পর্ব – ৪
“এবার শান্তি তো? স্ক্যান করে দেখে নিলে কোথাও কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়নি ব্রেনের ভিতরে। এবার চলো কোথাও ডিনারে যাই। ছেলেটা কতদিন ধরে ঘোরা ফেরা, বাইরে খাওয়া এসব করেনি বলো তো?”
হসপিটাল থেকে বেরোতে বেরোতে দিদানের কথা গুলো শুনে ভারী মজা হচ্ছিল রণিতের। আজ গেলে মাম্মা, ড্যাডিও না করবে না। ড্যাডির কোলে করে গাড়িতে উঠছিল রণিত। আজ ড্যাডির কোল থেকে নামাবে না। রণিতের লেগেছে তো। দাদুভাই -ও স্ক্যান-ট্যান সব না করিয়ে ছাড়বে না। থাক বাবা, সব মিটে গেছে – এবার দিদান সবাইকে ডিনারে নিয়ে যাবে।
“তুমিও কি নাতির মত ছেলেমানুষ হলে চিত্রা! একটা চোট পেয়েছে – কোথায় বাড়ি গিয়ে ঘুমাবে, তা না সারাদিনের ধকলের পরেও তুমি আরো ঘোরাবার প্ল্যান করছ”।
কোয়েল আড়চোখে দেখল রণিতের মুখটা ছোট্ট হয়ে গেছে। চোখের ইশারায় রণিতকে কিছু বলতে মানা করল।
“একটু খেতে গেলে কি এমন হবে?”
চিত্রা জানেন রণজয়ের কথার নড়চড় হবে না। তাও নাতির শুকনো মুখটা দেখে বলেই ফেললেন।
“অনেক কিছু হবে। ঘুরতে যেতে ইচ্ছা হলে আজ আমাদের ওখানে চলুক। দাদুভাই বাড়ি তো থাকাই হয় না। আজ থাকুক। তুমি নিজে রান্না করে খাইয়ো। আর আমার চোখের সামনে থাকবে সবসময় – নিশ্চিন্ত থাকা যাবে”।
কোয়েল এবার রণিতের সাথে সাথে রণিতের ড্যাডির মুখটাও শুকিয়ে যেতে দেখল। ছেলেকে ছেড়ে আজ তুষার থাকতে পারবে না। এমনিতেও কোনদিনই পারে না। মা-বাবা বহুবার নানা অছিলায় রণিতকে ওনাদের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখতে চেয়েছে, কিন্তু নাইট স্টে-টা বাপ ছেলে দুজনেই কোন না কোন বাহানায় এড়িয়ে গেছে। আজ বাবা সামনাসামনি বলেছিল। তুষার গুরুজনদের মুখের উপর না করতে পারে না। কোয়েলকেই হাল ধরতে হবে। অসুস্থ ছেলেকে ছেড়ে ও নিজেও থাকতে পারবে না।
“আজ না বাবা। আজ বাবু আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। জানোই তো কেমন মা ন্যাওটা ছেলে”।
কোয়েল রণিতের দিকে তাকিয়ে বলল। “ছেলের মুখটা হাসিতে ভএর গেল। আজ মাম্মা ছাড়া ও থাকতে পারবে নাকি? ড্যাডিকে ছাড়াও পারবে না”।
“তোর বাবাও তো আজ নাতিকে ছেড়ে থাকতে পারবে না মনে হচ্ছে পিয়া”। চিত্রা হেসে বললেন।
“তার থেকে চলো – আজ পিয়াদের ওখানেই থাকবে সবাই মিলে একসাথে। তোমার দাদুভাইয়েরও ভালো লাগবে। বাইরে থেকে ডিনারটা অডার করে দেব, না হয়”।
কোয়েল, চিত্রা, তুষার কেউ-ই ভাবেনি রণজয় এতে রাজি হবেন, অথচ রণজয় রাজি হয়ে গেলন।
“বেশ – তাই হোক”।
আজ চোখের সামনে রণিতকে অতবড় চোট পেতে দেখেছেন রণজয়। রণিত ওনার একমাত্র নাতি। আজ ওকে কাছ ছাড়া করতে পারবেন না। আগেরবার নার্সিং হোমে যে ক’দিন যমে মানুষে টানাটানি চলছিল – রণজয় খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। আর যাতে সেরকম না হয় তা দাদুভাই হয়ে রণজয়কেই দেখতে হবে। ছেলের বাবা তো আর খেলার বাইরে কিছু বুঝবে না। জেতাটাই তুষারের কাছে আসল। তার জন্য ছেলের প্রাণও যে বাজি রাখতে পারে – আজ নিজের চোখে তা দেখেছেন রণজয়। না হলে ওই টুকু ছেলেকে কোন প্রাণে মাঠে ফেলে রেখে চলে এল? রণজয় হলে পারতেন যদি পিয়ার এমন হত? ছেলের মর্জি আর জেদ শুনে চলেছে এখন বলবে হয়তো – কিন্তু রণজয়ের মনে হয়েছে তুষার নিজেও চায়নি রণিত উঠে আসুক। অত বড় আঘাতের পরেও চায়নি। এটাই রণজয়কে ভাবাচ্ছে। নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণ করতে চায় তুষার। রণিতের মাধ্যমে ছুতে চায় সেই সব কিছুকেই যা ও পারেনি। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য এতটা কঠোর হওয়াও কি ঠিক যে সন্তান কেবল স্বপ্ন পূরণের এক মাধ্যমে পরিণত হোক? ড্যাডির স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে রণিতের জীবনটাই উৎসর্গীকৃত হয়ে গেছে – এটা বেশ বুঝতে পারছেন রণজয়। রণিতও এতে খুশি। কিন্তু রণজয় কিছুতেই খুশি হতে পারছেন না। এত বড় সাফল্যের পরেও না। রণিতের শৈশবটাই হারিয়ে যাবে না তো এতে? তুষারের খেলা, রণিতের মায়ের পড়া – এসবের মাঝে যান্ত্রিক হয়ে যাবে না তো রণজয়ের ছেলে মানুষ নাতিটা? রণজয় চিন্তিত বোধ করলেন।
ছেলের কথায় ভীষণ অবাক হল কোয়েল। কি বলে ছেলেটা?
“দাদুভাই, দিদানের সাঠে শুবি?”
এই যে সারাটা সন্ধ্যা ড্যাডির কোলে করেই মায়ের পিছন পিছন ঘুরল – এখন হঠাৎ এমন কথা? মাম্মাদের ছাড়া অসুস্থ শরীরে শোবে বলছে, এমন তো বলে না! সুস্থ শরীরেও জীবনে বলেনি।
“হ্যাঁ। ওরা তো রোজ থাকে না, বলো? আমার জন্যই দাদুভাই থাকল – দাদুভাইয়ের ভালো লাগবে”।
“পিয়া, আমাদেরও তো ইচ্ছা হয় নাকি রণিতকে কাছে পেতে? আর তোর ও একটু আঁচলের তলা থেকে বার করা উচিৎ। ক’দিন পরে বাইরে যাবে খেলতে – তখন? এখন থেকেই তো অভ্যাস করাতে হবে, তাই না?”
কোয়েল মায়ের কথা শুনে বুঝল রণিতের কথা গুলো মায়ের বলানো। কিন্তু মায়ের কথা গুলোও অকাট্য। তবে কোয়েলের পক্ষে হ্যাঁ করাটা সহজ নয়। গত বছর – রণিতকে কনসিভ করার পর থেকে আজ অবধি একটা রাতও ছেলেকে ছাড়া থাকেনি। কিন্তু – পাশের ঘরেই তো। নিজের মা-বাবার কাছেই তো ছাড়ছে।
“আচ্ছা – শো, যা। ঘুমিয়ে পড়বি একবারে। গল্প শুনতে চেয়ে জ্বালাতন করবি না”।
চিত্রার মুখটা হাসিতে ভরে গেল। রণজয় খুব খুশি হবে। আজ রণিত দাদুভাই আর দিদানের আদর পুরোপুরি পাবে।
“বাবু কই?”
তুষার কোয়েলকে একা আসতে দেখে অবাক হল। ডিনার করে এসে শুয়ে পড়েছিল তুষার। মাথা ধরেছিল। ছেলে গল্প করছিল দাদুভাই, দিদানের সাথে – তাই ডাকেনি আর। কোয়েল দরজা ভেজাল।
“মা নিয়ে গেল”।
তুষার উঠে বসল।
“নিয়ে গেল, মানে?”
“রণিত আজ মা-বাবার সাথে শোবে”।
“মানে? তুমি ছাড়লে?”
তুষারের গলার স্বর চড়তেই কোয়েল ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলল।
“আস্তে, পাশের ঘর থেকে শোনা যাবে। না ছেড়ে কি করব? তোমার ছেলেই তো জেদ করল”।
তুষার আকাশ থেকে পড়ল।
“শরীর খারাপের মধ্যেও এমন জেদ?”
“বুঝলাম না, কেন করল – কিন্তু করল …………”।
“বাহ। আজ এমন একটা স্পেশাল দিন – কোথায় ছেলের কাছে শুনব, ব্যাট করতে করতে ওর মনের মধ্যে কি চলছিল, কোথায় ওকে একটু প্রেইজ করব, একটু ভুল ধরিয়ে দেব …………”।
“থাক। ওসব কাটাছেড়া পরে করলেও হবে। এবার শুয়ে পড়ো”। কোয়েল শুয়ে পড়ল।
“মন তো অন্য কারণে খারাপ। ছেলেকে শেখাবার দোহাই দিও না। ছেলের চোট তাই মন ভালো নেই, বুঝেছি”।
তুষার চুপ করে থাকল।
“মন আমারো খারাপ”, কোয়েল বলল।
তুষার কোয়েলের দিকে তাকাল।
“বাবুকে ছেড়ে এই প্রথম শুচ্ছ – এত বছর পর – বুঝি”।
কোয়েল চোখ মুছল, “না গো। অভ্যস্ত হতে হবে। আজ যা খেলা দেখলাম, ক’দিন পর থেকেই তো বাইরে বাইরে যাবে – তখন তো আর আমি যেতে পারব না? তুমি না হয় কোচ হয়ে যাবে”।
তুষার কোয়েলের কাছে সরে এল। কোয়েলের কপালে চুমু খেল একটা।
“এটাও তো ঠিক কথা ম্যাডাম। আমি তো এমন করে ভাবিই নি”।
“আমিও কি ভেবেছিলাম? আজ ভাবলাম। এখনো তো কিছু গুছিয়ে করতে পারে না তুষার, একা থাকবে কি করে?”
তুষার কোয়েলের হাত ধরল।
“পারবে। আস্তে আস্তে অভ্যাস করাতে হবে। তা বলে ওকে রোজ আলাদা শুতে বলবে না জানি”।
কোয়েল তুষারের গলা জড়িয়ে ওর মাথাটা টেনে নিয়ে এল নিজের দিকে। ওর গালে চুমু খেল।
“তাহলে রণিতের বুদ্ধু ড্যাডির ঘুম হবে না, জানি তো”।
তুষার কোয়েলের নাকে নাক ঘষল।
“চালাক মাম্মার-ও। কোয়েল, আজ আমার প্রাণটা বেরিয়ে এসেছিল, জানো?”
“বাবুর যখন লাগলো তো? আমারও। তোমার দৌড়ে যাওয়াটা দেখেছি আমি তুষার। তবে ও যে উঠে আসেনি – এজন্য আমি গর্বিত”।
“তোমার বাবা মনে হয় ভুল বুঝেছেন আমাকে। উনি তুলে আনতে চাইছিলেন, তোমার ছেলে উঠল না – আমি বাবা হয়ে কি করে ওকে জোর করে এমন একটা ঐতিহাসিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত করব বল? আর এত বছর খেলছি, চোট দেখেছি – এটুকু তো বুঝি যে কোনটা কেমন, তাই না?”
কোয়েল তুষারের ঠোঁটে আঙুল দিল।
“থাক। আমাকে আর এক্সপ্লেন করতে হবে না। বাবুর বাবার মনটা আমি পড়তে পারি”।
“তাই?” তুষার মিষ্টি হাসল।
“এখন বাবুর বাবা কি চায় বলতো?”
কোয়েল বুঝেও বুঝল না।
“ঘুমাতে তো? ঘুমিয়ে পড়”।
“বেশ দুষ্টুমি শিখেছ। আচ্ছা একটু আদর করো – শুয়ে পড়ব, ঘুম তো হবে না তেমন”।
“কেন?”
“বুকের উপরটা ফাঁকা থাকবে যে”।
কোয়েল তুষারের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল।
“এত মুগ্ধ হতে হবে না। তোমার মা’কে থ্যাঙ্কস দিতে হবে কাল সকালে একটা, উনি এটা এক্সপেক্ট করবেন”।
কোয়েল ভারি অবাক হল, “কেন?”
“বোঝ না? ডাক্তার চিত্রা লাহিড়ী নাতিকে এমনি নিয়ে জাননি, পিয়া- মেয়ে আর জামাইকে একটা নিভৃত রাত উপহার দিয়ে চেয়েছেন। আর একটা নাতি নাতনির শখ ওনার – বোঝো না?”
কোয়েল সেটা জানে। মা ওকে বলেওছে। কিন্তু তুষার জানল কি করে?
“ধ্যাত! কী যে বলো?”
“আমি সব বুঝি। কিন্তু তুমি তো জানোই আমার কী মত?”
তুষার কোয়েলের দিকে ঝুঁকে এল।
“জানি, আমারও তাই মত। কিন্তু মায়েদের তো একটা চাওয়া থাকেই। তোমার মা থাকলেও চাইতেন”।
“হয়ত। কিন্তু তা বলে আমি আমার, তোমার, মোর ইম্পর্ট্যান্টলি বাবুর লাইভে কোন ডিস্ট্রাকশন চাই না। আই হোপ ইউ আন্ডারষ্ট্যান্ড”।
“আই ডু”। তুষারের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে চুমু খেল কোয়েল। কানে কানে বলল,
“মা তো জানে না মেয়ে আর জামাই এর নিভৃতির জন্য পাশের একটা ঘরও পড়ে থাকে?”
তুষার লজ্জার হাসি হাসল।
“নিভৃতিটার সীমারেখা কতটুকু সেটা যেন মা না জানে”।
“কেউ জেনেও কোন লাভ নেই বাপ্পা, আমরা জানলেই হল। তবে আজ একটু একস্ট্রা আদর পাওনা তোমার। আন্ডার সেভেনটিন কোচ হয়েছ বলে কনগ্র্যাচুলেটই তো করিনি তালে গোলে”।
“কি দরকার এসব ফর্ম্যালিটির? আমি তো জানি আমার এই সাফল্যে সবচেয়ে কে খুশি হয়েছে – আর সে আমার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী”।
“না, তোমার স্ত্রী। কোয়েল লাহিড়ী সান্যাল। এটা আমার কাছে খুব গর্বের তুষার। তুমি আমার গর্ব। আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ”।
তুষারের চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়তে দেখল কোয়েল। বাধা দিল না। এভাবে ওকে কোনদিন কেউ বলেনি। মা যাওয়ার পর তো বলেইনি। কেউ যে ওর জন্য গর্বিত হতে পারে ভুলেই গিয়েছিল তুষার। আজ মনে পড়ে ভালো লাগল। খুব ভালো লাগল।
দরজায় নক শুনে কোয়েলের ঘুম ভাঙল।
“পিয়া …………”।
মায়ের গলা তো । মাঝরাতে এখন আবার কি? তুষারও জেগে গেল। সরেজমিনে কি কিছু দেখতে এলেন কোয়েলের মা? কোয়েল ততক্ষণে বিরক্তির সাথে দরজা খুলেছে।
“কী, মা? এত রাতে ……………”।
“তোর ছেলে নে পিয়া ……… নিজে তো দিব্যি ঘুমাচ্ছিস – আর তোর ছেলে আমাদের ঘুম আর হতে দিল না। কিছুতেই ঘুমোয় না। শুধু গল্প বল, মাম্মার ছোট বেলার গল্প, ফেয়ারি টেল এতসব বলে – টলে ঘুমাতে বললাম, চোখ বুঁজতে না বুঁজতেই আবার উসখুশ – জল খাবো, ও দিদান। বাথরুম যাবো,ও দিদান। এই নিয়ে বার দু’য়েক বাথরুম হয়ে গেল। শেষে তোর বাবাই বলল পিয়াকে দিয়ে এস – মা’কে ছাড়া ঘুমাবে না”।
কোয়েল নিজেও বুঝেছে ব্যাপারটা। দিদানের কথায় ঘুমোতে তো চলে গিয়েছিল রণিত, কিন্তু মাম্মা আর ড্যাডিকে ছাড়া ঘুম আসছে না – তাই এইসব দুষ্টুমি করেছে। যাতে দিদান-ই বাধ্য হয়ে দিয়ে যায়। রণিত দিদানের পিছনে কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল। মাম্মা ওর দুষ্টুমির কথা শুনে ওকে নির্ঘাত বকবে। মাম্মার মুখটা দেখে মনে হচ্ছিল। যাই করুক – ঘরে ডেকে নিক। কোয়েল একটু হাসল।
“ঘুমের সময় এমন বায়নাক্কা করে তোমার নাতি”।
চিত্রা অবাক হলেন।
“তোর ধৈর্য আছে, বলতে হবে তাহলে, বাপরে বাপ। তোর তো এমন ঘ্যানঘ্যানানি ছিল না। শুইয়ে দিলেই ঘুমিয়ে যেতিস। নে, তোর ছেলে সামলা। আমি ঘুমাতে গেলাম”।
কোয়েল মনে মনে ভাবল আমি ক’দিন-ই বা তোমার কাছে শুতে পেরেছি, মা! মুখে বলল না। রণিতকে বলল।
“আয়, ঘুম পাড়িয়ে দিই”।
রণিত হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মাম্মা ওর মনটাকে বুঝেছে। একছুটে ও বিছানায় চলে গেল। কোয়েল দরজা লক করল। রণিত ততক্ষণে ড্যাডির কোলের কাছে শুয়ে পড়েছে। তুষার মুচকি হেসে কোয়েলকে বলল,
“ভালোই নাটক শিখেছে তোমার ছেলে”।
কোয়েল পাশে শুয়ে পড়ল।
“দেখলাম তো”।
তুষার রণিতের মাথায় হাত রাখল।
“শখ মিটল তাহলে দিদান-দাদুভাই যাওয়ার?’
“আমি যেতে চেয়েছিলাম নাকি, দিদান-ই তো বলল! ”
তুষার হেসে ফেলল।
“সে তো বুঝেইছি। তা কিসের লোভ দেখিয়েছিল দিদান?”
রণিত চুপ করে থাকল। কোয়েল অবাক হল।
“কি রে? ড্যাডি কি জিজ্ঞাসা করছে?”
“বললে বকবে”, রণিত আস্তে করে বলল।
কোয়েল ধমক দিল, “বল”।
“আঃ! পিয়া, থাক না। পরে বলবে না হয়। আয়, ঘুমিয়ে পড় এবার। সকালে উঠে ট্রেনিং আছে”।
রণিত ড্যাডির কোল ঘেঁষে গেল আরো। কোয়েল ছেলের কানটা ধরে টানল। রণিত কঁকিয়ে উঠল,
“মাম্মা!”।
“ঘোর এদিকে”।
তুষার ছেলেকে চোখের ইশারায় মায়ের কথা শুনতে বলল। রণিত ঘুরল।
“দিদান কি বলেছিল? শপিং করতে চেয়েছিলি?”
রণিত সজোরে ঘাড় নাড়ল।
“ব্যাট?”
“না”।
“ঘুরতে যাবি বলেছিলি?” রণিত না করল।
“আমি কিছু চাইনি মাম্মা”।
কোয়েলের শাসনের কারণটা তুষার জানে। ছেলে যাতে বড় লোক দাদুভাই দিদানের কাছে যা চায় তা-ই পেয়ে লাই না পেয়ে যায় – এই জন্য কোয়েল সদা চিন্তিত। চিন্তাটা তুষারেরও। সব পেয়ে থাকলে খিদেটা নষ্ট হয়ে যায়। ছেলেকে তাই কোনকিছু চাইতে দেয় না ওরা। যেটুকু দেবার নিজেরা দেয়।
“বল, বাঁদর”।
রণিত কোয়েলকে অবাক করে দিয়ে জড়িয়ে ধরল ওকে। বকুনির সময় মাম্মাকে জড়িয়ে ধরার সাহস হয় না রণিতের। তুষার কোয়েলকে ইশারায় ছেলেকে জড়িয়ে ধরতে বলল। কোয়েলও বুঝল।
“কি হয়েছে, বাবু?”
কোয়েল ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো। রণিত মাম্মার বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে দিল। এটা ওর আদর চাওয়ার ভঙ্গি। কোয়েল কপালের ব্যথা জায়গাটায় চুমু খেল একটা।
“মাম্মা …… শোনো”।
ফিসফিস করে বলল রণিত। কোয়েল বুঝতে পারল কানে কানে কথা বলবে রণিত। এটা সাধারণত এলাউ করে না, আজ করল। হয়তো কোন কথা ড্যাডির সামনে বলতে পারছে না।
“বল”।
“দিদান বলেছিল আমি ওখানে শুলে ভাই বোন এনে দেবে। ড্যাডিকে বলো না। ড্যাডি শুনলে রাগ করবে দিদানের উপর”।
কোয়েল ছেলের বোধবুদ্ধির পরিণত ভাব দেখে খুশি হল।
“আচ্ছা, এবার ঘুমো”।
কোন কথা ড্যাডিকে বলা যায়, কোনটা যায় না – এটাও বুঝে ফেলেছে।
“আর শুতে চাইব না ওখানে, সত্যি। তোমায় ছাড়া, ড্যাডিকে ছাড়া ঘুমাব কি করে?”
এই কথা গুলো জোরে জোরেই বলল রণিত। তুষার ছেলের পিঠে হাত বোলাল।
“সেই ভালো। তাহলে আর রাতবিরেতে দাদুভাই দিদানকে জ্বালাতন করে অতিষ্ট করতে হবে না। কি নাটকটাই না করেছিস। যেটা পারিস না করতে যাস কেন, বোকা?” কোয়েল হাসল।
“থাক। আর বকো না। এমনিতেই দাদুভাই – দিদানের বকা খেয়েছে, এখানে এসে আমি বকলাম। ড্যাডি যাবি বাবু?”
তুষার-ও ডাকল, “আয়”।
রণিত একটু ঘুরে বলল, “আজ একটু মাম্মা থাকি, ড্যাডি? কপালে ব্যথা তো”।
তুষার খুব খুশি হল। রণিত এভাবে মা চায় না কখনো।
“বেশ, থাক। মাম্মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যা”।
তুষার চিৎ হয়ে শুল, রণিত একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ল।
কোয়েল তুষারকে ডাকল, “ঘুমোলে?”
“না, ছেলেটা বড় হয়েছে দেখলাম”।
“কানে কানে বলল বলে রাগ করলে?”
“না, না। দিদানকে ড্যাডির বিরাগভাজন না করার চেষ্টা দেখে ভালো লাগল”।
“মা-ও মাঝে মাঝে ছেলেমানুষি করে বসে”।
“ভাইবোনের লোভ দেখিয়েছে তোমার ছেলেকে – সে আমি আগেই জানতাম। তুমিই খামোখা অতগুলো বকুনি দিলে। বাবুকে আমার বলা আছে পিয়া, ও তুমি আর আমি বাদে কারোর থেকে কিছু চাইবে না”।
“ওকে তুমি ভাইবোনের ব্যাপারটাও বুঝিয়ে দিও”।
তুষার ঘুরে শুলো। রণিতের সাথে সাথে ওর মাম্মাকেও জড়িয়ে ধরল।
“দেব। তবে তোমার ছেলেকে তুমি কি দেবে বলো, আজ এত ভালো খেলল যে?”
কোয়েল মিষ্টি করে হাসল,
“যা চাইবে, দেব। আজ সত্যিই ও আমাকে খুব খুশি করেছে”।
“মনে থাকবে তো কথাটা?”
“একদম”।
পর্ব – ৫
সুজনের কিছুতেই ব্যাপারটা হজম হচ্ছিল না। ড্রিঙ্কস ব্রেকে কাকাকে জেভিয়ার্সের কোচের সাথে দেখেছে ও। আর তারপরই এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটল। দীপমাল্যর মত ছেলে, যে কিনা আন্ডার নাইনটিন বেঙ্গল খেলেছে, তার হাত থেকে এভাবে বল ছিটকে যাবে – না, তা হয় না। #### ইচ্ছাকৃত ছিল। প্ল্যানড। রণিতকে আউট করতে না পেরে রিটায়ার্ড হার্ট করার জন্য। কিন্তু এই জঘন্য প্ল্যানটা দীপমাল্যর হতে পারে না। ওকে কেউ করতে বলেছে এটা। কিন্তু তিনি কে? মনোজ স্যার? নাকি – মনোজ স্যার কারোর কথায় করিয়েছেন? সেই কেউটা কাকা নয় তো? হতেই পারে। এসব করে কি পায় কাকা? তুষার স্যারকে আটকাতে গিয়ে তো রণিতের প্রাণসংশয় করে ফেলছিল প্রায়। ভাগ্যিস চোটটা বেশি নয়, না হলে ব্রেন হ্যামারেজ হলে কি কি হতে পারে সেটা তো সবাই জানে। ফিল হিউজেস, অঙ্কিত কেশরী – এগুলো তো টাটকা উদাহরণ। ভাইটার যদি অমন কিছু হত? ভেবেই নিজেকে ধমকাল সুজন। এ দি ভাবছে ও? কিছু হবে না ভাই-এর। আজ বাবা-ও খুব খুশি হয়েছে। ভাইকে নিজে থেকে ডেকে কথা বলেছে, আদর করে দিয়েছে। সুজন কাল-ই ভাইকে দেখতে যাবে। চোটটার অবস্থা কেমন না দেখলে ওর শান্তি হচ্ছে না।
“তুষার বলছিস?”
উল্টোদিকের গলাটা একবারেই চিনে ফেলল তুষার। ছেলেকে পার্কে নিয়ে গিলে নকিং করাচ্ছিল ও। হঠাত মোবাইলটা বেজে উঠল।
“অনিকেতদা, তুমি?”
“কনগ্র্যাটস রে। আন্ডার সেভেন্টিন কোচ হবার জন্য”।
অনিকেত চ্যাটার্জী বেঙ্গল ক্যাপ্টেন ছিলেন। ইন্ডিয়ার হয়ে বেশ কয়েকটা টেষ্ট খেলেছেন। তুষারের খেলোয়াড় জীবনে ইনার যথেষ্ট অবদান ছিল। স্কটিশে পড়াকালীন একটা ফার্ষ্ট ডিভিশন ক্লাবের খেলায় তুষারকে স্পষ্ট ### অনিকেতদার রেকমেন্ডেশন বেঙ্গলে চান্স পেতে কিছুটা হলেও সাহাজ্য করেছিল। তুষারকে। একটা ওর দরকার ছিল। কারণ ও ক্রিকেট ব্যাকগ্রাউন্ডের ### দিন। বাড়ির কেউ এখনো খেলেনি। নেহাত নিজের আগ্রহ আর মায়ের সাপোর্ট ছিল বলে খেলাটা খেলতে পেরেছিল তুষার।
“থ্যাঙ্ক ইউ, দাদা”।
“শুধু থ্যাঙ্কসে আটকে থাকলে হবে না। একটা ফেভার চাই যে”।
তুষার অবাক হল। তুষারের থেকে কি ফেভার নেওয়ার থাকতে পারে অনিকেতদার? নিজে একসময় #### ছিল। সিসোদিয়ার আন্টিলবির লোক – এখন তাই ক্ষমতায় নেই। কিন্তু বোর্ডে ভালোই হাত আছে। অনিকেতদা অদ্ভূতভাবে বেটিং স্ক্যান্ডলটার সময় নিজে নিউট্রাল রেখেছিল। তুষার ভেবেছিল অনিকেতদা-ঈ সবার আগে তুষারের হয়ে ঝাঁপাবে। তা হয়নি। ঝাঁপিয়ে ছিলেন সিসোদিয়া স্যার। তবে সে নিয়ে রাগ পুষে রাখেনি তুষার। এতদিন অজ্ঞাতবাসের সময় যারা ওর একটাবার খোঁজও নেয়নি তাদের কারোর উপরেই রাগ নেই ওর। কে-ই বা ব্যর্থ মানুষের সঙ্গ চায়। ব্যর্থ তার ভাইরাস ছোঁয়াচে। তাই সবাই সযত্নে এড়িয়ে যায়। সফল হলেই বসন্তের কোকিলেরা ফিরে আসে। এটাই মানুষের চরিত্র। এ নিয়ে ভেবে লাভ নেই।
“ফেভার বলছ কেন? বলো, কি করতে হবে। আমার জীবনে তোমার অবদান আমি মানি অনিকেতদা। যদি কিছু করার সুযোগ পাই ত ভালো লাগবে। ঋণী হয়ে থাকতে ভালো লাগে না”।
অনিকেত কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন,
“আন্ডার সেভেনটিন সেলেকশনে আমার ছেলেটাও একটা প্রোবাবেল, বুঝলি? একটু দেখিস। আসলে বুঝিস-ই। আমি এখন পাওয়ারে নেই …… ভয় হয় যদি আমার জন্য ছেলেটা বাদ যায় ……. তুই ওর খেলা দেখেছিস, জেভিয়ার্সের ক্যাপ্টন ও। মনোসিজ নাম ………”।
তুষার হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মনোসিজ ওর পছন্দের তালিকায় এমনিতেই ছিল। অযোগ্য কেউ হলে তাকে নিত না তুষার। এদিকে অনিকেতদাকে মুখের উপর না বলতেও খারাপ লাগত।
“হ্যাঁ, ও ভালো খেলে। আমি রেফামন্ড করব, চিন্তা করতে হবে না”।
“থ্যাঙ্কস ভাই”।
“এতে থ্যাঙ্কস দেবার কিছু নেই অনিকেতদা। একদিন তুমি আমাকে রেফামন্ড করেছিলে। আমি যোগ্য ছিলাম বলেই করেছিলে। আমি আমি মনোসিজকে রেফামেন্ড করব – ও যোগ্য বলেই। এনিওয়েজ, তুমি আমার নাম্বারটা পেলে কোথা থেকে?”
“পুরনো নাম্বারটাই তো রেখেছিস দেখছি। আমার কাছে ছিল। আগে ট্রাই করে দেখলাম তাই”।
তুষার একটু হাসল।
“ওহ। মাঝে এতগুলো বছর ফোন করোনি তো – ভেবেছিলাম যে নাম্বারটা হারিয়ে ফেলেছ”।
তুষার কাউকে অসম্মান করতে চায় না। কিন্তু নিজের অসম্মান, অপমান ও ভুলে যেতে পারে না, কিছুতেই। অনিকেতদাকে কিছু বলতে না দিয়েই ফোন কেটে দিল ও।
সুজন সন্ধ্যাবেলা পড়া থেকে ফেরার পথেই স্যারের বাড়ি চলে এসেছিল। আজ সানডে। স্কুল ছুটি। কাল স্কুলে সেলিব্রেশন হবে। লরেন্স এত বছর পর স্কুল ক্রিকেট কাপ জিতল। খুব বড় করে সেলিব্রেশন হবে। সুজনকেই ক্যাপ্টেন হিসাবে ট্রফি হাতে করে স্টেজে উঠতে হবে। কাল এমনিতেই ভাইয়ের সাথে দেখা হত। কিন্তু মন মানছিল না। ভাইটার খুব ব্যথা লেগেছে। জিতেও এইজন্য মন খারাপ সুজনের। এভাবে স্যারকে না জানিয়ে দুম করে চলে আসা উচিৎ হয়নি হয়তো। কিন্তু স্যার ওকে দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন, আন্টিও।
“সুজনকে কালকেই বলছিলাম আসার কথা, তাই না সুজন?”
সুজন ঘাড় নাড়ল, “ইয়েস আন্টি”।
আন্টিকে সবসময় রাগী আর গম্ভীর-ই দেখেছে সুজন। আজ খুব ভালো মুডে আছে মনে হয়। মিষ্টি করে হাসছে সবসময়। নাকি আন্টি বাড়িতে এমন-ই। ভাই যে বলে ভীষণ রাগী?
“বসো”, স্যার বললেন।
“ভাই নেই?”
তুষার বসল সুজনের পাশে।
“ওহ, তাহলে মিঃ ক্যাপ্টেন আমার সাথে দেখা করতে আসেননি? আমি ভাবলাম জেতার আনন্দটা স্যারের সাথে ভাগ করতে এসেছেন আপনি”।
“এসেছি তো স্যার। কাল জেতার প্র অত লাফালাফিতে আপনার সাথে ভালো করে কথা-ই হয়নি”।
“হ্যাঁ, আমিও তোমার ভাইকে নিয়ে হাসপাতাল গেলাম। তাহলে এখন ভালো করে কথা বলে নিই?”
তুষার ইচ্ছা করেই সুজনের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছিল। ও এখানে স্যারের জন্য না, ভাই – এর জন্য এসেছে – এটা তুষার জানে।
“স্যার, বলছিলাম কি – ভাই ভালো আছে?”
কোয়েল দরজার কাছে থেকে সব শুনছিল।
“তুষার, ছেলেটাকে আর কষ্ট দিও না। যাকে দেখতে এসেছে – তাকে ডেকে দিই। সুজনকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভাইয়ের চিন্তায় ঘুম হয়নি”।
সুজন অবাক হয়ে আন্টির দিকে তাকাল। ওর সত্যিই ভালো করে ঘুম হয়নি। আন্টি বুঝলেন কি করে? তুষার হাসল।
“ডাকো, ওর ভাই-ও কি এখন আর পড়ছে ভাবছ? কান খাড়া করে সব শুনছে – এ ঘরে কি কথা হচ্ছে না হচ্ছে”।
সুজন মাথা নীচু করল। ভাই পড়ছিল? তাহলে তো ওর জন্য ভাই-এর পড়ার ডিস্টার্ব হল”।
তুষার সুজনের মনের কথা বুঝল।
“সবে পড়তে বসেছে। পড়ায় যা মন, জানোই তো। এখনো ওর মাম্মা নিয়ে বসেনি। তোমার আন্টি পাশে না বসলে ওর পড়া হয় না”।
“ওর চোটটা বেশি নয় তো?”
“না, কাল তো স্ক্যান হল। সব নর্মাল। কপালে ফোলাটা আছে …… এই তো বাবু এসে গেছে”।
রণিতের ভারী মজা হচ্ছিল। আজ সানডে। দাদুভাই দিদান চলে যাবার পর ### পড়েছে রণিত। সন্ধ্যায় ড্যাডিকে বাইক রাইডের জন্য ধরবে ভেবেছিল – মাম্মা পরশু হিস্ট্রি টেস্টের জন্য পড়তে বসিয়েছিল। একটুও ভালো লাগছিল না রণিতের, মন বসছিল না। ভাগ্যিস সুজনদা এল। এবার গল্প হবে।
“এখনো তো ফোলা আছে, স্যার”। সুজন উদ্বিগ্ন হল।
“হ্যাঁ, কমে যাবে। যা জোরে লেগেছিল”।
রণিতকে কোলে বসিয়ে নিল তুষার।
“আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম স্যার। হেলমেটে লাগার সাথে সাথেই বুঝেছিলাম কতটা লেগেছে। তার উপর ভাই যখন পড়ে গেল ……”।
“ভয় তো আমিও খুব-ই পেয়েছিলাম। একবার ভাবলাম তুলে নিয়ে আসি। তোমার ভাই-ই বলল খেলবে”।
“হি ইজ ভেরি ব্রেভ। জানেন স্যার, বাবাও খুব খিশি হয়েছে ভাই-এর স্পিরিট দেখে। কাল ডিনারে গল্প করছিল। এরকম মাথায় চোট নিয়ে কেবল আপনাকেই খেলতে দেখেছে”।
রণিত অবাক হল, “ড্যাডিরও লেগেছিল, নাকি?”
“হ্যাঁ রে ভাই। তুই তো জানিস না। তাও রাঞ্জি সেমিফাইনালে। ইউ পির এগেইনস্টে। ঐ পেসারটার নাম শুনেছিস তো – কুন্দন প্রশাদ? একেকবারে মাথায় মেরেছিল। ফেটে গিয়ে ব্লিডিং। সেই অবস্থায় ব্যান্ডেজ করে ব্যাট করেছিল। বেঙ্গলকে জিতিয়েও ছিল”।
“কবে, ড্যাডি?”
তুষার ভাবছিল সালটা। কোয়েল সুজনের জন্য বিস্কিট, চানাচুর, পেস্ট্রি নিয়ে এসেছিল।
“অনেক আগে। বাবু তখনো হয়নি। আমরা কলেজে পড়ি – ফাইনাল ইয়ার”, কোয়েল বলল।
তুষার হেসে ফেলল।
“ও হ্যাঁ, তাই তো! ফাইনাল ইয়ারের শুরুর দিক। পরের দিন ব্যান্ডেজ নিয়ে কলেজে ঢুকতেই তোমার আন্টি খুব বকেছিল আমায় – কেন এত চোট নিয়ে খেললাম – উঠে এলাম না। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে ছিলাম যে দলকে না জিতিয়ে ওঠা যায় না”।
“বাবাও তাই বলছিল। রণিত এই স্পিরিটটা আপনার থেকেই পেয়েছে”।
রণিতের খুব ভালো লাগছিল। ড্যাডি যা যা করেছে ওর সেই সবকিছু করতে অবে। আর করতে পারলে ওর খুব ভালো লাগবে। সবাই তখন বলবে – রণিত ইজ জাস্ট লাইক হিস ড্যাডি।
“সুজন, নাও। খেতে খেতে কথা বলো”।
কোয়েল সামনের সোফায় বসল।
“তবে তোমার স্যারের সেই বারো তেরো বছর আগের বোঝানোটা আমার মাথায় গেঁথে গেছে। কাল যখন তোমার ভাই-এর লাগল আমি খুব কষ্ট পেলেও ওদের বাবা-ছেলের ডিসিশনটাকে রেসপেকট করে ছিলাম টিমকে না জিতিয়ে উঠতে নেই, এখন আমি বুঝি”।
ড্যাডি আর আর মাম্মার কলেজে এত ভালো রিলেশন ছিল। তাও মাম্মা কেন ওই লোকটাকে বিয়ে করল – এটা ভাবলেই রণিতের রাগ হয়। মাম্মা খুব বোকা। কোথায় ড্যাদি আর কোথায় ওই লোকটা। প্রিটেন্ড করেছিল ভালোবাসে – বাস। কালকেও টিভিতে দেখাচ্ছিল। একটা নিউজ চ্যানেলে। ইন্টারভিউ দিচ্ছিল। দিদান চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে ওখানে এসে পড়লেই রণিত চ্যানেল চেঞ্জ করে দিয়েছে। দিদানের হাত থেকে রিমোট নিয়ে নিয়ে চট করে চেঞ্জ করেছিল। না হলে ড্যাডি কি মাম্মা দেখে ফেললে ওদের কষ্ট হবে।
“স্যার দীপমাল্যর মত বোলারের হাত থেকে ওভাবে বিমার হয়ে গেল – এটা ভাবতেই কেমন লাগছে”।
তুষার সুজনের কথা শুনে মৃদু হাসল।
“মনে হয় ইচ্ছাকৃত ছিল”।
“ইচ্ছাকৃত মানে!” কোয়েল চমকে উঠল।
“তোমার ছেলেকে আউট করতে না পেরে আহত করে মাঠ থেকে সরাতে চেয়েছিল”।
“আমারো তাই মনে হয় স্যার”।
“আহত করে! সে কি! এর থেকে কত বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত – ওরা জানে না? জেজটা কি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে কাউকে প্রাণসংশয়ে ফেলতে হবে?”, কোয়েল উত্তেজিত হয়ে পড়ল।
“জেতার থেকেও বেশি করে আমার হারাটা ওদের কাছে ইম্পর্ট্যান্ট ছিল। মনোজের প্ল্যান এটা। জিতলে ও আন্ডার সেভেনটিন কোচ হবে, জানত। তাই ওর জেতার পথের কাঁটাটাকে সরাতে চেয়েছিল”।
“এটা তো অন্যায়! ঠান্ডা মাথার খুন! তুমি সব জেনেও বসে আছ কি করে?”
তুষার হাসল, “কি করব? প্রমাণ তো নেই। বললে বলবে অ্যাকসিডেন্ট। ক্রিকেট মাঠে এমন হতেই পারে। নাহলে কাল মনোজের টুটি চেপে ধরার ইচ্ছা আমার হয়নি – এমন হতে পারে?”
বাব্বাঃ! ওকে সরাবার জন্য এত কিছু করেছিল জেভিয়ার্স। রণিত অবাক হল।
“স্যার, আই থিঙ্ক মনোজ স্যার না। এর পিছনে অন্য কেউ আছে। আর আমি তাকে চিনি”।
সুজন এই কথাটা লুকিয়ে রাখতে চাইল না আর।
“অন্য কেউ?”
“ইয়েস স্যার। আমি কাকাকে ড্রিঙ্কস ব্রেকে মনোজ স্যারের সাথে কথা বলতে দেখেছি। এমন ট্রুফেড আইডিয়া কাকার-ই হবে”।
তুষার এবার অঙ্কটা মেলাতে পারল।
“ওহ, আমিও তাই ভাবছিলাম মনোজের এত সাহস হল কোথা থেকে”।
“সুজনদা, একটা কথা বলি? তোমার কাকা একদম ভালো না। কাল আমাকেও ট্যানেলের মধ্যে ধরে উল্টোপাল্টা কথা বলছিল”।
তুষার কালকেই বুঝতে পেরেছিল যে সৃঞ্জয় রণিতকে উল্টোপাল্টা কিছু বলেছে।
“কাল যখন জিজ্ঞাসা করলাম, বললি না তো?”
রণিত ড্যাডির মুখের দিকে তাকাল।
“বললে তুমি খুব রেগে যেতে ড্যাডি। খুব খারাপ কথা বলেছিল। ম্যাচ শুরুর আগে রাগারাগি হলে খেলায় এফেক্ট পড়ত। তাই বলিনি”।
সুজন খুব লজ্জিত হয়েছিল, “স্যার, আমি জানতাম কাকা যখন মাঠে এসেছে কোন না কোন একটা কান্ড বাঁধাবে। ভাই, কি বলেছে তোকে? আমি আজকেই বাবাকে বলছি”।
“থাক, সুজনদা। বাদ দাও। ড্যাডির নামে যা বলেছে সব মিথ্যা তো। আমি তো জানি আমার ড্যাডি কেমন”।
তুষার, সুজন, কোয়েল সবাই বুঝতে পারল প্রসঙ্গটা কি। সেই বেটিং আলিগেশন নিয়ে এখনো জল ঘোলা করছে সৃঞ্জয়। নাহ। সৌমেনদা কে সরাসরি বলতে হবে। তারপর সিসোদিয়া স্যারকে। সৃঞ্জয়ের ডানা ছাঁটার সময় চলে এসেছে।
“মাম্মা-“।
কোয়েলের কাছে পড়তে বসেছিল রণিত। পড়ায় মন বসছিল না। ঐ সুজনদার কাকা লোকটা এমন একটা কথা বলেছে যেটা ড্যাডিকে বলা যাবে না। অথচ মাম্মাকে বলতে হবে। না বললে কষ্ট হচ্ছে।
“বল”।
“একটা কথা বলব?”
কোয়েল কথার সুরে বুঝল গুরুতর কোন কথা।
“হ্যাঁ, বল”।
“ড্যাডিকে বলবে না তো?”
কোয়েল মাথা নাড়ল, “না, বলব না। ড্যাডি ওঘরে টিভি দেখছে তুই বল আস্তে আস্তে”।
“মাম্মা, স্টেপফাদার কথাটা খুব খারাপ, বলো?”
কোয়েল চমকে উঠল, “কে বলেছে?”
“ঐ লোকটা। সুজনদার কাকা। কিন্তু ড্যাডি তো আমার ড্যাডি। স্টেপফাদার হবে কেন? ড্যাডিকে হেরো, জুয়াড়ি কি সব বলছিল। তুমি ড্যাডিকে বলো না – কিন্তু তোমাকে না বললে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল”।
কোয়েল রণিতকে আদর করে দিল।
“ড্যাডিকে না বলে ভালো করেছিস। খুব কষ্ট পেত। আর তুই তো জানিস ড্যাডি ফেয়ার”।
“সে তো জানিই। বাট ড্যাডি কেন স্টেপফাদার হবে? আমি তো একদম ড্যাডিরই মতো। সবাই তো তাই বলে। আর এখন তো আমার সারনেমটাও ড্যাডির। তাহলে?”
কোয়েল রণিতের চোখ মুছিয়ে দিল।
“স্টেপফাদার না তো। ড্যাডি তো তোরই ড্যাডি। ইউ নো দ্যাট, না?”
“ইয়েস মাম্মা। বাট মাম্মা – একটা কথা বলি? বকবে না কিন্তু”।
কোয়েল ছেলেকে মাথা নেড়ে আশ্বাস দিল, একদম বকবে না।
“তুমি ড্যাডিকে কলেজের সময় থেকেই চিনতে। তোমার বেষ্ট ফ্রেন্ড ছিল। হি লাভড ইউ সিনস, দেন। তাহলে তুমি ড্যাডিকে তখন ম্যারি করলেই এত ঝামেলা হত না। সবাই আমাকে ড্যাডির ছেলেই বলত”।
কোয়েলের চোখে চল চলে এল।
“আমি যে বুঝতে পারিনি বাবু। ড্যাডির মনটা পড়েও পড়তে পারিনি। আমার-ই ভুল। অ্যাম সরি”।
“এভাবে বলো না। ঐ লোকটার দোষ। তোমাকে ভুল বুঝিয়েছিল তো। ওর জন্যই সব হয়েছে”।
কোয়েল চোখের জল মুছল। দোষটা একা প্রিয়মের না, কোয়েলেরও।
“থাক। হি ইজ পাস্ট ফর অ্যাস। কেউ স্টেপফাদার বললে মন খারাপ করবে না। কারণ ইউ নো হু ইজ ইওর ড্যাডি”।
রণিত বুঝল, মাম্মার গালে চুমু খেল একটা। মাম্মা খুব ভালো। দেরিতে হলেও মাম্মা-ই তো ওকে ড্যাডি এনে দিয়েছে। এই জন্যই মাম্মাকে আদর করল রণিত।