◆ রাহুল ঘোষ / হরিণ শিকার ও মত্ত হস্তী সমাচার

◆ রাহুল ঘোষ / হরিণ শিকার ও মত্ত হস্তী সমাচার

উইকেট পড়েছে একটা। কিন্তু সেটা এখন ডিআরএসে। অতএব উল্লাসের কিছু নেই। গ্যালারি দেখেছে আউট। অপোনেন্ট দেখেছে আউট। ফিল্ড আম্পায়াররা দেখেছেন নিশ্চিত আউট। তবু্ও ডিআরএস কেন? কারণ, ব্যাটসম্যানটি যেন ডব্লিউজি গ্রেস! আঙুল-তোলা আম্পায়ারকে যিনি বলবেন : 'ওহে, তোমার আম্পায়ারিং দেখার জন্য লোকে মাঠে আসেনি। এসেছে আমার ব্যাটিং দেখতে।  অতএব বুঝে-শুনে ডিসিশন নাও।' আম্পায়ার আর কী করবেন! তোলা আঙুল ফিরিয়ে নিলেন। বল পাঠিয়ে দিলেন থার্ড আম্পায়ারের কোর্টে। কিন্তু থার্ড আম্পায়ার যেন খিজির হায়াত। অথবা শাকুর রানা। আশির দশকে যাদের ক্রিকেটমুগ্ধ শৈশব ছিল, তারা নামদুটো জানে। ওই দুটি নামের সৌজন্যে পাকিস্তান তখন হোম-সিরিজে ১৩ জনে খেলতো। তাতে অবশ্য ইমরান খান বা জাহির আব্বাসের ক্রিকেট-মাহাত্ম্যে কোনো আঁচড় পড়েনি। নিজেদের আলোতেই তাঁরা বিশ্বসেরাদের মধ্যে ঝকঝকে। ইমরানের বোলিং অ্যাকশনের একটা মারকাটারি পোস্টারই বোধহয় আমার পড়ার টেবিলের সামনের দেওয়ালে আটকানো প্রথম ছবি! সীমানাপারের যাবতীয় শত্রুতা সত্ত্বেও আমরা তাঁদের ভক্ত ছিলাম। যেমন ওরা আমাদের সুনীল গাভাসকর বা কপিলদেব নিখাঞ্জের।

গল্প আসলে দুটো। একটা অন্যায়ভাবে হরিণ শিকারের। অন্যটা কিছু পাগলা হাতির দাপাদাপির। সেখানে ক্রিকেটের কথা কেন? আমরা যারা বড়ো হয়েও ক্রিকেটটা অল্পবিস্তর সিরিয়াসলি খেলতে চেয়েছিলাম, কারণটা তারা জানবে। ক্রিকেট শুধু একটা খেলা নয়। ইট ইজ মোর দ্যান আ গেম। জীবনের রেপ্লিকা। কখন ন্যায্য প্রাপ্য দেবে আর কখন নির্মম অবিচার, জাস্ট ধরতে পারবেন না! এইজন্যই সে গ্রেট লেভেলার। ইন দ্য লং রান, সব সমান করে দেয়। ভবিতব্যের অমোঘ ইশারায় খেলাটা একদিন হাত ছাড়িয়ে চলে গেছে। ব্যাট তুলে রেখেছি। খুলে রেখেছি যাবতীয় প্রোটেক্টিভ গিয়ার। কিন্তু ভালোবাসা খাঁটি হলে যা হয়! চলে গিয়ে, গভীর হয় আরও। তার দেওয়া শিক্ষাগুলো গভীরতর হয় বিশ্বাসে। তবে ক্রিকেটের মতো জীবনেও তো বেশ কিছু পক্ষপাতপূর্ণ বিচারক থাকে। তখন যা দেখতে হয়, এক্ষেত্রেও তাই হলো। খিজির-শাকুরসম তৃতীয় আম্পায়ারের কলকাঠি নড়লো। 'গ্রেস'-সাহেব নট আউট রইলেন। তাঁর বিদায়-সম্ভাবনায় এতক্ষণ পুলকিতজনেরা ক্ষুণ্ণ হলেন। কেউ ক্রুদ্ধ। কেউ বিরক্ত। বিষণ্ণ এবং ব্যথিতও জনাকয়েক। কেউ আবার নানারকম সার্কাজম দিয়ে উজাড় করলেন ক্ষোভ। স্বাভাবিক। সবার বহিঃপ্রকাশ তো এক হবে না! হাতের পাঁচটা আঙুলই সমান হয় না! 

এখন কথা হলো, উনি যে 'গ্রেস'-সুলভ হয়ে উঠেছিলেন, গ্রেট হয়েও উঠেছিলেন, তা কী করে সম্ভব হলো? একলহমায়? না। একদিনে? না। ওয়ান ফাইন মর্নিং, ঘুম থেকে উঠে দেখা গেল? তাও তো না! হে অন্ধ চাক্ষিকগণ, আপনারাই ওই গ্রেটনেসের নির্মাতা। পূজনীয় ভাবমূর্তির সহায়ক। কেন? তাকে খুশি রাখা গেলে, কিছু-মিছু সুবিধা মেলে বলেই তো! অস্বীকার করার উপায় আছে? এখন হাওয়ায় মোড় বদলাতেই, হঠাৎ ভীষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় কেউ-কেউ। ঠিক কীভাবে যে নিজের অবস্থান প্রকাশ করা যায়! সেটাও স্বাভাবিক। এতদিন উপলক্ষের খোঁজ ছিল। 'অমুকদা' অথবা 'তমুকদা'-র জন্মদিন? পাশাপাশি দাঁড়ানো একটা ছবি একজিবিট করা যাক। সুনজরে থাকতে চেয়েই তো? এখন হঠাৎ করে প্রতিবাদী হওয়া, খুব সহজ তো নয়! অথচ চুপ করে থাকাও চলে না। তাহলে লোকে ভাববে, নিশ্চয়ই কোনো স্বার্থ আছে। 'আলোকপ্রাপ্ত' বাঙালি মানেই এখন ফেসবুক-সর্বস্ব। এখন বাঙালি ফেসবুকের লাইক-কমেন্ট সংখ্যা দিয়ে মানুষের গুরুত্ব বিচার করে! আরে দাদা, আপনার বন্ধুতালিকাটি ৪৯৫০ জনের হলে ৩০০ লাইক তো পাবেনই! তার জন্য ৮৪০ জনের তালিকা নিয়ে যে ৭৫টি লাইক পায়, সে ছোটো হয়ে যায় নাকি! পার্সেন্টেজ কার বেশি হলো, অঙ্কটা করে দেখবেন? কিন্তু অতসব ভাবনার সময় না-থাক, সবকিছু নিয়ে ফেসবুকে কিছু-না-কিছু বলতেই হয়। না-বললে, পিছিয়ে পড়তে হয়। অতএব একবার কড়া প্রতিবাদে নাম লেখানো হলো। কয়েকটা জায়গায় মোলায়েম প্রতিবাদ হচ্ছিল। সেখানেও সায় দিয়ে আসা গেল। একবার 'ধরি মাছ, না-ছুঁই পানি'-র মধ্যপন্থায় সহমত জানানো। আবার মৃদু সন্দিহানদের সঙ্গেও গলা মেলানো। অর্থাৎ যেখানে জল যেদিকে গড়াচ্ছে, সেদিকেই নিজেকে বইয়ে দেওয়া। সবই হিসেবের খেলা, ইয়ারোঁ!

সাদা মনে কাদা থাকে না। তবুও একটা কূট প্রশ্ন বড্ড খোঁচাচ্ছে! 'পূজনীয়'টি যে এমন, আপনাদের অজানা ছিল? আচ্ছা, না-হয় বেনিফিট অফ ডাউট পেলেন। আবার ক্রিকেটীয় টার্ম এসে পড়লো! মার্জনা করবেন। সাধে কি আর জীবনের রেপ্লিকা বলেছি! এবার বলুন তো, চামড়া ও মাংসের ব্যাটিং পিচে পূজনীয়টি কি একা? আসমান সে টপক পড়া? নয় যে, তা নিশ্চয় জানেন! তাহলে বাকিদের ক্ষেত্রে এতদিন কী করলেন? চোখে ঠুলি, কানে তুলো, মুখে সেলোটেপ। ব্যস, এই তো? এর বেশি আর কী! বাকি বলতে কারা, বুঝলেন না? এইরে, এবার তো সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুটিও ঠাট্টা করবে! কথা হচ্ছে, দর-কষাকষির বাজারে এই পূজনীয়টি জাস্ট ফেঁসে গিয়েছেন। ঠিকঠাক দাম লাগিয়ে আবার সামলেও নিলেন। কিন্তু এরকম অজস্র ফাঁসযোগ্য 'পূজনীয়' ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। বহাল তবিয়তে। তাঁদের কাছেও তো বিস্তর সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ব্যাপার আছে! তাহলে কি আবার কবে কেউ স্ক্রিনশট, রেকর্ডেড কল ইত্যাদি নিয়ে আসবে, সেই অপেক্ষা? নেহাত বাধ্য হয়ে। 'সততা' প্রদর্শনের নিরলস প্রয়াসে। প্রাসঙ্গিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টায়। যতক্ষণ কেউ-না-কেউ ফাঁস করে দিচ্ছে সেইসব গূঢ় ও গোপন, ততক্ষণ চলতে থাকুক চুপচাপ, পূজনীয়দের পায়ে ভক্তির ছাপ। এই সুবিধাবাদের জন্যই বাঙালি আঁতেলেকচুয়ালদের  নিয়ে আমজনতা আজকাল মস্করা করে।

বস্তুত পৃথিবীতে পরকীয়া বলে কিছু নেই। যা আছে, সবটাই স্বকীয়া। ফিচেল লব্জে বললে, নিজকিয়া। ওইসব ফিচেল-ফাজলামি সরিয়ে রাখা যাক। আসলে, কামনা-বাসনাময় পৃথিবীতে দুটো জিনিস আছে। প্রেম আর লালসা। লাভ এবং লাস্ট। দুটোকে এক করে ফেললে, কেস খেয়ে যাবেন ভাইটু! প্রথমটি ভারী বিষম বস্তু। খুব গভীর হলে, সঙ্গে না-থাকলেও সঙ্গ ছাড়ে না! দুই বছরের চূড়ান্ত নৈকট্য একদিন ছিঁড়ে গেলে কোনো এক 'দু'দিনের প্রেমিক' আজীবনের জন্য এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। দিওয়ানগি যাকে বলে! 'হমকো কিসকে গম নে মারা, ইয়ে কহানি ফির সহি'। টাইম-স্প্যানগুলো খেয়াল করবেন। মহাকালের কাছে কিছুই না। তবুও তার এত জোর! দ্বিতীয়টিতে ওসব কোনো ঝামেলা নেই। খাও-দাও, ফুর্তি করো। সাত মহারথী হোক বা এগারো অশ্বারোহী। কোনো ইমোশনাল ব্যাগেজ নেই। রাত গ্যয়ি, বাত গ্যয়ি। আপনাদের ফেঁসে যাওয়া পূজনীয়টি আসলে দ্বিতীয় পথের পথিক। পূজনীয়রা সাধারণত ওই পথেই থাকেন। নিজের অবস্থানের সুযোগ নিয়ে পাওয়ার-প্লে করেন। ইনিও করতেন। এদিক-ওদিক হরিণশিকার তাঁদের কাছে নতুন কিছু তো নয়! যুগ-যুগ ধরে হয়ে আসছে। প্রশ্নটা এইখানে যে, হরিণেরা কি স্বেচ্ছায় ধরা দিল? নাকি পাওয়ার ইকুয়েশনের কাছে হার মেনে ধরা দিল? পূজনীয়টিকে বাঁচাতে গিয়ে যাঁরা পারলে পিঁয়াজি আর নেতাজিকে এক করে দেন, তাঁরা স্বেচ্ছাকৃতিকেই তুলে ধরবেন নিশ্চয়! কিন্তু মনের খুব গভীর থেকে তাঁরাও জানেন, ক্ষমতার 'ক্ষমতা'-ই আসলে চিরকাল হরিণদের ওই ফাঁদে পা রাখতে বাধ্য করেছে।

এই যে ক্ষমতার খেলা, সেখান থেকেই আসলে দ্বিতীয় গল্পের শুরু। যদিও গল্পটি আরও কিছু বিস্তৃতি দাবি করে। চামড়া ও মাংসের বাইশ গজ সেখানে একটি উপাদান মাত্র। আরও যে-সব উপাদান আছে, তাদের গুরুত্বও কি কম? মঞ্চ, আলো, চেয়ার, স্বীকৃতি এবং অন্যান্য পারিতোষিকের আবেদন হয়তো সবক্ষেত্রে খুব সামান্য থাকে না! এসব প্রাপ্তিযোগ বজায় রাখতে চাইলে, অনেক কিছুতেই হ্যাঁ-মেলানো জরুরি। এই ইকুয়েশনটা আমরা কেউ-কেউ বুঝি। বুঝি বলেই, স্বেচ্ছায় ওই বলয়ের বাইরে থাকতে পেরেছি। যে-কোনো কিছুর বিনিময়েই হোক, ওই চাপিয়ে দেওয়া মনোভাব সবার তো হজম হওয়ার কথা নয়! তাছাড়া কপি-পেস্ট করে যে প্রতিবাদ হয় না, প্রিয়! ওই 'ধর তক্তা মার পেরেক'-পদ্ধতির মধ্যে এমন অনেক নাম থেকে যায়, যাদের পিছনের অন্ধকার তুমি জানো না। অথবা, বুঝতে পারো না। অথবা, বুঝেও না-বোঝার ভান করো। কেন করো? আবার সেই হিসেবের খেলার কথাই চলে আসবে তো? ক্ষমতার 'ক্ষমতা'-কে সেই একইভাবে তুষ্ট রাখা। কিন্তু প্রতিটি কপি-পেস্টে ওই অন্ধকারাবৃত নামগুলোর উপস্থিতি যে প্রতিবাদটিকেই মূল্যহীন করে! প্রতিবাদকে তাই স্বাধীন হতে হয়। স্বতন্ত্র হতে হয়। যাকে বলে, স্বক্ষেত্রে স্বরাট। না-হলে প্রতিবাদের নামে প্রায়শই কিছু অন্যায়েও হ্যাঁ-মেলাতে হয়। অনেক গা-জোয়ারিকে না-দেখার ভান করে, সরে আসতে হয়। পিছনে সরতে-সরতে একদিন হিট উইকেট হয়ে গেলে কী হয়? দেখুন, আমি ক্রিকেট লিখবো না ভাবলেও, ক্রিকেট আমার লেখাকে অধিকার করে থাকে! হিট উইকেট হয়ে গেলে, সালিশি মানানোর জন্য কোনো ধলোদাদা অথবা কেলোখুড়োকে ডেকে আনতে হয়!

গল্পটা তাই শুধু ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়ের নয়। গল্পটা কমলবনে মত্ত হস্তীর দাপাদাপিরও। এই যারা দলবেঁধে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অরণ্যে। কোথাও গাছ ভাঙছে, কোথাও ফুল ছিঁড়ছে; এরা কারা? একে হুমকি দিচ্ছে, তাকে ধমকি। কারা থাকতে পারবে অরণ্যে। কাদের থাকতে দেওয়া হবে না। কে কী পরবে। কে কী বলবে। সব ঠিক করে দেবে ওই মত্ত হস্তীযূথ। এসব তো আসলে তাদের পার্সোনাল স্কোর সেটল করার উদ্যোগ! এও কি একরকমের অবৈধ শিকারকাহিনি নয়? এরা কি সবাই এই অরণ্যেরই বাসিন্দা? তা কিন্তু নয়! এদের মধ্যে অনেক অনধিকারীও আছে। অরণ্যের ক্ষমতালিপ্সুদের হাত করে, অরণ্যে ঢুকে পড়ে জোর বাড়িয়েছে তারা। বড়ো জঙ্গলে ডেকে নিয়ে বাঘ-সিংহ বানিয়ে দেওয়ার টোপ খাইয়ে, হাতে রেখেছে দূরদূরান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অজস্র বাঁশবনের শিয়ালরাজাদের। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত বিদ্বেষের ফসল তোলার জন্য ব্যবহার করছে অন্যদের। কে দিল তাদের এমন স্বঘোষিত অধিকার? ক্ষমতার অশালীন আস্ফালনই তো! কোথা থেকে এল এই শক্তিমত্ততা? ক্ষমতার গুডবুকে থেকেই তো! অরণ্যের আকাশের রঙ কোনোদিন আবার পাল্টালে, এই মত্ত হস্তীযূথ অন্যত্র আত্মগোপন করবে। অথবা আকাশের রঙে বদলে নেবে নিজেদের। এও তো জানা কথা! সময়ের সঙ্গে অনেক কিছুই তো পাল্টায়! যেমন, সেদিনের ইমরান যদি আজকের 'উজির-এ-আজম ইমরান খান' হতো? যে কিনা নিজের গদি শক্ত করার নির্লজ্জ তাগিদে ভারতের ভূখণ্ডকে নিজেদের ম্যাপে দেখায়! তার ছবি কি আমার দেওয়ালে জায়গা পেত? কিছুতেই না! আবার বিপরীতটাও থাকে। খিজির হায়াত ও শাকুর রানা-র রেখে যাওয়া কালো দাগ অনেক পরে মুছে ফেলতে পেরেছে ওদের আম্পায়ারিং। সৌজন্যে আসাদ রউফ ও আলিম দার। যোগ্য ও নিরপেক্ষ দুই আম্পায়ার। কিন্তু কমলবনে পাগলা হাতিদের এই বিধ্বংসী কালো দাগ আরও কতদিন পরে, মুছে দেবে কে?

©রাহুল ঘোষ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

সুচিন্তিত মতামত দিন