শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

বাড়ি ফিরে আবার মনে হল আমি মানুষটা জনপ্রিয় না হলেও গল্পের চরিত্র হিসাবে বেশ বিনোদনযোগ্য। আজ কলেজ স্ট্রিটের তীর্থক্ষেত্র কফি হাউসে যাবার আগে একটি দপ্তরে, আচ্ছা বলেই ফেলি, একটা প্রকাশনার দপ্তরে গিয়েছিলাম। বার তিনেক ভুলভাল জায়গায় ঢুঁমারার পর ঠিকঠাক ঘুপচি সিঁড়ি বেয়ে সরু দালান কাম ব্যালকনি পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারি। ফেরার সময় সতর্কবার্তা সত্ত্বেও সেখানকার অন্ধকার মূত্র গন্ধী সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রথমেই ভাগ্যদেবতার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখি। শুধু বিপন্মুক্ত হওয়ার জন্য নয়,পরবর্তী ঘটনাবলিও না হলে বর্ণনার সুযোগ পেতাম না।

ফাঁড়া কাটিয়ে বিধান সরণীতে পৌঁছে প্রায় আধ ঘণ্টা ট্রামের জন্য অপেক্ষা করে ও আন্দাজ পনেরো মিনিট হেঁটে কফি হাউসে পৌঁছলাম। পথে হাঁটতে হাঁটতে আমার কাঁধের ব্যাগটা কব্জা ভেঙে রাস্তায় ধপাস্। ব্যাগটা বড্ড পুরুষালি দেখতে ও বেশ লম্বা ফিতের বলে আমার মতো বেঁটে মোটা মহিলাকে যে মোটেই মানায় না সেটা আগেই মনে হয়েছিল। তাই সকালে ডিভানের ভেতর থেকে আবিষ্কার করার পর স্থির করেছিলাম আমার রাঁধুনিকে দান করব। কিন্তু এত ধূলো ধূসরিত যে ভাবলাম ছাই চাপা মানিকের কদর কি হবে? হারানিধি গছানোর জন্য মিনতির সম্মতি আদায়ের পরেও মনে হয়েছিল একটু চলনসই সংস্কার করে দেওয়া আমার কর্তব্য। সেই ব্যবস্থা করতে গিয়ে ধূলো-ঝুল ঝেড়ে,হেঁচে, গলা জ্বলে চুলকে, অ্যালার্জির ওষুধ খেয়ে শয্যা নেওয়ার পর মনে হল অনেকগুলো ফ্ল্যাপ বিশিষ্ট বেশ বড়োসড়ো কেজো দপ্তরি ব্যাগটায় স্বচ্ছন্দে একটা ছাতা,জলের বোতল,কাগজ-কলম,ভ্রাম্যভাষ, আইডেন্টিটি কার্ডের মতো সঙ্গে রাখা নিজের খান চারেক বই,চাইকি নতুন বইয়ের পাণ্ডুলিপি ইত্যাদি হেসেখেলে কুলিয়ে যাবে। তাই সিদ্ধান্ত বদলে  দত্তাপহৃত বস্তুখানা পরীক্ষামূলকভাবে নিয়ে আজই বেরিয়ে পড়েছি। 

প্রথম দিনই বেইমানি করল? নাঃ! ওটা দিয়েই দেব, সঙ্গে কব্জা সারানোর পয়সা। অবশ্য এখন মনে হচ্ছে পতনটা আমার বদলে আমার ব্যাগের ওপর দিয়ে গেল। বেচারা এতদিন বাক্সবন্দি থেকে মাকড়সা ও ধূলোর অত্যাচার সহ্য করেছে, আর এখন আবার মালকিনের ফাঁড়া কাটানোর দায় নিয়ে আছাড়ও খেলো।   

কফিহাউস পৌঁছে দেখি যা আশঙ্কা করেছিলাম ঠিক তাই। আমায় সৌজন্য সংখ্যা দেবেন বলে এক লেখক-দা আমি আসছি কিনা দুপুরবেলা ফোন করে নিশ্চিত হয়েছিলেন। সময় দিয়েছিলেন সন্ধ্যা ছ‌‌‌টা। আমি পৌঁছোই বাইশ মিনিট দেরিতে যদিও দেরির কথা জানিয়ে দিয়েছিলাম। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম তাঁকে দেখেছে কিনা। চন্দ্রশেখরদা জানতে পারেন ভেবে তাঁকেও ডেকে প্রশ্ন করলাম অমিতদার কথা। ভদ্রলোক বার কয়েক ডাকার পর জবাব দিলেন,“বলতে পারব না।”

ফোন করলাম। পিঁকপিঁক করে গেল। যাব্বাবা! আধঘণ্টা আগেও তো উপলব্ধ ছিলেন, এখন পরিষেবা সীমার বাইরে? এখান সেখান প্রশ্ন করে তাঁর পুনরাগমনের সম্ভাবনার কথা জেনে একটি চেয়ার খুঁজে বসলাম। একটা মাঝারি স্বীকৃতি উপলক্ষে আমার কাছ থেকে একটা ট্রিট জুলাই মাসে আবদার করেছিলেন এই টেবিলের মধ্যমণি দাদা। এতদিন কন্যার পিতার অন্যত্র বদলি নিয়ে কাঁদুনি গাইতাম। কিন্তু এদিন যখন জীবনসঙ্গীর প্রত্যাবর্তনের সুখবরটা দিয়েই ফেলেছি তখন ওদের আবদারটাও আজই পূরণ করব ঘোষণা করে দিলাম। পত্রিকার কপি সেখানে বসে থাকতেই হাতে এল অতঃপর। কিন্তু দেরি হয়ে গেলেও পত্রিকা পাওয়া মাত্র ওঠার উপায় নেই, কারণ বিল আসতে ঢের দেরি। 

দীর্ঘ ব্যবধানে যাই বলে চেষ্টা করি পরিচিতদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাদের টেবিলের ধারে অন্তত কিছুক্ষণ হাজিরা দিতে। তেমন এক টেবিলে একটি পত্রিকার বেশ মোটাসোটা শারদ সংখ্যায় আমার গল্প দেখে রীতিমত আশ্চর্য হলাম। সম্পাদকের সঙ্গে দেখা হল, একটি করে বাক্য বিনিময়‌ও হল,অথচ আমায় কিছু বললেন না তো! ভদ্রলোক কি আমায় এড়াতে চাইছেন? চন্দ্রশেখরদা ডাকে প্রথমে সাড়া দেননি। ওনাকেও কি লোকে পছন্দ করছে না? কারণ যাকেই অমুক পত্রিকার সম্পাদক চন্দ্রশেখরদার কথা বলি কেউ যেন চিনতেই পারে না। যাইহোক পত্রিকার সৌজন্য কপি না দিক জানানো পর্যন্ত হল না বলে যতটা ক্ষুন্ন হয়েছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি অবাক হলাম অন্তত বছর আষ্টেক আগের লেখা গল্পটা সেখানে পৌঁছোল কী করে ভেবে। কাকে দিয়েছিলাম সেটাই মনে নেই, গেলই বা কার কার হাত ঘুরে?

আসার সময় এক বয়স্কা লেখিকাকে দেখে খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে বললাম,“দিদি ভালো আছেন?” আমার ঠোঁট নাড়া ও চোখের অভিব্যক্তি পৌঁছলেও কফিহাউসের ওই নায়েগ্রা প্রপাতের কলরোলে কথা যথাস্থানে গেল না। কাছে গিয়ে বললাম,“আপনাকে চিনি কিন্তু আমার মেমারি মাঝে মাঝে গোলমাল করে তাই নামটা মনে করতে পারছি না”। উনি কিছু বললেন। শুনতে না পেয়ে ঝুঁকে পড়ে বললাম,”আপনি সান্ধ্য আজকালে লেখেন,আমায় মাঝে মাঝে ফোন করেন”। ভদ্রমহিলার মুখটা কেমন ভ্যাবাচাকা খাওয়া হয়ে গেল। 

আমি মোবাইলের যোগাযোগ তালিকা খুঁজতে খুঁজতে ‘ইউরেকা’র ভঙ্গিতে বললাম, “মনে পড়েছে,আপনি রূপশ্রীদি তো?” ভদ্রমহিলা আমায় আরও কাছে ডেকে জানালেন, তাঁর নাম জয়ন্তী রায় বা বসুরায় বা ঐরকম কিছু (দিদি মাপ করবেন,আমার গুণিজন চেনার পরিধি ও স্মৃতিশক্তি দুটোরই অবস্থা খুব শোচনীয়)। বেশ কয়েক প্রস্থ ‌স্যরি‌-টরির পর বললাম,”আপনি আমাকে চেনেন?” জয়ন্তীদি বললেন, “দেখেছি তো। লম্বা চুল ছিল কেটে ফেললে কেন?”

পরিচিতদের কাছে প্রেজ়েন্ট প্লীজ় পর্ব সারার পর বেরিয়ে আসতে বেশ দেরি হয়ে গেল। কারণ মুখ ঢাকার নিমিত্ত কাপড়ের মুখোশটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না কিছুতেই। এটা নতুন কিছু নয়। আমি গড়ে প্রতি তিন দিনে একটা করে মাস্ক হারাই। তাই একাধিক কেনা আছে, মোটামুটি জামার সঙ্গে ম্যাচিং করে। কিন্তু হতচ্ছাড়াকে তখনই হারাতে হল। এক শুভানুধ্যায়ী লেখক দাদার প্রবন্ধ লিখলে সাহিত্যিক হওয়া যায় না কিংবা সুনীল গাঙ্গুলি নাকি একটাও প্রবন্ধ লেখেননি – এমন সব আনখাই কথাবার্তার জুতসই জবাব দিতে না পারার অন্যতম কারণ ঐ ছোট্ট সম্প্রসারণশীল বস্ত্রখণ্ডটির অন্তর্ধান। ভদ্রলোক কথাগুলো বলতে বলতে সিগারেটও ধরিয়েছিলেন কিনা। 

এই টেবিল, সেই চেয়ার, পায়া ও পায়ের ফাঁক-ফোকরে ইতস্তত উঁকিঝুঁকি মেরে নিরাশ হয়ে অনাবৃত মুখ ও নাক সিঁটকে বাইরে এলাম। প্রার্থিত বাসও পেয়ে গেলাম খানিক বাদে। গোটা উত্তর কলকাতা পরিক্রমা করে যান বহুল রাস্তা দিয়ে বাসটা আমার বাড়ির কাছাকাছি স্টপেজে পৌঁছতে কখনও কখনও আড়াই ঘন্টার বেশি সময় নিলেও ওটাই আমার পছন্দের বাহন, কারণ কোথাও বদলাতে হয় না। সেটা শুধু হ্যাপার নয়, আমার মতো মানুষের পক্ষে কতটা বিপজ্জনক তা যারা আমায় রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে দেখেছে বিশেষত বেপরোয়া ওজন বৃদ্ধির পর, তারা বিলক্ষণ জানে। 

বাসে ওঠার পর চলভাষটি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। যা! মাস্ক খুঁজতে আর অমিতদাকে ফোন করতে গিয়ে কি মোবাইল হারালাম? কতশত যোগাযোগের সংখ্যা সব শূন্য হয়ে গেল? নির্ঘাৎ কফি হাউসেই ফেলে এসেছি। নেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও নামার আগে পাশের অজানা সহযাত্রীকে নিজের নম্বর দিয়ে অনুরোধ করলাম একটু ফোন করার। ব্যাগের সুনামি কম্পন জানান দিল তিনি আছেন। 

যাক! মহিলা সিটে জুত করে বসে এবার চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায়কে ফোন করার পালা। করতে গিয়ে দেখলাম চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি নামে একজনের নম্বর আছে। ও চন্দ্রশেখর নয় চন্দ্রনাথ। ফোন বেজে গেল ধরল না। খানিক পর আবার কল করায় ওপার থেকে পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এল। ভদ্রলোকের গলাটা বেশ মোলায়েম শোনাচ্ছে তো। 

“চন্দ্রনাথদা বলছেন তো।”

“বলছি...”

“আমি শ্রীপর্ণা বলছি। আপনার পত্রিকায় শারদীয়া ইস্যুতে আমার একটা গল্প দেখলাম। আমায় জানাননি তো।”

“অ্যাঁ! কী জানাইনি? কিসের কথা জানতে চাইছেন?”

“আপনি চন্দ্রোদয় পত্রিকার সম্পাদক চন্দ্রশেখর মানে চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী তো। আমি শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছি।“

“সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনি কাকে চাইছেন?”

“চন্দ্রোদয়ের সম্পাদক চন্দ্রনাথবাবুকে।”

“কিন্তু আমি তো হাই কোর্টের উকিল। চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি মনে পড়ে? আপনার একটা বই নিয়েছিলাম সই করিয়ে।”

“ও হো! এ মা স্যরি স্যরি। মনে আছে বই কি, আপনি বোধহয় আমার ইয়ে সম্ভবত। আসলে –.”

“না না স্যরির কিছু নেই। একই নামে আর কেউ আছেন, যিনি হয়তো লেখক। ভেরি কমন মিসটেক। কিছু মনে করিনি। তাছাড়া ভুল করে হলেও এতদিন বাদে অধমকে একটা কল তো করলেন। রাখছি।”

“গুড নাইট।” 

আমি আবার আমার ভ্রাম্যভাষটিতে চন্দ্রের খোঁজ চালাতে গিয়ে দেখলাম ‘অর্ণব চ্যাটার্জি চন্দ্রোদয়’ নামে একটি নম্বর রক্ষিত। আর ভুল হওয়ার নয়; ‘চন্দ্রোদয়’ পত্রিকার সম্পাদকের নাম অর্ণব চট্টোপাধ্যায়। এতক্ষণে বোঝা গেল কফি হাউসে চন্দ্রশেখর চ্যাটার্জির নাম শুনে সবার এমন কি চন্দ্রশেখর থুড়ি অর্ণবদারও অমন ছিরির প্রতিক্রিয়ার কারণ। হায় ভগবান!  

বাসে বসে নিজেই খানিক হাসলাম। পাশের কয়েকজন তাকাচ্ছে দেখে নিজের বরকে ফোন করলাম হাসাহাসির পার্টনার জুটিয়ে ভরা বাসে আমার আপন মনে হাসার অস্বস্তি কমাব বলে। এদিকে আমার একটার পর একটা ঘটনা মনে পড়ছে – জয়ন্তী নামে রূপসী বৃদ্ধা লেখিকাকে দেখে আমার রূপশ্রীদি বলে লাফিয়ে ওঠা। আগ্যিস জড়িয়ে টড়িয়ে ধরার অভ্যেস নেই। থাকলে নির্ঘাৎ ভদ্রমহিলার হৃদয় হালকা করে হলেও আক্রান্ত হোত। মনে পড়ল রূপশ্রীদির যা বয়সজনিত শারীরিক অবস্থা, তাতে তাঁর পক্ষে আর যাই হোক কফি হাউসে গিয়ে আড্ডা মারার কথা নয়। আমার বরের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমার যা অবস্থা হল তাতে শুধু কয়েকজন নয়, আশপাশের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ড্রাইভার ও কন্ডাক্টারও অপাঙ্গে দেখে নিল কী রকম যাত্রী, বাস থেকে নামিয়ে দেওয়ার মতো কেস নাকি।

যাইহোক হাসি নিয়ন্ত্রণে এলে অর্ণব চট্টোপাধ্যায়কে ফোন করলাম। তাঁর গম্ভীর গলা থেকে জানা গেল ‘চন্দ্রোদয়’ নাকি দু ভাগ হয়ে গেছে। ওই চন্দ্রোদয়ের সম্পাদনা তিনি করছেন না। তা চান্দ্র মাসের তো দুটি পক্ষ থাকেই। এখন কোনটা কৃষ্ণ কোনটা শুক্ল পক্ষ বোঝা যাচ্ছে না। শারদীয়ার কলেবর এবং বহু পুরোনো ভাঁড়ার থেকে ছাপা লেখা দেখে মনে হল আদি চন্দ্রোদয়েই নিজের লেখা দেখে এসেছি। তার নতুন সম্পাদকের নাম নাকি আমার পরিচিত এক ব্যক্তি জানেন শুধু এটুকু জানিয়ে চন্দ্রশেখরদা থুড়ি চন্দ্রনাথদা ধ্যাৎ অর্ণবদা “ভালো থেকো” বলে ফোন কেটে দিলেন।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.