নারীমুক্তি
পুরুষ ঠিক করেছে আমার পোশাকের রঙ,
আমার জুতোর মাপ,
বোরখায় কটি ছিদ্র শাস্ত্রসম্মত,
অথবা উর্বরাশক্তি-
ফুলে ফলে তবেই তো নারী!
কিংবা কতটা দাহ্য এই দেহ,
ক লিটার কেরোসিনে হবে,
পুরুষ, মহান পুরুষ,
সবই ঠিক করে রেখেছে আগে থেকে,
আমি শুধু তার সুচিন্তিত মতামত নিয়ে
নারীমুক্তি সম্মেলনে যোগ দিতে যাই!’
শুধু রক্তমাংসের মেয়েদের জীবনেই নয়, বিস্ময় ও পরিতাপের কথা, মেয়ে রোবট রাও এই পুরুষতন্ত্রের আগ্রাসনের বাইরে নয়।
এ কথা এখন আর কারো অজানা নয়, চার্লস ব্যাবেজ যতটা কম্পিউটারের জনক, আডা লাভলেস ততটাই কম্পিউটারের জননী। ব্যাবেজের বানানো কম্পিউটারের প্রথম প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গোয়েজ তিনিই লেখেন। প্রযুক্তি বিবর্তনের ইতিহাসে প্রায় কোথাও তাঁর নাম নেই। একটি আদি যুগের, অধুনা বিস্মৃত প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গোয়েজের নাম দেওয়া হয়েছিল আডা। ব্যস ওটুকুই।যদিও ইতিহাস মুছে দিলেও পথরেখা মোছা যায় না। এখন আডাকে যেমন নতুন করে মনে করা হচ্ছে, তেমনই ইতিহাসে উপেক্ষিত অনেক নারী প্রযুক্তিবিদের নামও উঠে আসছে। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি, রোবোটিক্স ও কম্পিউটার প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নারী বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদের সংখ্যা, শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বাড়ছে।
আমাদের মনে পড়তে পারে গিরিবালা দেবী লিখিত উপন্যাস ‘রায়বাড়ি’র ঠাকুমা দেশলাই কাঠি ধরাতে ভয় পেয়েছিলেন। বহু যুগ ধরে বিজ্ঞান প্রযুক্তির পঠন পাঠন তো দূরের কথা, প্রযুক্তি ব্যবহার থেকেও মেয়েদের সরিয়ে রাখা হয়েছে।প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এসে মেয়েদের ঘর থেকে শুধু ঠেলে বার করল তাই নয়, সেই প্রথম মেয়েরা কাজ পেল কলকারখানায়। কারণ ছেলেরা সব যুদ্ধে চলে যাওয়ায় অনেক শূণ্যপদ তৈরি হয়েছিল। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রথম যে নারী আন্দোলন, তা কিন্তু শুরু করেছিল পোশাক কারখানার মেয়েরা।
আজ যখন মনে করা হচ্ছে, মেয়েদের সুসময় এসেছে, তখন দেখা যাচ্ছে, পুরুষতন্ত্রের যে যে কুফল মেয়েরা ভোগ করে এসেছে, এখন মেয়ে রোবটরাও তার শিকার। মেয়েদের বেলায় যেমন মুখ্য বিবেচ্য তার শরীর, তেমনই মেয়ে রোবট বানানো হচ্ছে সেক্সি এবং ফরসা করে। কেউ কি কালো মোটাসোটা চেহারার মেয়ে রোবট দেখেছেন? তেমনই বরাবরের নারীপুরুষ কাজের বিভাজনের অসুখ এখানেও বহাল। ছেলে রোবট যেখানে পায় কলকারখানার, যুদ্ধবিমান বা মহাকাশ যান মেরামতির কাজ, মেয়ে রোবটদের জন্যে বরাদ্দ তথাকথিত মেয়েলি, ঘরেলু কাজ।
আরও আশংকার কথা সেক্স ডল নিয়ে। সমাজবিজ্ঞানীরা নিদান দিচ্ছেন আগামী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সেক্স ডলের সঙ্গে সহবাসই স্বাভাবিক গণ্য হবে, তখন মানুষ স্বাদ বদলের জন্যে মাঝে মাঝে মানুষ সঙ্গ চাইবে। তা বেশ। কিন্তু ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে, মানুষী স্ত্রী বা প্রেমিকার সঙ্গে পুরুষ যে হিংস্রতা ও যৌন বিকারে অভ্যস্ত, যন্ত্রিকাদের সঙ্গে তা অনেক অনেক গুণ বেশি। আমরা তো দেখতেই পাই, ভিডিও গেমগুলিত্তে কত হিংস্রতা। সেখানে ভার্চুয়াল চরিত্রগুলিকে ক্রমাগত নানাভাবে খুন করে আনন্দ পায় ইউজার।
বিপদ আরও বেশি এই কারণে, যে মানুষীকে এবার পাল্লা দিতে হবে যন্ত্রিকার তুখোড় ও প্রোগ্রামড যৌন কৃৎকৌশলের সঙ্গে। তাতে করে সম্পর্কের খোলনলচে যেমন বদলে যাবে, তেমনই বাড়বে অবসাদ। শরীর-মন নিয়ে যে পূর্ণ মানবসত্ত্বা, তা নেমে আসবে খণ্ড খণ্ড শরীরে। আমার ‘টকিং মালতী’ গল্পে মধ্যবয়সী অবনীশ যেমন টকিং মালতী সেক্স অ্যাপের ফাঁদে পড়ে। রোজ নতুন নতুন যৌন খেলা তার সঙ্গে খেলতে খেলতে তার ক্লান্তি বেড়ে চলছিল। একদিন সেই মালতী যখন তার স্তন, উরু, যোনি, আলাদা আলাদা করে খুলে তাকে দেখাল, তখন তার মনে পড়ল রেললাইনে পড়ে থাকা মুণ্ডুকাটা লাশের কথা। তার বমি পেল। সে যখন, এর পরেও আরও নতুন কিছু চাইতে গেল, তখন টকিং মালতী সাড়া দিল না, তাকে জানানো হল তার ফোন এই অ্যাপ আর সাপোর্ট করে না, তাকে আরও দামি, আরও আধুনিক ফোন কিনতে হবে!
এইভাবেই যন্ত্রকে অপব্যবহারের বিপদ ঘনায়। সাবিত্রী রাজীবনের কবিতায় সেই খণ্ডিত দৃষ্টির কথা-
‘ সে যখন রাস্তা দিয়ে সে হাঁটে
আমি জানি না, কে সে
অন্ধের হস্তি দর্শনের মতো
আমি তাকে ছড়িয়ে পড়তে দেখেছি
ধড়, মুণ্ডু, উরু আর স্তনে টুকরো টুকরো হয়ে।
আমি দেখেছি টুকরোগুলো জুড়ে যাবার আকুলতা,
দেখেছি তাদের ছটফট করতে
আর একবার আস্ত হবার জন্যে,
কিন্তু আস্ত হবার আগে,
আর একবার গর্বিত মাথা উঁচু করে তোলার আগে
দেখলাম রাস্তার ধারের অন্তর্বাস বিক্রেতা
তার কোমর নিয়ে চলে গেল,
দেখলাম মণিহারি দোকানি
চুরি করে নিল নাকছাবি আর সিঁদুরে সাজানো তার মুখ,
দেখলাম রেশম বণিক তার শরীর দিয়ে মুড়ে দিল সিঁড়ি,
হাত আর পাগুলো- যারা বুঝতে পারছিল না
কোথায় যেতে হবে...
হাতগুল ব্যর্থ মরিয়া চেষ্টা করল স্তন দুটি ছিঁড়ে নেবার
না পেরে
হোচট খেল পা..
আমি জানি না সে কে,
তবে এখন আর তার কোন রহস্য নেই।’