৃত উপত্যকার দিকে—এই বুঝি দেখা হয়ে যাবে সেই ছবির সাথে। মাঝে মাঝেই ট্রেনটা ঢুকে পড়ছে অন্ধকার গুহাপথে। নিকষ কালো অন্ধকার তখন চারিদিকে। মনে হচ্ছিল যদি হঠাৎ এই সুরঙ্গের মধ্যেই ট্রেনটা স্থবির হয়ে যায় চিরকালের জন্য! কি ভয়ঙ্কর সেই ভাবনা! কিন্তু সব অন্ধকারের শেষে আলোর মতো আঁধার পেরিয়ে ছুটে চলেছে ট্রেন। মনে মনে এমন কুড়িটি টানেল গোনার পর আর হিসাব রাখতে পারলাম না। তবে এরকমই অনেক গুলো টানেল আর আকাশে নীল সাদা মেঘের ছোটাছুটি দেখতে দেখতে প্রায় এগারোটার দিকে ট্রেন বোরা কেভ স্টেশনে থামতেই নেমে পড়লাম আমরা। পাহাড়ের কোলে কি সুন্দর ছোট্ট একটা স্টেশন! স্টেশনের বাইরে অজস্র গাড়ির মেলা। ছোট্ট দু’ধাপ সিঁড়ি দিয়ে নেমে চারিদিকে চোখ বোলালাম। কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে ড্রাইভার দা। হাত নাড়ছেন। স্টেশনের দু’পাশে লাল সাদা থোকা থোকা গোলাপ ফুটে আছে। গাড়ি আমাদের নিয়ে ছুটে চলল বোরাকেভের পথে। ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম্য রাস্তা ধরে কিছুটা এগতেই একটা সরু রাস্তা ডানদিকে বেঁকে গিয়েছে। এই পথই মিশেছে বোরা কেভের দরজায়। চলার পথেই নজরে এল স্থানীয় আদিবাসী শিল্পীদের হাতের কাজ। রাস্তার ধারে বসে কাঠ কেটে ঘরসাজানোর নানা জিনিস তৈরি করছে তাঁরা। গাড়ি বেশি ভিতরে ঢুকলে বেরতে অসুবিধা হবে,তাই বেশ অনেকটা আগেই আমরা নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। গুহামুখ পর্যন্ত হাঁটা পথটা বেশ মনোরম। একদিকে উঁচু পাহাড়ের দেওয়াল আর আরেক দিকে সবুজ গাছে ভরা অনন্তগভীর খাদ। মাঝের পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে আমরা হেঁটে চলেছি অনন্তগিরি পর্বতের গায়ে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা বোরা কেভের দিকে যার স্থানীয় নাম বোরালু গুহালু। ছোট্ট একটা সিঁড়ি ধাপে ধাপে নেমে গিয়েছে নিচে। বেশ খাড়া।লোহার রেলিং এর ওপাশে চোখ রাখলেই বুক কেঁপে উঠছে। অনন্ত বিস্তৃত খাদের শেষ সীমায় সরু একফালি নদী দেখা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে নেমে চলেছি গুহায়। আস্তে আস্তে মাথার উপর থেকে খোলা আকাশটা হারিয়ে যাচ্ছে, আর ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাকমাইট এর অসাধারণ ভাস্কর্য। অদ্ভুত অদ্ভুত সব আকৃতি। একটা জায়গায় এসে চোখ আটকে গেল। এ কি অদ্ভুত জিনিস দেখছি! এ যে মনে হচ্ছে অসংখ্য কঙ্কালের হাত ঝুলে ঝুলে আছে। বাঁদুরের বিভৎস গন্ধে ভিতরটা গুলাতে লাগল। বাজার চলতি হাওয়া নিরধক মাস্ক লাগিয়ে নিলাম মুখে। হাইদ্রাবাদে সোয়াইন ফ্লু চলছিল, তাই এইগুলো সঙ্গে নিয়েছিলাম। এখানে এসে কাজে লেগে গেল। প্রায় ২০০ মিটার দীর্ঘ এই গুহা ১৮০৭ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজ জিওলজিস্ট উইলিয়াম কিং খুঁজে পান। গুহার অন্ধকারকে দূর করতে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা গুহার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর রোমাঞ্চকে অনেকটা ব্যহত করেছে ঠিকই,তবে চলতে চলতে কখনও কখনও সত্যিই মনে হচ্ছিল,এমন আলোর সত্যিই প্রয়োজন ছিল। একটা অদ্ভুত অনুভূতি সমগ্র মস্তিষ্ক জুড়ে। এ কোন আদিম অনুভব! ঢুকে যাচ্ছি গভীর থেকে গভীরে। চারপাশে ভেজা ভেজা অন্ধকার যেন ঝুলে পড়ছে গায়ে।প্রাচীন সভ্যতার জঠরে ঘুমিয়ে আছে কোন সে অজানা এক ইতিহাস। এখানেও কি কোনো সময় গুহামানবের বাস ছিল? জানি না! জানার ইচ্ছায় কেমন যেন কল্পনা শক্তি জেগে উঠতেই শিহরিত হলাম মনে মনে! একটা সরু পিচ্ছিল সিঁড়ি উঠে গিয়েছে উপরে। নিচ থেকে বোঝা যাচ্ছে নয়া ভালো করে কি আছে উপরে। ধূপের গন্ধ ভেসে আসছে। সাবধানে পা ফেলে উঠতে লাগলাম উপরে। একটা মূর্তি। পুজো হচ্ছে।
উঁচু খাড়া সিঁড়ি বেয়ে ফেরার পথে উপরে ওঠা সত্যিই বেশ কষ্টকর। ঘনঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে উপরে উঠেই বসে পড়লাম, পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে সাজানো কাঠের চেয়ারে। হাত-পা ছড়িয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম। সামনে একপাল বাঁদর ঝোলাঝুলি করছে। দেখেই বেশ ভয় লাগল,যদি লাফিয়ে পড়ে ঘাড়ে! একটু চা, ছোট্ট করে স্ন্যাক্স খেয়ে আবার উঠে পড়লাম গাড়িতে। তবে যাবার আগে নিতে ভুললাম না স্থানীয় আদিবাসী মানুষদের হাতের কাজ। কেভের বাইরে এমন বেশ কিছু দোকানে চোখ ধাঁধানো বস্তুর দেখা মিলবে। দুপুরের খাবার সময় হয়ে গিয়েছে।প্রায় দু’টো বাজছে ঘড়িতে তখন। প্রচন্ড খিদে নিয়ে ঢুকলাম একটা হোটেলে। আরাকুর মনোরম পরিবেশ ও প্রকৃতিতে থাকার জন্য বেশ কিছু হোটেল আছে।এখানে আসার পর থেকেই মন আর ফিরতে চাইছে না। কি সুন্দর স্নিগ্ধ, নির্জন এখানকার প্রকৃতি। কিন্তু ফিরতেই হবে। ট্যুর প্ল্যান করার সময় আরাকুর জন্য একটা দিনই শুধু বরাদ্দ রেখেছিলাম। খাওয়া সেরে হোটেলের সামনের নির্জন প্রকৃতির পথে বেশ কিছুটা হাঁটলাম। অনেক কিছু তখনও দেখার বাকি। তবু হাঁটছি সমনের পথে। নির্জন সরু রাস্তাটা ক্রমশ হাতছানি দিয়ে ডাকছে যেন! কোথাও কোথাও আধখানা গড়ে ওঠা হোটেলের কাঠামো জানাচ্ছে ধ্বংস হয়ে যাওয়া গাছেদের আর্তনাদের ইতিহাস। তবু হাঁটছি, আজ যা দেখে যাচ্ছি হয়তো আগামীদিনে এইটুকুও বিরল হয়ে যাবে!
একটা সুন্দর প্রবেশদ্বার। ভিতরে সাজানা বাগান।গোলাপের বাহারের মাঝে ঘুরেফিরে কেটে গেল বেশ কিছুটা সময়,কিন্তু এতো সুন্দর প্রকৃতির মাঝেও কেমন যেন একটা বিষণ্ণতা। কি নেই যেন! কি নেই ভাবতে ভাবতে গাড়ি এসে পৌঁছাল ট্রাইবাল মিউজিয়ামের সামনে। দূর থেকে মিউজিয়ামের গঠনশৈলীর দিকে তাকিয়েই মুগ্ধ হল মন। টিকিট কেটে সোজা ভিতরে। গোলাকার মিউজিয়ামের ভিতরেও অপূর্ব সব নিদর্শন। আদিবাসীদের জীবন যাপনের ছবি মাটির মূর্তিতে ফুটিয়ে তোলা। মূল মিউজিয়ামের বাইরে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আলাদা আলাদা মাটির বাড়ি আর প্রতিটি বাড়িতে সজ্জিত আছে আদিবাসীদের ব্যবহার করা বিভিন্ন সামগ্রী। কোথাও অস্ত্র,কোথাও বাদ্যযন্ত্র, কোনো বাড়িতে ব্যবহার করা বাসনপত্র, আবার কোথাও গহনা। দেখতে দেখতে ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যাওয়া আদিম সভ্যতার ইতিহাসের পথে। এ কল্পযাত্রা মন্দ নয়,সুখদায়ক! এমনই এক বাড়ির দুয়ারে বসে নিজেকে সেই আদিম মানবী কল্পনা করার তৃপ্তি বুঝি লিখে প্রকাশ করতে পারব না। অনেক হস্তশিল্পের দোকান পুরো এলাকা জুড়ে। রয়েছে ছোট্ট একটা বোটিং স্পট। আকাশের দিকে তাকালাম। কেমন যেন ম্লান হয়ে আসছে। একঢাল সন্ধে রং নেমে আসার প্রস্তুতি চালাচ্ছে। তবু তো বিষণ্ণতা কাটল না! ঝিমধরা নির্জনতায় কান পাতলাম আরাকুর বুকে,অন্তরের কথা শুনব। সেখানে কুলুকুলু বয়ে চলেছে বেদনার স্রোত। সারাদিন ধরে খুঁজে চলা বিষণ্ণতার কারণ সে এক ঘূর্ণিঝড় ‘ হুদহুদ’। মাস ছয়েক আগেই আছড়ে পড়েছিল বিশাখাপত্তনম সমুদ্র উপকূলে। আমরা সারাদিন ধরে সেই ধবংসের অবশেষই দেখে বেরিয়েছি।
পড়ন্ত বিকেলে পাহাড়ি বাঁকে ফেরার পথে ছুটে চলল গাড়ি। ডানপাশে পড়ে রইল কফি বাগান। সময়ের অভাবে দেখা হল না। প্রায় সন্ধে সাতটা,গাড়ি থেকে নেমে বিদায় জানালাম আমাদের সারাদিনের সঙ্গী ড্রাইভারদাকে। মানুষটি বড্ড ভালো। পরের সারাদিনের প্রোগ্রাম রুমে ফিরে সাজিয়ে নেব।তবে রুশিকোন্ডা তালিকায় তোলাই আছে। ক্রমশ...।