শুনহে মানুষ ভাই। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপর নাই। নগর সভ্যতায় যে কোন আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার এটাই প্রথম কথা। এটাই শেষ কথা। যে কোন আধুনিক গণতান্ত্রিক সংবিধানেরই দায়িত্ব এই সত্যকে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে রক্ষা করা। যে সংবিধান এই বিষয়ে যত বেশি দক্ষতার পরিচয় দিতে পারবে সেই সংবিধানই তত বেশি উন্নত। এবং সেই সংবিধান পরিচালিত রাষ্ট্রের নাগরিকরা একটি উন্নত ও সমৃদ্ধশালী জাতিতে পরিণত হয়ে উঠবে। এবং দেখা যাবে সেই রাষ্ট্রই মানবসম্পদ উন্নয়নে বিশ্বে শ্রেষ্ঠ স্থান অর্জন করতে পারবে। আশা করা যায় গণতান্ত্রিক পরিসরে এই বিষয়ে অধিকাংশ শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষই সহমত হবেন।
এই যে একটা অবস্থান। যেখানে সবার উপরে মানুষকে স্থান দেওয়া। এটাকেই বলি সভ্যতা। এই অবস্থান থেকে বিচ্যুত হওয়া মানেই সভ্যতা থেকে বিচ্যুত হওয়া। অর্থাৎ যে দেশে মানুষের উপরে দেশ। যে সমাজে মানুষের উপরে সমাজ। যে ধর্মে মানুষের উপরে ধর্ম। যে রাষ্ট্রে মানুষের উপরে রাষ্ট্র। যে আইনে মানুষের উপরে আইন। সেই দেশ সেই সমাজ সেই ধর্ম সেই রাষ্ট্র সেই আইন, সভ্যতার প্রাথমিক শর্ত থেকেই বিচ্যুত। তাই আবারো বলতে হয়। দেশ সমাজ ধর্ম আইন ও রাষ্ট্রের থেকেও মানুষ বড়ো। মানুষের ভালোর জন্য। মানুষের সুরক্ষার জন্য মানুষের উন্নতির জন্য এবং মানুষের স্বাধীনতার জন্যই দেশ সমাজ ধর্ম রাষ্ট্র ও আইন। উল্টোটা কখনোই নয়। যে যে দেশ সমাজ ধর্ম রাষ্ট্র ও আইন এই সত্যকেই ধ্রুব মনে করে কাজ করে চলে, সেই সেই দেশ সমাজ ধর্ম রাষ্ট্র ও আইনই শ্রেষ্ঠ ও উন্নত।
এতো গেল তত্বকথা। আমারা যে দেশে বসবাস করি। যে সমাজে চলাফেরা করি। যে যে ধর্মের খুঁটিতে বাঁধা পড়ে থাকি। যে রাষ্ট্রের নাগরিক। ও যে আইনের অধীনের বসবাস করি। সেখানের চিত্রটি ঠিক কিরকম? এই যে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’। এইটিকে কি আমাদের দেশে আমাদের সমাজে আমাদের ধর্মে আমাদের রাষ্ট্রে ও আমাদের আইনে সর্বোচ্চ মূল্য দেওয়া হয়? অবশ্যই সকলেই যে এই প্রশ্নের উত্তরে সহমত হবেন এমনটা নয়। কথায় বলে নানা মুনির নানা মত। কিন্তু যদি সত্যই ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এই নীতিকে সর্বোচ্চ মূল্য দেওয়া হয়ে থাকে। তবে বিচারের বাণীকে নিরবে নিভৃতে কাঁদতে দেখা যেতেই পারে না।
গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে তাহলে আমরা যখন তখন বিচারের বাণীকে নিরবে নিভৃতে কাঁদতে দেখি কেন? দেখি এই কারণেই যে, আমাদের দেশে আমাদের সমাজে আমাদের ধর্মগুলিতে আমাদের রাষ্ট্রে আমাদের আইনে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এই নীতি নেহাতই কথার কথা। কোথাও এই নীতিকে মানা হয় না। নীতিগত ভাবে স্বীকার করে নেওয়াও যদি হয়। কর্মক্ষেত্রে তা কার্যকর করা হয় না। সেখানে মাইট ইজ রাইট অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক সত্য। গণতান্ত্রিক পরিসরে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোর অনেক বেশি। আর সেই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অজুহাতে দিনকে রাত কিংবা হয় কে নয়, নয় কে হয় করা সম্ভব। অনেকেই বলবেন, যদি তাও হয় তবুও দেশের আইন ব্যবস্থাকে ডিঙিয়ে সেটা করা সম্ভব নয়। আইনের ধারাকে উলঙ্ঘন করে করা সম্ভব নয়। ঠিক কথা। কিন্তু নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আইন ব্যবস্থাকে নিজেদের কব্জায় একবার নিয়ে আসতে পারলেই, আইনকে ব্যবহার করেই দিনকে রাত, হয় কে নয় করা সম্ভব।
বর্তমান ভারতীয় রাজনীতি, আমাদেরকে সেই সিলেবাসেই শিক্ষিত করতে চাইছে। এবং শিক্ষিত করছেও। অনেকেই অনুভব করছেন বিগত বেশ কয়েক বছর এই সিলেবাস খুব দ্রুতই সর্বাত্মক হয়ে উঠেছে। এবং দুঃখের বিষয়, দেশের আইন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ অবস্থান থেকেও এই সিলেবাসের পৃষ্ঠপোষকতা করা শুরু হয়েছে। এর একটা সর্বগ্রাসী প্রভাব পড়ছে আমাদের সমাজের সর্বত্র। সাধারণত, গণতান্ত্রিক সিঁড়ি বেয়ে ক্ষমতার শীর্ষে উঠে এসে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ শক্তির স্বৈরতান্ত্রিক কার্যকলাপ ভিন্ন এমন ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়। গণতন্ত্রের সবগুলি মাধ্যম ও স্তম্ভকে অধিকার করেই স্বৈরতন্ত্র কাজ শুরু করে। ইতিহাস বারবার সেকথা প্রমাণ করেছে। আর এসব তখনই সম্ভব হয়, যখন বৈদেশিক কোন শক্তির স্বার্থ জড়িত মদত থাকে পেছনে। সেই মদত ছাড়া একটি দেশের গণতান্ত্রিক পরিসরকে ব্যবহার করেই স্বৈরতান্ত্রিক শক্তির উত্থান সম্ভব হয় না। লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাস এই বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সাক্ষ্য দিতে পারে। আজকের ভারতবর্ষও কি সেই পথ ধরেই এগিয়ে চলছে না? অনেকেরই ধারণা একেবারে তাই। একটি গণতান্ত্রিক দেশের প্রধান যখন কোন একটি বিশেষ বিদেশী রাষ্ট্রের আগামী নির্বাচনে বিশেষ একজন রাষ্ট্র প্রধানকে নির্বাচনে জিতিয়ে নিয়ে আসার ডাক দেন। তখন বুঝতে হবে কোন দেশ কোন দেশের খপ্পরে পড়েছে। সেই রকম কোন খপ্পরে না পড়লে কোন গণতান্ত্রিক একটি দেশে স্বৈরতন্ত্রের বিকট লক্ষ্মণগুলি বারংবার ধরা পড়তেই পারে না।
স্বৈরতন্ত্রের এই বিকট লক্ষ্মণগুলির ভিতর, সবচেয়ে ভয়াবহ হলো বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়েই যখন প্রশ্নচিহ্ন দেখা দেয়। কারণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সুরক্ষা কবচই হলো তার বিচার ব্যবস্থা। অনেকেই বলতে পারেন, কেন সংবিধানই তো সেই রক্ষাকবচ। একশবার। কিন্তু সংবিধান হলো ঠুঁটো জগন্নাথের মতো। কিছু নির্দেশাবলী মাত্র। যেগুলি ঠিকঠাক কার্যকর করা হলো কিনা, বা কোনভাবে সেই সংবিধান লঙ্ঘিত হলো কিনা, সেটিই দেখার কথা বিচার ব্যবস্থার। সংবিধানের বিচার করার ক্ষমতা নাই। তাই সংবিধানের সুরক্ষা কবচগুলি ঠিকমত রক্ষণাবেক্ষণ করাই বিচারব্যবস্থার দায়িত্ব। গণতন্ত্রের প্রথম রক্ষক সংবিধান। শেষ রক্ষক বিচার ব্যবস্থা। সংবিধানকে না বদলিয়েও বিচার ব্যবস্থাকে হাত করে গণতন্ত্রের কন্ঠ রোধ করা সম্ভব। আর সেটাই স্বৈরতান্ত্রিক সংস্কৃতি।
সেই সংস্কৃতির দ্রুত প্রসার ও বৃদ্ধিতে আদালতের এক একটি রায়ের সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়ে। এক একটি রায়ে বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতার বিষয়ে মানুষের বিশ্বাসের ভিত যত টলমল করতে থাকে, স্বৈরতান্ত্রিক শক্তিগুলির আস্ফালন ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর সেই আস্ফালন আদালতের বিশেষ বিশেষ রায়কেই হাতিয়ার করে তোলে। এই ঘটনা বিশ্বের যেকোন দেশেই ঘটতে পারে। বিশেষ করে যে দেশে যত বেশি কুসংস্কার অশিক্ষা ও সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন যত বেশি। দুর্ভাগ্যক্রমে একবিংশ শতকের ভারতবর্ষে এই তিনটি অপশক্তিরই বাড়বারন্ত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কুসংস্কার। অশিক্ষা। আর সাম্প্রদায়িক আস্ফালন। বলা যেতে পারে, এই তিনটিই হলো স্বৈরতান্ত্রিক শক্তির উত্থানের প্রধান স্থপতি। আর সেই স্বৈরতান্ত্রিক শক্তির ধর্মই হলো সকলের আগে বিচার ব্যবস্থাকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে আসা। সেটি সম্ভব হলেই সংবিধানকে দিনে দুইবেলা বুড়ো আঙুল দেখানো সম্ভব হয় অনেক সহজেই। কারণ পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। সংবিধানের আত্মরক্ষার কোন উপায় নাই। যদি না বিচার ব্যবস্থা সংবিধানকে সুরক্ষিত রাখতে পারে।
এই কারণেই যে কোন শুভবোধ সম্পন্ন মানুষ দেশের বিচার ব্যবস্থার উপরেই শেষ ভরসার নোঙর ফেলে রাখেন। বিশেষ করে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের উপরে অগাধ আস্থা পোষণ করা যে কোন নাগরিকের প্রধান কর্তব্য। কিন্তু যদি দেখা যায়, সেই শেষ প্রতিষ্ঠানটিতেই ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’- এই নীতি লঙ্ঘিত হচ্ছে, তবে বলতেই হবে, বিষয়টি গুরুতর। আদালতের রায় মান্য করা যেমন প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। তেমনই আদালতের নিরপেক্ষতার বিষয় নিশ্চিন্ত হওয়ার চেষ্টা ও ব্যবস্থা করাও নাগরিক দায়িত্বের ভিতরেই পরে। মনে রাখতে হবে, সেই দায়িত্ব শুধু যে সংবিধান স্বীকৃত তাই নয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় পরিসরে সংবিধান প্রতিটি নাগরিকের উপরেই সেই দায়িত্ব অর্পণ করে রেখেছে। তাই আদালতের রায়ই শেষ কথা নয়। জনগণেরও দায় রয়েছে আদালতের নিরপেক্ষতার বিষয়ে লক্ষ্য রাখার। এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই সেই নিরপেক্ষতা যাতে ঠিকমত রক্ষিত হয়, তার ব্যবস্থা নেওয়া। এই দায়িত্ব সংবিধান স্বীকৃত। এই দায়িত্ব গণতন্ত্রের ভিত্তি। এই দায়িত্ব নাগরিক সভ্যতার অন্যতম প্রধান শর্ত।
১৮ই আগস্ট’ ২০২০
সুচিন্তিত মতামত দিন