সুনেত্রা সাধু​

নুলো


কি রে শুনবি কবিতাটা আর একবার? শোন না, আচ্ছা দুলাইন বলছি,​  “আত্মীয় কেহ নাই নিকট কি দূর, আছে এক ল্যাজকাটা ভক্ত কুকুর।” সহজপাঠ প্রথম ভাগের এই কবিতাটা দিনে অন্তত দশবার বাঘাকে শুনতে হয়। নেহাৎ সে কুকুর তা না হলে কবেই গড়গড়িয়ে মুখস্থ বলে দিতে পারত! এরপর ঠিক কোন কথাটা আসবে বাঘা তাও জানে, তাই চুপচাপ ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে।​ 

শুনলি? তোর আর আমার কথা লিখেছে রে, লোকটা সেই কবে মরেছে, তবু কি করে এমন কথা লিখল বলতো! পরের লাইন গুলো আর বলছি না বুঝলি , 'আর আছে একতারা বক্ষেতে ধরি' হাত দুটোই নুলো সে কি আর একতারা ধরতে পারে রে, পারলে চাঁদ তারা ধরতাম না?

কচি সজনের ডাঁটার মতো দুখান হাত, ​  আর সেই আমার নাম কিনা সব্যসাচী, ভাব একবার। বাপটা কি ন্যাবা ছিল নাকি, কে জানে! দেখছিস্ ছেলের হাত দুটো ন্যাগব্যাগ করে, সেই ছেলের নাম কেউ সব্যসাচী রাখে! তা বেশ করেছে রেখেছে, লোকে এই নাম নিয়ে দিব্যি মজা লুটেছে, তাতে অবিশ্যি আমার কিছু যায় আসেনা। লোকে টিকিট কেটে সার্কাসে জোকার দেখতে যায়, কেন যায়? লোকে চ্যাপলিনের সিনেমা কেন দেখে? কারণ লোককে অপদস্থ হতে দেখলে একদল মানুষের ভারি আমোদ হয়। তাদের জীবন জোড়া অতৃপ্তি, সে গুলো জুড়োবে কোথায় বল?​  আমাকে দেখলেও লোকের হাত আর মুখ সুড়সুড় করে। খুব মজা পায় ওরা, অথচ আমি কিন্তু এক পয়সাও​ নিই না, বিনি পয়সায় ফুর্তি বিলি করি। সতুদের বাড়ির সামনের ল্যাম্পপোস্ট দেখলেই যেমন তোর পেচ্ছাব পায়,​ ল্যাম্পপোস্ট কি তোর গায়ে কখনো পেচ্ছাব করতে আসে ? তেমনি আমার পিছনে লেগেও লোক ভারী আমোদ পায়, আমিও কিছু বলিনা। ল্যাম্পপোস্টের কাছ থেকেও শিক্ষার আছে বুঝলি।

ধুর, আজ গল্পে একেবারেই মন নেই তোর। ঘুমুচ্ছিস নাকি!​ 

সব্যসাচী মুখার্জি ওরফে 'নুলো'র​  কনুই এর ধাক্কায় কুঁই শব্দ করে অল্প নড়ে উঠল বাঘা, তারপর দাঁত খিঁচিয়ে জিভ বার করে একটা প্রকান্ড হাই তুলে আবার মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ল, ভাবখানা এমন যে রোজ রোজ এক কথা আর কত শুনবো, একটু থাম দেখি।

নুলো থামেনা। বলে, লোকে আমায় কি বলে ডাকে জানিস তো? তবু​  তোর নাম রেখেছি বাঘা। সামান্য কোন কৃতজ্ঞতা নেই তোর ! অরণ্যদেবের কুকুরের নামও বাঘা, তা জানিস? তুই তো মাঝে মাঝে আমায় ফ্যান্টম বলতে পারিস। ছোটবেলায়​  আমার খুব অরণ্যদেব হতে ইচ্ছে করত, ডেনকালির জঙ্গল, খুলি গুহা, ডায়না, গাছ বাড়ি উফ! হাসছিস তো! হেসে নে, হাত দুটো নুলো বলে স্বপ্ন দেখব না? হ্যাঁ রে বাঘা তুই স্বপ্ন দেখিস?​ 

#

“রোয়াকখানা​  কখনো খালি দেখি না। সকাল সন্ধ্যে বসে বসে​  আপন মনে বিড় বিড় করিস। সরে বস একটু, কুত্তাটাকে নামা না রোকায় থেকে।” লুঙ্গি পরে কাঁধে গামছা ফেলে কেষ্ট খুড়ো এল, মুখে হরবখত চিরতা গোলা ভাব।​ 

বাঘাকে নামাতে হলনা, খুড়োকে দেখে এমনিই নেমে গেল,​  কুকুর বলে কি মান অপমান বোধ নেই?​  গিয়ে বসল মিষ্টুনীদের বাড়ির দোড় গোড়ায়, একটা বাজলে মিষ্টুনীর মা বাঘাকে চারটি ভাত দেয়, বাঘার খাওয়া শেষ না হওয়া অবধি দাঁড়িয়ে থাকে। যেমন করে 'নুলো'র মা তাকে সামনে বসিয়ে খাওয়াতো তেমন। আচ্ছা সে যদি ওদের বাড়ির দোড়গোড়ায় গিয়ে বসে তাহলে কি মিষ্টুনীর মা ওমনি করে দাঁড়িয়ে থেকে ভাত খাওয়াবে?

“ কি রে উদিক পানে হাঁ করে কি দেখছিস?” কেষ্ট খুড়োর কথায় নুলো মুখ ঘোরায়।​  কোঁচড় থেকে তেরঙ্গা ছাপ বিড়ির প্যাকেট বার করে তাতে আগুন দেয় খুড়ো। যতবার নুলো তেরঙ্গা ছাপ বিড়িতে আগুন ধরতে দেখে, ততবার তার চোখের সামনে দাউ দাউ করে জাতীয় পতাকাটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়।​  যদিও এ পোড়া দেশের নতুন করে পুড়বার​  আর কিছুই নেই। পড়ে আছে শুধু ছাই, তাই মেখে দেশের তাবড় তাবড় মানুষেরা নেত্য করে।​ 

খুড়ো বলে “আজ আর কোন নতুন খবর নেই বুঝলি।” কেষ্ট খুড়ো এপাড়ার সিসিটিভ, ওর চোখ এড়িয়ে একটা খবর গলতে পায়না, এমনি নজর।​ ​ ​ 

পৃথিবীটা যখন বন বন করে ঘুরতো তখন খুড়োর কাছে পাড়ার হরেক রকম খবর থাকত, সব খবরের আবার শ্রোতা থাকেনা। সেসব শোনার জন্য 'নুলো' আছে। কে চাকরি পেল, কার বিয়ে, কার বাড়িতে টিভি এল, কে কোথা বেড়াতে গেল, কার মেয়ের ডিভোর্স হল , কোন ছেলে বউ পেটালো, কার সাথে কার লটঘট সব। তাতে খুড়ো আরো তেল মশলা ঢেলে মাখো মাখো করে পরিবেশন করত। সন্ধ্যের আড্ডায় খুড়োর কি ডিমান্ড! যেন 'একঘন্টা সঙ্গে খুড়ো' চলছে।​  প্যান্ডেমিকের চক্করে সেই খবরের তোরঙ্গে তালা পড়েছে। নুলো ঘাড় নেড়ে বলে খবর আর কি থাকবে খুড়ো, রাস্তায় মানুষ কই! সব তো ছাদে। তুমি ছাদে ওঠো।​ 

চুপ শালা নুলো, আমায় ছাদ দেখাচ্ছিস, টালির চালে ছাদ থাকে! তুই ওঠ ছাতে, তোর বাপ ঠাকুদ্দা তিনতলা দালান রেখে মরেছে, তবু তোর ছাদে ওঠার মুরোদ আছে? রোয়াকে শুয়ে থাকিস কুত্তা মাথায় দিয়ে, আবার ছাদ দেখাচ্ছে আমাকে।”​ 

খুড়োর বাক্যবাণ দিয়ে নুলোর ঝাড় খাওয়ার খাতায় বৌনি হয়। এই রকম করেই যে যা পারে বলে যায়। নুলো কিন্তু ল্যাম্পপোস্ট। যৌন হতাশা, আয়া সেন্টার, উই পোকার ওষুধ, গোপনে মদ ছাড়ান বা কোচিং সেন্টার যার পোষ্টারই পড়ুক না কেন নুলো চুপ।​ ​ 

খুড়ো উঠে গিয়ে কলতলায় বসল। লুঙ্গিটাকে বিপদসীমার কাছাকাছি তুলে ঘষে ঘষে চান করতে লাগলো।​ 

নুলো'র তাড়া নেই। দুটোর সময় দাদা, বৌদি, ভাইপো আর তার বউ এর খাওয়া শেষ হলে সে ঘর ঢোকে, দালানের একপাশে তার খাবার ঢাকা থাকে, উঠোনের কোনার দিকে ভাঙাচোরা বাথরুমে চান করে ওই ল্যাগবেগে হাত দিয়ে ফেলে ছড়িয়ে ভাত খায় নুলো। তার খাওয়া দেখলে সুস্থ মানুষের ঘেন্না হয়। তাই দু'বেলায় আড়ালে বসে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নুলো ভাত খায়। ওই হাতেই এঁটো ঘোচায়, বাসন মাজে। বাবা সম্পত্তি রেখে গিয়েছে তার নামে তবে সে সবই দাদার জিম্মায়, তাকে​  তিন বেলা​  খেতে দেয় ওরা, আর কটা টাকা হাত খরচা, এর থেকে বেশি নিয়ে কি করবে নুলো? টাকা ওড়াতেও তো হাত লাগে নাকি? তার খরচা বলতে বাঘার খাবার আর একটু চা। এখনো দুটো বাজেনি, রায় গিন্নি গোপালের ভোগ দিয়ে শাঁখ বাজালে দুটো বাজে। নুলো দুর থেকে বাঘার খাওয়া দেখতে থাকে।​ 

“তোর কাছে আগুন হবে?” নন্তু এসে পাশে বসেছে, বহু বহুদিন পর। ছোট বেলার খেলার সাথী নন্তু। বড় হয়ে আর নুলোর সাথে তেমন করে কথা বলেনি কোনদিন, মাঝে অবশ্য ছিলও না অনেকদিন। সেলস এ চাকরী করত। সেই নন্তু হটাৎ আগুন চাইছে শুনে ঘাবড়ে গেল নুলো। আগুন নেই শুনে সিগারেটটা আবার পকেটে রেখে দিল নন্তু।​ 

“কবে এলি? থাকবি তো?” জিজ্ঞেস করল 'নুলো'।​ 

“হ্যাঁ আর কোথাও যাব না, চাকরিটা আর নেই। ব্যাঙ্কে লোন ছিল অনেক, ফ্ল্যাট,​  গাড়ি সব বেচে দিতে হল। এখানেই থেকে যাব, ভাগের দুটো ঘর আছে, মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিতে পেরেছি ব্যাস আর কি দরকার।”

“দরকার যখন এতো অল্প তখন লোন কেন করেছিলি?” নুলো মনে মনে বলে, আজকাল কোন কথায় কে রেগে যায় বোঝা মুসকিল। বিয়ের পর নন্তু যেদিন লাল টুকটুকে গাড়িটা মোড়ের মাথায় দাঁড় করিয়ে গরদের পাঞ্জাবি পরে জুতো মসমসিয়ে হেঁটে গিয়েছিল, সেদিনও নুলো ঠিক এইখানেই বসেছিল, নন্তু ফিরে তাকানোর প্রয়োজন মনে করেনি। হয়তো পাশে সুন্দরী বউ ছিল তাই।​  কত নম্বর প্রেমিকা বউ হয়েছিল জানেনা নুলো, তবে ছোট থেকেই নন্তুর মেয়ে নিয়ে খেলা করার বড় শখ। নিষিদ্ধ বই জামার ভিতর​  লুকিয়ে বন্ধুর দল বোসেদের ভাঙা বাড়িতে গিয়ে বসত, নন্তু ছিল পান্ডা, নুলো কতদিন থাকতে চেয়েছে সেই আড্ডায় ওরা কেউ থাকতে দেয়নি, বলেছে “ভাগ শালা, এসব দেখে তুই কি করবি! তোর তো হাতই নেই।”​  সব্বাই হেসেছে,​  নুলোও হেসেছে,​  তার সমস্ত রাগ অপমান দুঃখ চিরকাল সে হাসি দিয়ে প্রকাশ করেছে। তারপর বাথরুমে ঢুকে কেঁদেছে হাউ হাউ করে। সেই নন্তুও​  দুঃখের কথা বলার লোক পায়না?

এসময় যত কড়াকড়িই থাকুক না কেন সন্ধ্যের দিকে মোড়ের মাথায় অল্প কটা লোক জমেই যায়। আজকাল আবার লোকের মুখে মুখোস, তাতে আবার দলীয় ছাপ। ঠিক দাঁতের উপর দলীয় প্রতীক, “খা, চিবিয়ে খেয়েই ফেল।” এমনিই সব দলীয় আদর্শ চুলোয় গিয়েছে এখন ওই মুখোস পড়েই ভণ্ডামি কর। যে কটা আদর্শবান বেঁচে আছে তাদের দশা নুলোর মতো, শুধু ঘাড় হেলিয়ে হ্যাঁ বলে আর হাসে, অনাবিল হাসি।​ 

নুলো মাস্ক পরলেও লোকে মজা করে, বলে পাগলের কখনো জ্বর হয় শুনেছিস! তুই তো আধপাগল। তোর জনমেও জ্বর হয়েছে? নুলো সত্যি মনে করতে পারে না তার জ্বর হয়েছে কিনা। ওরা থামে না, বলে চলে, “তুই হলি গিয়ে দাদাদের বোঝা, তুই ম'লে ওরা বাঁচে, নুলো ভাইকে সারাজীবন বসিয়ে খাওয়ানো কি চাট্টিখানি কথা!”

নুলো ল্যাম্পপোস্ট তাই শুধুই হাসে। যে বলছিল সেও মুখে বিজয়ের হাসি টেনে মনে করে “আচ্ছা দিলুম, ব্যাটা নুলো, সমাজের কোনো কম্মে লাগে না, শুধু সরকারের রেশন ধংস করছে।”

ঠিক এই রকমই ফুরফুরে গুলতানি মারা এক সন্ধ্যায়​  দাসেদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো অ্যাম্বুলেন্স। ও বাড়ির কর্তার বয়স হয়েছে, হার্টে সমস্যা ছিলই, একটা অ্যাটাক হয়েছে আজ। বাড়িতে আর দ্বিতীয় কেউ নেই, ছেলে থাকে বাইরে। গিন্নীই অ্যাম্বুলেন্স ডেকেছে, কিন্তু অতবড় মানুষটাকে টেনে গাড়িতে তোলা কি সোজা!মোড়ের মাথায় লোকের জটলা, বারান্দা থেকেও ঝুঁকে আছে কত মাথা। সেদিকে তাকিয়ে গিন্নী ডাকছে “তোমারা এসো একটু তুলে দিয়ে যাও, তোমাদের কাকার জ্বর হয়নি, সত্যি বলছি৷”

কেউ নড়ে না, তিন চার রকম চিহ্নওয়ালা মাস্ক পড়ে দাঁড়িয়ে থাকে লোকজন, নিশ্চুপ। অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভারটা পর্যন্ত দূরে দাঁড়িয়ে। গিন্নীর আকুতি থামে না, বারে বারে বলতে থাকে “তোমাদের কাকার জ্বর নেই গো, বিশ্বাস করো জ্বর নেই।”

নুলো উঠে পড়ে, সাথে বাঘা। এগিয়ে যায় দুজনে, একটা পঙ্গু হয়ে আসা সমাজ শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে​  দেখতে থাকে তাদের। হাত নেই তো কি হয়েছে নুলো কাঁধ এগিয়ে দেয়,​  দাসকাকু কোন রকমে আঁকড়ে ধরে তাকে, আর এক পাশে ধরে থাকে স্ত্রী। দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর দিকে মুখ করে তারস্বরে ভৌ ভৌ করতে থাকে বাঘা,​  যেন বলে “ছিঃ ছিঃ ছিঃ,​  হাত থাকতেও তোমরা নুলো? ”​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ 

সুনেত্রা সাধু

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.