সালটা ২০০৯। আমাদের কাগজ ট্রামলাইনের প্রথম সংখ্যা হবে। নবারুণদার একটা লেখা চাই। ফোন করলাম। ওপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো একটা গম্ভীর গলা। সবটা জানালাম, শুনলেন। তারপর ফের তেমনই নবারুণীয় ঢঙে বললেন, "আমি ওভাবে লিখতে পারি না। সময় দরকার।" তারপর বললেন, "আগের লেখা ছাপবে তাতে অনুমতির দরকার কি! এগুলো জানতে চাইবে না। করে ফেলবে।"
বলা বাহুল্য আমাদের তাড়া ছিল। কিন্তু নবারুণ যে ব্যক্তিযন্ত্রণায় দীর্ণ হয়ে তাঁর অন্তর্জালক পাতা ভরান, তা কোনও ডেডলাইন পরোয়া করে না। একজন লেখকের সাথে প্রথম আলাপেই বললেন, আমি ওভাবে লিখতে পারি না..এ কথাটা আমায় ভাবিয়েছিল সেই কলেজবেলায় প্রবল। ওভাবে মানে কীভাবে? বাজার-ডিকটেটেড "হিসিত্যিক" রা যেভাবে ভাবে, সেভাবে? প্রোডাক্টের মত করে লেবেল মেরে বছরে তিরিশটা নভেল নামায় তারপর?
নবারুণদার মায়া হয়েছিল। নেহাত বালক তখন। ভাষাবন্ধনে যেতে বললেন। আমার বিশ্ববিদ্যালয় যাদবপুরের কাছেই। গেলাম। ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। একমনে লেখা পড়ছেন। তীব্র গরম। ঘরে সিগারেটের ধোঁয়া। ঝাপসা। ক্যাঁচক্যাঁচ করে পাখা চলছে৷ দুপুরের আলোয় সাদা দাড়ির প্রবীণকে সহসা মনে হচ্ছে, ঘটক। সহসা, সমর সেন। টেবিলের ওপারে বসলাম। আমার দিকে তাকালেন। অনেক দেখা একজোড়া চোখ। নবারুণদার মাথার পিছনে একটা পোস্টার। আমস্টারডাম মিউজিয়ামের। ঘরজোড়া ভাষাবন্ধনের নানা বই। পুরোনো পত্রিকা। বাইরে বিজয়গর অটোস্ট্যান্ডের কিচাইন...
আপনার প্রিয় শহর কোনটা? - জানতে চাইলাম। লেনিনগ্রাদ। এক কথায় উত্তর। সপাট। কারণ জানালেন, দু পা হেঁটে সেখানে কাফে ও গ্যালারি। আমাদের রবীন্দ্রসদন মার্কা আঁতলামো নেই। আমার লেখা উল্টে-পাল্টে দেখতে দেখতে জানালেন, র/ড় -তে এত বানান ভুল কেন? পরে নিজেই বললেন, "তুই বাঙাল?" বললাম, হ্যাঁ। বললেন, "এ ভুলটা আমারও হয়। ওই বাঙাল বলেই। সচেতন থাকবি"।
আমার বরাবর গর্বের একটা ছিল, আমাদের ফ্রন্টিয়ার ছিল না যৌবনে কিন্তু ভাষাবন্ধন ছিল। মুখিয়ে থাকতাম, কি সম্পাদকীয় বেরচ্ছে। কি লিখছেন নবারুণ। কি ভাবছেন ছেটানো রক্তের দাগের পাশে। কলেজ শেষ করেই ছুটে যেতাম ভাষাবন্ধন দপ্তরে। কত প্রশ্ন। " নবারুণদা কি বই পড়ব? মার্ক্সিজম নিয়ে? বললেন, এখনও তুই বালক। তবে কয়েকটা বই ইউ মাস্ট হ্যাভ। ডিকশেনারি অফ মার্কিস্ট থট/ সোশ্যাল হিস্ট্রি অফ আর্ট এগুলো পড়ে ফেল।
নবারুণদাই আমার দেখা বিরল বাঙালি, যিনি দেখা হতেই জানতে চাইতেন, "কি বই পড়ছিস?" ২০০৯ তে ট্রামলাইনে ফাইনালি লেখাটা দিলেন। নীচে যে লেখাটা ছাপা। আমরা সাম্মানিক হিসেবে একটা ছোট মাটির ঘন্টা দিতে পেরেছিলাম। হেসে বলেছিলেন, "এটা বাজে?" বাজিয়ে দেখেও ছিলেন। আমরা যারা গত দশ বছরে যৌবনের দিনগুলি কাটিয়েছি, যাদের সামনে নন্দীগ্রামের আন্দোলন ছিল, পিছনে ছিল আদর্শবিহীন সাউথসিটি, যারা ইতিহাসবঞ্চিত ওয়াটসাপ-ফেসবুকের ধাক্কা প্রথম খেয়েছিল, যারা ডিপ্রেসড আর সাইকটিক একটা প্রজন্ম, বামপন্থার পরাজয় দেখল, এনালগ গিয়ে ডিজিটালের আসা দেখল, দেখল কি দ্রুত বদলে যেতে স্মার্টফোন-হাজার এপ-ডিজিটালসমাজ-ভিডিওগেম ছেলেমেয়ে-ঈশ্বরযৌনতা তাঁদের আইকন ছিলেন নবারুণ। কারণ শুধু এ জন্যে না তিনি খিস্তি লেখেন। এ জন্যেও কারণ তাঁর কমান্ড। স্বর। আর সে স্বর আমাদের দিত ইতিহাসের আশ্রয়। বলত, বোকা বুড়ো নবারুণ পাহাড় ভাঙছেন। একদিন রাস্তা হবে। হবেই। ডিনামাইট ফাটবে। কবে কীভাবে ফাটবে, তা জানতে এখনও বাকি আছে..
ক্যাঁচক্যাঁচ করে পাখা চলছিল ভাষাবন্ধনের দপ্তরে। প্রথম আলাপের কথা একটু আগেই বললাম। বালক আমি হারবার্টের বিস্ফোরণের কথা বলায়, নবারুণ আমায় তাকাতে বলেন সেই পাখার দিকে। বুড়ো পাখা। ঝুল লেগে। বলেন, ইলেক্ট্রিক তারের ভেতর দিয়ে ওই ফ্যানে কারেন্ট যাচ্ছে। হাত দেখান দেওয়ালের দিকে। দেখান, কীভাবে সেই কারেন্ট যাচ্ছে। তারপর বলেন, সেই কারেন্টটা ওভাবে না যাওয়াই তো নর্মাল। বরং আগুন ছড়িয়ে গিয়ে এ ঘর পুড়িয়ে দেবে সমস্ত তার ফাটিয়ে, সেটাই তো স্বাভাবিক! তাই টব ফেটে যাওয়ার গল্প তিনি বলেছেন। বাকিরা খেলনা পিস্তলের বনসাই শোনান। তিনি ঘরটা পুড়ে গেছে, বলে দিয়েছেন, যেটা যে কোনও আর্টিস্টের সত্য কাজ।
নানা সময়ে নানা বিষয়ে কথা হত৷ সমাজে কেজো না হয়ে উঠতে পারার কথা বলতাম। বলতেন, কর্নার করা হচ্ছে মানে ঠিক আছিস! বলতেন, সততা আর রাগের মধ্যে গোপন আঁতাতের কথা বলেছিলেন সার্ত। নিজের লেখা লেখ। তাতে টাকা হবে না কিন্তু রেসপেক্ট পাবি। বলতেন, না লিখলে শান্তি পান না লেখক। চেষ্টা করবি রোজ লেখার। এ যুগটা স্ট্র্যাটেজিক্যাল কম্প্রোমাইজের, বারবার বলতেন। সাবেক বিপ্লবের দিন বিগত। নতুন ভাবে ভাব। নানা সভা-সমিতিতে নিয়ে যেতাম নবারুণদাকে। মাঝে মাঝে। গাড়িতে নানা প্রশ্ন করতেন, নানা হোর্ডিং দেখতে দেখতে। এটা কি? ওটা কেন? এই চ্যানেলটা আসে না কেন? একবার হঠাৎই বললেন, বাবা-মা যতদূর গেছেন, সন্তান ততদূর বা তারচেয়ে বেশি যাবে, একই পথে। মোটামুটি এই হল জীবন। আরেকবার বললেন, বেশি বড়লোকদের সাথে গলাগলি না করাই ভালো। শো-বিজে থাকতে থাকতে কখন শো-পিস হয়ে যায়, খেয়াল থাকে না। বলতেন, জীবনে এমন কোনও কাজ না করতে যার জন্য রিগ্রেট থাকে..
এরকম হাজারো উক্তি আজ আমায় ছেঁকে ধরে মাঝ রাতে। প্রোফাউন্ড। না-ছোড়। অস্বস্তিতে ফেলে। বুঝতে পারিনা কি করব। অভিশপ্ত সিসিফাস মনে হয় নিজেকে। একবার জানতে চাইলাম, থিয়েটার করলেন না কেন? বললেন, ডেডিকেটেড ছেলে পাইনি। একবার বললাম, আপনি একটু মার্ক্স পড়াবেন? বললেন, ওরে বাবা, সে পান্ডিত্য নেই আমার! অকপটেই জানাতেন, খারাপ সময়ে ভেঙে পড়েন না। লেখায় সে সময়কে ব্যবহার করেন। মানুষের অপমান নবারুণকে রাগাত। বলতেন, পায়ে সরষে ঘষলে এক রকম লাগে আর ইস্ত্রি চেপে ধরলে আরেক রকম। আজ সারা দুনিয়ায় অনুবাদ হচ্ছে নবারুণ। সারাজীবন মানুষকে নানা ভাবে সাহায্য করেছেন। বারবার ঠকে গিয়েও। আজ তাঁর আরাধ্য ঘটকের মতোই তিনি সব কিছু ছাপিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বলতেন, ইন্টারন্যাশানাল বাজলে বুলেট -ফুলেট পরোয়া করবেন না। সত্যি কিছুরই আর পরোয়া করলেন না নবারুণ।
আমায় ব্যক্তিগত ভাবে একবার একটি বই রিভিউ করতে বলেছিলেন ভাষাবন্ধনের জন্য। মিউজিক এন্ড দ্য মাইন্ড। আর্নিস্ট ফিশারের লেখা। আমি রিভিউ জমা দেবার আগেই নবারুণ মারা যান। সব গল্প শেষ না হওয়াই ভালো..
(নবারুণের জন্মদিবস উপলক্ষ্যে দীর্ঘ একমাসব্যাপী , লেখক-সাংবাদিক দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় এর নেওয়া বিভিন্ন গুণীজনের সাক্ষাৎকার, আলোচনার অংশ বিশেষ)