বহুদিনের তৃষ্ণার্ত মাটিতে বৃষ্টি ঝরাবে বলে আষাঢ় শ্রাবণ নিয়ে আসে জলভরা মেঘ। বৃষ্টি ঝরে। রুদ্ধ দ্বার খুলে বারান্দায় এসে সেই ঝরো ঝরো ধারার দিকে তাকিয়ে মন যখন একটু রোম্যান্টিক হয়ে ওঠে, তখন অবধারিত ভাবে মনে এসে যায় ভরসা জাগানো কথাগুলি, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’। দিনগুলোই তো এমন। জমে থাকা যত কথা, প্রকাশ না করতে পারা যত আবেগ আরও আস্কারা পায় দিনগুলোর কাছে। কে যেন ভিতর থেকে প্ররোচনা দেয়, বলে, বলো, বলো, তোমার অব্যক্ত যত আনন্দ আর যন্ত্রণা আছে, যত অবরুদ্ধ ঢেউ আছে সবাইকে মুক্তি দাও। ইচ্ছেমতো ভাসিয়ে দাও। প্রকৃতি এক বিশেষ বিশেষ সময়ে এই রকম উচ্ছ্বাস দাবি করে, এক এক রকম শব্দে আর সুরে তার বন্দনা শুনতে চায়। আমাদের প্রাণের সেই মানুষটি দু হাত ভরে তার আয়োজন করে দিয়ে গেছেন আমাদের জন্য। তাঁর কথাই তাই মনের মধ্যে বেজে ওঠে।
তবু সব কথা কি আর বলা যায়? কেই বা শুনবে সে সব? যে কথা শোনার জন্য মন ভাবে কেউ কান পেতে আছে, হৃদয় ভাবে কারও অকারণ টানই সেই কথার জন্ম দেয়, তার অন্তরালে কাজ করে ভালোবাসা। তা স্বার্থপরের মতো শুধু নিজেকেই নয়। তার যে অনন্ত রূপ, অনন্ত আধার! এক এক সময় এক এক ভাবে তার আবির্ভাব হয় নিজের মত করে। ভালোবাসার আষাঢ় শ্রাবণ কত যে খণ্ড খণ্ড ছবি সাজিয়ে দেয়! কোনো চাষি যখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যেও তালপাতার ছাতিতে পিঠ মাথা ঢেকে নিপুণ হাতে ধানের চারাগুলি পুঁতে চলে, তখনও সেই ছবিটি স্পষ্ট হয়। কোনো রিক্সাচালক যখন নিজের রিক্সাতেই প্লাস্টিকের ছাউনির মধ্যে বসে হয়তো বা ভিজে হাতেই একটি বিড়ি ধরিয়ে একটু জিরিয়ে নেয় পরবর্তী প্যাসেঞ্জারের অপেক্ষায়, সেটিও সেই ভালোবাসার ছবি। সবগুলোই এক ভালোবাসার টান, একটা আবর্ত, যা চিরকাল ধরে রেখেছে মানুষকে অদৃশ্য বন্ধনে।
আর ভালোবাসার ছাতা! সেও কি কিছু কম করে ভালোবাসার জন্য? ঝিরঝির বৃষ্টিতে দুজন প্রেমিক প্রেমিকা যখন একটি ছাতার নিচে ঢুকে যায়, সেই ছাতা থেকে যখন বৃষ্টির ধারা গড়িয়ে পড়ে গোল হয়ে, তখন তার মধ্যেকার জায়গাটিতে তৈরি হয়ে যায় ছোট্ট একটা ভালোবাসার পৃথিবী। সেখানে সেই দুজন ছাড়া আর কারও মাথা গলানোর অনুমতি নেই। সেখানেও সৃষ্টি হয় কথার। হয়তো তা কখনো অব্যক্ত থাকে, বাক্যহীন থাকে। তবু মনের ভাবনাটি নিঃশব্দে বুঝিয়ে বলবার কেউ থাকে। শুনবার কেউ থাকে।
কিন্তু এর বাইরেও যে কত কথা আছে! সেও তো ভালোবাসা থেকে সঞ্জাত, একরকম টান থেকেই তার উৎপত্তি। মানুষের মধ্যে, প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে উঠতে উঠতে মানুষ তো আসলে মানুষই হয়ে উঠতে চায়। তার কাছে শুধু প্রকৃতির রূপই একমাত্র আকর্ষণের নয়, জীবনের সার্বিক আনন্দ আর মঙ্গলচেতনা তাকে সামাজিক করে তোলে। হয়তো মানুষের সমাজে প্রকৃতির মতো সবকিছু উজ্জ্বল নয়, উচ্ছল নয়। প্রকৃতি নিজের হাতে সাজিয়ে দেয় যে ক্যানভাস, সেখানে তো উজ্জ্বলতা থাকবেই। স্বভাবতই তা হয়ে উঠবে রূপবতী। কিন্তু রূপের মোহেই তো সব সময় মজে থাকা যায়না। মেঘের পরে যে আরও মেঘ জমে, রূপের ঘরে জমে আরও রূপ, তেমনি দুচোখ মেলে দেখতে দেখতে মনের মধ্যে কথার উপর জমা হয় আরও অনেক কথা।
এই সময়ের আবহে তা বেড়ে গেছে অনেকগুণ। করোনার চোখ রাঙানি এবছর ভণ্ডুল করে দিয়েছে সব। না, রথের মেলা হয়নি, ঘুরে ঘুরে জিলিপি খাওয়া, বা রথ দেখা কলা বেচা কিছুই হয়নি। আরও অনেক কিছু হয়নি। ভেবেছিলাম দীর্ঘ ঘরবন্দী অবস্থায় অনেক ভুল শুধরে নেব। সারা পৃথিবী যখন একটা আতংকের কাছে এখনও প্রায় অসহায়, মরিয়া হয়ে সন্ধান করে চলেছে তা থেকে মুক্তির আলোর, তখন জীবনের আসল সমস্যাগুলো ঠিকমতো চিনে নিতে পারবো। অতিমারি যখন কিছু মূল্যবান প্রাণ কেড়ে নেয় তখন বড়ো অসহায় লাগে। মনে হয় এই জীবনগুলি আমরা ফালতু ফালতু হারালাম। এগুলি যেন অনির্ধারিত মৃত্যু। এরকম তো কথা ছিলনা। খুব আশা হয়েছিল, আগ্রাসী সংক্রমণের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ অনুভব করবে জীবন বড় অনিত্য। অহেতুক লোভ, হিংসা, মারামারি, খুন, ধর্ষণ এসবে কাজ কি! এগুলো অন্তত অতিমারির ভয়েও দূরে থাক।
কিন্তু নিজেকে শুধরে নেওয়া বোধ হয় সহজ নয়। আরও যারা দুঃসময়ে কোনো না কোনো ভাবে পাশে থাকতে পারত, তারাও কেউ কেউ সেবার চেয়ে বাণিজ্য বোঝে বেশি। সারা বিশ্বের কাছে যা দুঃসময়, কারও কারও কাছে তা যেন একটা মস্ত সুযোগ। পারস্পরিক আস্থা আর বিশ্বাসে ফাটল ধরলে বড় আঘাত লাগে।
সেই কথাগুলি মনের মধ্যে জমতে থাকে। জনজীবন যখন বিপর্যস্ত হয়ে যায়, যখন ভালোবাসার ঘরবাড়ি সমেত শেষ সম্বলটুকুও কোথাও কোথাও গ্রাস করে নেয় প্রকৃতিরই সৃষ্টি কোন ঘূর্ণিঝড় কিম্বা বেগবতী নদীর ভয়ংকর স্রোত, সেও তো জীবনের এক ট্র্যাজেডি! তখন আর রোমান্টিকতার বিলাসিতা চলেনা। তখন বাস্তুচ্যুত সর্বহারা মানুষগুলির পাশে দাঁড়ানোর দরকার হয়ে পড়ে। তাদের আটপৌরে সংসারে চাল ডাল তেল নুনের কতটা আকাল তৈরি হলো, কার পেটে আটকে থাকলো কতটা খিদে, তখন সেটাই উঁকি মেরে দেখার দরকার হয়ে পড়ে। কারও কাছে সেটা একটা ব্রত, কারও কাছে সেটাও হয়ে যায় একটা সুযোগ।
মানুষ এখন বড় উদভ্রান্ত। অতিমারির দাপটে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ভবিষ্যৎ। তাই সবার বুকেই জমা হচ্ছে অনেক আশংকা। দিশাহীন হয়ে দিন গুনছে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের। মনে অনেক রকম ভয়। তবু একজনের কাছে সাহস পাওয়া যায়। তা শুধু পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণই নয়, জীবনের যেকোনো মুহূর্তে। তিনি যে বলে গেছেন, মানুষের উপর বিশ্বাস রাখতে। সেই আপ্তবাক্য এই দুঃসময়ে আলোর সন্ধান দেয়। যারা জীবনপণ করে মানুষের জন্যই কাজ করে যাচ্ছেন এই দঃসময়ে, তাঁরা দেবতার চেয়েও মহান। সবাই তাঁদের মতো হবেন এমন নয়। তবু যদি একটু বিজ্ঞান মনস্ক হওয়া যায়, যদি ভরসা থাকে যে সামাজিক বন্ধনের টানে মানুষই মানুষের একমাত্র সহায়, তাহলে লড়াইটা সহজ হয়। অপেক্ষা একটু দীর্ঘ হতে পারে, কিন্তু এই বিশ্বাসটা থাকলে আর একটু সহমর্মিতা থাকলে এই অন্ধকার গুহা থেকে নিজেরাই ঠিক বেরিয়ে আসতে পারবো আলোর সমতলে।
°©তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়
সুচিন্তিত মতামত দিন