জয়তী রায় মুনিয়া

জয়তী রায় মুনিয়া

যখন যা হবার নয়, তাই যদি হয় , মাথাটা গরম হতেই পারে। এই যেমন , কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকলাম,সাথে সাথে একটা ঝপাত বৃষ্টি। আরে! এটা বৃষ্টি ঝরবার সময় ? বাড়ি থেকে বেরোলাম, ইউনিভার্সিটি যাবো। ঝলমলে রোদ উপচানো একটা দিন। মাকে অবাক করে​ সাজলাম একটু। মা স্নেহের চোখে তাকালেন। টম বয় মেয়ে তার। সবসময় , জিনস আর টপ। চুলে একটা যেমন তেমন চিরুনী। হ্যাঁ, চোখে ঘন কালো কাজল টা পরি। বাকি আর কিচ্ছু না।​ বই খাতা উপচানো একটা ঝোলা সঙ্গে নিয়ে, চুইংগাম চিবোতে চিবোতে , চটি ফটাস ফটাস করতে করতে বেরিয়ে পড়ি। আর কি চাই বস! লাইফ হো তো এ্যাইসা। কলেজের বিশ্ব ন্যাকা সাজুনি মেয়েগুলো এইজন্য আমাকে দু চোখে দেখতে পারে না। আমিও পারি না। আবার মাঝে মাঝে গলা জড়াজড়ি করে আড্ডা মারি। আসলে, বিন্দাস থাকাই ভালো। ওরাও আমাকে পাগলি বলে সুখী, আমিও ওদের সাজুনি শাকচ্চুনি বলে হ্যাপি।​

​মুশকিল হল, এই পাজি জীবন ,কক্ষনো হিসেব মানবে না। কিছু না কিছু উল্টো পাল্টা করবেই করবে। না হলে, আমি কি না আজ চুড়িদার অঙ্গে দিলাম!​ ​ নীল চুড়িদার কামিজ। সঙ্গে , সর্ষে হলুদ ওড়না। কানে ছোট্ট ঝুমকো। কপালে হলুদ টিপ। চুল নিয়ে চুলোচুলি নেই। সে এমনি সোজা খোলা। চোখে কাজল। প্রিয় সুগন্ধী সারা অঙ্গে। নিজেই কেমন অবাক হয়ে , আয়নার দিকে বার বার তাকাচ্ছিলাম। মানে ? এমন সাজলাম কেন খামোকা! টিপ! ঝুমকো! আজ কি ভূমিকম্প হল কোথাও? আমার মাথায় গন্ডগোল হল সত্যি সত্যি?​ না কি, এই সাজের পেছনে​ ​ আছে গতকাল ইন্দ্রর শ্লেষ ভরা কথা?​

ধুর, কি সব আজে বাজে ভাবছি আমি। কে কি বললো , তা তে এত গুরুত্ব দেব কেন?​ অবশ্য ইন্দ্রকে ঠিক আজে বাজে ছেলে বলা যাবে না। বরং ,ক্যাম্পাস কাঁপানো তুখোড় ছেলে। ইংলিশ অনার্সের ঝকঝকে ছেলে।

কবিতা লেখে, নাটক লেখে। হতে পারে। এগুলো মানতেই হবে। কিন্তু মুখে পাত্তা দি না। আর ওর হাড় জ্বালানি কথা শুনলে, গা মাথা চিড় বিড় করতে থাকে।​

গতকাল হলো কি! আমরা সকলে মিলে, লবিতে বসে তুমুল আড্ডা দিচ্ছি। এবং যথারীতি আড্ডা ধীরে ধীরে পরিণত হলো তর্কে। আমার আর ইন্দ্রর তর্ক উঠলো তুঙ্গে। এটাই হয় শেষপর্যন্ত। বিতর্ক আমার প্রিয়। যেকোনো বিষয় হোক। পড়ার বই ছাড়া প্রচুর বাইরের বই পড়ি। সেইসঙ্গে আছে, একটা​ সোজা স্বভাব। তাই, ছেলেদের আমি ছেড়ে কথা বলি না। পুরুষ​ মনে করে, দুনিয়াতে তারা একটা জাত, শাসন করবার। ঠোঁটের আগাতে সবসময় একটা তাচ্ছিল্য ভাব। অসহ্য।​

তাই যখনই সুযোগ পাই, সে তর্কে হোক, কি, রাজনীতি হোক, রাস্তা ঘাটে হোক, পুরুষ দের কাছে , বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সুচাগ্র মেদিনী। খুব লড়ে যাই।​

গতকাল, ইন্দ্রর সঙ্গে তর্ক হতে হতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। চারিদিকের ছেলে মেয়েদের বৃত্ত​ ক্রমশ বড়ো।​ ​ শেষে ইন্দ্র বলতে বাধ্য হয়: :

:ছাড় তো, তুই আসলে একটা জিদ্দি মেয়ে। কোনো লজিকে আসিস না।​ বলেই , চকিত দৃষ্টিতে আমাকে মেপে নিয়ে বলল: অবশ্য,​ মেয়ে বলা যাবে কিনা কে জানে?

চারিদিকে একটা হাসির হুররা উঠলো বন্ধুদের গলায়। আকাশের গায়ে ফুটে ওঠা তারাগুলোকে সাক্ষী রেখে জ্বলতে জ্বলতে, গেটের দিকে যাই। চন্দ্রিমা, মাধুরী সঙ্গে আসে। মাধুরী আমার সবথেকে প্রিয় বন্ধু। সে বলেই বসে: তুই তো এত সুন্দর রুমি। এক আধবার মেয়েদের মতো সাজলে​ তো পারিস!

তারই ফলশ্রুতি , আজকের এই নীল পোশাক। এর মানে এই নয় যে আমি কারো কাছে মাথা নোয়াচ্ছি। আমি শুধু দেখাতে চাই যে, মানুষ কেমন ভুল ভাবে! অথবা, মানুষ নিজের মতন করে ভাবে!​

*

বাড়ি থেকে ইউনিভার্সিটি। ঝলমলে​ রোদ উপচানো সকাল। অথচ, কলেজ গেটের সামনে, এসেই​ ঝপাত বৃষ্টি। ইস। গেল সব গেল ।​ প্রকৃতির সহ্য হলনা আমার কৃত্রিম সাজ। তাই ধুয়ে গেল সব। যা তা! ফাইল​ বুকে চেপে, ব্যাগ​ সামলে দৌড় লাগলাম। লবির নিচে পৌঁছে ভাবলাম , ভিজেই গেলাম এক্কেবারে। বৃষ্টি এমন পাজি।ঝরবার আর সময় পেলো না ? কেমন ভূত ভূত লাগছে কে জানে? আমি তো আবার ঐ ন্যাকা মেয়ে গুলোর মতো ব্যাগের মধ্যে, আয়না, চিরুনি রাখি না!​

ভাবতে ভাবতেই মাধুরীর ফোন:

​:এই রুমি, কোথায় তুই?​ উত্তেজিত গলা শুনে​ আমি মিউ মিউ করে বললাম:

​:এই তো লবিতে। বৃষ্টি হচ্ছে।

: তুই শিগগিরই ডিপার্টমেন্টে চলে আয়।কি কান্ড হচ্ছে। ধুর বাবা, তাড়াতাড়ি আয়।

আমি কোনোমতে, ওড়নাটা দিয়েই , একটু ঝেড়েঝুরে, হাত দিয়ে চুল ঠেলে,​ দৌড় মারলাম , ডিপার্টমেন্টের দিকে।​

সেখানে গিয়ে দেখি, হৈ হৈ ব্যাপার। ইন্দ্রের লেখা এক নাটক, বড়ো পত্রিকাতে মনোনীত হয়ে প্রাইজ পাবে। তাই, ছাত্র ছাত্রী, প্রফেসর, সকলের মুখে খুশির হাওয়া।​

শুধু ...আমার বুকটা কেমন শূন্য হয়ে গেল! মনে হল, ধূ ধূ প্রান্তরে একলা দাঁড়িয়ে আছি। মরুভূমির মত রুক্ষ্ম কঠিন চারিধার। আমার বৃত্তের বাইরে অঝোর বৃষ্টি। অঝোর খুশি। কেন এমন হয়! নীল পোশাক যেন ব্যঙ্গ করছে।​ তার কি তাকাবার মতো, সময় আছে? দরজার কোনে দাঁড়িয়ে কান্না পেয়ে যাচ্ছিলো আমার। স্তুতির ফুল বর্ষণ হচ্ছে। আর ওই ছেলেকে দেখো! দেখে গা জ্বলে যাচ্ছিল আমার! ইস! দ্যাখো, দ্যাখো__কেমন গোপী মাঝে কৃষ্ণ মার্কা মুখ! ওরে রে। আমার পাল্লায় পড়লে বুঝিয়ে দিতাম। নারীশক্তির মহিমা!​

এর থেকে, না সাজলেই হতো! সত্যি, কি বোকা হয় মেয়েরা! আমি ও আজ ওই বোকা মেয়েগুলোর মত সং সেজে এলাম!​ ছি ছি। নিজের ওপরেই ধিক্কার আসছিল।মাধুরীটাও ভিড়ের সঙ্গে নেচে চলেছে। আর , কি আশ্চর্য, আমি যোগ দিতে পারছিনা। বুকের মধ্যে জমাট বাঁধছে অভিমান।​ আকাশে বেড়ে ওঠা বেড়ে ওঠা বর্ষার মেঘের মতো।​

ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে, ইন্দ্রের ওপরে। আঁচড়ে, কামড়ে ... উফ। চাইনা চাইনা বৃষ্টি। চাইনা চাইনা কিচ্ছু।

আর থাকা যাবে না। থাকব না আর এখানে। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দিলাম বাইরের দিকে।

বৃষ্টি থেমে গেছে​ আকাশ পরিষ্কার। যত বৃষ্টি ঝরছে এখন আমার ভিতরে। অকারণে মোবাইল দেখলাম। দোপাট্টা ঝেড়ে , চুল হাত দিয়ে ঠিক করলাম। কি বোকা বোকা পোশাক। জীবনে আর কোনোদিন পরবনা। পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য যত সব ন্যাকামো। আজ আর ক্লাস হবে কি না কে জানে? যা শুরু হয়েছে ! নায়ককে ঘিরে! ভাবছিলাম এইরকম আকাশ পাতাল। কখন এসে দাঁড়িয়েছে ইন্দ্র ...টের পাইনি। হঠাৎ , ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের তাগিদে, পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখতে পাই পুরুষের এক জোড়া মুগ্ধ চোখ। পুরুষের চোখ যখন মুগ্ধ হয়, তখন সে যে কি অনিবার্য সুষমায় ভরে ওঠে, কি অদ্ভুত ভালোলাগার সূর্যোদয় হতে থাকে চোখের তারাতে, জীবনে প্রথম বুঝতে পারলাম আমি।​

তাকাতেই পারলাম না। নামিয়ে নিলাম চোখ। সমস্ত দস্যি পনা​ উধাও হয়ে ,বৃষ্টি ভেজা শিউলির​ মতো নরম হয়ে উঠলো আমার সমস্ত শরীর।

হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করলো ইন্দ্র। মুগ্ধ কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, এক অমোঘ শব্দ: ভালোবাসি তোকে রুমি। বলতে চেয়েছি অনেক বার। সুযোগ পাইনি। ভালোবাসি তোকে।

​নির্জন লবি। বাইরের আকাশে মেঘের আচ্ছাদন।

ইন্দ্র মুছে দিতে থাকে আমার ঠোঁট থেকে জলে ধোয়া লিপস্টিকের শেষ রঙ টুকু। ।​


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

সুচিন্তিত মতামত দিন