বাতিল নিঃশ্বাসের স্বর

পাঠ প্রতিক্রিয়া /   পুরুষোত্তম সিংহ
বারে বারে আমায় বাতিল বলে ডেকো না
কীভাবে পড়ব আমরা উপন্যাস, এ প্রশ্ন আজ বড় হয়ে উঠেছে। তা কি নিছকই ভাতঘুমের বাটিকা না জীবনের অনুসন্ধান। জীবন জিজ্ঞাসার আত্মমন্থন। সাহিত্য যখন বিনোদন সর্বস্ব পণ্যায়নের দিকে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে তখন কোন জিজ্ঞাসার তত্ত্ব খুঁজবো ? উপন্যাস পাঠ নিছকই সময় কাটানো না বড় বোধে উপনীত হওয়া ? পাঠকের দৈনত্য, সংকীর্ণবোধকে জাগিয়ে দেওয়ার কোন দায়িত্ব কি লেখকের নেই ! লেখক নিজের মর্জি অনুসারে লিখবেন সেটাই স্বাভাবিক। পাঠক পড়তে গিয়ে বহু প্রশ্নের মুখে পড়বেন, এমন তো ভাবিনি বা এমন ভাবেও ভাবা যেতে পারে। এখানেই লেখকের সঙ্গে পাঠকের ব্যবধান। যিনি ভাবাতে পারেন না সে লেখকের সঙ্গে পাঠকের কোন ব্যবধান নেই, সে লেখক ও পাঠক সমশ্রেণির। আর কতদিন আমরা সমান্তরাল উপন্যাস পড়ব, আর কতদিন একই কাহিনির পুনরাবৃত্তি শুনতে হবে। বাঙালি মধ্যবিত্ত পাঠক কবে বেরিয়ে আসবে গোলকধাঁধা থেকে, চিনে নেবে প্রকৃত কথাকারকে। অলোক গোস্বামীর মতো লেখকরা কবে সর্বজনীন পাঠকের পাঠ্য হয়ে উঠবে এ বড় সংশয়ের বিষয়। কিন্তু এ সংশয় কাটিয়ে না উঠতে পারলে বাংলা উপন্যাস আরও বড় সংশয়ের মুখে পরে যাবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এ সংশয় কাটিয়ে তোলার দায়িত্ব কে নেবে ? পাঠককেই নিতে হবে। পুনঃপাঠের মধ্য দিয়ে জেনে নিতে হবে প্রকৃত কথাকারকে। বিকল্প বয়ন লিখে চলেছেন অলোক গোস্বামী নব্বই এর দশক থেকে।  

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘লেখকের সমস্যা’ প্রবন্ধে জানিয়েছিলেন যিনি ক্রমাগত লিখছেন তাঁর লেখায় একই কাহিনির পুনরাবৃত্তি বারবার ঘটতে বাধ্য। এই পুনরাবৃত্তি যিনি ঘটাতে চান না, তার লেখার পরিমাণ স্বল্প। অলোক গোস্বামী পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চাননি বলেই লেখার পরিমাণ স্বল্প। অলোক গোস্বামীর সাহিত্যে পাঠেই সচেতন পাঠক সে সম্পর্কে অবগত থাকবেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘বাতিল নিঃশ্বাসের স্বর’ ( ২০০৫ ), দ্বিতীয় পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে ‘ভিকি পাবলিশার্স’( গুয়াহাটি ) থেকে। আমরা আলোচনায় দ্বিতীয় সংস্করণের পাঠ গ্রহণ করেছি। উপন্যাসের পশ্চাৎপটে বলা লেখকের বক্তব্য পাঠকের ধারণা গড়ে তুলতে জরুরি মনে হয়েছে বলে এখানে তুলে ধরা গেল –

‘’এ আখ্যান মূলত তেমনই কিছু ব্যর্থ মানুষদের জীবনচরিত। যারা সফল মানুষদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেনি। মুখ বুজে সব অবিচার সয়ে মেনে নিয়েছে নির্বাসন দণ্ড। জীবনের প্রতি তীব্র ভালোবাসার কারণে মৃত্যুকে ঘৃণা করেছে। অন্যায় দণ্ডাদেশ মাথা পেতে মেনে নিয়ে সভ্যতা থেকে অনেক দূরে সরে গিয়ে গঠন করেছে নিজস্ব সমাজ। বাতিল মানুষের সমাজ। নিজেদের মতো করে খুঁজে নিতে চেয়েছে জীবনের অর্থ। প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে স্বাধীনতার প্রকৃত তাৎপর্য। কিন্তু সভ্যতার ইতিহাস তো মূলত অসভ্যতারই নামান্তর। আমাদের লোভ কি একদিন সেই কল্পিত সমাজটাকেও চুরমার করে দিয়ে মানুষগুলোকে ফের পাঠিয়ে দেবেনা অনির্দিষ্টের পথে ?’’ 

কেন বদলে দিলেন প্রথম সংস্করণ। এক দশকে যেহেতু সঙ্ঘ ভেঙে যায়, তাঁর ভাবনা চিন্তাও পাল্টে গেছে। একজন সচেতন লেখক বারবার নিজের পাঠ পাল্টে ফেলেন। তা ধুয়ে মুছে সম্পূর্ণ থেকে সম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলেন। যেহেতু কবি বলেছেন কবিই কাব্যের শ্রেষ্ঠ সমালোচক, তাই পাঠকের ওপর তাঁর বিশ্বাস নেই। নিজেই নিজের অপূর্ণতা খুঁজে বার করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আখ্যানের কাঠামোটা তো পাল্টানো সম্ভব নয়, তাই তার ঘসা মাজা করেছেন। তিনি মনে করেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লেখাটি আজও হয়নি, তাই একজন অক্ষরকর্মী হিসেবে সে চেষ্টা করে চলেছেন। তাঁর চিন্তার স্তর বারবার পাল্টে যাচ্ছে, একই চরিত্র নিয়ে তিনি বারবার ভাবছেন ফলে এই বদল ঘটে যাচ্ছে। আমরা নিশ্চিত এ উপন্যাসের যদি তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় সেখানেও হয়ত দেখবো কিছু বদল ঘটে গেছে। ‘আসর বন্দনা’ অংশে উত্তর আধুনিক আখ্যান বয়ন গড়ে তোলার আভাস পাই। নিজের সঙ্গে পাঠককেও স্বাগতম জানান। তবে পাঠককে স্বাধীনতাও দিয়েছেন। পাঠক লেখক থেকে বিচ্যুত হয়ে স্বাধীনভাবেই যেতে পারে। কিন্তু যেটা জোরের সঙ্গে জানিয়েছেন তা হল এ আখ্যান শুরুর পর পাঠকের মুক্তি নেই। উপন্যাস শেষে এ প্রশ্ন আরও প্রবল আকার ধারণ করে। বহু প্রশ্নের মুখে পাঠককে দাঁড় করিয়ে বিদায় নেন। সাহিত্য যখন বিনোদন নির্ভর, বিজ্ঞাপন নির্ভর, জনরুচিকে সামনে রেখে বা জনরুচিকে গ্রাস করতে আধিপত্য বিস্তার করছে তখন মনে হয় আছে, আছে এখনও আলো আছে।

পুরুষোত্তম সিংহ

প্রতিটি লেখককেই একটা বিন্দু থেকে শুরু করতে হয়। তিনি একটি চরিত্র বা ঘটনার বিশেষ বিন্দু থেকে শুরু করতে চান। কিন্তু তার আগেও অনেক ঘটনা থাকে, চরিত্রের অনেক পটভূমি থাকে। লেখক যেহেতু সে ঘটনার কথা বলেন না তাই আমাদের জানার প্রয়োজন হয়না। কিন্তু একটি বা একাধিক ঘটনা যে থাকে তা অস্বীকারের কোন পরিসর নেই। এ উপন্যাস শুরু হচ্ছে তপন মল্লিক বা তপুর হাঁটার মধ্য দিয়ে। আসলে উপন্যাসও তো এক যাত্রা। বলা ভালো আলোর সন্ধানে যাত্রা। মনে পড়ে কমলকুমার মজুমদারের ‘অন্তর্জলী যাত্রা’  উপন্যাসের প্রথম বাক্য –‘আলো ক্রমে আসিতেছে’। লেখক তো পাঠককে আলোর সন্ধানেই নিয়ে যেতে চান। তপু হেঁটে চলেছে। লেখক একটি বিন্দু থেকে তপুর হাঁটাকে ধরেছেন। কেননা লেখক জানেন ‘প্রত্যেকটা শুরুরই একটা ইতিহাস থাকে।‘ তত্ত্ব আমাদের শিখিয়েছে উপন্যাসের শেষ বিন্দু থেকেই পাঠককের পথ চলা শুরু। এবার পাঠক নিজের মনে অনুরণন তুলবেন তার পাঠ প্রতিক্রয়া নিয়ে। লেখকের সঙ্গে নিজের ভাববিশ্বের মিল অমিল নিয়ে। জীবনের যেহেতু শেষ নেই, জীবন সম্পর্কে যেহেতু লেখকের ভাবনার শেষ নেই, কিন্তু উপন্যাস তো নির্দিষ্ট বন্ধনে আবদ্ধ। ফলে লেখকেও একটা জায়গায় এসে থেমে যেতে হয়। এই থামাই কিন্তু শেষ নয়, এখান থেকেই লেখক আবার ভিন্ন উপন্যাস শুরু করতে পারেন, পাঠকও ভিন্ন পরিসরে যেতে পারেন। তাই ‘শেষ কথাডা বলবে কেডা’ পরিচ্ছেদের বয়নে পাই –

‘’হয়তো নিছকই হাঁটার আনন্দে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়ায়, একটু বিশ্রাম নিতে গিয়ে কোথাও একটা পৌঁছে যাবে। বিশ্রাম নেয়া শেষ হলে ফের হাঁটতে শুরু করবে। ফের বিরতি নেবে। ফের হাঁটবে। অর্থাৎ কিনা যে দৃশ্যটার মারফৎ আমরা এই আখ্যান শুরু করছি সেটা যেমন আদৌ শুরু নয়, তেমনই যে দৃশ্যটাকে আমরা আখ্যানের শেষ বলে ভাববো সেটাও আদৌ শেষ হবেনা। হয়তো শুরুও বলা যেতে পারে !’’

এই যে শেষ ও শুরুর তত্ত্ব তা আবার লেখক উদাহরণ সহযোগে ব্যাখ্যা করে দেখান। আপাত ভাবে আমরা যা শেষ বা শুরু বলি সে ধারণা যে কত ভুল তা প্রতিপন্ন করেন। আমরা সাল তারিখের বিভাজন রেখা দ্বারা শেষ বা শুরু ঘোষণা করি। এ ধারণা যে নিছকই ভ্রান্ত তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন ধরুন- ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ভারতচন্দ্রের মৃত্যুতে মধ্যযুগের অবসান। কিন্তু তারপরেও মধ্যযুগের সাহিত্যের নিদর্শন আমরা পাব। রবীন্দ্রনাথ তো বলেছিলেন –আধুনিকতা মর্জি নিয়ে, সময় নিয়ে নয়। অথচ সময়পর্বে আমরা বিশ্বাসী। লেখকও ব্যঙ্গ করে লেখেন –‘’মধ্যযুগের শেষ করে আধুনিক যুগ শুরু করতে সময় লেগেছে এক সেকেন্ডের থেকে খানিকটা বেশী।‘’ অলোক গোস্বামীর লেখার মূল শক্তি ব্যঙ্গের পারদ। গোটা সমাজ ব্যবস্থার সমস্ত সিস্টেমটাই যে বুজরুকিতন্ত্রের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তার মর্মমূলে তিনি আঘাত করেন। রাষ্ট্র, মিডিয়া সাধারণ মানুষকে কীভাবে প্রতারিত করছে, মেকি বুদ্ধিজীবী কীভাবে টিকে রয়েছে তার স্বরূপ প্রকাশ পেয়ে যায়। এই স্বরূপ সাধারণ মানুষের চোখে ধরা পড়েনা, লেখক দূরদর্শী বলেই তা উপলব্ধি করতে পারেন। আখ্যান তো চক্রাকারে বিবর্তিত হয় তাই আপাতত শেষ বলে কোন নির্দিষ্ট শেষ নেই। যিনি সস্তা প্রেমের নাটক লিখতে বসবেন তিনি হয়ত মেলোড্রামা বা ট্র্যাজেডি করে শেষ করবেন। কিন্তু যে লেখক সময়, জীবন সম্পর্কে বহু জিজ্ঞাসা নিয়ে আখ্যান রচনা করবেন তার শেষ নেই। ফলে এ আখ্যানেরও শেষ নেই। আপাত বাতিল বলে যে মানুষগুলিকে আমরা বর্জিত করছি তারা বাতিল নয়। সময়ের রন্ধ্র থেকে সে কণ্ঠগুলিও সাড়া জাগায়। কেন্দ্র থেকে বিচ্যুত হয়ে প্রান্তে পড়ে থাকে, কিন্তু সে মানুষগুলিও জীবনের স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন বোনে, সেই বাতিল কিছু মানুষ এ আখ্যানে রয়েছে।
        
টাকা সর্বস্ব মানুষ। এ যেন টাকা ধর্ম টাকা কর্ম টাকা হি পরমতপঃ। টাকাই শ্রেণির জন্ম দিয়েছে। মানুষের মানবিক বোধ, মূল্যবোধ, শুভচিন্তাগুলি ধ্বংস করে দিয়েছে। সভ্যতার আদি লগ্নে ছিল বিনিময় প্রথা তখন শ্রেণিবিভাজন প্রবল না হলেও টাকার জন্ম থেকেই তা প্রবল আকার ধারণ করে। টাকা ধ্বংস করে দিয়েছে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে। শিক্ষকের আদর্শ বলে আজ কিছু নেই। তেমনি লেখক যৌনতার ট্যাবুগুলি ভেঙে দেন। এ উপন্যাসের কাহিনি যত এগিয়ে গেছে তিনি যৌনতার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। যৌনতাকে নন্দনততত্ত্বের জায়গায় নিয়ে গেছেন। যৌনতা সর্ম্পকে আমাদের যে বিরূপ ধারণা সেগুলি ভেঙে যায় অলোক গোস্বামীর সাহিত্য পাঠে। যৌনতাকে অস্বীকার করে আমরা চোরাবালিতে ডুবে থাকি, কিন্তু জীবনের ক্ষেত্রে যৌনতা অনিবার্য, তা অস্বীকারের কোন জায়গা নেই। সেই ট্যাবুগুলি তিনি ভেঙে দেন। স্যার আনতে বলেছিল জীবন বিজ্ঞান বই, তপু স্যারের ব্যাগ থেকে নিয়ে আসে ‘জীবন যৌবন’ বই। কেননা সেখানে অন্য কোন বই ছিলনা। এ অপরাধে শিক্ষক তপুকে উপমা দিয়েছিলেন ‘ছারপোকা’। সেই বেকার তপু আজ গৃহশিক্ষক। চাকরি নেই ফলে শিক্ষিত যুবকদের এ পথ বেছে নেওয়া ছাড়া ভিন্ন উপায় নেই। তপুর মুখে একটা ব্রোন হয়েছে, যাকে লেখক বলেছেন ‘পোঁচ’। এই পোঁচের সন্ধানেই কৈশোর থেকে যৌবনে প্রবেশের রহস্য লেখক উন্মোচন করেন ও যৌনতার লক্ষণগুলি স্পষ্ট করেন। তেমনি রয়েছে সময়, সংস্কৃতি পরিবর্তনের চিত্র। শহরের বুকে গড়ে উঠেছে বহু বিউটি পার্লার, জেন্টস পার্লার। সনাতন শীলদের ‘জয়গুরু সেলুন’ হারিয়ে যাচ্ছে, সনাতনরা হয়ে যাচ্ছে বাতিল মানুষ। তেমনি আছে ক্লাব সংস্কৃতি। রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের প্রয়োজনে এই ক্লাবগুলি ব্যবহার করে। ‘অদ্ভুত আঁধার’ উপন্যাসে দেখেছিলাম উদ্বাস্তু কলোনিতে  কীভাবে নতুন ক্লাব গড়ে উঠেছিল। এ উপন্যাসে ক্লাব ছিলই কিন্তু তার প্রেসিডেন্ট বদল হয়েছে। তপুর প্রয়োজন ছিল চাকরি। সে মুখে বলতে পারেনি, তাই জুটেছে একটি টিউশনি। প্রেসিডেন্টের কন্যা জয়িতাকে পড়ানোর দায়িত্ব। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থা কীভাবে পাল্টে যাচ্ছে, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কোন বৃত্তে এসে উপস্থিত হয়েছে লেখকের দৃষ্টি সেদিকে। তেমনি বাতিল মানুষের যেন কোন মূল্য নেই, গৃহশিক্ষকের যেন কোন মূল্য নেই। সত্যি তো আমরা গৃহশিক্ষকদের কথা ভাবিনি। এই লকডাউনের দিনগুলিতে এ উপন্যাস যখন পড়ছি এ প্রসঙ্গগুলো চেতনায় আরও প্রবলভাবে নাড়া দিচ্ছে। তেমনি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছাত্রছাত্রীরা কোন সংস্কৃতিই শেখেনি। আদর্শ, শ্রদ্ধা বলতে কিছু নেই। কেন-ই বা থাকবে, যাঁর পিতা রাজনৈতিক দলের নেতা, যিনি মানুষকে মানুষ বলে বিশ্বাস করেনা, সে পরিবারে কোন মূল্যবোধ গড়ে উঠবে ? লেখক ব্যঙ্গবানে সে বিষয়গুলি তুলে ধরেন –

‘’মেয়ে হিসেবে জয়িতা মায়ের কিছুই পায়নি, না রূপ, না গুণ। বরং বাপের ধারাটাই পেয়েছিল। একেই বড়লোকের মেয়ে তায় পড়াশোনায় ভালো হওয়ার অহঙ্কার ছিল ষোল আনা। তার সঙ্গে ছিলো নেতা নেতা হাবভাব। নাহলে ছাত্রী কখনও শিক্ষকের ইন্টারভিউ নেয় ?

--কি বলে ডাকবো তোমায় ?
প্রশ্নটা শুনে হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারেনি তপু।
--কী আবার বলবে, স্যার বলবে !
-যাঃ, স্যারদের তো ভুঁড়ি থাকে, পাকা চুল থাকে, ধুতি পাঞ্জাবী পরে থপথপিয়ে হাঁটে। তোমার তো এসবের কোনোটাই নেই। বরং একটু কেষ্ট ঠাকুর মার্কা লুক আছে তোমার। হাতে একটা বাঁশী ধরিয়ে দিলেই দেয়ালে ফিট করে দেয়া যাবে।‘’

অলোক গোস্বামী আখ্যানে প্রথমে ঘটনা সৃষ্টি করেন। পাঠককে জানিয়ে দেন এই ঘটনা ঘটেছে। তারপর সেই ঘটনার কার্য, কারণ, কেন ঘটেছে, সে ঘটনায় কারা কারা যুক্ত তা অনুসন্ধান করেন। জয়িতাকে পড়ানো বন্ধ হয়ে গেছে তপুর। হাত থেকে বেরিয়ে গেছে তিনশো টাকা। কিন্তু কেন বন্ধ হয়ে গেল পড়ানো ? সে কারণে জানা যাবে শিক্ষক সুলভ দায়িত্ব, আদর্শ দেখাতে গিয়েই তা বন্ধ হল। লেখকের লক্ষ্য শিক্ষা ব্যবস্থা কীভাবে ভেঙে যাচ্ছে সেদিকে। ‘অদ্ভুত আঁধার’ উপন্যাসে ছিল নিম্নবিত্ত সমাজের শিক্ষার চিত্র, এ উপন্যাসে উচ্চবিত্ত সমাজের শিক্ষার চিত্র। শিক্ষার মধ্য দিয়েই অভিজ্ঞতা লাভ হয়। এই ‘শিক্ষা’ ও ‘অভিজ্ঞতা’ শব্দদুটিকে দ্বিবাচনিক পরিসরে নিয়ে যান লেখক। তপু শিক্ষার মধ্য দিয়ে জীবনের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। এমনকি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সে বড় শিক্ষা পেয়েছে। উচ্চবিত্তের সন্তানের পড়াশোনা ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা যে অন্যায় তা সে বুঝেছে। তেমনি শুভ্রজ্যোতির কাছে বারবার অপমানিত হতে হয়েছে। শুভ্রজ্যোতিরা কোন শিক্ষাই নেয়নি। কোন শিক্ষাই বা নেবে, যেখানে শিক্ষায় কোন আদর্শ, বিশ্বাস নেই। নষ্ট প্রজন্মের ছাত্র শুভ্রজ্যোতিরা। আর তা নষ্ট করেছে অর্থ ও রাজনীতির ক্ষমতা। তাই ‘লেবুর যত্ন নিন’ পরিচ্ছেদ হয়ে ওঠে নষ্ট সময়ের ভাষ্য। পড়ানো ছাড়া শিক্ষকের কোন দায়িত্ব নেই। পাঠ্য বইয়ের বাইরে কোন জ্ঞান দেবার প্রয়োজন নেই। কেননা লেবু বেশি টিপলে তা তেতো হয়ে যায়। মুন্নীর সুযোগ তপুই করে দিয়েছিল। লেখক ক্লাব সংস্কৃতিকে বড় করে তোলেন। কেননা ক্লাবেই থাকে সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন বাতিলদের আড্ডা। সবুজ সংঘের বেশির ভাগ যুব সদস্য ‘বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো ছেলেদের নিয়ে’। তবে ক্লাব মানেই যে সব মন্দ তা নয়। মুন্নীর সুযোগ ঘটেছিল ক্লাবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকেই। আসলে এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি যৌনতার বহিরাবরণ গুলি উন্মোচন করে দেন। মানুষের অবদমিত কামনা, মুখে আমরা যতই সভ্য দাবি করিনা কেন, ভিতরের যে চেতনা তা প্রকাশ হয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট সুধাংশু প্রথমে সভ্য সংস্কৃতির কথা বললেও তাঁর যৌনচেতনা প্রকাশ হয়ে গেছে। প্রতিটি ক্লাবই অবৈধ কাজের সঙ্গে যেমন যুক্ত তেমনি প্রতি ক্ষেত্রেই মানুষকে প্রতারণার স্বীকার হতে হয়। বিশেষ করে পূজা, সাংস্কৃতিক উৎসবের বিষয়গুলিতে। লেখক সেদিকেও নজর দেন –

‘’তুমাদের কেলাব টাকা মারে। ম্যালা টাকা পাই। আইজ দিবো কাইল দিবো কইরা ঘুরায় শুদু। একেই তো রঙের পইসা, ম্যাহনত পুরা জলে, তার উপারে দোকান বনদো রাইখা যুদি তুমাদের পায়ে ত্যাল মাখাইতে হয়, তাইলে এক্কেরে হাতে লন্ঠন পোঙায় বাশ।‘’

খবরের কাগজের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ছিল। কিন্তু সে শ্রদ্ধা ধীরে ধীরে রসাতলে গেছে। সমাজের চালচিত্রের মধ্যে প্রতিপদক্ষেপে যে বুজরুকিতন্ত্র, নষ্টামি যা আপাত ভাবে চোখে পড়ে না বা জানলেও লিপিবদ্ধ করতে চান না তা তিনি স্পষ্ট করে তোলেন। উপন্যাসে একটা বড় পরিসর জুড়ে আছে যৌন সংস্কৃতি। শুভ্রজ্যোতি, সুধাংশু, তপু, বীথিদি কেউই এর বাইরে নয়। আসলে সে চেতনাকে আমরা অস্বীকার করে ভুলে থাকি। তবে গ্রামের মেয়েরা এভাবেই প্রতারিত হয়ে চলেছে। মুন্নী নিজে শিল্পী হতে গিয়ে সুধাংশুদের হাতে পড়েছে। সংস্কৃতি বদলে যাচ্ছে। ক্লাবের যুবকরা ব্যঙ্গ করছে সুধাংশুকে। কিন্তু ক্ষমতাই যেখানে শেষ কথা, যৌনতা উপভোগের ক্ষমতাও তার হাতে। আসলে রাজনীতির সংস্কৃতিতে এটাই হয়। ‘শিল্পীরা কখনো বেইমান হয়না’ –এই বক্তব্যে তিনি ব্যঙ্গ হাসি হাসেন। একজন শিল্পীর কোথায় দায়বদ্ধতা ছিল আর শিল্পী কোন দায়বদ্ধতা পালন করেছে। এক গোস্বামী প্রবলভাবে রাজনৈতিক সচেতন হয়ে রাষ্ট্র, মিডিয়ার প্রকৃত রহস্য উন্মোচন করে দিচ্ছেন, অন্য গোস্বামী ক্ষমতার অলিন্দে থেকে, ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রের পক্ষে সাওয়াল করছেন। রাষ্ট্র যেখানে নিজেই অত্যাচারী, তার পক্ষে সাওয়াল করা কবির ওপর কোন ভরসা রাখবো ? আধুনিক প্রজন্মের ষড় গোস্বামীর বড় গোস্বামী (১৯৫৪) জয়ের পতাকা নিয়ে শাসকের পাশে অবস্থান করছেন আর ছোট গোস্বামী (১৯৬২) আজও আলোর সন্ধান করে যাচ্ছেন। শিল্পীর মধ্যে আবার প্রভেদ আছে –বড় শিল্পী, ছোট শিল্পী। ছোট শিল্পীর কোন দায়বদ্ধতা নেই, সে সামান্য দোকান করে ছবি এঁকে সংসার চালায়। কিন্তু প্রকৃত শিল্পীর দায়বদ্ধতা অনেকখানি, সে দায়বদ্ধতা ভুলে ক্ষমতার অলিন্দে সে প্রবেশ করেছে।
                    
তপুর কৈশোর থেকে যৌবনে প্রবেশে যৌনসত্তাগুলির কীভাবে পরিবর্তন ঘটল তা লেখক আমাদের দেখান। তপু, বীথিদি সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা জগৎ গড়ে নিয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে সমাজের মূল স্রোত থেকে এঁদের বিচ্ছিন্ন করল কে? বিজয় বোসরা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে বীথিকে। তবে যৌনসত্তাগুলিকে বিচ্ছিন্ন করা যায়নি। বীথিদি নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছে। নিজের অন্তরের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেও বাঁচতে চেয়েছে। অলোক গোস্বামীর চরিত্রগুলি রক্ত মাংস সহ জীবন্ত হয়ে ওঠে। জীবনের ওপর স্তর অতিক্রম করে তিনি গভীরে প্রবেশ করেন। বীথি যেভাবে নিজের আকাঙ্ক্ষার কথা প্রকাশ করেছে তাঁতে লেখকের মুন্সীয়ানা প্রশংসনীয়। কৈশোরে তপু ‘পেট খসানো’ অর্থ বুঝতো না, বীথির যৌন আবেদনকে অস্বীকার করেছে, যৌবনে সেই আবার বীথিকে পেতে চেয়েছে। যদিও বীথি তখন যৌবন পেরিয়ে গেছে, তবুও অস্বীকার করতে পারেনি। তিনি সবসময় বিপরীত আখ্যান নির্মাণ করে চলেন। তাঁর ভিখারীরাও ব্যঙ্গ করে, মজা করে। জীবনের মূল স্রোত থেকে বিচ্যুত মানুষের সত্তার কথা তিনি বলতে চেয়েছেন।
                        
ধ্রুপদী সংগীতের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে জীবনমুখী গান। মার্কেটে জীবনমুখী গান ভীষণ জনপ্রিয়। সেই জীবনমুখী গানের মধ্যে যে কত বিচ্যুতি, ভণ্ডামি তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রচুর জমির মালিক সুধাংশু গ্রামের নাম পাল্টে ফেলেছে। ক্ষমতা ঐতিহ্যকে কীভাবে ধ্বংস করে দেয় তা আমরা দেখি। পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিতেও দেখবো একটি সরকারের বিদায়ে নতুন সরকারের আগমনে নাম পরিবর্তনের ইঙ্গিত। আখ্যানের চোরাস্রোতে তিনি সচেতন ভাবে সমাজ বিবর্তনের চিত্র গুলি এঁকে চলেন। রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে তা করেন। সুধাংশু গ্রামের নাম পাল্টে নিজের স্ত্রীর নামে করেছে। অথচ জানিয়েছে গ্রামবাসীর ইচ্ছায় পরিবর্তন। এভাবেই ইতিহাস পাল্টে যায়। নব্য স্রোতে হারিয়ে যায় প্রকৃত ইতিহাস। জীবনে যৌনতা সত্য। সেই যৌনতার নন্দনতত্ত্বই তিনি বারবার গড়ে তোলেন। তবে নিছক যৌনতার কাহিনি নয় বরং সমাজ দংশন, সমাজের সমগ্র চালচিত্রের পাশাপাশি সমান্তরাল ভাবে যৌনতা থাকে। মানুষ আপাতভাবে যা ভুলে থাকে, ভুলে থাকার ভান করে তা তিনি স্পষ্ট করে দেন। তপুর বাল্য বন্ধু কালু, সেও বর্জিত মানুষ। সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে না পেরেই সে বিকল্প পথ গড়ে নিয়েছে। বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে দংশন করে তেমনি সমাজের উচ্চবিত্ত সর্বদা নিম্নবিত্তকে শোষণ করে। প্রত্যকেই চক্রাকার পথে সবাইকে শোষণ করতে চায়। তাই উপন্যাসে পাই –‘’আরশোলার কামড়েও বিষ আছে, টিকটিকির কামড়েও আছে।‘’ হোটেল ও পানশালায় যে যৌনতার বিজ্ঞাপন তাও দেখি। আসলে মানুষের রুচিবোধ পাল্টে যাচ্ছে। তেমনি ঐতিহ্যগুলিকে বিকৃত করে দেওয়া হচ্ছে। মদের নাম ‘রাম’, যে ছিল রামায়ণের নায়ক।
 
কালু নিজের ব্যবসায় নিয়ে এসেছে তপুকে। অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যবসা, দালালি করে সে। কালুরা কেন এ পথ বেছে নিল তার উৎস সন্ধানে গেছেন লেখক। অর্থনীতির সমস্ত  মুনাফা এক শ্রেণির হাতে, ফলে গরিব মানুষ বিকল্প পথ হিসেবে চোরা কারবার বেছে নেয়। তপু, কালুরা হয়ে যায় ছারপোকা, গুবরে পোকা। তাঁরা খুলে বসেছে প্রভা এন্টারপ্রাইজ। শুধু শহর নয় গ্রামেও কীভাবে এই এন্টারপ্রাইজগুলি গড়ে উঠছে তা দেখি। সংস্কৃতি নিয়ে ব্যঙ্গ করেন। তেমনি আছে লেখকদের প্রতি ব্যঙ্গ। শহরের লেখক গ্রামে এসেছেন আখ্যানের প্লট খোঁজে। একজন গ্রামে থাকা ভূমিপুত্র লেখক ও শহরে বড় হওয়া লেখকের গ্রাম নিয়ে কাহিনি গঠনের মধ্যে বহু প্রার্থক্য। সৈকত রক্ষিতের মনে হয়েছিল ‘অতিথি লেখক’। সত্তর দশক থেকে চালু হয়েছিল গ্রাম নিয়ে লেখার রীতি। কিন্তু নগর থেকে গ্রামকে দেখার যে প্রার্থক্য তা স্পষ্ট করে দেন। স্বপ্ননীল এসেছে গ্রামের প্লটের খোঁজে। গ্রামের মানুষ প্লট মানে বোঝে জমির ভাগ। সে ভুল করেছে তপু। জমির ফসল ভাগের যে বিবর্তন তাও দেখি। তেভাগা থেকে বামফ্রন্ট আমলে চারভাগ হয়ে তৃণমূল সরকারে এসে তা বহুভাগে পরিণত হয়েছে। লেখক স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতেই ব্যঙ্গবানে তা ফুটিয়ে তোলেন। স্বপ্ননীলের প্লট খোঁজা নিয়ে তপুর মনে নানা সংশয়, সন্দেহ দেখা দেয়। লেখক নয়টি সংশয় উল্লেখ করেছেন। আমরা দুটি উল্লেখ করব –

৬.’’ধরা যাক ফরেন কোম্পানি পছন্দ করলো কিন্তু মিস্টার পাঠক হুমড়ি খেয়ে পড়লেন না, তখন?’’
৭. ‘’শেকড় দিয়ে কি নেশার ওষুধ বানাবেন স্বপ্ননীল রায়, যে মিস্টার পাঠক হুমড়ি খেয়ে পড়বেন ?’’

পাঠক-লেখক-আখ্যান-প্লটকে তিনি ভেঙে দিলেন। পাঠকের যেমন বিবিধ স্তর, তেমনি বিবিধ ভূগোল। একজন পাঠক কেমন আখ্যান পছন্দ করেন ? যে আখ্যান লেখক গড়ে তুললেন সে জীবনের সঙ্গে পাঠকের কতখানি পরিচয় ? জীবনের সঙ্গে পরিচয় না থাকায় লেখকের আখ্যানকে মনে হয় সুন্দর। কিন্তু যে পাঠক নিম্নবিত্ত জীবনে সংগ্রাম করে বড় হচ্ছে, সেই ভূগোলের কথাই লেখক যখন আবেগ সর্বস্ব হয়ে লেখেন তা সেই পাঠকের কাছে রোমান্স হয়ে দাঁড়ায়। স্বপ্ননীলের প্লট সন্ধানেই তপু উপস্থিত হয়েছে বীথিদির কাছে। কৈশোরে যে তপু বীথিদির যৌন আবেদনকে অস্বীকার করেছিল সেই আজ যৌবনে পৌঁছেছে, মুখে ব্রোন হয়েছে। বাতিল মানুষ বীথিদি নিজস্ব স্থান খুঁজে নিয়েছেন। যা লোকালয় থেকে বহু দূরে। গ্রামের মানুষ ভালোবাসে শহরকে, শহরের মানুষ গ্রামকে। তবে বীথি গ্রামের নাম জানায়নি। হয়ত নিজেই জানে না। লেখকের ব্যঙ্গ এখানেও –‘’নাম নেই এমন কোনো দেশ আজকের দুনিয়ায় আছে নাকি ? বরং এখন তো নাম বদলে নতুন নাম রাখার রেওয়াজ চালু হয়েছে।‘’ তবে বীথিদি জানিয়েছে গ্রামের নাম ‘স্তপায়াইল’ বলে ডাকা যেতে পারে। উপন্যাসের শেষে আমরা দেখবো এ শব্দের অর্থ ‘স্টপ অ্যা হোয়াইল’ বা ‘সাময়িক বিশ্রাম’। উপন্যাসও যেন সাময়িক জীবনের চিত্র। লেখক পাঠকককে সাময়িকের জন্য বেঁধে রাখেন। কিন্তু তার চিন্তা ও ব্যাপ্তির পরিসয় দীর্ঘ।
          
তিনি যেন ভাষাহীন মানুষের ভাষানগর গড়ে তুলতে চেয়েছেন। কিন্তু ভাষাও কীভাবে পাল্টে যাচ্ছে। মিডিয়া, বিজ্ঞাপন ভাষা পাল্টে দিতে বাধ্য করছে। সংবাদ ঘোষক যখন ভাষার মধ্য কিছু হিন্দি, ইংরেজি শব্দ প্রবেশ করিয়ে বাংলা ভাষাকে বিকৃত করে দিচ্ছে তখন কোন ভাষা মানুষ শিখবে ! তেমনি আছে বানানবিধি। লেখকের ব্যঙ্গ এখানেও- ভাষাবিদরা বানান বদলাতে পারলেও ভাষা বদলাতে পারেনা। বানান নিয়ে খেলা যায় কিন্তু ভাষা নিয়ে খেলা যাবেনা। মাতৃদুগ্ধ সমান মাতৃভাষা নিয়ে খেলতে গেলে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হতে পারে। অথচ ভাষাটাই হয়ে গেছে জগাখিচুরি। তপু বেশ কিছু শব্দ পূর্বে শোনেনি। বীথিও বাতিল জীবনে বেশ কিছু ভিন্ন শব্দ প্রয়োগ করেছে। সভ্য সমাজে যে শব্দগুলো শোনা যায়না। আসলে সমাজের ব্যবধানে, পরিসরের ব্যবধানে ভাষা ও সংস্কৃতি যে পাল্টে যায় লেখক তা দেখান। এই ভাষা সন্ত্রাস অবিরত চলছে। তেমনি রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট কোন ভাষা নেই। রাষ্ট্র জানে ক্ষমতার ভাষা। সেই ক্ষমতা দ্বারাই প্রান্তিক মানুষকে বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়। বীথিদি’র বয়ানে পাই –‘’রাষ্ট্র আমাদের কোন দায়িত্বটা নিয়েছে ? তাছাড়া রাষ্ট্রের কোনো আলাদা ভাষা আছে নাকি ! পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের ভাষা তো একটাই। অত্যাচারের ভাষা।‘’ প্রান্তিক মানুষ, বর্জিত মানুষ, বাতিল মানুষের কোনো দায়িত্ব যখন রাষ্ট্র নেয়না, তাই সেখানে রাষ্ট্রের ভাষা চলতে পারেনা। এই মানুষগুলো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারেনা ঠিকই, কিন্তু অন্তরে কি প্রতিবাদ নেই। অবশ্যই আছে। উপন্যাসের মধ্যে সমান্তরাল কাহিনির বদলে রাষ্ট্র, সময়, সমাজ সম্পর্কে বিভিন্ন জিজ্ঞাসা কোন কোন পাঠকের হয়ত ভালো লাগবে না। মিস্টার পাঠকদের হয়ত এমন আখ্যান ভালো লাগবে না। মিস্টার পাঠকরা তো জানেন গ্রাম মানে – শান্ত সুনিবিড় ছোট ছোট গ্রামগুলি। কিন্তু গ্রামের মধ্যে যে কত বীভৎস চিত্র বিদ্যমান তা লেখক জানেন। শহরের লেখকরা, স্বপ্ননীলের মতো লেখকরা হয়ত এমন প্লট পেয়ে শহরে গিয়ে উপন্যাস লিখে বা সংবাদপত্রে লিখে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। কিন্তু বীথি, তপুরা যেখানে ছিল সে পরিসরেই থেকে যাবে। ক্ষমতার ভাষা মানুষকে কীভাবে ভাষাহীন করে তোলে লেখকের দৃষ্টি সেদিকে। তাঁর আখ্যান প্রবল ভাবে বিশ্লেষণধর্মী। ফলে নেরেটিভে বারবার পরিবর্তন আনেন। তেমনি চরিত্রের মুখে আঞ্চলিক সংলাপ রেখে উপন্যাসকে ভিন্ন পরিসরে নিয়ে যান। অর্থনীতির যে চাহিদা-জোগান-বাজারতত্ত্ব তা মিলিয়ে দেন নারীর সঙ্গে। যৌবন থাকলে নারীর দাম থাকে বাজারে। কিন্তু যৌবন অতিবাহিত হতেই বীথিরা বর্জিত হয়ে গেছে।             
   
‘দুঃস্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে যে বিস্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ পরিচ্ছেদ সময়, পরিবেশের ভাষ্য হয়ে ওঠে। যে দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে আজকের মানুষ সহ সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে ব্যঙ্গ করেন। মানুষ ক্রমেই অরণ্য ধ্বংস, নদীগ্রাস করে বিপন্ন পরিবেশ গড়ে তুলছে। নদীতীরে যে সভ্যতা একদিন গড়ে উঠেছিল, মানুষ নিজের ক্ষুধা মেটাতে তা ধ্বংস করে চলেছে। নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা বলতে আমরা যা বুঝি তা বহুদিন আগেই হারিয়ে গেছে, মানুষ নিজের প্রয়োজনে নদীর সর্বনাশ ডেকে এনেছে। জলের অপর নাম জীবন, কিন্তু এখানে জল নেই তাই জীবনও নেই। বর্জিত, বাতিল মানুষের কোন জীবন থাকবে ? বীথির বয়ানে পাই –’জীবনভর শুধু পতন’। সেই পতনের আখ্যান এ উপন্যাস। তেমনি সে পতনের জন্য কারা দায়ী তাও লেখক সচেতন ভাবে দেখিয়ে দেন। জীবিকার সঙ্গে ভাষা সংস্কৃতিও পাল্টে যায়। বলা ভালো পরিস্তিতি মানুষকে ভিন্ন ভাষা আয়ত্ত করতে বাধ্য করে। বাতিল মানুষের কাছে স্বপ্ন, স্মৃতি বলে কিছু নেই। সবই যেন দুঃস্বপ্ন, বিস্মৃতি। কথা, সুর, ভাষা নিয়েই গড়ে ওঠে গান। সুরের আগে যেহেতু ভাষার জন্ম, কথার জন্ম, আর বাতিল মানুষের জীবনে যেহেতু কোন সুর নেই তাই তাদের গান বোঝা যায়না। সভ্য মানুষ আজ আদিম যুগের কাহিনি লিখতে চেয়েছে, গ্রামীণ পটভূমিতে আখ্যান গড়তে চেয়েছে। কিন্তু সে নির্মাণে যে কত ফাঁকি তা লেখক জানেন। বীথির বয়ানে পাই-‘’দিব্যি রসে বশে আছো, আর সুযোগ মত আদিম সাজছো। তোমাদের ধান্দাবাজী ধরে ফেলেছি।‘’ বাতিল মানুষগুলির জীবন ধন্দে ভারা। কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক তাঁরা জানেনা। তবে এই মানুষগুলো ধান্দাবাজ নয়। এ মানুষগুলোরও আবেগ আছে কিন্তু সে আবেগ মানুষের কাছে প্রকাশ করতে চায়না। মিডিয়ার সামনে আবেগ প্রকাশ করে জনপ্রিয় হতে চায়না। বীথিদির যৌবন আজ অতিক্রান্ত। তপু আজ যৌবনে পৌঁছেছে। তপুর যৌনসত্তাগুলি আজ জেগে উঠলেও, বীথির আগুন নিভে গেছে। অথচ তপুর যৌন মিথ গড়ে উঠেছে বীথিকে সামনে রেখেই। তাই সে বারবার বীথিকেই পেতে চেয়েছে। যৌনতার ট্যাবুকে ভেঙে দেন ‘কে যেন গো ডেকেছে তোমায়’ পরিচ্ছেদে। নারী পুরুষের কামনা যে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত, সমান চাহিদা, সমান আকাঙ্ক্ষা তা স্পষ্ট বীথির বক্তব্যে –

‘’দু পা দুদিকে সরিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘’নারে, আমি কিচ্ছু মনে করিনি। শরীরের প্রতি শরীরের আকাঙ্ক্ষা থাকাটাই স্বাভাবিক। নারী আর পুরুষকে প্রকৃতি সেভাবেই তৈরি করেছে যাতে দুজনে দুজনের পরিপূরক হয়ে উঠতে পারে। যৌনতা যদি এক তরফা হয় তবে সেটা ব্যাভিচার। যেহেতু যৌনতা এক স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া তাই দুজনের ভূমিকা এবং মর্যাদা সমান সমান হওয়া উচিত। একমাত্র তাতেই যৌন কর্ম লালসার ফাঁদ কেটে রোদ-জল-আকাশ-বাতাসে মতো ঝলমলিয়ে উঠতে পারবে।‘’

প্রান্তিক মানুষ, বর্জিত মানুষ, ধর্ষিত মানুষ, অসহায় মানুষের ভাষ্য তিনি নির্মাণ করে চলেন। এ প্লট নিয়েই স্বপ্ননীলরা হয়ত বিখ্যাত লেখক হয়ে যাবে আর এ গ্রাম তেমনই থেকে যাবে। মানুষ যেহেতু ক্ষমতার দলদাস, নিজের শক্তি অনুসার ক্ষমতা দখল করতে চায় তাই তপু ভেবেছে গ্রামের নাম পাল্টে ‘তপনপুর’ বা ‘বীথিপুর’ করা যেতে পারে। বাতিল মানুষের নিজস্ব কোন গ্রাম নেই, রাষ্ট্র নেই। তাঁরা যেন রাষ্ট্রের বিচ্যুত অংশ। তাই তাদের গ্রামের নাম মানচিত্রে থাকতে পারেনা। রাষ্ট্রের অংশ থেকে, সমাজ থেকে বিচ্যুত হয়ে এঁরা বাতিল মানুষে পরিণত হয়েছে। বীথির বয়ানে পাই –‘’মানুষ নামের যোগ্যতা হারিয়েই তো আজ আমরা এখানে আস্তানা গাড়তে বাধ্য হয়েছি। এটা স্বর্গ নয়। তাহলে আমাদের এখানে ঠাঁই জুটতো না। তা বলে, নরকও নয়। বরং বলতে পারিস, বাতল নিঃশ্বাসের শেষ আশ্রয়। এখানে সবকিছু বেখাপ্পা।‘’ অনুভূতিহীন পুরুষ শুধুই নারী ভোগ করতে চায়। সে রহস্য জালে জড়িয়ে নারীরা বাতিল হয়ে যায়। যেমন হয়েছিল বীথি। তেমনি পুরুষের সব নারী পছন্দ নয়, নারীরও। তপু অন্য নারীকে মেনে নিতে পারেনি, তাঁর কামনা বীথিকেই। বাতিল মেয়ে হয়ে যায় ‘মেয়েছেলে’। পুরুষ ভোগে সুখ পায়, ভোগ করে হাসে। সেই হাসিই নারীর রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। বীথিরা অভিশাপ দেয় পুরুষকে।
                                
শ্রমজীবীর তত্ত্ব, দর্শন, মার্কস সব একাকার হয়ে যায় উপন্যাসের অন্তিমে। নারী ভোগে বা মিলনে কোন তত্ত্ব প্রযোজ্য নয়। অলোক গোস্বামীর লেখার মূল থিম হল রাজনীতি, যৌনতা ও মৃত্যু। তিনি নায়ককে মৃত্যুপুরীতে নিয়ে যান, মৃত্যুর প্রেক্ষাপট তৈরি করে ফিরিয়ে আনেন। বাতিল মানুষের জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার। এখানে চাঁদ ওঠেনা। চাঁদের সৌন্দর্য দর্শনে এখানে কেউ জেগে থাকেনা। চাঁদ এখানে সুকান্তের কবিতার মতো ‘ঝলসানো রুটি’। তবে সূর্য আসে, কিন্তু কতদিন আসবে তার নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। তপুর মৃত্যুচেতনা, বীথির মনস্তত্ত্ব, সুর হারিয়ে নিছক কথা, যা জীবনের বড় বড় জিজ্ঞাসায় পৌঁছে দেয় আমাদের তা নিয়ে লেখক অন্তিমে পৌঁছে যান।
                                                  
এ উপন্যাসের আপাত শেষ বলে কিছু নেই। যেহেতু একটি নির্দিষ্ট পরিসরে লেখককে থামতে হবে তাই থেমেছেম। উপন্যাসের শুরুতেই তিনি যেহেতু পাঠককে বিরক্ত হবেন না –এমন প্রত্যাশা দিয়েছিলেন তাই থেমে যেতে হয়েছে। জীবনের শেষ কোথায় ? আমাদের জানা নেই। কবির সেই যে –পথের শেষ কোথায় । শেষে কী আছে আমাদের জানা নেই। তবে অনেকগুলি প্রশ্ন আছে। তিনি পাঠককে আনন্দ দিতে চাননি বরং অনেকগুলি প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন, যার কোনো উত্তর নেই। তবে তা যে ভিত্তিহীন তা নয়। আসলে এও এক জানিনা। উপন্যাসের বয়নে পাই –

‘’এরপর ঠিক কি ঘটেছিল ? জানিনা। তপু কি পুড়ে মরেছিল ? জানিনা। যদি জীবিত দশায় ফিরে থাকতে পারে তবে কে ফেরার রাস্তা চিনিয়ে দিয়েছিল ? জানিনা। কীভাবে সে এরপর মেয়েটাকে জব্দ করেছিল ? জানিনা। শেষ পর্যন্ত বীথিদির সঙ্গে দেখা হয়েছিল কীনা ? জানিনা। যদি হয়ে থাকে তাহলে কীভাবে বিদায় নিয়েছিল তার কাছ থেকে ? জানিনা। বিদায়বেলায় কী বলেছিল বীথিদি ? জানিনা।‘’

এক অন্তহীন প্রশ্নের মুখোমুখি তিনি পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেন। যে উত্তর খুঁজে দেওয়ার দায়িত্ব লেখকের নেই। লেখকের ভাষ্য অনুসারে এ উত্তরগুলি তপু জানে। কিন্তু তপুকে তো এখন বিদায় নিতে হবে। ফেল উত্তরগুলি খুঁজে চলতে হবে পাঠককে। সভ্যতা মানে প্রগতি, আলো। কিন্তু প্রদীপের আলোর নিচে যে অন্ধকার তা রাষ্ট্র দেখতে পায়না, সে সন্ধান একমাত্র লেখক জানেন। সভ্যতা প্রগতির গর্ব নিয়ে এগিয়ে চলেছে। সেখানে বাতিল মানুষের কোন স্থান নেই। কিন্তু বাতিল মানুষেরও যে জীবন থাকতে পারে, জীবনবীণা থাকতে পারে তার সন্ধান লেখক জানেন। দেশের সমগ্র ইতিবৃত্ত জানতে হয় একজন লেখককে। দেশের সম্পূর্ণ চালচিত্র জানতে হয়। দুই-তিনদিন ভ্রমণে গিয়ে দেশকে জানা সম্ভব নয়। এক আত্মজিজ্ঞাসয় তিনি সমাপ্ত ঘোষণা করেন। পাঠককে সাময়িক বিশ্রাম দেন। আখ্যানের শেষ বলে কিছু নেই। তেমনি শেষ দৃশ্য বলেও কিছু নেই। সেখান থেকেই আবার যেন শুরু করা যেতে পারে। উপন্যাসের বয়নে পাই –

‘’কেউ যেন দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটাকে এই আখ্যানের শেষদৃশ্য না মনে করেন। তার কারণ যে শুধু ‘অশেষ’ শব্দটার মধ্যেই ‘শেষ’ আছে, তা নয়। আরও একটা কারণ, ‘স্তুপয়াইল’ শব্দটাকে তো আমরা ‘’স্টপ অ্যা হোয়াইল’’ ভেবে নিতেই পারি। যে কথাটার অর্থ সাময়িক বিশ্রাম। আর সাময়িক বিশ্রামের পর্ব তো একদিন শেষ হয় ! হতেই হয়। সুতরাং প্রশ্ন ওঠে, তারপর কোথায় যাবে এখানকার মানুষগুলো ? ফের মূল স্রোতে ফিরে যাবে ? অনুমতি পাবে ? ওরকম অদ্ভুত ভাষা, অদ্ভুত আচরণ, অদ্ভুত সংস্কৃতি মেনে নেবে আধুনিক মানুষ ! না মানাটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে কি করবে এরা ! আরও কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের খোঁজে হাঁটবে ? সেই জায়গাটাও কি সাময়িক বিশ্রামস্থল হিসেবে বিবেচনা করা হবে ! এভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে শুধু অগম্য স্থান খুঁজে বেরাবে ওরা।‘’

এসব প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। যেহেতু উত্তর জানা নেই তাই দেখে যাওয়া ছাড়া পরিত্রাণ নেই। আর দেখে যাওয়ার যেহেতু শেষ নেই তাই থামতেই হবে। সে দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জীবনের সুখের স্রোতে ভেসে যেতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হল উপন্যাস পাঠ শেষে সে জীবন কি ভুলে থাকা যায় ? বাতিল মানুষগুলি কি কোন বোধে আমাদের নিয়ে যায় না ? সেই বোধে, চেতনায় লেখক আমাদের নিয়ে গেছেন।
           
অত্যন্ত সচেতন ভাবেই তিনি এ আখ্যান পরিকল্পনা করেছেন। জীবনের রন্ধ্র থেকে একাধিক প্রশ্ন উত্থাপন করে এক জীবন জিজ্ঞাসায় উপনীত হয়েছেন। সে পরিক্রমায় নিজের স্বভাবভঙ্গিতে ব্যঙ্গ করেছেন। যৌনতার মিথগুলি ভেঙে দিয়েছেন। বাতিল বলে ঘোষণা করা মানুষগুলি যে নিছকই বাতিল নয়, তাদের জীবন আছে, জীবনভাবনা আছে, যৌনতা আছে সেই বোধে আমাদের নিয়ে যান। এমনকি সে স্বর বহুস্বরে পৌঁছে যায়। তপুরা হয়ে ওঠে বিভ্রান্ত সময়ের প্রতিনিধি। যে সময়ে রাষ্ট্র সমস্ত বাতিল বলে ঘোষণা করতে বদ্ধ পরিকর তখনই লেখক তপুদের স্বর তুলে ধরেছেন। ঘটনা অপেক্ষা বিশ্লেষণ, কাহিনি অপেক্ষা সামাজিক বিবর্তনে তিনি বিশেষ নজর দেন। সামাজিক বিবর্তনের চালচিত্র থেকেই তাঁর পাত্র-পাত্রীরা উঠে আসে, কথা বলে। তিনি নির্মমভাবে তা প্রত্যক্ষ করেন, আমাদের দেখান। কোনো আবেগ বা রোমান্স নয়, তাঁর চরিত্ররা ভয়ানক ভাবে সময় সচেতন। সময়, সভ্যতার বুকে আঘাত করেই নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়। আসলে সেগুলি লেখকরই বক্তব্য, তিনি নিজে না বলে আখ্যান গড়েন, চরিত্রের মুখ দিয়ে বলান। আপাত ভাবে বাতিল মানুষগুলিকে আমরা কোনভাবেই বাতিল বলে ঘোষণা করতে পারিনা। রাষ্ট্র, সমাজ বাতিল বলে ঘোষণা করলেও তাদের নির্দিষ্ট পরিসর আছে। ভিন্ন ভূগোল, ভাষা, সংস্কৃতি, চালচিত্র আছে। সেই ভিন্ন জীবনবোধের সন্ধান করেছেন লেখক এ উপন্যাসে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.