আলিঙ্গন দাও রানি

পুরুষোত্তম সিংহ , আলিঙ্গন দাও রানী

সংস্কৃতি সংস্কৃতি ঐতিহ্যের প্রতি তোমার মন নাই রাষ্ট্র
               
বাঙালি সংস্কৃতির ভিত্তিমূল কোন সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত? উত্তরে বলতে হয় নির্দিষ্ট কোন সত্য নেই। তবে সেই ভিত্তিমূল যে বাঙালিয়ানা ও ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বাস তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। সেই ভিত্তিমূলে প্রথম কুঠারাঘাত করল ইংরেজ। ইংরেজ শাসনে সংস্কৃতি তো ধ্বংস হলই, তবুও যেটুকু ছিল স্বাধীনতার পর আমরা নিজেরাই তা ধ্বংস করতে উদ্যোত হয়েছি। একবিংশ শতকে এসে সে ধ্বংসবীণা আরও প্রবল ভাবে বেজে উঠেছে। জ্ঞান, মেধা যেখানে জুয়ার আসরে রূপান্তরিত হয়েছে ( কৌন বনেগা ক্রোড়পতি ), ক্রিকেট যেখানে নিলজ্জহীন পোশাকের বিজ্ঞাপন, প্রতি চ্যানেলে যৌনতার নানা সাজসজ্জা, ও সরঞ্জামের চোখ ধাঁধানো দৃশ্যসজ্জা, পূজা মণ্ডপে হিন্দি গানের অবিরাম বর্ষণ, বিসর্জনে ভোজপুরি সংগীতের সঙ্গে উচ্ছৃঙ্খল নৃত্য, লোকসংগীতকে বিকৃত করে আধুনিক যন্ত্র সহযোগে রুচিমুখর করে তোলা –এই পরিমণ্ডলে নবীন শিশু সংস্কৃতি বলতে কী বুঝবে ? হাসান আজিজুল হক যে গভীর বেদনা থেকে লিখেছিলেন ‘সংস্কৃতি, কী আছে তোমার পেটিকায়’ এর উত্তর খুঁজতে আমাদের যেতে হবে রবীন্দ্রনাথের তোতাপাখির কাছে। তোতাপাখির পেটের ভিতর থেকে যেমন কিছু শুকনো পুঁথি পাওয়া গিয়েছিল তেমনি আধুনিক বাঙালির পেটের ভিতর থেকে সংস্কৃতির স্বরূপ বলতে কিছু শুকনো পুঁথি বা প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা পাওয়া যাবে। কিন্তু তেমন তো হওয়ার কথা ছিলনা। ফ্ল্যাট কালচারে আমরা সব হারিয়ে ফেললাম। পাল্টে গেল রুচিবোধ। সংস্কৃতির স্থান দখল করল অপসংস্কৃতি। পণ্যায়ন ও বিজ্ঞাপনের দৌলতে অপসংস্কৃতিকেই সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দেওয়ার রীতি প্রচলিত হল। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’ গ্রন্থে গভীর আক্ষেপ করে লিখেছেন –

‘’কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের যাঁরা বিশুদ্ধ কিংবা সংস্কৃতিচর্চার জন্য প্রাণপাত করে চলেছেন, নিম্নবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী তো দূরের কথা, সাধারণ ও আরোগ্যপিপাসু মধ্যবিত্তের মধ্যে তাঁরাও কি কোনোরকম সাড়া জাগাতে পারছেন ? সৃজনশীল শিল্পীর হাতে সংস্কৃতির সৌন্দর্যময় ও উদ্দীপ্ত প্রকাশ ঘটবার কথা। কিন্তু সংস্কৃতিচর্চার যে-সংগঠিত প্রকাশ শিল্প- সাহিত্যের মাধ্যমগুলোতে দেখি তা দিনদিন নির্জীব ও একঘেয়ে অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে ; কী সাহিত্যে কী চালচ্চিত্রে কী সংগীতে কেবল পানসে ও নিস্প্রাণ পুনরাবৃত্তি চলছে।‘’ ( তদেব. পৃ. ২৭ )

সেই ‘পানস’ ও ‘নিস্প্রাণ’ সংস্কৃতির মূলে জল সিঞ্চন করেছেন কথাকার মধুময় পাল। শুধু জল সিঞ্চনই নয় গল্পে তা লালন-পালন করেছেন। কিন্তু ঝড়ে ও মনুষ্য হস্তক্ষেপে বৃক্ষের যেমন অঙ্গবিচ্যুতি ঘটে তেমনি বাঙালি নামক বৃক্ষের দেহ থেকে সংস্কৃতির অঙ্গচ্ছেদ ঘটে যাচ্ছে। তিনি তা গভীর ভাবে ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন আখ্যানে। কিন্তু কর্পোরেটের পুঁজি, রাষ্ট্র ও মিডিয়ার দম্ভের কাছে একজন গল্পকারের শক্তি কতটুকু ! তিনি নিজেও জানেন সে শক্তির কথা, তবুও মননে ও চেতনে তা লালিত করে চলেছেন। একদিকে সংস্কৃতির অবক্ষয় অন্যদিকে প্রাণপনে সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার অভিপ্রায় – এই দুই সেতুবন্ধের মাঝে মধুময় পালের গল্পভুবন।

বাস্তবের এক রুদ্ধশ্বাস নিয়ে উপস্থিত হন ‘কমরেড, নবযুগ কোথায় ‘ গল্পে। বাস্তবের প্রতিবদেনগুলিকে ভেঙে দেন। বাস্তবের ভিতর থেকে এক আঁকড়া বাস্তব বের করে নিয়ে আসেন। শাসন ব্যবস্থা, শাসন ও শোষকের প্রকৃত চিত্র দেখিয়ে দেন। এ সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যে নিছকই হাস্যকর, যে সত্যবদ্ধ প্রতিবাদে অংশ নেয় তাঁকেই ধ্বংস করে দেয় সরকার সহ ইউনিয়ান। এক মেকি নির্ভর সমাজ ও সময়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্র সহ মানুষ। সেখানে আদর্শ বলে কোন ধারণা নেই। রাষ্ট্র সহ ট্রেড ইউনিয়ান, পার্টি সব কিছুই এক ভ্রান্ত ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। অথচ সেই ভ্রান্ত ধারণাকেই মানুষের কাছে আদর্শ বলে চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সেই মোহিনীমায়ায় আত্মসিদ্ধ মানুষ নিজের বোধ বিবেক ভুলে স্রোতে গা ভাসিয়েছে সত্য কিন্তু কেউ কেউ তো প্রতিবাদ করে। সে প্রতিবাদ করেছে এ গল্পের প্রবোধ, ও তাঁর উত্তরাধিকারীরা – সন্তান ও নাতি – নীলু, বাপ্পা। সবাইকে নিঃস্ব হতে হয়েছে। শাসন ব্যবস্থার সব কিছু মেনে নিতে না পারায় প্রবোধের বদলির নির্দেশ এলে সে চাকরি ছেড়ে দেয়, কিন্তু নীলু, বাপ্পাকে রাষ্ট্র হত্যা করেছে। রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র, শোষণতন্ত্র, ধনতন্ত্রনির্ভর সমাজ কাঠামো, জনগণকে মূল্যহীন করে সর্বস্ব লুঠ করে নেবার যে কায়েমিতন্ত্র, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে রাষ্ট্র কণ্ঠরোধ করে দেয়। রাষ্ট্র মানেই আদর্শ ধারণা। কিন্তু আমরা জানি রাষ্ট্রের আদর্শের মধ্যে কত ঘুণধরা মাকড়সার জাল বিদ্যমান। রাষ্ট্র কখনোই নিজের ভুল স্বীকার করেনা, বরং জনগণের ভুল ধরিয়ে দেয়। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে নিঃস্ব করে দেওয়া হয়। যেমন করে দেওয়া হয়েছে প্রবোধের পরিবারকে। এমনকি সুভদ্রা যে সামান্য স্কুল চালিয়ে সংসার বাঁচিয়ে রেখেছিল, তা বন্ধ করে দেবার চক্রান্ত চলছে। আসলে আদর্শের মৃত্যু ঘটাতেই এই কায়েমিতন্ত্র। সুভাষ মুখোপাধ্যায় যে নবযুগ আনার ডাক দিয়েছিলেন সে যুগের সন্ধান আজ পাওয়া সম্ভব নয়। যে নবযুগ আনার জন্য সেদিন যুবকরা ঘর ছেড়েছিল, তা আসেনি, আসা সম্ভবও নয়। কেননা আজ আদর্শ বলে কোন ধারণা নেই, সবাই লুটে খেতে ব্যস্ত। গণতন্ত্র, রাষ্ট্রতন্ত্র, ট্রেড ইউনিয়ান, রাজনৈতিক দলের আদর্শ, বুদ্ধিজীবীর কার্যকলাপ আজ সবই ভিত্তিহীন। অথচ এঁরাই রাষ্ট্রকে আজ সঠিক পথ নির্ধারণের দায়িত্বে আছে। সে পথ যে কত ভুল তা লেখক অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপন্ন করেন। সেই শোষণতন্ত্র ও কায়েমিরাজের বিরুদ্ধে নিজের আদর্শকে বাঁচিয়ে রেখেছে প্রবোধ। সেই শোষিত মানুষের ভাষ্য বুনে চলেন এ গল্পে –

‘’একটা বিপন্নতা ধূসর ধোঁয়ার মতো অনিলার ভেতর জমছিল সেই দুপুর থেকে. প্রবোধ হেরে গেলে তাদের বাঁচা অসম্ভব, বউমা যে যুদ্ধটা করেছে তা তো প্রবোধেরই পরম্পরা, এ পরিবারে কেউ হারে না, মরে যেতে পারে, হারে না, ওদের বেঁচে থাকা এই না-হারার মধ্যে, খোকা মরেও বেঁচে থাকে, তার সন্তান বনে যায়, পিতা উত্তরাধিকারে, এ এক অন্য রামায়ণ, শাসকের গাথা নয়, শাসিতের।‘’ ( আখ্যান পঞ্চাশ, আত্মজা পাবলিশার্স, প্রথম প্রকাশ ২০২০, পৃ. ১৮৭ )

এই বিশ্বাস, আদর্শবোধকে সামনে রেখে প্রবোধ আজ বেঁচে আছে। কিন্তু এই আদর্শের মূল্য কোথায় ? সবাই যদি আদর্শ, বিশ্বাসকে সামনে রেখে এগিয়ে যেত, সরকারের কার্যকলাপের প্রতিবাদ করত তবে বুঝি নবযুগ আসতো। কিন্তু মধ্যবিত্ত উটপাখির মতো আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করতে ক্রমে অগ্রসর হয়েছে। সেই আত্মস্বার্থে বিবেকহীন হয়ে অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেছে। রাষ্ট্র, সরকার, কারখানার মালিকদের মিথ্যাগুলিকে সত্য বলে মনে করে গোটা সমাজ ব্যবস্থাটাকেই জীর্ণ করে তুলেছে। এখানে প্রবোধদের মতো ব্যক্তিমানুষের প্রতিবাদ ভিত্তিহীন হয়ে দাঁড়ায় । তবে সমস্তটাই যে ভিত্তিহীন তা বলা যাচ্ছে না, তাহলে রাষ্ট্র তাঁদের পঙ্গু করে দিতে অগ্রসর হল কেন ? আসলে প্রবোধদের লড়াই চাঁদ সদাগরের মতো ব্যক্তি মানুষের লড়াই। আদর্শকে সামনে রেখে চিরকাল লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত। গল্পকার সমাজের ভিতরে প্রবেশ করে সমগ্র সমাজটাই যে ভিত্তিহীন বাস্তবের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তার মর্মমূলে আঘাত করেন। পাঠককে দেখিয়ে দেন কোন আদর্শের ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্র এগিয়ে যাচ্ছে।
                        
একজন প্রকৃত লেখক তো সময়ের রন্ধ্রে জমে থাকা ক্ষতগুলিকেই চিহ্নিত করে যাবেন। রাষ্ট্র যেখানে নিজেই নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন সেখানে লেখককের দায়িত্ব যেন আরও বেশি। যদিও ছদ্মবাস্তবতা নিয়ে লেখার আজ অভাব নেই। প্রতিষ্ঠান সেই ছদ্মবাস্তবতাকেই প্রকৃত বাস্তবতা বলে চালাতে চাইছে পাঠককের কাছে। পাঠক কতদিন সেই ছদ্মবাস্তবতাকে ভুলে থাকবে ! পাঠক রুচি নামক ইউপোটিয়াকে ধ্বংস করে দিয়ে বিকল্প বাস্তব হিসেবে ছদ্মবাস্তবকেই পাঠকের মজ্জায় ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সেই স্রোতের বিরুদ্ধে কিছু কথক আজও দাঁড়িয়ে আছেন। মধুময় পাল লিখেছেন ‘মনসার গান অথবা অনুপ্রবেশ’ গল্প। দেশভাগ, অনুপ্রবেশ ও এনাআরসির ধারণাকে মিলিয়ে দিয়েছেন মনসার গানের সঙ্গে, মনসার গানের কথক ঠাকুরের সঙ্গে। অনবদ্য ক্যানভাসে দেশভাগের সত্য, মানুষের নিপীড়ন, রাষ্ট্রের অত্যাচারকে তুলে ধরেন। ট্রিটমেন্টের বিচারে গল্পটি অসামান্য। আসলে এক ভয়ংকর সত্যকে ফুটিয়ে তুলতে লেখক এই প্রন্থার আশ্রয় নিয়েছেন। মনসার বাসর ঘরে কালনাগিনীর প্রবেশও তো অনুপ্রবেশ। সময়ের বিবর্তনে মনসার গানের ভাষ্য পাল্টে গেছে। লোকশ্রুতি, লোককথা এভাবেই বিনির্মিত হতে হতে কাল থেকে কালান্তরে এগিয়ে যায়। সেই পালাগানের কাহিনিকে সামনে রেখে লেখক এক আঁকড়া বাস্তবতাকে আমাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন। মনসার গান যে শ্রোতারা মনযোগ দিয়ে বহুকাল আগে শুনতো, আজকের শ্রোতা সেখান থেকেই প্রশ্ন করেছে। আসলে অন্ধবিশ্বাস পাল্টে যাচ্ছে, মানুষের চেতনা প্রসারিত হচ্ছে। রাষ্ট্রের সব ধারণাকে মানুষ মেনে নিতে পারছে না। গল্পের বয়নে পাই –‘’শ্রোতাদের সমর্থন পায় হেন্তালের লাঠি। জবরদস্তি কেন ? কে কাকে পুজো করবে, সেটা মানুষের অধিকার। চাপিয়ে দেবে কেন ? চাপিয়ে দিতে ভয় দেখাবে ? হেনস্থা করবে ? মিলন কথক যখন বলে, চলো চলো সাধুরাজা, আছি তব সাথে / হেন্তালের লাঠি হব চরম সাক্ষাতে। শ্রোতারাও গেয়ে ওঠে, চলো চলো সাধুরাজা।‘’ ( তদেব, পৃ. ৬২৬ ) মিলন কথক দেশভাগের সত্য জানতো। দেশভাগে সাধারণ মানুষের কোন লাভ হয়নি। রাষ্ট্রের ক্ষমতাপিপাসুরা লাভের মুনাফা ভোগ করেছে। দেশভাগের সময় সাধারণ মানুষের কোন বয়ান নেওয়া হয়নি। ফলে অনুপ্রবেশ ছিল সত্য। অনুপ্রবেশের কোন আইন হতে পারেনা। তেমনি রয়েছে সংখ্যালঘু তোষণ। দেশভাগের সত্য, মুনাফা লাভ, পাচার চক্রান্ত, অনুপ্রবেশ সব কিছু বুঝতো মনসা গানের কথক মিলন। সেই কথকে রাষ্ট্র গুলিবিদ্ধ করেছিল। রাষ্ট্র কখনও শ্রেণিশত্রুকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়না। দেবতার নিয়ম মেনে নেয়নি বলেই তো চাঁদ সদাগরের এতো লাঞ্ছনা। রাষ্ট্রের কার্যবলী মনে না নিলে, রাষ্ট্রের মুখোশ খুলে দিলেই রাষ্ট্র তাঁকে ধ্বংস করে দেয়। যেমন করে দিয়েছিল মিলন কথকে। এমনকি ধ্বংস করে দিয়ে স্ট্যাচু নির্মাণ করে দিয়েছে। এই স্ট্যাচুই যেন জনগণকে ভয়ের বার্তা দিয়ে যাবে, রাষ্ট্রের প্রতিবাদ করলে পরিণাম কী হতে পারে সেই বার্তা বহন করে যাবে । কিন্তু মানুষের প্রতিবাদ শেষ হতে পারেনা। শত অন্ধকার, রন্ধের মন্থনজাল থেকেও মানুষের কণ্ঠ জেগে উঠবেই। মিলন কথকের সন্তান মধুমঙ্গল কথক আজ আবার মনসার গান গেয়ে চলে। সেও ‘বিপরীত কহ কথা’। পিতার ঐতিহ্যকে সে জানে। পিতা ক্ষমতার কাছে মাথা নত করেনি সেও করবে না। কিন্তু ইতিমধ্যেই পাল্টে গেছে দেশকালের চিত্র। কনস্ট্রাকশনের উন্নয়ন, গাছ ধ্বংস করে দিয়ে যান্ত্রিক পৃথিবী গড়ে উঠেছে। এনআরসিতে নাম নেই মধুমঙ্গল সহ বহু মানুষের। এঁদের যেন নাম গোত্র, বংশ পরিচয় নেই। এঁদের নাম রাষ্ট্রের তালিকায় নেই। মিলন কথক বলত ‘স্বাধীনতার বিধিলিপি’। এঁরা যেন বেহুলার মতো আবার ভেসে যাবে। মনসা, কালনাগিনীর মতো দংশন করে চলেছে আজকের রাষ্ট্র। গল্পের বয়নে পাই –

‘’ভিতর ঘর থেকে ভেসে আসে, মধুর বাপেরে সাপে কাটিছিল। আপনেরা জানেন। কিন্তু জানেন না কোন সাপে কাটিছিল। যেহেতু সাপের পরিচয় জানা নাই, তাই মধুর বাপের দেশ নাই। মধুর মা- বইনেরও নাই। আমরা মৃতদেহ। মড়া। জলে ভাইসা আসছি। আবার জলে ভাসুম। সাপ ঢুকিছে। সাপ। মধুর বাপ বলত, স্বাধীনতার বিধিলিপি। নিজের দেহ লইয়া জলে ভাসো গো। ভাসো ! জয় মা বিষেশ্বরী !’’ ( তদেব, পৃ. ৬২৯ )


দেশভাগের ক্ষত এখনও শুকিয়ে যায়নি। মনসা যেমন ছয় সন্তানের পরেও লখিন্দরকে দংশন করেছিল তেমনি দেশভাগের যন্ত্রণা পর্ব থেকে পর্বান্তরে বয়ে চলেছে। সেই ট্র্যাজিক বেদনা থেকে বুঝি মানুষের মুক্তি নেই। লখিন্দরকে দংশনের পরেও চাঁদ সদাগর যদি পূজা না দিতেন আর বড় ধ্বংস লীলায় হয়ত সে মেতে উঠতো, রাষ্ট্রও তেমনি। সেখানে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, ‘বিপরীত কহ কথা’ বললেই শুরু হয়ে যাবে দংশন লীলা। সময়ের এক দংশনকে লেখক গল্পে রূপান্তর করেছেন। আর সে রূপান্তরের জন্য যে ফর্ম তিনি বেঁছে নিয়েছেন তা অনবদ্য।
                
চাকরি নির্ভর সমাজ ব্যবস্থার মুখোশ খুলে দেন ‘বর্ণপরিচয়’ গল্পে। বাঙালি সংস্কৃতি যে কোন তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে, বিভিন্ন অফিসে সরকারি চাকুরিরত কর্মীদের সংস্কৃতি বলতে যে কিছু নেই তার প্রকৃত স্বরূপ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বিদ্যাসাগের ‘বর্ণপরিচয়’ থেকে কোন আদর্শ শিক্ষাই যে কেউ নেয়নি, আদর্শের কোন মূল্য চাকুরিজীবীদের কাছে ভিত্তিহীন, যেনতেন প্রকারে নিজের উন্নতির চেষ্টা, অথচ মুখে মুখে আদর্শের বার্তা বয়ে চলা, পরশ্রীকাতর, পরচর্চাকারী সরকারি অফিসের এক নির্মম রূপ লেখক বুনে চলেন। এই গোলকধাঁধায় একটি সৎ ছেলে পিষ্ট হয়ে গেল। আজকের সমাজ যেন ঘুণপোকার ক্রমাগত দংশনে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। এখানে আদর্শের কোন মূল্য নেই, আদর্শ নিয়ে কেউ বাঁচতে পারেনা, বলা ভালো বাঁচতে দেওয়া হয়না। সমাজ ও সময় ক্রমেই অধঃপতনের দিকে এগিয়ে গেছে। সেই অধঃপতনের ফলে মানুষের সুস্থ চিন্তাগুলিও হারিয়ে গেছে। অথচ মানুষ ভেবেছে এভাবেই বাঁচতে হবে। শিক্ষা মানুষকে অধিকার দিয়েছে ‘সহধর্মী’, ‘সহবাসী’, ‘সহভাষী’ হতে। যিনি সিস্টেমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে তাঁর পতন অনিবার্য। আজকের সময়ে চাকরি ব্যবস্থায় নানা ফাঁকফোকর। মেধার কোন দাম নেই। নানা লগিবাজির মধ্য দিয়ে, অর্থ দিয়ে বা আত্মীয়কে চাকরি ক্ষেত্রে সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।  এই গোলকধাঁধায় কেউ প্রবল লড়াই করে চাকরি পেলেও অবিশ্বাসের সুর বড় হয়ে উঠছে। তেমনি আছে দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগহীনতার কথা। অফিসে কাজ বলতে কিছুই নেই। লেখক সমাজ ব্যবস্থার এক দংশন ক্ষত চিত্রকেই ফুটিয়ে তুলেছেন। এই গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেল অরিন্দম নামক একটি সৎ ছেলে। গল্পের বয়নে পাই অরিন্দম নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছে। ডেপুটি ম্যানেজার অরিন্দমের প্রশংসা করেছিল। এরপর থেকেই অফিসের সমস্ত সহকর্মীরা ম্যানেজারের নামে যেমন কুৎসা প্রচার করতে থাকে তেমনি নিজে যে সৎ তা প্রমাণের চেষ্টা সহ বাকি সব অসৎ তা প্রমাণের চেষ্টা চালিয়ে যায়। অথচ ভিন্নজনের কাছে গিয়েই সে বয়ন ভেঙে যায়। উঠে আসে বিপরীত তথ্য। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের নামে নিন্দা করে তবে গোপনে, এমনি নিজেকে ভালো প্রতিপন্ন করতে চায়। কেউ কেউ অরিন্দমের চাকরি কীভাবে হল তা নিয়ে নানা কুৎসা প্রচার করে, এমনকি অরিন্দমকেও সরাসারি বলে। এক সংস্কৃতিহীন গোলকধাঁধার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আজকের সময়। ব্যক্তি স্বার্থ বিবেক দংশনের চরম পর্যায়ে নিয়ে গেছে। মূল্যবোধ বলে এঁদের মধ্যে কোন ধারণা নেই। এঁরা শুধু জানে কীভাবে নিজের উন্নতি করা যাবে, দেশ সমাজ, সময় রসাতলে যাক। গল্পের বয়নে পাই –

‘’ইহারা কেমনতরো মানুষ ? বাংলার কোনো সুন্দর ইহাদের চোখে ধরা দেয় নাই ? বাংলার কোনো গান, কোনো ব্রত, কোনো পার্বণ ইহাদের স্পর্শ করে নাই ? কোনো গ্রাম-চন্দ্রিমা, জলভাগে সূর্যোদয়, শালবনে বৃষ্টিধারা, আশ্বিনের স্বর্ণদুপুর, হেমন্তনির্জনের ঘুঘু, শীতের পায়েসগন্ধ, কাঞ্চনবুকে সন্ধ্যাশিশির ইহাদের হৃদয়ে হাত রাখে নাই ? মায়ের দুধে চালের গন্ধ, গাভীর দুধে ঘাসের ঘ্রাণ ইহাদের শিরায় শিরায় খেলা করে নাই ? কোনো নদী, ইছামতী বা তিতাস, ময়ূরাক্ষী বা সরস্বতী, সুবর্ণরেখা বা আড়িয়াল খাঁ ইহাদের স্বপ্নের তীরে আসিয়া দাঁড়ায় নাই ? পাঁচালি বা পটকথা, ভাটিয়ালি বা ভাওয়াইয়া, বিরহ বা বারোমাস্যা ডাকে নাই ? অবন ঠাকুর, ভোঁদড় বাহাদুর, বেহুলা বা মহুয়া, সাঁওতাল পরিবার বা কোমল গান্ধার, কপালকুণ্ডলা বা কুমুদিনী ইহাদের দূরে রাখিয়াছে ? বাংলার ফল-ফুল আতা নোনা টগর জামরুল, দোয়েল পাপিয়া টুনটুনি বুলবুলি ইহাদের কাছে আসে নাই ? ইহাদের ঘৃণা করিয়াছে ?” ( তদেব, পৃ. ২০৪ )

অরিন্দম এই বুর্জোয়া নির্ভর, মেকি চাকরি ব্যবস্থা মেনে নিতে পারেনি। বাড়ি ফিরে আত্মহত্যা করেছে। তাঁর দাদা আগেই বলেছিল যেকোন অফিসের হাল হকিকত। বুর্জোয়া সমাজে কীভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। কিন্তু সবাই তো মানিয়ে নিতে পারেনা। ফলে শ্রেণির বাইরে যেতে গিয়ে নিজেই বিপদ ডেকে আনে। ব্যক্তির এই পতনের জন্য অফিসের কোন অনুশোচনা, বেদনা নেই। তাঁরা জানে এই সিস্টেমে মানিয়ে নিতে না পারলে ব্যক্তির পতন অনিবার্য। লেখক সচেতন ভাবেই তাঁর নায়ক পরিকল্পনা করেন। লেখকের আজও বিশ্বাস আদর্শের প্রতি। অথচ আদর্শ কীভাবে ধীরে ধীরে মূল্যহীন হয়ে পড়ছে। সেই মূল্যবোধহীন সমাজ ব্যবস্থা থেকে তাঁর নায়ক নিজেই আলাদা হয়ে যাচ্ছে। এ যেন ব্যক্তির মুদ্রাদোষ। সেই মুদ্রাদোষের মধ্যেই সুপ্ত রয়েছে আদর্শের ভিত্তি। রাষ্ট্র ও দেশ এক নয়। রাষ্ট্র নিজেই শোষণ করে। সেই শোষণ থেকে বাঁচতে ব্যক্তিও নানা চোরাপথ বেঁছে নিয়েছে। যে বেঁছে নিতে পারেনি তাঁর পতন ঘটে গেল। রাষ্ট্র সহ সমাজ ব্যবস্থার কীভাবে দ্রুত পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে, মানুষের সংস্কৃতিবোধ কীভাবে পাল্টে যাচ্ছে অথচ বুর্জোয়া ও মেকি সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে মানুষ বাঁচতে চাইছে, তা যে কত ভুল, তার মর্মমূলে লেখক আঘাত করেন।
                
সমাজ, সংস্কৃতির চালচিত্রের বিবর্তন তিনি ধরতে চেয়েছেন। সময়ের স্রোতে সংস্কৃতির বিবর্তন ঘটে যাবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু কোন সংস্কৃতিকে আমরা গ্রহণ করছি ? বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্য কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে, বিজ্ঞাপন নির্ভর সমাজ ব্যবস্থা সংস্কৃতিকে কীভাবে দূষিত করে দিচ্ছে, পণ্যায়ন, বাণিজ্যিক সংস্থা নির্ধারিত করে দিচ্ছে ব্যক্তির সংস্কৃতি। ক্রমেই আমরা এক উদ্বাস্তু সংস্কৃতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। যে বাংলাভাষা পৃথিবীর অন্যতম মধুর ভাষা অথচ নগর কলকাতার মানুষ সঠিক ও শুদ্ধ বাংলা বলতে পারছে না। কথ্য ভাষায় ইংরেজি, হিন্দি শব্দ প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছে। এক বুজরুকি সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে আজকের যে প্রজন্ম বড় হয়ে উঠছে সে নিজের সংস্কৃতি বলতে কী বুঝবে ? আমরা ভুলে যাচ্ছি নিজের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বাঙালি দেশভাগের দলিল লিপিবদ্ধ করে রাখেনি। দেশত্যাগের মর্মান্তিক ইতিহাস লিপিবদ্ধের প্রয়োজন মনে করেনি। শুধু কী মানুষ সাহিত্যও তো নীরবতা পালন করেছে । জাতির ট্র্যাজিক বেদনা নিয়ে যে বিপুল সাহিত্য গড়ে উঠতে পারতো, যার মধ্যে বাঙালিজাতির ঐতিহ্যের শেকড় খুঁজে পাওয়া যেত তা মুছে গেছে।  ‘আমি লোকটা আরবান নকশাল’ গল্পের বয়নে পাই –

‘’উদ্বাস্তুদের নিয়ে কাজ করছে। তার অভিজ্ঞতা বেশ খারাপ। সহযোগিতা তো দূরের কথা, কলোনির কেউ কেউ তাড়া করে, কেউ কেউ মশকরা করে। কেউ ভাবে, যেন তাদের অতীত-কলঙ্ক ফাঁস হয়ে যাবে। কেউ বলে, কাজমম্ম নেই বুঝি ? ফুটপাতে শনিঠাকুর নিয়ে বসলেই পারেন। ছেলেটি বলে, আমাদের দেশভাগের ইতিহাস লেখা হয়নি। উদ্বাস্তু মানুষের নাছোড় লড়াইয়ের ইতিহাস লেখা হয়নি। গদির লোভে কিছু পলিটিক্যাল নেতার বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস লেখা হয়নি।‘’(তদেব, পৃ. ৫৫৫)

ইতিহাস থেকে ধীরে ধীরে আমরা ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। ইতিহাসের নামে বিকৃত ইতিহাস গড়ে উঠছে। ইতিহাসের সত্য ঘটনা, জীবনসত্যকে সরকার সহ শ্রেণিচরিত্ররা পাল্টে দিচ্ছে। তেমনি ক্ষমতার পরিবর্তনে ইতিহাসের রূপান্তর ঘটে যাচ্ছে। সেই বুজরুকি শাসন ব্যবস্থা, ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই তকমা জুটে যাবে উন্নয়ন বিরোধী। যেমন ঘটেছিল সত্তর দশকের নক্শালদের। প্রযুক্তির ব্যবহার ও উন্নয়নের ধাপে পরিবেশকে বিপন্ন করে গড়ে উঠছে শপিংমল। একজন সৎ কথাকার তো এই শ্রেণিচিত্রের মর্মমূলেই আঘাত করবেন। ফলে আশ্রয় নিতে হয় লিট্‌ল ম্যাগাজিনে। ইতিহাস বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতা রাস্তা, প্রশাসন সহ বিভিন্ন ভবনের নাম পাল্টে ফেলছে। গল্পের বয়নে পাব বাঘাযতীন বস্তুহারা সম্মিলনী স্কুল থেকে ‘বস্তুহারা’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে। মানুষের রুচিবোধ পাল্টে যাচ্ছে। মানবিক সম্পর্কগুলি ক্ষুণ্ণ হয়ে যাচ্ছে। হিংস্রার বিষবাস্পে ভরে গেছে সমস্ত দিক। ক্ষমতার লিপ্সা মানুষকে করে তুলেছে বড় অসহিষ্ণু। গল্পের বয়নে অদ্ভুত ভাবে এক গান পাই –‘তোমার টানাটানিতে টিকবে না ভাই, রবার যেটা সেটাই রবে।‘ কালের চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। নক্শাল আন্দোলনের ডাক দিয়ে যে মানুষগুলি ঘর ছেড়েছিল আজও কেউ কেউ সেই তলানিতেই পড়ে রয়েছে। পরিবর্তন ঘটেনি। শাসন ব্যবস্থার স্বরূপ পাল্টে দেওয়া যায়নি। নক্‌শাল ক্ষুদনরা আজ মাঠে চাষ করে। সভ্যতার সমগ্র চিত্রটাই কীভাবে পাল্টে যাচ্ছে তা একজন নক্‌শাল আরকেজন নক্‌শাল প্রদীপনের কাছে বলে চলেছে। যে বিবর্তন, পরিবর্তনের স্বপ্ন তাঁরা দেখেছিল তার পরিবর্তন তো হয়-ই নি বরং গোটা সমাজ ব্যবস্থাটাই ধ্বংসের মুখে এগিয়ে গেছে। রাষ্ট্র মানুষকে ভিখারি করতে বদ্ধ পরিকর। ক্ষমতা মানুষকে দলদাসে পরিণত করেছে। মানুষ সেই ক্ষমতার পিপাসু হয়ে নিজের বিবেক ধ্বংস করতে উদ্যোত হয়েছে। গল্পের বয়নে পাচ্ছি চারিদিকে একটাই কলরব –‘চুরি হয়ে যাচ্ছে, দেশ চুরি হয়ে যাচ্ছে’ অথচ কোন প্রতিবাদ নেই। আরও ভয়ংকর সত্যের মুখোমুখি লেখক আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন –‘চুরিটা পলোটিক্যাল ইশ্যু বা বিনোদনের বিষয়’। আজকের প্রজন্ম ভুলে যাচ্ছে প্রতিবাদের ভাষা। প্রতিবাদ করলেও হয়ত চিহ্নিত করে দেওয়া হবে নক্‌শালদের উত্তরাধিকারী বলে। রাষ্ট্র নিজের প্রয়োজনে মানুষের চিন্তা চেতনাকে ধ্বংস করে দেয়। ব্যক্তি মানুষ ভুল, রাষ্ট্র ঠিক। এই গোলকধাঁধায় হারিয়ে যায় সব। সেই সময়ের ক্ষতগুলিকেই চিহ্নিত করে চলতে হয় লেখককে।
                     
এক বহুস্বরিক ভাষ্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন ‘বায়ু বৃক্ষ বারি অথবা অবৈধ যুগলের গল্প’ এ। সময়ের বিবর্তনে পরিবেশ, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, মানুষের শুভ চিন্তা, প্রশাসনের কার্যকলাপ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। লেখক সেই সময়ের ক্ষতকেই ভীষণ ভাবে আঘাত করেন। কী ছিল বাঙালি পরিসর, আর কোনদিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাঙালির জীবন তা তিনি বহুবিধ নিদর্শনে দেখিয়েছেন। আজ প্রতিবাদ করলেই নানা সন্ত্রাস নেমে আসবে, কনস্ট্রাকশন রাজ পরিবেশকে ধ্বংস করে দিয়ে নগরায়ণের পথে নিয়ে যাওয়ায় নানা অসুখ দেখা দিচ্ছে। গোটা সমাজ ব্যবস্থটাই ক্রমে ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই ধ্বংসের যাত্রাপথ যেন লেখক দেখতে পাচ্ছেন। একজন সচেতন লেখক তো এই ধ্বংসের বার্তার ক্রন্দনধ্বনি শুনতে পেয়ে চুপ করে থাকতে পারেন না, ফলে কলম তুলে নিতে হয়। গল্পের শুরুতেই তিনি গল্পের সমান্তরাল পাঠ ভেঙে দেন। টুকরো টুকরো বয়ান ও সমীক্ষার মধ্যে দিয়ে জীবনের গভীর সত্যে পাঠককে পৌঁছে দেন। গল্পের শুরুতেই পাই –‘’মিছা কথায় চিটা আসে। চিটায় ময়লা ধরে। ময়লা অসুখ ডাকে।‘’( তদেব, পৃ. ৫৯৯) শুরুতেই তিনি বাস্তবতার পাঠ ভেঙে দেন। কোন প্রেম রোমান্স নিয়ে তিনি গল্পে অবতীর্ণ হন না। এক সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষকের ভূমিকায় তিনি গল্প বুনে চলেন। হাজার বছরের যে বাঙালি ঐতিহ্য তা হারিয়ে যাওয়ার জন্য লেখকের গভীর মায়া। সেই বেদনার কথা তিনি মায়াবি ভাষায় ফুটিয়ে তোলেন। বিজ্ঞাপন নির্ভর যে জীবন, যে জীবনের বাঁকে বাঁকে শুধুই প্রলোভন, মানুষকে গ্রাস করার এক চক্রান্ত তা লেখক স্পষ্ট করে দেন। মানুষের চিন্তাশক্তিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে বিজ্ঞাপন, কখনও রাষ্ট্রই নির্ধারণ করে দিচ্ছে কোন কোন বিষয়ে সাধারণ মানুষ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, করলে কণ্ঠরোধ করে দেবার চেষ্টা চলছে ক্রমাগত। খানাবাগানের কীভাবে বিবর্তন হয়ে গেল, খানাবাগের সব গাছ ধ্বংস করে দিয়ে কীভাবে ড্রিমল্যান্ড গড়ে উঠল, জনজীবন থেকে রিক্সা হারিয়ে টোটোর আধিপত্য শুরু হল তা লেখক এঁকে চলেন। একজন লেখক তো কাহিনি বুনন করবেনই কিন্তু কাহিনির ভিতর দিয়ে যিনি আরেক কাহিনি বুনে চলবেন তাঁর গল্প বহুপাঠের দাবি করে। মধুময় পাল তা করেছেন। ভাষা হয়ে গেছে জগাখিচুরি, গাছ, নদী, জল, পাখি সব হারিয়ে যাচ্ছে। সাহিত্যের নামে বস্তাপচা জঙ্গলে ভরে গেছে বাজার, অথচ সেটাই চালানো হচ্ছে প্রকৃত সাহিত্য বলে। গল্পের বয়নে পাই –‘’বই বাছি আর বই বাছি। ধর্মের বই, কুকর্মের বই, ভূতের বই, ভিতুর বই, চুরমুর বই, সুড়সুড়ি বই – সব ফালান দিই। লোকে মজা করে বলে, ফালান বিস্তার। ওদের বলি সেইসব বইয়ের কথা, যা ভাবায়, মানুষ হতে বলে, যে বইয়ের পাতা পুরোনো হলে আরও কাছের হয়, যে বইয়ের পড়া কোনোদিন ফুরোয় না। সেইসব বইয়ের কথা বলি।‘’ ( তদেব, পৃ. ৬০২ ) কিন্তু সেই সব বইকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। বাঙালির ঐতিহ্য বহনকারী কত বই তো বাজারে নেই। প্রকাশক নতুন করে তা পাঠকের হাতে তুলে দেওয়ার দায়বদ্ধতা পালন করেনি। অথচ প্রতিবছর কয়েকশো সস্তা প্রেম রোমান্স যৌনতার গন্ধযুদ্ধ উপন্যাস প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থ বাঙালিকে কোন শিক্ষা দেবে ? লেখক সমাজের গভীরে প্রবেশ করে পাঠকের ভাবনাকে উস্কে দিয়েছেন। আজকের গল্প তো নিছক বিনোদনের সামগ্রী নয়। এক ভয়ংকর সময় ও সমাজ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে আজকের প্রজন্ম এগিয়ে যাচ্ছে। সেই সময় যন্ত্রণা অনেকের চোখেই ধরা পড়েনা, বিজ্ঞাপন আমাদের দেখার সে চোখ নষ্ট করে দিয়েছে, ফলে লেখক সেই সত্যগুলি জানান দিয়ে যান।
                 
আজ শ্রেণির কোন বিভাজন নেই। রাষ্ট্রের কাছে দুটি শ্রেণি-শোষক, শাসিত। লেখকের বয়নে তা ‘উন্নয়নমূলক গণতান্ত্রিক ঢ্যামনামি’। কেউ আবার দুইদিকেই ব্যালান্স করে বেঁচে থাকতে চাইছে। এই অন্ধকারহীনতা থেকে বাঁচতে প্রতিবাদ ছাড়া ভিন্ন পথ নেই। তাই পালান সরকারে বয়ানে পাই –‘যুদ্ধটা এখন আরও কঠিন’। এই ভাষ্যের বারবার পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে লেখক দেখিয়ে দেন সময় যন্ত্রণার গভীর ক্ষত। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই চিহ্নিত হতে হবে ‘ওরা’ বলে। এই ‘ওরা’ থেকে ব্যক্তিমানুষের মুক্তি নেই। যিনি ব্যালান্স করতে পারছেন না তিনিই ‘ওরা’ হয়ে যাচ্ছেন। ইতিহাস কীভাবে বিকৃত হয়, ইতিহাসের নামে কীভাবে গপ্প ফাঁদা হয় তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ‘জ্ঞানশ্রী- কথিত খানবংশ এবং’ পরিচ্ছেদে। ভাষা সন্ত্রাস, নেতার জন্মবৃত্তান্ত, নেতাদের বয়ান, এক নেতা থেকে বহুনেতার জন্মের সুসমাচার নিয়ে তিনি বহুস্বরিক ভাষ্য এঁকে চলেন। বিপ্লব মাস্টারের বক্তব্য ঠিক ছিল কিন্তু যখনই বিপ্লব মাস্টার ওয়ান, টু হল তখনই পাল্টে গেল রাজনীতির অঙ্গন। পাল্টে গেল বক্তব্যের ভাষা ও বয়ান। ‘ওরা এই করে নাই, সেই করে নাই’ আর ‘আমরা এই করেছি, সেই করব’টাই বেশি’ (তদেব, পৃ. ৬০৫) পাল্টে গেল রাজনীতির সংস্কৃতি। জনগণের মগজ ধোলাই বৃত্তান্তের প্রকৃত লীলা। শুরু হল প্রতিশ্রুতির বন্যা। এই মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ন্যাকামি সবাই যে বোঝেনি তা নয়। কেউ কেউ বুঝেছে, কিন্তু সেখানেও আছে গুণ্ডামি। আর তা পালান সরকারের কাছে –‘যুদ্ধটা এখন আরও কঠিন’। ঝিলিম মুছানিদের এখন আর ফ্ল্যাটে ঢুকতে দেওয়া হয়না, কেননা সময় পাল্টে গেছে। এভাবেই ডাকাতি হয়ে যাচ্ছে ফ্ল্যাটে। ভোগবাদী সভ্যতা ধ্বংস করে ফেলেছে প্রকৃতিকে। তাই আখ্যানের শিরোনাম হিসেবে উপস্থিত হয় ‘ফুল –পাখি-নদীর কথা বলাও একটা যুদ্ধ’। উন্নয়নের নামে চলছে গাছ সাফাই অভিযান। কিন্তু সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছাড়া উপায় নেই –

‘’তোমরা যদি নিজের সংস্কৃতিকে জানো এবং ভালোবাসো, তাহলে তোমাদের ওপর রাষ্ট্র ও বেওসারিয়া যে সংস্কৃতি চাপিয়ে দিচ্ছে, তাকে আক্রমণ করতে পারো। আক্রমণ ছাড়া প্রতিরোধ নেই। ওরা যদি তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালায়, তোমাকে পালটা মার দিতেই হবে। একটা পয়লা বৈশাখ বা পঁচিশে বৈশাখ বা ভাষা দিবস বা বৃক্ষরোপণ দিবস বা পরিবেশ দিবস দিয়ে যুদ্ধ হয় না। ধান্দা হয়। খানাপিনা হয়। ভালো বই পড়া ও পড়ানো তোমার রোজকার যুদ্ধ। ভালো গান শোনা ও শোনানো তোমার রোজকার যুদ্ধ। এ যুদ্ধে হুংকার নেই, শাল গাছের মতো নিঃশব্দে বেড়ে ওঠা আছে।‘’ ( তদেব, পৃ. ৬০৮)
 
প্রতিবাদ করলে উপমা জুটে যেতে পারে বহিরাগত, নক্‌শাল। উন্নয়নের নামে গাছে বিষ দেওয়া হচ্ছে। ছদ্ম দেশাত্মবোধ, দেশ সেবার নামে লুণ্ঠনের কার্যকলাপ, জনগণকে সেবার নামে পুলিশের অত্যাচার। সন্ত্রাসবাদীর থেকে কম নিপীড়ন করেনা পুলিশ তা লেখক দৃষ্টান্ত সহকারে দেখিয়ে দেন। ঐতিহ্য, দর্শন বলে কিছুই নেই, হয় ক্ষমতার লড়াই নয় আত্মসিদ্ধির মুনাফা লুঠ এই বুজরুকি সময়তন্ত্রের মধ্য দিয়ে আজ আমাদের বেঁচে থাকা। প্রতিবাদীকে মেরে ফেলা, জঙ্গী বলে উপমা দেওয়া। বৃক্ষ, নদী ধ্বংসের ফলে মানুষের নানা নতুন অসুখ দেখা দিচ্ছে। সেই অসুখকে লেখক মিলিয়ে দেন সময়ের ভাষ্যের সঙ্গে। লেখকের অসাধারণ উপস্থাপনভঙ্গি। রাজনৈতিক দলগুলি যেন আজ পালাবদলের ইতিহাস। রাজনীতি যেমন ক্ষমতার ইতিহাস তেমনি পালাবদলের রহস্য। পালান সরকার নামের মধ্য দিয়ে লেখক দ্ব্যর্থবোধক অর্থে দ্বিবাচনিক পরিসর নির্মাণ করে চলেন। এ যেন রাষ্ট্রের অবৈধ প্রণয়। ঝিলিম মুছানিরা যেন সময় থেকে সময়ান্তরে মুছে যাচ্ছে, পালিশ করে যাচ্ছে। রাজনীতির পরিবর্তন, ক্ষমতা হস্তান্তরে কিছু মানুষের কিছু এসে যায়না। চিরকাল তাঁরা শোষিত মানুষের প্রতিনিধ হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এই সিস্টেমের কোন পরিবর্তন নেই। অথচ গোটা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সহ রাষ্ট্র ব্যবস্থটাই ভেঙে পড়ছে। এই ভঙান রোধে আছে বিজ্ঞাপনের চটকদারি, হিন্দি গানের মুর্ছনা ও বিদেশী সংস্কৃতির হাতছানি। বাঙালি জাতির ঐতিহ্য ক্রমহাসমান হয়ে কোন পর্যায় থেকে কোন পর্যায়ে চলেছে তা লেখক চিহ্নিত করে চলেন দক্ষতার সঙ্গে। এই সময়তান্ত্রিক পাঠ আবিষ্কারের জন্য গল্পের ফর্মকে ভেঙে দেন। ‘গোয়ালপাড়া, ভুবনধারা’ গল্পের বয়নে পাই –

‘’গদাধরের পাড় থেকে ভেসে আসে, নদী বৃক্ষ বারি হারিয়ে গেলে লোকগান বাঁচে না। লোকগান না বাঁচলে লোকজীবন বাঁচে না। আমাজনে শুধু গাছ পুড়ছে না, পাখি পুড়ছে, প্রেম পুড়ছে, গান পুড়ছে, নাচ পুড়ছে, জীবন পুড়ছে। পোড়ানো হচ্ছে। এখানেও গলগল ধোঁয়া। পোড়ার গন্ধ। অনাদরে পুড়ছে। উন্নয়নের বাহানায় কর্পোরেট পুঁজি মাটির সন্তানদের হত্যা করে, মাটির সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে, যুগে যুগে।‘’( তদেব, পৃ. ৬২০)

বিপন্ন বাঙালি জাতি ক্রমেই সব হারিয়ে ফেলছে। সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত হয়ে এক অন্ধের হস্তিদর্শনের মতো এগিয়ে যাচ্ছে উদ্বাস্তু পরিমণ্ডলের দিকে। নিজের ঐতিহ্যের যাবতীয় সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এক পরিমণ্ডলহীনতার দিকে। নদী, বৃক্ষ, অরণ্য হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকগান হারিয়ে যাচ্ছে। লোকসংস্কৃতিকে চিহ্নিত করে দেওয়া হচ্ছে ছোটলোকের সংস্কৃতি বলে। হিন্দি, ভোজপুরী গান শোনা মানুষ নিজেকে দাবি করছে সাংস্কৃতিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে। বাঙালি সংস্কৃতির শেকড়ে ফিরতে চেয়েছেন এ গল্পে। যে গান মিলনের বীণা বাজিয়েছিল, প্রেমের জোয়ারে বিভেদের বীজকে ভুলিয়ে দিয়েছিল সেগুলি আমরা ভুলে যাচ্ছি। মধুময় পালের গল্প বিশ্লেষণে কেউ কেউ হয়ত বাখতিনের কার্নিভাল থিয়োরির আশ্রয় নেবেন, তা স্বাভাবিক। নিজের চোখের সামনে যেভাবে সংস্কৃতির বিবর্তন ঘটে যাচ্ছে তা লেখক মেনে নেবেন কীভাবে ! একে কি বিবর্তন বলব ? যে সংস্কৃতিকে বিদেশ গ্রহণ করছে, মনেপ্রাণে আনন্দ নিয়ে গেয়ে চলেছে অথচ আমরা ভুলে যাচ্ছি। এই সংস্কৃতিক বিমূঢ়তা একজন লেখক কীভাবে মেনে নেবেন। গল্পের বয়নে পাই –

‘’আজ আমেরিকার যুবক জোনাথন পার্লেনের গলায় ভাওয়াইয়া শুনলাম। ও মোর কাজল ভোমরা রে। অবাক হয়ে গেলাম। বাংলার মাটি জল হাসি কান্না এভাবে এক বিদেশি, হাজার হাজার মাইল দূরের , ভিন্ন এক সংস্কৃতির যুবকের গলায় ঠাঁই বেঁধে নিয়েছে। আপনি বলতে পারেন, এক দেশের লোকগান অন্য দেশের লোকগানের আত্মীয়। লোকগানের বিদেশ নেই। দেশীয় পরিচয় থাকলেও রক্তের নিবিড় সূত্রে পরদেশ তার স্বদেশই। জোনাথন পার্লেন গরিমার গান দিনের পর দিন যে শুনছেন, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।‘’( তদেব, পৃ. ৬২০)

সুদাম লিখতে বসেছে রাজকন্যা গায়েত্রী দেবীর জীবনী। গদাধরের পাড় থেকে ভেসে আসছে বহু ভাওয়াইয়া গান। কিন্তু এই বিবর্তিত সময়ে কীভাবে জীবনী লিখবেন ! যেখানে সব হারিয়ে গেছে, বাঙালির ঐতিহ্য বলে কিছু নেই। আসলে লেখক সুদামের জীবনী লেখাকে কেন্দ্র করে বাঙালি জীবনের একটা বৃহৎ অংশের চালচিত্রের বিবরণ দিলেন। গানের কোন হিন্দু-মুসলিম, দেশকালের সীমা পরিসীমা নেই। তা গোয়ালপাড়া থেকে রচিত হলেও দেশকে অতিক্রম করে বিদেশে গিয়ে সমগ্র ভুবনের গান হয়ে যায়। তা ভুবনগ্রামের গান হয়ে যায়, পৃথিবীর সমগ্র মানুষের আনন্দ-বেদনা, প্রেম ভালোবাসার গান হয়ে দাঁড়ায়। হারিয়ে যাচ্ছে নদী, সভ্যতার বিকাশের জন্য যে মাটি-জল-বাতাসের ত্রিপাক্ষিক প্রণয়ের প্রয়োজন ছিল তা সব কর্পোরেট পুঁজির দৌলতে ধ্বংস হয়ে গেছে। সংস্কৃতি থেকে কীভাবে বিচ্যুত করে দেওয়া হচ্ছে মানুষকে, ঘোষণা করে দেওয়া হচ্ছে এ গান তোমার নয়, তুমি উচ্চ সংগীত শুনবে, হিন্দু-মুসলিমের যে মিলিত সংগীত ছিল, যেখানে ধর্ম কোনভাবেই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি সেই সংস্কৃতিকে আমরা ধ্বংস করে দিয়েছি। আমরা ভুলে গেছি করিতুল্লা শেখ, সমিউল্লাদের। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের ফলে তাঁদের গানও মুছে ফেলেছি। এ তো শুধু প্রতীমা বড়ুয়াদের গান নয়, প্রতিটি অবরুদ্ধ নারীর যন্ত্রণার ভাষ্য। শুধু যন্ত্রণাই নয় মাটির জন্য কান্না। মানুষের বেঁচে থাকার গান। অথচ আজ মানুষই মানুষকে বাঁচতে দিতে চাইছে না। নবদ্বীপ স্টেশনে মাতাকে ফেলে রেখে গেছে পুত্র। এই বিভ্রান্ত সময়ে কোন গান রচিত হবে ? সুদামের পক্ষেই যেন লেখা সম্ভব  জীবনী। গানের যে দায়বদ্ধতা ছিল সেখানে থেকে কোথায় যেন সরে গেল আধুনিক গান। শুধুই কি বিনোদন ? সময় সমাজ নিয়ে গানের কি কোন ভূমিকা নেই, সঙ্গবদ্ধ বিবেক গঠন, মানবতার লাঞ্ছনা, নিপীড়নে গান কি জেগে উঠবে না ? সুদাম যখন জীবনী লিখতে ব্যর্থ হচ্ছে তখনই উড়ে আসে ডায়েরির পাতা। জাদুবাস্তবতার আশ্রয় নেন লেখক, তবে বাঙালি সংস্কৃতির প্রকৃত স্বরূপ দেখিয়ে দেন। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিই যে প্রকৃত বাঙালির স্বরূপ তা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে –

‘’আমি মাটির মানুষ, মাটির গান গাই। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করি। কারণ আমি জানি, এইসব লোক ছাড়া সমাজ বাঁচতে পারে না। সমাজ মানে কী ? ভালো সাজপোশাক, মিঠি সাতকথা, মৌখিক ভদ্রতা ? এসব আমি মানি না। আমি গাই সাধারণ মানুষের গান। বর্তমানে আমার বয়স প্রায় পঁয়ষট্টি বছর। এখনও আমি ক্লান্ত হইনি। বর্তমানের ছবি প্রত্যক্ষ করছি। বর্তমান সমাজের কথা ভাবছি। কী আছে এ সমাজে ? হিংসা, রেষারেষি। আমি অসমিয়া, আমি বাঙালি, আমি বিহারি, আমি গারো, আমি বোরো, আমি হিন্দু, আমি মুসলমান, আমি রাভা...। আমি ভারতবাসী। আমি অসম, বঙ্গ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা, বাংলাদেশ বুঝি না।–আমি মানুষ, একই মাটির। একই জল, একই বায়ু সেবন করি।‘’ ( তদেব, পৃ. ৬২৩ )

বাস্তবের সমান্তরাল পাঠ ভেঙে দিতে তিনি নানা কৌশল অবলম্বন করেন। আপাত ভাবে অবাস্তব ভ্রান্তি মনে হলেও সেখানে আরও এক আঁকড়া বাস্তব উঁকি দেয়। উত্তর আধুনিক গল্পবলয় নির্মাণে মনবিবেশ করেন। বাখতিনের কার্নিভাল তত্ত্বের জোকার, ভূত প্রেতকে তাঁর গল্পবলয়ে দেখতে পাই। কখনও জাদুবাস্তবতার আশ্রয় নেন। ‘মুক্তি মাছালার গল্প অথবা উন্নয়ন’ গল্পের বয়নে পাই –‘’যাহাকে তুমরা বাঙলায় উন্নতি বলো, তাহা দুর্নীতির মাসিতুত ভাই। তবু উন্নাইন চাই। উন্নাইন ছাড়া মানুষ বাঁচিতে পারে না। সর্বমানুষদিগকে বাঁচিতে হইবে এমন কথা কে কোথায় কবে কহিল ?’’( তদেব, পৃ. ৫১৬ ) উন্নয়নের বিভিন্ন স্তরগুলিকে তিনি ভেঙে দেন। বস্তি ভেঙে ভেঙে কীভাবে ফ্ল্যাট গড়ে উঠছে, উড়ালপুন নির্মাণ করে নগরকে আধুনিকতার শীর্ষে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বটে কিন্তু বস্তিবাসীর কাজের কোন সন্ধান নেই। মুক্তি মাছালার মাছ বিক্রির সংলাপে লেখক যে ভাষ্য নির্মাণ করেছেন তা সময় ও সমাজ সম্পর্কে এক বড় জিজ্ঞাসার সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। সময়ের মন্থনজালে চোরাগোপ্তা যে দুর্নীতিগুলি লুকিয়ে থাকে তা তিনি ভেঙে দেন। শোমাস্টার রঘুনন্দন মিশ্র অর্থ দিয়ে চাকরি পেয়েছে। মুক্তিকে ক্লাবের মানুষ বড় একটা কিছু বলেনা কারণ সে গাছ ধ্বংসের রহস্য জানে। মুক্তির জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি দেশের জন্ম। বাংলা ভাষার জন্য মানুষের এতো সংগ্রাম, নতুন রাষ্ট্রের জন্ম অথচ সেই ভাষাকে হিন্দিমিশ্রিত করে বিকৃত করে দেওয়া হয়েছে। আসলে ক্ষমতার ভাষা চিরকালই ভিন্ন। উন্নয়নের নামে কর্পোরেট পুঁজি বিনিয়োগে দেশ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। মুক্তি মাছালার মধ্য দিয়ে লেখক সেই জীবনসত্যের আভাস দিয়ে যান। ভূতের রূপকের মধ্য দিয়ে সমাজ রাষ্ট্র সম্পর্কে এক আঁকড়া বাস্তবতার পাঠ দিয়ে যান। উন্নয়নের নামে দেশ রাষ্ট্রকে ধ্বংসের যে সোপান আবিষ্কার করে চলেছে ক্ষমতা, সেই ক্ষমতার বিবিধ পাঠ আবিষ্কার করে যান। 
                
এক বহুপাঠের দাবি রাখে ‘সব সন্ত্রাস শান্তি হয়ে আছে’ গল্প। তিনি যে আখ্যান পরিকল্পনা করেন সেখানে গল্প অপেক্ষা জীবনের ভাষ্যই বেশি। জীবন সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব বিশ্লেষণ আছে। সেই বিশ্লেষণ তিনি গল্পের মধ্য দিয়ে বপন করে চলেন। আখ্যানকে তিনি নিজেই ভেঙে দেন। টুকরো টুকরো ঘটনার মালা গেঁথে তা সম্পূর্ণ বৃত্তে পৌঁছান। এ গল্পের কাহিনি ধরে রেখেছে নলিনীকুমার। দেশভাগের কাল থেকে তিনি সাধারণ মানুষের অত্যাচার দেখ এসেছেন। অত্যাচার, সন্ত্রাসকে রাষ্ট্র শান্তি বলে চালিয়েছে। আটটি ঘটনা বয়নের মধ্য দিয়ে তিনি দেশকালের চিত্র এঁকে চলেন। সেখানে নিজের ভাষ্য আছে। নলিনীকুমারের ভাষ্যের মধ্য দিয়ে লেখক বয়নকে যেমন ভেঙে দেন, তেমনি সত্য-মিথ্যার প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন করে, রাষ্ট্র ও প্রশাসন সহ বিভিন্ন একক মানুষকে কীভাবে শোষণ করে তার ফাঁদ দেখিয়ে দেন। দেশত্যাগে মানুষকে অত্যাচারিত তো হতেই হয়েছে, তেমনি ইচ্ছাকৃত দাঙ্গা সৃষ্টি করে মুসলিমকে কী করে তাড়িয়ে দেওয়া হল, দেশসেবার নাম করে পুলিশ অফিসার কীভাবে মানুষকে শোষণ করল, রাষ্ট্র কীভাবে মানুষকে খেলনায় পরিণত করল, নারী ধর্ষণ, শিল্পীর স্তব্ধতা, লেখকের দায়বদ্ধহীনতা, রাজনীতির নামে মানুষ ঠকানোর ফাঁদ, হাসপাতালে সাধারণ মানুষের লাঞ্ছনা, বুদ্ধিজীবীদের সময় বুঝে পালটে যাওয়া – এমন একাধিক ঘটনাবৃত্তান্ত এনে সন্ত্রাসের প্রকৃত রূপ দেখিয়ে দেন। নলিনীকুমারের বয়ানে পাই –

‘’নলিনীকুমার এ বিষয়ে প্রায় কিছুই বলেননি। তিনি সন্দিহান ছিলেন, এটা তাঁর অপদার্থতা, নাকি রাষ্ট্রের ? নিজের অপদার্থতার কথা তিনি আর বলতে চান না। রাষ্ট্রের অপদার্থতা হলে তার বিরুদ্ধে বলার ভাষা অন্যরকম। প্রতিকারও অন্যরকম। অনেকটা জানা গেছে মেনকার বিবরণ থেকে, বাকিটা ভেবে নেওয়া।‘’ ( তদেব, পৃ. ২৭৪ )

প্রতিকারহীন প্রতিকারের দিকে এগিয়ে যায় তাঁর ভাষ্য। সময়ের বিপ্রতীপ স্বরগুলিকে তিনি ভেঙে দেন। সেখান থেকে কারওই পরিত্রাণ নেই। হাফ চিকিৎসক রমেনের কাছে সাহায্যের জন্য গেলে জানা যায় সে নিজেই আত্মহত্যা করেছে। শান্তির ভেতরেই যেন সন্ত্রাসের বীজ লুকিয়ে আছে। শুধু ভিন্ন রাষ্ট্রই সন্ত্রাস চালায় না, রাষ্ট্র নিজে সন্ত্রাস তো চালায়ই, আবার রাষ্ট্রের নানা স্তরে সেই সন্ত্রাসের বিবিধ রূপ। এ যেন বড় সন্ত্রাস, ছোট সন্ত্রাস। বড় সন্ত্রাস মানুষের শান্তির যেমন বিঘ্ন ঘটায় তেমনি ছোট সন্ত্রাসও। কিন্তু এই ছোট সন্ত্রাসের চেহারা মানুষের চোখে ধরা পড়েনা। কিন্তু ব্যক্তি সেই সন্ত্রাসজালে ক্ষতবিক্ষত হয়। সেই সন্ত্রাসের রূপ লেখক চিহ্নিত করে চলেন। 
                
( ২ )
‘অয়ি, হাত ধরো, করেক্ট করো’ গল্পের অন্তিমে শুনতে পাই –‘’আমি ম্যানেজারের জন্য একটা অশ্লীল গল্প ভাবতে চাই। অয়ি বাস্তবতা, প্লিজ হেল্প মি, আমার হাত ধরো, আমাকে গল্প দাও, স্টোরি অব গ্লোবালাইজ্‌ড সেক্স অ্যান্ড প্রফিট। আমাকে কারেক্ট করো !’’( তদেব, পৃ. ২৩৫) বাস্তবতার বহিরাবরণ গুলিকে তিনি ভেঙে দেন। যে বাস্তবতায় আমরা বাস করি, যে বাস্তবতার স্বপ্ন দেখি, অথচ ঘটমান বাস্তবে যার মধ্য দিয়ে আমাদের যাপনচিত্র গড়ে ওঠে সেগুলোর মধ্যে তারতম্য যে অনেকটা । বাস্তবতাকে ভুলে এক আদর্শ জীবনের, আদর্শ ভাবনাবলয় গড়ে তোলেন কিন্তু সেই আদর্শ ভাবনা টিকিয়ে রাখা যায়না, বাস্তবতার রহস্য এসে ভেঙে দেয়। সেই বাস্তবতার হাত ধরেই তিনি এক ভিন্ন বাস্তবতায় পৌঁছতে চেয়েছেন। কিন্তু কোন বাস্তবতায় পৌঁছবেন ? যেখানে চারিদিকে মেকি, স্বার্থপর, আত্মসিদ্ধ মানুষ নিজের আখের সংগ্রহে মত্ত, রাজনীতির দলবিভাজন রেখা মানুষকে পিষ্ট করতে সদা ব্যস্ত, জনচিত্তের রুচি বদলে যাচ্ছে দ্রুত, সেখানে কোন বাস্তবতার পাঠ নেবেন ? এক বিভ্রান্ত সময়ের মধ্য দিয়ে আমাদের এগিয়ে যাওয়া। ব্যক্তি নিজেই জানে না কোন আদর্শকে বিশ্বাস করে সে বেঁচে থাকবে। তবুও মানুষকে বাঁচতে হবে। সবাই তো প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না। আর জনসংস্কৃতির বিবর্তনের প্রতিরোধ কীভাবে গড়ে তুলবে। ব্যক্তির আদর্শ কীভাবে ডুবে যাচ্ছে চোরাবালিতে তা লেখক দেখান-

‘’আমিও একদিন এমন এক খুশিমুখ সমাজের স্বপ্ন দেখেছি, যেখানে অর্থ নয়, অস্ত্র নয়, প্রভু নয়, বাণী নয়, মানুষই শেষকথা বলে। সেসব স্বপ্নদোষ গেছে। বহু মনীষার বহু বহু বর্ষের সাধনার হাতে সেই কোনোদিনের সম্ভাবনা ছেড়ে দিয়ে আপাতত আমি বলি, আই বাস্তবতা, কাছে এসো, হাত ধরো, ধরো-না, সত্যিই তোমাকে চাই।‘’(তদেব,পৃ. ২৩০) 

মোড়ে মোড়ে জনসংস্কৃতির পৃথক রূপ। বাসে প্রতিদিন নিত্য যাত্রীদের বিবিধ রূপ দেখে গল্প কথক উপলব্ধি করতে পারেন বাস্তবতা কীভাবে পাল্টে যাচ্ছে, কেউ ভাড়া না দিয়েই নেমে গেছে, অফিসে ব্যক্তিস্বতন্ত্রতা বিসর্জন দিয়ে সবাই ম্যানেজারের চামচা হয়ে উঠছে। তবে কন্ডাক্টর চরিত্র পৃথক। সে প্রতিবাদী বংশের ছেলে। রাষ্ট্র তাঁর পিতামহকে টেররিস্ট সন্দেহে হত্যা করেছে, পিতা রিফিউজি ক্যাম্পে প্রতিবাদ করার পুলিশ গুলি করেছে, মাতা মিছিল করার অপরাধে মৃত্যু ঘটেছে। লেখক বাস্তবতার পাঠগুলিকে ভেঙে দেন। শোষক ও শোষিত, রাষ্ট্র প্রতিবাদের স্বরূপকে কীভাবে মুছে দেয় সে আখ্যান নির্মাণ করে চলেন। সেও পার্টির মিছিলে যায়নি বলে পার্টি সতর্ক করেছে। জানে মৃত্যু অবধারিত তবুও লড়ে যাচ্ছে – এটাই বাস্তবতা। লেখক এ গল্পের বাস্তবতার বিপ্রতীপ স্বর বুনে চলেন। কন্ডাক্টর যখন পার্টির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মৃত্যু অবধারিত জেনেও লড়াই করে যাচ্ছে তখন গল্পকথক ভেবেছে কীভাবে ম্যানেজারকে হাতে রাখা যায়। প্রত্যেক মানুষ যেমন ক্ষমতার দিকে এগিয়ে যায় তেমনি প্রতিটি মানুষেরই পৃথক সত্তা আছে। ব্যক্তিমানুষ যখন আদর্শ কিছু ভাবে তখনই বাস্তবতা এসে তা ভেঙে দেয়। ব্যক্তি নিজেই নিজের দোসর হয়ে ওঠে। সেই বিদ্ধস্ত জনচিত্তের সন্ধান দেন লেখক।
                            
নিম্নবিত্তের জীবন পরিসর নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘শবযান ও মোতিসুন্দরী’ গল্প। জীবন ও মৃত্যুর দোলায় তিনি গল্পকে নির্মাণ করেছেন। মৃত্যুর ওপর পিঠেই যে জীবন, মৃত্যুই যেন নবজীবনের ইঙ্গিত দিয়ে যায় সেই দর্শনে গল্পের অন্তিমে লেখক পৌঁছে যান। আদিগানের ভ্যান সবার কাছে হয়ে উঠেছিল শবযান। এই ভ্যান নিয়ে স্ত্রী যেমন বিরক্ত তেমনি সে নিজেও। কিন্তু সে জানে একদিন কাউকে বাঁচিয়ে ফিরবেই। পৌরসভা থেকে  মৃতলাশ বহনের জন্য ঠিক করা হয়েছিল তাঁর ভ্যান। এরপর রোজগার কমেছে। তেমনি এসেছে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা।  আজ ভ্যানে করে মৃত্যুমুখী মোতিসুন্দরীকে সে নিয়ে যাচ্ছে হসপিটালে। আজ আর মৃত্যু নয় মোতিসন্দুরীর কাছেই সে পেয়েছে জীবনের সন্ধান, প্রেমের সন্ধান।
        
শিল্প সাহিত্যের দায়বদ্ধতা কোথায় ? শিল্প কি শুধুই বিনোদনের জন্য ? প্রতিষ্ঠান তো বিনোদন দ্বারাই জনরুচিকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে। ছদ্মবাস্তবতা দ্বারা বাস্তবতার আসল স্বরূপ ভুলিয়ে দিতে চাইছে। খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার মোহে সেই ছদ্মবাস্তবতার কেচ্ছা কাহিনি লিখে একদল শিল্পী সাহিত্যিক তো জনরুচিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের মোহে পাঠক ভুলে যাচ্ছে সাহিত্যের সত্য কোথায়, শিল্পের দায়বদ্ধতা কোথায় । তবুও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ছদ্ম সাহিত্য, মেকি শিল্পের বিরুদ্ধে কিছু লিট্‌ল ম্যাগাজিন আজও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞাপনহীন লিট্‌ল ম্যাগাজিনের এ লড়াই কতদিন ? ছদ্ম সাহিত্য, বিনোদন নির্ভর সাহিত্য দ্বারা যে পাঠক রুচি গড়ে উঠছে, তাঁরা তো জানবে এটাই প্রকৃত সাহিত্য। বড় ভয় হয় বিজ্ঞাপন, প্রতিষ্ঠানের দাপাদাপিতে আমরা প্রকৃত সাহিত্য তো হারিয়ে ফেলব না। সেই স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা কথাকারদের মধ্যে অন্যতম মধুময় পাল। ‘মেঘে ঢাকা তারা > মেঘ-ভাঙা স্পর্ধা’ গল্পের শুরুতেই এক ভয়ংকর প্রশ্নের মুখে পাঠককে থমকে দাঁড়াতে হয় –‘’প্রতিবাদ করা শিল্পীর প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। শিল্প ফাজলামি নয়। যারা প্রতিবাদ করছে না, তারা অন্যায় করছে।‘’ (তদেব, পৃ. ৩৭১ ) কিন্তু প্রশ্ন হল আজ ইচ্ছা করলেই কি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যায় ? রাষ্ট্র প্রতিমুহূর্তে যেখানে মানুষ সহ শিল্পীর কণ্ঠরোধ করতে চাইছে সেখানে প্রতিবাদের মূল্য কতটুকু ? রাষ্ট্র যখন শিল্পীর সত্তা কেড়ে নিতে চাইছে, সে নিজেই জানিয়ে দিচ্ছে শিল্পের স্বরূপ কী হবে, প্রতিপদক্ষপে নিজের গুণগান প্রচার করতে শিল্পীকে উদ্বুদ্ধ করছে সেখানে প্রতিবাদ লিখে চলা তো নিজেরই মুদ্রদোষে নিজেই পৃথক হয়ে যাওয়া নয় কি ! তবুও কেউ কেউ তো শিরদাঁড়া শক্ত করে প্রতিবাদ রেখে যাবে। সময়ের প্রকৃত স্বরূপ চিহ্নিত করে যাবে। যেমন ঋত্বিক ঘটক। যিনি শিল্পের স্পর্ধা দেখাতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেই স্পর্ধার মধ্যেও যে কত ফাঁকি তা লেখক আবিষ্কার করেছেন। এ গল্পের পটভূমি দেশভাগের কাল থেকে একববিংশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত। অবনীশ এক সাহিত্য সভায় বক্তৃতায় তিনটে উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করেছিল –
   
ক.’ It is dangerous to be right when the government is wrong.’( ভলতেয়ার )
খ.  The job of a citizen is to keep his mouth open.’ (গুন্টার গ্রাস )
গ. The writer is the natural enemy of dictatorship.’ ( ইসমাইল কাদারে )

এরপরেই এক জনৈক মহিলার আত্মবয়ান ছিল যেখানে বাস্তবের প্রকৃত স্বরূপ ভেসে ওঠে। কিন্তু আজকের বুদ্ধজীবী, সাহিত্যপ্রেমী তো বাস্তবের শোকগাথা ভুলে সাহিত্যের নন্দনতত্ত্বে ভেসে থাকতে ভালোবাসে। সাহিত্য যেন নিছক বিনোদনের আড্ডা, ভাতঘুমের সঠিক রসদ। রাষ্ট্রও চায় সাহিত্যের বয়ন এমনই হোক। বিপরীত ভাষ্য পেলেই কণ্ঠরোধের চেষ্টা চলে অবিরত। শুধু রাষ্ট্র নিজেই নয় রাষ্ট্রের বড় বড় দালাল, সাহিত্যিক ভেকধারী গোঁসাইজীরা ঠিক করে দিচ্ছে সাহিত্যের বয়ন। সেই বয়নকে বিদ্রুপ করতেই লেখকের ভাষ্যে পাই –‘’শিল্প ফাজলামি নয়, শাসকও বোঝে। তাই ফাজলামি পেলে খুশি হয়। তাকে ঘর দেয়, বর দেয়, আদর দেয়।‘’( তদেব, পৃ. ৩৭২) মধ্যযুগের যে রাজসভার সাহিত্য, রাজার গুণগানে প্রজাকে সমস্ত ভুলিয়ে রাখা সেই ট্র্যাডিশন কি ফিরে এল ? একজন লেখক তো সমাজিক ক্ষতগুলিকেই আবিষ্কার করবেন। ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশে শত সহস্র সমস্যা আছে যার নির্মাণ করে চলবেন লেখক। অথচ আজকের লেখক বিনোদন, প্রেম, যৌনতা, পোশাকের ফাঁক ফোকর, অবৈধ সম্পর্ক, যুবক যুবতির নষ্টামি নিয়ে মেতে আছেন। কেউ রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরীর সম্পর্ক নিয়ে সস্তা কেচ্ছা লিখতে ব্যস্ত। কেউবা গোয়েন্দা গল্প, সরকারি উন্নয়নের তালিকাবদ্ধ লিপিকরণ। আবার এঁরাই তো বুদ্ধজীবী, এঁদের হাতেই পুরস্কার। বাংলা সাহিত্য কোন পথে যাচ্ছে তার অবয়ব স্পষ্ট করে দেন লেখক –

‘’অসীম বলে, সাহিত্যসভাটা চালু থাকবে। আপনিও উপকৃত হবেন। ওদের হাতেই তো পুরস্কার, কমিটি, বই কেনাকাটা, রবীন্দ্র, নজরুল ...। ওরা বললে তবেই আপনি লেখক। ওরা মনে করলে তবেই আপনি বুদ্ধিজীবী। ওরা কাঠি করলে আপনার ফুটুরডুম, মানে ফিউচার ভোগে। আপনাকে পছন্দ করি, সেই হিসেবে এটুকু বলতে পারি, এখনই গিয়ে ভুল স্বীকার করুন।‘’ ( তদেব, পৃ. ৩৭৩ )

বিকৃতরুচি যে সাহিত্যের দালালি, ভণ্ডসর্বস্ব সাহিত্যিক নামধারী বাজারি কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতের বাংলা সাহিত্যকে তা এখানে স্পষ্ট। প্রতিবাদের ভাষ্য, শ্রেণির হয়ে কলম ধরা, বিপক্ষের রাজনীতির বয়ন, সরকার বিরোধী কথা বললেই ক্ষমতা বর্জিত করে দেবে লেখককে। বইমেলা, আকাদেমি সব বর্জন করবে। গল্পের বয়নে পাব ‘সুদাম, ঘরে চাবি মেরে দে’। বারবার এই বয়ন পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে ক্ষমতার ছবি স্পষ্ট করে দেন। অবনীশ আজ ঋত্বিক ঘটকে নিয়ে তৈরি ছবি দেখতে গেছে। এই ছবি দর্শনের মধ্য দিয়েই বিগত শতকের চিত্র যেমন স্পষ্ট করে তুলেছেন তেমনি মানুষের সংস্কৃতি কীভাবে পাল্টে গেল, জনরুচি কীভাবে বিকৃত হয়ে যাচ্ছে ও বিজ্ঞাপন কীভাবে মানুষকে গ্রাস করছে তা স্পষ্ট করে তোলেন। যৌনতার বিজ্ঞাপনে ভরে গেছে চারিদিক। বিজন ভট্টাচার্য, উৎপল দত্ত, সুনীল জানা একটি নির্দিষ্ট দর্শন নিয়ে সাহিত্যে এসেছিলেন। লেখক জানেন শিল্পী কখনও নিরপ্রেক্ষ হতে পারেন না। শিল্পীর নির্দিষ্ট দর্শন আছে, ব্যক্তিসত্তা আছে। সেই দর্শন, ব্যক্তিসত্তাকে ধ্বংস করে দেয় রাষ্ট্র। নক্‌শালবাড়ি আন্দোলন, ভূমিহীন কৃষকের লড়াই, শ্রেণিস্বার্থে যুবকদের ঘরছাড়া সব ব্যর্থ করে দিয়েছিল রাষ্ট্র। সাহিত্যও নীরবতা পালন করেছে। রাষ্ট্র কৃষকের সমস্যার সমাধান না করে কৃষকের হৃদয় পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিল। কৃষকরাই যে দেশের সম্পদ তা রাষ্ট্র অস্বীকার করেছিল। কৃষকদের চোখে ধুলো দিয়ে ক্ষমতার রাষ্ট্র বুদ্ধিজীবী, এলিটদের আরও বড়লোক করেছে। এই এলিটশ্রেণিই দৈনিক পত্রিকারয় সম্পাদকীয়, উত্তর-সম্পাদকীয় লিখে জনগণের লড়াইকে ভিত্তিহীন করেছে। উৎপল দত্ত, হেমাঙ্গ বিশ্বাসরা নক্‌শালবাড়ি আন্দোলনকে সামনে রেখে নাটক, গান লিখেছিল মানুষ ভুলে গেছে সেসব। রাষ্ট্র ভুলে গেছে। নক্‌শালবাড়িকে আদর্শ হিসেবে কেউ গ্রহণ করেনি। নইলে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের মতো ঘটনা ঘটত না। ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে নির্মিত ছবিতে আজ দর্শক নেই। অথচ আগের শো ‘শটকার্ট রোমিয়ো’তেই বহু দর্শক ছিল। চিরকালই ক্লাসিক সাহিত্য, শিল্পের দর্শক স্বল্প। জনরুচি কীভাবে ধ্বংস হয়ে গেল তা লেখক আমাদের দেখান। এই জনরুচি ধ্বংস করেছে প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র। সংবাদপত্রে নারীধর্ষণের গুরুত্বপূর্ণ খবরের নিচেই যৌনতার বিজ্ঞাপনে তা ধ্বংস হয়ে গেছে। ক্রিকেট খেলার নামে যৌনতার যে বিজ্ঞাপন রাষ্ট্র প্রচলন করেছে তা মানুষের জনরুচিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ঋত্বিক নির্মিত ‘সুবর্ণরেখা’ ছবিতে সেদিন দর্শক ছিলনা, আজ ঋত্বিককে নিয়ে নির্মিত ছবিতেও দর্শক নেই। ঋত্বিক মানে বাঙালি মনে রেখেছে মাতাল ঋত্বিকের কথা। তাঁর স্টাইলকে মনে রেখেছে, মেধাকে মূল্য দেয়নি। তেমনি ঋত্বিকের ছবির যে অপূর্ণতা তা স্পষ্ট করে দেয় রণজিৎ। ‘সুবর্ণরেখা’ শুরু হল উদ্বাস্তু মানুষদের চিত্র নিয়ে, কিন্তু এই মানুষগুলি কেন উদ্বাস্তু হল তাঁর খোঁজ ঋত্বিক করেননি। সে ঋত্বিকের উদ্বাস্তু প্যাশন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। রণজিতের অভিযোগ স্পষ্ট করে দেয় দেশভাগ নিয়ে বাঙালির নীরবতাকে। শুধু দেশভাগ নয়, তেভাগা, নক্‌শাল আন্দোলনের ইতিহাস বাঙালি লিখে রাখলো না, তেমন কোন সাহিত্য সৃষ্টি হলনা। সে আক্ষেপ থেকেই লেখক এ কাহিনি নির্মাণ করে চলেন। মদ আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি। স্কুল কলেজ হসপিটালের সামনে গড়ে উঠেছে ওপেন শপ। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে লেখা এ গল্প ২০২০ খ্রিস্টাব্দে করোনার মর্মান্তিক দিনে লকডাউন পর্বে যখন পড়ছি লেখকের এ ভাষ্য আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে। ঋত্বিকের সেই ধর্ষিত নারী বঙ্গবালা মুক্তি পায়নি। এশতকের সূচনা লগ্ন থেকেই অবিরাম ধর্ষণ হচ্ছ জেলায় জেলায়। তাপসি মালিক, রাধারানিরা ধর্ষিত হয়ে যাচ্ছে। আর রাষ্ট্র তা চাপা দিতে চাইছে। বঙ্গবালারাও সেদিন রাষ্ট্রের খানসেনাদের হাতে ধর্ষিত হয়েছিল, তাপসি মালিকরাও আজ রাষ্ট্রের হাতেই ধর্ষিত হল। সময় পাল্টে গেলেও, সংস্কৃতির বিবর্তন ঘটলেও, জনরুচির বিকৃতি ঘটে গেলেও রাষ্ট্রের স্বরূপ পাল্টায়নি। ঋত্বিক যেন এক মেঘ ভাঙা স্পর্ধা। সেই স্পর্ধার কাছ থেকে বাঙালি শিল্পসাহিত্য কোন শিক্ষা নেয়নি। শিল্পের প্রকৃত স্বরূপ কোথায়, দায়ববদ্ধতা কোথায়, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কীভাবে কলম তুলে নিতে হয় ঋত্বিক থেকে সে শিক্ষা আমরা নেইনি, মনে রেখেছি মাতাল ঋত্বিককে। সেই মদ্যপানই আজ আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি, অর্থনীতির ভিত্তি। লেখক তীব্র শ্লেষে ঘটনাপুঞ্জের মধ্য দিয়ে একাধিক দৃষ্টান্ত ও ইতিহাসের সত্য ঘটনার পরম্পরা নির্মাণের মাধ্যমে এমন এক আখ্যান গড়ে তুললেন যা স্বতন্ত্রতার দাবি করে।
        
কর্পোরেট পুঁজি, চিকিৎসা শাস্ত্র, চিকিৎসা বিজ্ঞান, নার্সিংহোম, চিকিৎসা ব্যবস্থার গাফিলতি, সাধারণ মানুষ চিকিৎসার নামে কীভাবে বিপর্যস্ত হয়, হাতুড়ে ডাক্তার, এককথায় চিকিৎসা ব্যবস্থার যাবতীয় কার্যকলাপ নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘কালীডাক্তাররা কোথায়’ গল্প। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায়, নার্সিংহোম নির্ভর চিকিৎসা ব্যবস্থায় মানুষকে সুস্থ করার নামে আরও বেশি অসুস্থ করে তোলা হয়। ব্যক্তির অবরুদ্ধ রুদ্ধশ্বাসকে যতদিন টিকিয়ে রাখা যাবে ততদিনই লাভ। তেমনি হসপিটালে রয়েছে নানা গাফিলতি। প্রিয়নাথরা তাই সুস্থ হয়ে ওঠেনা। সুস্থ হতে দেয়না চিকিৎসা ব্যবস্থা। দিকে দিকে উৎসবসজ্জার মতো সেজে উঠেছে নার্সিংহোম। সরকারি ডাক্তার তাঁর কর্ম ভুলে চলেছে নার্সিংহোমে। আছে বিবিধ পরীক্ষা নিরীক্ষার বন্দোবস্ত। তবে সব ডাক্তাররাই যে খারাপ তা কিন্তু নয়। সে আভাসও লেখক রেখে যান। রুগির সঙ্গে আন্তরিক ভাবে কথা বলায় শাকিয়ার স্থান হয়েছে অন্যত্র। সামান্য বেতনে এইসব নার্সরা আর কোন পরিষেবা দেবে। তেমনি আছে ধর্মের বুজরুকি। ডাক্তার নিজেই ধর্মে বিশ্বাসী হয়ে চিকিৎসা করতে এসেছে। এই গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেছে কালীডাক্তাররা। তারাশঙ্করের জীবন কবিরাজ কালের নিয়ম অনুসারে বিদায় নিয়েছিল। অথচ বহুদিন জনজীবনকে তাঁরা সেবা দিয়ে এসেছে। অনুতোষ ডাক্তারের কম্পাউন্ডার কালীডাক্তাররা আজ হারিয়ে গেছে। যেতে বাধ্য হয়েছে। কর্পোরেট পুঁজি ও বহুতল বিশিষ্ট নার্সিংহোম এঁদের দক্ষতা স্বীকার করতে নরাজ। চিকিৎসা আজ ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। নার্সিংহোম জানে সেবা দিলে রোজগার হবেনা, সেবাকে উড়িয়ে দিয়ে ব্যবসায় নামতে বাধ্য হয়েছে শান্তনু ডাক্তাররা। ‘স্বর্গের অন্তঃপুর’ গল্পে এই ব্যবসা আরও উচ্চসুরে ও ভয়ংকর ব্যঙ্গে ধরা হয়েছে। নার্সিংহোম যেন স্বর্গের সিঁড়ি। তার কাজই হল মানুষকে মৃত করে দেওয়া, যত তাড়াতাড়ি আইসিইউতে ঢুকিয়ে দেওয়া। এই আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির নানা পর্যায় আছে। প্রতি পর্যায়ে আছে ঘুষের চক্রান্ত, অবৈধ ব্যবসা। মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ, কোম্পানির সেল্‌স এগজিকিউটিভ, ডাক্তারের কমিশন, উপহার, রোগী ধরে আনা দালাল,  অ্যাম্বুলেন্সের  আধিপত্য। নার্সিং হোমে থেকে তা প্রত্যক্ষ করেছে মধুবন। নার্সিং হোম যেন কসাইখানা। নচিকেতা তাঁর গানে নিজের মতো করে ধরেছেন, মধুময় পাল গোটা ব্যবস্থাটার উদ্ভট রহস্য উন্মোচন করে দিয়েছেন। আজ রয়েছে ওষুধের বিজ্ঞাপন, নার্সিং হোমের ঝাঁঝালো বিজ্ঞাপন। রোগীকেই শুধু ভ্রান্ত করা হয়না, রোগীর আত্মীয়কেও ভ্রান্ত করে, জীবনের মূল্য বুঝিয়ে, মূল্যবোধের দীক্ষা দিয়ে আরও মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। যত আইসিইউ তত টাকা। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব, উদার অর্থনীতি, অর্থনৈতিক সংকট, আলগা দেশপ্রেম, নেতামন্ত্রীদের ভাষণে জনগণের মগজ ধোলাই যেমন করা হয় তেমনি মিডিয়া জনগণের দৃষ্টিকে এই ব্যবসার রহস্য থেকে দূরে রাখতে বিজ্ঞাপনের মায়াজালে আরও এক বড় বিভ্রাম আবিষ্কার করে দেয়। সেই বিভ্রাম থেকে মানুষের মুক্তি নেই। আর ভারতবর্ষের মতো খেতে না পারা অশিক্ষিত দেশে এ কার্যকলাপ উপলব্ধি বেশ শক্ত কাজ। ডাক্তার শান্তনুর বয়ানে পাই –

‘’শোনো, বিজনেস ইজ বিজনেস। আমরি দেখেছ, বিড়লা দেখেছ। দেখে শেখো। সেবা দিয়ে বিজনেস হয় না। দোকান উঠে যাবে। সেবার গল্প শেষ। পেশেন্ট দিয়ে নার্সিং হোম চলে না। হোম লাটে উঠবে। বডি ধরতে হবে। আট-দশটা কেমো হয়ে গেছে, পাঁচ-সাতটা ডায়ালিসিস, বাঁচার চান্স নিল। এইসব বডি ধরতে হবে। লোক ফিট করতে হবে। হাইওয়েতে পোস্টিং করো। সব অ্যাম্বুলেন্স চেক করাও। হাসপাতালে যেন যেতে না পারে। অন্য কোনো নার্সিং হোমে ঢুকতে না পারে। অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার ফিট করো। লোকাল ডাক্তার ফিট করো। বড়ো হতে হবে রাজু। সেবা দিয়ে নাম হয়। বড়ো হতে পারবে না।‘’(তদেব,পৃ. ৪৩০)

যেখানে অর্থলালসাই বড় স্বপ্ন সেখানে সেবার প্রশ্নই আসেনা। এইভাবে গরিব মানুষ অপদস্থ হয়ে চলেছে চিকিৎসা ব্যবস্থায় ক্রমাগত। তারাপদ রায়ের ‘ভালো আছ গরিব মানুষ ?’ উত্তরে শুনতে পাওয়া যায় আজকের গরিব মানুষ ভালো নেই। কর্পোরেট পুঁজি, বিজ্ঞাপন, মিডিয়া ও নার্সিং হোম গরিব মানুষের ভালো থাকার স্বপ্ন শেষ করে দিয়েছে। নার্সিং হোম তাদের কাছে নরকযাত্রা। তবে সে যাত্রা থেকে মুক্তি নেই। লেখক মধুবনকে সামনে রেখে চিকিৎসা ব্যবস্থার রহস্য উন্মোচন করে দেন। মধুবনের সামনেই দুটি মৃত দেহ, অথচ সুগন্ধ স্প্রে ছিটিয়ে রেখে দেওয়া হয়েছে, অর্থ রোজগার চলছে। ‘অলোকসফর’ গল্পেও সেই বুজরুকিতন্ত্র বড় হয়ে ওঠে। আজকের আরোগ্য নিকেতন যেন অন্ধকার নিকেতন হয়ে উঠেছে। ফলে অলোকসফরে আরও বড় অন্ধকার উঁকি দেয়। যে অন্ধকার থাকে আমাদের মুক্তি নেই। অনির্বাণের নাম নার্সিং হোম ও চিকিৎসকদের ভুলে পাল্টে গেছে। সে নাম হয়ে যায় নির্বাণ। সে মৃত্যুতে মুক্তি পেয়েছে ঠিকই কিন্তু বরণের চেতনার মধ্যে রয়ে গেছে। লেখক বরেন এর মধ্য দিয়ে সেই বুজরুকিতন্ত্রের ছবি এঁকে চলেন। তবে ‘সব সন্ত্রাস শান্তি হয়ে আছে’ গল্পের কবিরাজ মশাই নলিনীকুমার কিন্তু আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের কাছে পরাজয় স্বীকার করেনি। আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্র যেখানে প্রতারণার পথ বেঁছে নিয়েছে সেখানে নলিনীকুমাররা নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করেছে। বৃক্ষ নিধনে কবিরাজ মশাইয়ের সব হারিয়ে গেছে। সময়ের বিবর্তনে চিকিৎসা শাস্ত্রের বিবর্তন দেখেছেন নলিনীকুমার, আর প্রিয়নাথরা নিজেরাই ভুক্তভোগী হয়ে প্রত্যক্ষ করেছে দেশের স্বরূপ। ‘আরণ্য রজনি’ গল্পে সংস্থার টাকা চুরির গল্প শুনিয়েছেন। আমরা জানি পশ্চিমবাংলায় সারদা, নারদা, রোজভ্যালি গরিব মানুষের লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছিল। সেই টাকায় ভাগ বসিয়েছিল রাষ্ট্র ও মিডিয়া। এ যেন আরব্য রজনির গল্প। আরব্য রজনির অসম্ভব ঘটনাগুলিও আজ সম্ভব হয়ে চলেছে। বাস্তবের সত্যকে ফুটিয়ে তুলতেই লেখক এই ক্যানভাস বেঁছে নেন। গল্পে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে রেখে কাহিনির সমান্তরাল পাঠ ভেঙে দেন। কিন্তু বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলিও যেন পূর্ণতা পেতে চাইছে। সেই পূর্ণতার শেষে আছে রাষ্ট্রের শোষণ, মিডিয়ার কায়েমি স্বার্থ, পুলিশের অর্থ ললুপতায়। প্রথম আখ্যান –‘সব আলো অন্ধকারের বিকল্প হলে শোনা যায়’। আসলে আলোর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে অন্ধকারের পূর্বভাস। সভ্যতা যত এগিয়ে যাচ্ছে মানুষের প্রতারণা তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজ প্রতারণা যেন শিল্পে পরিণত হয়েছে। সে শিল্পের নানা ধাপ রয়েছে , পর্যায় ক্রমে মানুষ ক্ষমতা ব্যবহার করে চক্রাকারে তা বিবর্তিত হয়। এই প্রতারণা শৃঙ্খলের সর্বশেষ পর্যায়ে আছে গরিব মানুষ। গল্পের বয়নে পাই –

‘’সমাজটা নীতিকথার পুস্তক নয়। পুস্তকের বাইরের এলাকাটাই সমাজ। আপনি যা পড়েন, জানেন, তা পুজো সংখ্যার উপন্যাস আইটেম, নাম ফাটানোর নাটকের আইটেম, বিজ্ঞাপনের ব্যান্ডেজ-মোড়া সিরিয়ালের আইটেম। বুঝলেন মিস্টার হালদার, ইন রিয়্যালিটি যে সমাজ এগজিস্ট করে, তার নিজস্ব নিয়মরীতি আছে।‘’ (তদেব, পৃ. ৪৪৭ )

বিজ্ঞাপন মোড়া যে সংস্থা তার প্রকৃত রূপ উন্মোচন করে লেখক দেখিয়ে দেন। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সংস্থায় জমানো টাকা সাধারণ মানুষ আজও পায়নি। অথচ সাধারণ মানুষের টাকা নিয়ে সংস্থার বিভিন্ন পর্যায়ের বিবিধ অফিসাররা ফুর্তি করেছে। সংস্থার নীতিতত্ত্ব এমনই হাস্যকর তা লেখক দেখান। শুধু সংস্থা নয় ভদ্র বাঙালির মেকি সর্বস্ব যে সংস্কৃতি চর্চা তার প্রকৃত রূপ প্রকাশ পেয়ে যায়। ইন্দ্রাণী অফিসে যাওয়ার সময় একবারে প্রণাম করেছে মা কালী, বিবেকানন্দ ও হনুমানজির। উদ্বাস্তু কলোনি নিয়ে কোন ইতিহাস লেখা হয়নি। কেউ লেখার প্রয়োজন বোধ করেনি। সে ইতিহাস নির্মাণ বাদ দিয়ে বাঙালি মজে ছিল সস্তা প্রেমের কবিতা লেখায়। সেখানে গড়ে উঠেছে কারখানা, আবার লকআউটও হয়েছে। রাষ্ট্রের সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাস কেউ লেখার দায়বদ্ধতা উপলব্ধি করেনি। সংস্থার নাম কীভাবে পাল্টে যাচ্ছে, দেশপ্রেমের নাম ব্যবহার করে দেশভক্ত সাজার ভান করে প্রতারণায় কীভাবে দক্ষ হয়ে উঠছে তা দেখি। শ্মশানের দুটি চুল্লির আটটি থাম নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ষোলো লক্ষ টাকা। জরুরি ফাইল কীভাবে লুটপাট হচ্ছে, নারী ভোগ, এলিট শ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের নষ্টামি, শেষে আত্মবিসর্জন। লেখক বাস্তবতার স্তরে স্তরে প্রবেশ করে সমাজ বিবর্তনের চিত্র আবিষ্কার করেন। একজন প্রকৃত লেখকের হয়ত সেটাই কাজ। বিকল্প বাস্তবতার সন্ধানে গিয়ে লেখক দেখিয়ে দিয়েছেন দেশের প্রকৃত স্বরূপ।
                    
আখ্যান ভাবনায় তিনি যত এগিয়ে গেছেন ততই গল্পের ফর্মকে ভেঙে দেন। ক্রমাগত আখ্যান নিয়ে চিন্তার ফলে নিজেই নিজেকে নির্মাণ করে নেন। এক সত্তা থেকে ভিন্ন সত্তায় যাত্রা করেন। শুধু গল্প নয় উপস্থাপন শিল্পে নতুননত্ব সঞ্চার করেন। কী লিখব তো বটেই, কেমন করে লিখব সেটাও মধুময় পালের কাছে জরুরি হয়ে ওঠে। ক্ষমতার নন্দনতত্ত্বের যে কতস্তর তা তিনি ভেঙে দেন। ‘আকাশবাণী কলকাতা’ গল্প সময়ের জলবিভাজিকা নিয়ে গড়ে উঠলেও শিল্প উপস্থাপনায় জরুরি পাঠ রচনা করে। ‘আকাশবাণী’ যেন রাষ্ট্রেরই কণ্ঠ। সেই কণ্ঠের মধ্যে যে কত বিপ্রতীপ স্বর তা তিনি ভেঙে দেন। কাহিনির ঠাঁস বুনন অপেক্ষা তিনি দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যাত্রা করেন। দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ ও নক্‌শাল আন্দোলনকে প্রেক্ষাপটে রেখে এ গল্পের আখ্যান বিবর্তিত হয়েছে। যে রাষ্ট্র উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছে, মুক্তিযুদ্ধে সে দেশকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, নতুন রাষ্ট্র গঠনে আনন্দিত হচ্ছে সেই রাষ্ট্রই একই সময়ে নক্‌শাল নিধনে ব্যস্ত হয়েছে। মধুময় পাল গল্পের ভিতরে প্রবেশ করে গভীর ভাবে কাহিনিকে বিশ্লেষণ করেছেন। কাহিনির ভিতরে যে রহস্য, রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপের চুড়ান্ত ব্যর্থতা, নিপীড়ন লুকিয়ে থাকে, যার স্বরূপ উপলব্ধি সম্ভব নয় সেই পাঠ গুলি ভেঙে দেন। প্রশ্ন হল নক্‌শালরা বিদ্রোহ ঘোষণা করল কেন ? এই ‘কেন’র কোন উত্তর খোঁজেনি রাষ্ট্র। সে চেয়েছে যেনতেন প্রকারে শান্তি বজায় রাখতে। আর সেই শান্তির বার্তার ঘোষক আকাশবাণী। কার্তিকরা পুলিশের গুলিতে কেন খুন হয়ে গেল, রাষ্ট্র তার কোন উত্তর খুঁজতে যায়নি। আপাত শান্তিকেই জীবনের শেষ সত্য বলে মনে করেছে। রাষ্ট্রীয় ধ্যানধারণা যে কত বিভ্রান্ত তা লেখক দেখাতে বাধ্য হন। ট্রিটমেন্টের বিচারে গল্পটি অনবদ্য। একদিকে উদ্বাস্তুদের জীবনযাপন অন্যদিকে আকাশবাণীর ঘোষণা, দুইয়ের মধ্যে যে অসামঞ্জস্য তা লেখক এঁকে চলেন। মাঝে মাঝে শ্যামলবরণ দত্তের খড়মের শব্দে সে পাঠ আরও ভেঙে দেন। অন্ধরাষ্ট্রের এক পিঠেই যে আলো-ছায়ার খেলা ক্রমাগত পাল্টে যায়, ক্ষমতার রাষ্ট্র দম্ভের সঙ্গে ছায়াকে আলো বলে ঘোষণা করে আরও এক গোলকধাঁধা রচনা করে সেই ভাষ্যই লেখক আমাদের জানিয়ে যান।
                            
এক অসম্প্রদায়িক মন নিয়ে সম্প্রীতির বাতাবরণ গড়ে তুলেছেন ‘লালনের দেশে’ গল্পে। বিভেদের সংস্কৃতি যেখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, প্রতি মুহূর্তে যেখানে মানুষকে ভাগের রাজনীতির শিকার হতে হচ্ছে, রাষ্ট্র নিজের স্বার্থে বিভাজনোত্তর পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে যেখানে সদা প্রস্তুত সেখানে একজন শিল্পীই তো সঠিক পথ দেখিয়ে দেবেন। লালনের জাতিসত্তা অপেক্ষা আমরা মনে রেখেছি তিনি যে গান লিখেছিলেন, হিন্দু-মুসলিমের মিলিত সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলেন, যা বাঙালিকে বাঁচার প্রেরণা দিয়েছিল। আজকের অবক্ষয়িত অবিশ্বাস ও সংশয়ের সময়ে, যেখানে প্রতি পদক্ষেপে বন্ধনের সেতু ভেঙে যাচ্ছে সেখানে লালনের আদর্শ ও দেখানো পথ গ্রহণ করা ছাড়া আমাদের পরিত্রাণ নেই। দুটি গাছ পাশাপাশি বড় হয়ে উঠলেও তার শেকড় যে একই কেন্দ্রে গিয়ে মেশে, তেমনি হিন্দু-মুসলিম দুটি পৃথক জাতি হিসেবে গড়ে উঠলেও তার সংস্কৃতি যে একই ভিত্তিমূলে অবস্থিত সেই চেতনায় আমাদের নিয়ে যান লেখক। শুধু হিন্দু-মুসলিম নয়, হিন্দুর মধ্যেই যে কত শ্রেণি, মুসলিমের মধ্যে যে কত বিন্যাস তা লেখক মিলিয়ে দেন পল চরিত্রের মধ্য দিয়ে। লেখককের যে আদর্শ, জীবনস্বপ্ন তা যেন বহন করে চলে পল। বহুবিধ ও বহু বর্গের চরিত্রকে উপস্থাপন করে তা এক সূতোয় বেঁধে দেন পল। মানুষের জাতি গোত্র পরিচয় জানার প্রয়োজন নেই, সে বাঙালি সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী কী না, বাঙালির জীবনবীণা তার মজ্জায় মজ্জায় সংযুক্ত কী না সেটাই আজ প্রয়োজন। তাই ভজন মির্জার বয়ানে পাই –‘’পল কি বাইরে থেকে এসেছিল ? নাকি আমরাই তার জন্ম দিয়েছি ? নিজেদের মতো করে বাঁচার ইচ্ছা আমাদেরই জননের ভেতর ধারণ করেনি কি পলকে ? পল আমাদের সন্তান নয় ? আমাদের লালনের দেশে সে কি ভূমিষ্ঠ হয়নি ?” ( তদেব, পৃ. ৩৫৩ ) শুধু বিষয় নয় ভাষা সঞ্চারেও লেখক যথেষ্ট সচেতন। আসলে ভাষার ভিতর দিয়েই তো পাঠক ভুবনধারাকে দেখে। ভাষা সঞ্চারে যেমন রয়েছে গতি তেমনি সাবলীলতা। বাক্যের গঠন  স্বচ্ছ, নির্বেদ। এক পরিসর থেকে ভিন্ন পরিসরে যখন যাত্রা করেন ভাষা যেমন বদলে যায় তেমনি অতি দ্রুত এগিয়ে যায়। শুধু এ গল্প নয় সমস্ত গল্পেই তিনি ভাষা ব্যবহারে দক্ষ চিত্রকরের মতো এগিয়ে চলেছেন। এ পরিবর্তন গল্পের সালতামামি পাঠে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ তো লেখকের দক্ষতা। কিন্তু বিশুদ্ধ বাংলা ভাষাকে কি বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে ? মিডিয়া, সংবাদপত্র যেখানে চটকদারি শিরোনামে বিশ্বাসী, আর তা করতে গিয়ে বাংলা ভাষার মধ্যে ভিন্ন ভাষার শব্দ প্রবেশ করিয়ে যে যুক্তশব্দবিন্যাস গড়ে উঠছে তা থেকে মুক্তি বোধহয় নেই। ‘অলোকসফর’ গল্পে ড্রাইভারের মুখে লোকসংগীত সহ বাংলা হিন্দি গান শুনতে পাই। এই মিশ্র সংস্কৃতি সে পেল কোথায় ? ভাষাবিদরা ভাষাকে নদীর সঙ্গে তুলনা করেন, যেখানে নদীই হারিয়ে যাচ্ছে সেখানে ভাষাও যেন হারিয়ে যাবে। তাই এ গল্পে উচ্চারিত হতে দেখি –‘’তোমাদের ভাষার নদী শুকিয়ে গেছে। প্রথমে পার্টিশন, পরে আরবানাইজেশন সর্বনাশ করে দিল। সাহস না থাকলে ভাষা রুগ্‌ণ হয়, প্রতিবন্ধী হয়। তোমাদের সাহস আর নেই। খবরের কাগজ, চ্যানেল দিয়ে ঠকনো দিচ্ছে। এটা ভাষা নয়। তোমাদের ভাষা থাকবে না। একদিন দেশটাও। ভাবছ, লেকচার দিচ্ছি। মিলিয়ে নিয়ো। হুতোম পড়েও তুমি বুঝতে পারলে না ভাষা কীভাবে বাঁচে, কোথায় বাঁচে।‘’ (তদেব, পৃ. ৪৪১ )
                           
জীবনের বহুস্বরিক ভাষ্য নিয়ে তিনি আখ্যান পরিক্রমা করেছেন। খণ্ড খণ্ড সত্যকে সামনে রেখে পূর্ণ সত্যে পৌঁছতে চেয়েছেন। আসলে আখ্যান রচনা করতে গিয়ে নিজের চারপাশের জনজীবনকে তিনি বিনির্মাণ করে নিয়েছেন। কীভাবে অতিদ্রুত মানুষের চেতনা পাল্টে গেল, কিন্তু সমস্ত মন্দের মধ্যেও তো কিছু কিছু ভালো জেগে থাকে, নিজের শেকড়ে ফিরতে চায়, সেই বোধের গল্প ‘বাড়ি খুঁজছে রুদ্র’। যে বোধ থেকে মৌসুমী ভৌমিকরা লেখেন ‘বাড়ি কোথায়’ ভাষ্য, একই বোধ লেখককে যন্ত্রণা দেয়। বাঙালির দেশভাগ নামক সর্বনাশা পরিণামের কোন দলিল সেভাবে লিপিবদ্ধ হলনা। দেবেশ রায় যে আক্ষেপ করেছিলেন ‘রক্তমণির হাড়’ এ তা অত্যন্ত বাস্তব। তেমনি সময়ের ব্যবধানে লেখার পরিসর পাল্টে যাচ্ছে। কী লেখা উচিত ছিল, বয়নে কোন সত্য ফুটিয়ে তোলা জরুরি ছিল, আর প্রতিষ্ঠান, মিডিয়ার দাপটে কোন লেখা হল। এই দুইয়ের মধ্যে মস্ত ব্যবধান। তাই এ গল্পের বয়নে পাই –‘’লেখালেখির জায়গাটা নষ্ট হয়ে গেছে। লিখতে পারাটা এখন বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা, তুমি কোন সিন্ডিকেটে আছো কি না। বড়ো কথা তোমার কোনো প্রোমোটার আছে কি না।‘’( তদেব, পৃ. ৫৮৮) শুধু লেখালেখির জায়গা নয় গোটা সমাজ ব্যবস্থটাই এগিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের দিকে। সে সমাজ ব্যবস্থা কীভাবে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে গেল বা কারা ধ্বংসের বাতাবরণ তৈরি করল তা লেখক দেখেন। এ গল্পে রুদ্র বাড়ি খুঁজতে বেরিয়েছে, আসলে সে শেকড়ে পৌঁছতে চেয়েছে। দেশভাগে সে উদ্বাস্তু হয়েছিল। গল্পের শেষে মিলেছে কালজিনি নদীর তীরে মাঝি আজব বাঙালের সঙ্গে। সেও দেশভাগে উদ্বাস্তু। এক উদ্বাস্তু গিয়েছে আরেক উদ্বাস্তুর কাছে। শহরতলির রুদ্র গিয়েছে মফস্‌সলের আজবের কাছে। আজব নিজের সংস্কৃতি নিয়ে বাঁচে আছে, কিন্তু রুদ্রের সংস্কৃতি পাল্টে গেছে। মিডিয়া, শহরের পরিমণ্ডল পাল্টে দিতে বাধ্য করেছে। সে স্রোত গ্রামে পৌঁছায়নি ঠিকই কিন্তু গ্রামীণ সংস্কৃতিরও ভাঙন ধরেছে। গল্প থেকে দুজনের বয়ান সম্পর্কে দুটি মন্তব্য তুলে ধরি –

রুদ্র –
‘’মা বলেছিলেন, তোকে আমরা ঘর দিতে পারিনি। দেশ দিতে পারিনি। আদরও দিতে পারিনি। আমার পেটের ভেতর তুই, তখন দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। আমি আজও ঘর খুঁজি। তোর খোঁজার মধ্যে আমি আছি।‘’ (তদেব, পৃ. ৫৮৫ )
 
আজব বাঙাল –
‘’নমস্কার। আমি আজব বাঙাল। পার্টিশনের জিনিস। আদি বাড়ি সাতক্ষীরা। জন্ম সাতচল্লিশে। বাবা মাধব বাঙাল। যাত্রার দল ছিল। সব বাজনা বাজাইতে পারতেন। বাঁশি বলেন বাঁশি। ঢোল বলেন ঢোল। দোতারা বলেন দোতারা। সবাই ওস্তাদ মানত। আমি একটা ভাদাইম্মা। অমিতরা আসে। প্যাঁচাল পাড়ি। অরা মজা পায়। তা আপনেরা শহরের লোক। কত জানেন। কত ক্ষমতা আপনেগো। আমরা বর্ডারের লোক। বর্ডারের লোকের কাছে ভালোমানুষ আসে না।‘’ (তদেব, পৃ. ৫৯০)
 
উদ্বাস্তু মানুষ যেন রাষ্ট্রের উচ্ছিষ্ট মানুষ। তবে আজব নিজের সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রেখেছে। মনের সুখে গান গায়, বাঁশি বাজায়। যে পরিসর রুদ্রদের নেই। ‘আকাশবাণী কলকাতা’ গল্পে বাচ্চা মেয়েটি রেডিও চেয়েছিল, আসলে বাঙালি সংস্কৃতি কীভাবে পাল্টে যাচ্ছে লেখক অক্ষরে অক্ষরে তা দেখান। সব সুরের তত্ত্ব, ব্যাখ্যা থাকলেও আজবরা মনের সুখে গায়। অথচ সে গানকেই বিকৃত করে দিচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। রুদ্রের মনের মতো বাড়ি কোথাও পায়নি। পাওয়া সম্ভব নয়। কেননা দেশের বাড়ি তো কখনোই পাওয়া যাবেনা। কিন্তু সে বিকল্প বাস্তবের সন্ধান পেতে চেয়েছিল। আসলে এই অনুসন্ধানের মধ্য দিয়েই নিজের শেকড়ে ফেরা, ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা। তবে সব মানুষই মন্দ নয়। জহরলাল বাগের মতো ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করা উকিল এখনও আছে। কিন্তু এই মানুষগুলোর মূল্য হৃাস পেয়ে যাচ্ছে। কেননা এক বুজরুকি তন্ত্র বিরাজ করছে সভ্যতার বুকে। উন্নয়ন যে কত ভয়ংকর, ধীরে ধীরে জঙ্গল নাশ করে সভ্যতা যে কোন বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা গল্পের ভাষ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে সুধাকান্ত শ্রেণি বৈষম্য, সাধারণ মানুষদের নিয়ে কমল ধরেছিল, কিন্তু নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারেনি। সাহিত্যের ভাষ্য পাল্টে গেছে। পাঠক আজ মেকি সর্বস্ব হয়ে গেছে। প্রকৃত সাহিত্য কোনটা তা চিনতে বড় ভুল করছে। সুধাকান্তের ভাষ্যে পাই –‘’যেমন যা গেলানো হয় তা-ই গেলে। তেমনই যা পড়ানো হয় তা-ই পড়ে। পাঠ্য কি অপাঠ্য বিচার নেই। মিডিয়া। অল পাওয়ারফুল মিডিয়া।‘’(তদেব, পৃ. ৫৮৭) বিভ্রমের বাস্তবতা যেমন উঁকি দেয় রুদ্র, মায়ার কথোপকথনে, তেমনি ঐতিহ্য কীভাবে ধ্বংস হয়ে গেল- লেখকের বাড়ি হয়েছে পোলিয়ো খাওয়ানোর অফিস। তেমনি যাঁরা শেকড়ের সন্ধান করে যাচ্ছেন, এতবছর পরেও দেশভাগের সত্য আবিষ্কার করতে ব্যস্ত, তাঁরা কারও কারও চোখে ‘ভাদাইম্মা’। আসলে শেকড়হীনতা, ঐতিহ্যহীনতার মধ্য দিয়েই আজকের বাঙালি নিজের স্বরূপ গড়ে তুলতে চাইছে, কিন্তু সে ভাবনা যে কত ভুল তার মর্মমূলে লেখক আঘাত করেন। 
             
( ৩ )
এই অবক্ষয়িত সময়ে আরও একবার প্রয়োজন ছিল রবীন্দ্রনাথের জন্ম। বাঙালি সংস্কৃতির এই রুগ্ন অবস্থায় তাঁকে বড় বেশি মনে পড়ে। যদিও রবীন্দ্রনাথের জন্ম সম্ভব নয়, তবুও তাঁর আদর্শ, চেতনা মননকে নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে। সেই চেতনায় পৌঁছে গিয়েছেন ‘গীতিনাথ’ গল্পে। তিনি ভাষাকে বারবার ভেঙেছেন। ভাষা নিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। আসলে নতুন সময়ের পরিপ্রেক্ষিপ্তে ভাষার বদল বিশেষ জরুরি। ভাষাও যেন লেখকের স্বতন্ত্রতা বহন করে চলে। বহিঃবিশ্বে যত পরিবর্তন ঘটেই চলুক না কেন কেউ কেউ তো রবীন্দ্র আদর্শকে সামনে রেখে বেঁচে থাকবে, তেমনি অবচেতন সত্তায় যে আকাঙ্ক্ষা, কোন আদর্শকে আঁকড়ে মানুষ বাঁচতে চাইছে তা বড় হয়ে উঠেছে। তবে আদর্শকেও তো সবসময় টিকিয়ে রাখা যায়না। সময়ের রন্ধে রন্ধে পরিবর্তনের সুর বেজে চলেছে। বাংলা মিডিয়াম শূন্য হয়ে যাচ্ছে, বাগান কেটে বিনোদনের পার্ক, পাখিদের নির্বাসন, চোখের সামনেই নানা রহস্যের ধাপ। শপিংমল, কলিং বেলে বিদেশি বাজনা, রুচিবোধ ও শব্দ ব্যবহারের পরিবর্তন ক্রমাগতই চলেছে। এই রহস্য মুক্তি কীভাবে তা আমাদের জানা নেই। তাই বুঝি রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ধরা।
                           
‘রঙ্গিলা দালানের মাটি’ গল্পের বয়নে পাই –‘’জন্ম নেয় নতুন নতুন কথা। কথার পথ ধরে বাঁচার নতুন নতুন জায়গায় পৌঁছোনো যায়।‘’( তদেব, পৃ. ৫৩১ ) সময়ের পরিবর্তনে কথার ভাষ্য যেমন পাল্টে যায় তেমনি কথার অন্দরমহলের চিত্র বদলে যায়। নতুন সময় নতুন সংস্কৃতি, নতুন বয়ন নিয়ে উপস্থিত হয়। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম যে শিষ্ট বাংলা ভাষায় কথা বলত তা আজ অপংস্কৃতির দাপটে অশ্লীল হতে বাধ্য হয়েছে। তেমনি পূর্বে মানুষ নিজের উপভাষায় কথা বলে আনন্দ অনুভব করত, এখন কোথায় যেন এক ঘৃণাবোধের জন্ম দিয়েছে। আসলে কেন্দ্র বা উচ্চবিত্ত নিজের সংস্কৃতি দ্বারা গোটা সমাজকেই আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে। আর স্বাভাবিকভাবেই তাই হচ্ছে। ফলে জনজীবনের বৃহত্তর অংশ, ও তার সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। তবে সব মাছ তো জালে ধরা পড়েনা। কেউ কেউ বেরিয়ে যায়। সেইসব মানুষ বাঁচিয়ে রেখেছে বাঙালির ঐতিহ্যকে, সংস্কৃতিকে। সংস্কৃতি তো নদীর মতো বহমান। উত্তরসূরী তা বহন করে না চললে তা মৃতপ্রায় হয়ে যায়, খসে পড়ে রঙ্গিলা দালানের মাটি। ভেসে আসে শবরীর গান –‘’দিনে দিনে খসিয়া পড়িবে রঙ্গিলা দালানের মাটি..”। সময় সব গ্রাস করে নেয়। এই গ্রাসের চিত্র মধুময় পাল বিভিন্ন গল্পে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেখিয়েছেন। রিক্সা হারিয়ে আজ টোটো-অটোর দাপট। একদিন ছিল গোরুর গাড়ি, ঘোড়া গাড়ির দাপট, তা লুপ্ত হয়ে এসেছিল রিক্সা,আজ রিক্সাও হারিয়ে যাচ্ছে। রিক্সা চালক ভাগবতের পুত্র বাধ্য হয়েছে টোটো চালাতে। বিশ্ব সংস্কৃতিকে দূরে রেখে নিজের ঐতিহ্য নিয়ে বাঁচতে চাইলে প্রশ্ন ওঠে চিন্তার সংকীর্ণতা বা প্রাদেশিকতা নিয়ে। গল্পের বয়নে পাই –‘’কর্পোরেট পৌঁছে গিয়েছে সাতবাটিতে। ফ্যাশানের মায়ায় দিনমজুরের সন্তানেরা আজ কার্টুনপিস।‘’(তদেব, পৃ. ৫২৭) রাষ্ট্র ও কর্পোরেট সংস্থা ঠিক করে দিচ্ছে মানুষের সংস্কৃতি কী হবে। সুমন্তর মাতা ছিল বাংলা সাহিত্যের পাঠক, লোকসংগীত শুনে নিজের হৃদয় তৃপ্ত করত, সন্তান বড় হয়ে চলেছে লুকাচ, গ্রামশি, গোদার, বার্গম্যান চর্চা করে। লুকাচ, গ্রামশি চর্চা ভালো কিন্তু নিজের ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিয়ে সে চর্চা খুব কি ভালো ? লেখকের জিজ্ঞাসায় সমাজ পরিবর্তনের এক রহস্য আমাদের কাছে ধরা পড়ে। মাতার পছন্দের করবীকে পছন্দ হয়নি সুমন্তর। এখানেও সেই সংস্কৃতির ব্যবধানের প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে। করবী ভাওয়াইয়া গান শেখা কলোনির মেয়ে, সুমন্ত চায় কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত শেকড়হীন , সংস্কৃতিহীন আধুনিকা। তাই হয়েছে। তাই যে প্রাচ্য ভুলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে ডুবে যাওয়া এর থেকে বাঙালির মুক্তি নেই। ফল হিসেবে বাঙালির সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। করবীর মৃত্যুতে সে ঐতিহ্য কন্যা শবরী ধরে রেখেছে ঠিকই কিন্তু অপসংস্কৃতি, বিশ্বয়ন ও কর্পোরেট পুঁজির দাপটে কতদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে তা বড় সংশয়ের বিষয়। সব ধসে যাচ্ছে রঙ্গিলা দালানের মাটির মতো। কোন ঐতিহ্য নিয়ে বেঁচে থাকবে আমাদের উত্তরাসূরীরা ? এক শেকড়হীন সাংস্কৃতিক বোধ নিয়ে বড় হয়ে উঠবে আগামী প্রজন্ম। অথচ আমাদের কী কিছুই ছিলনা ? আমরা হারিয়ে ফেলছি, কর্পোরেট হারিয়ে ফেলতে বাধ্য করছে, সংস্কৃতি বিচ্যুত মানুষের গভীর সংকটকে লেখক বড় করে তোলেন। হয়ত এসব গল্পের মধ্য দিয়েই আগামীদেনের বাঙালি নিজের সংস্কৃতিকে  খুঁজে নিতে পারবে। ‘কারণ নদীর জল’ গল্প থেকে দুটি উক্তি তুলে ধরি –

ক. ‘’আমার একটা লেখাও সত্যি নয়। সব বানানো। লোকজনকে আরাম দেওয়ার জন্য লেখা। নিজেকে যতটুকু জানি, তাতে একটি সত্য কথা বলার মুরোদ নেই। কারও নেই। আমাদের আত্মজীবনী নেই, ডায়েরি নেই। যা আছে ফালটুস। ভেবে ভেবে বানিয়ে লেখা। আমি নিজের অপকর্ম জানি, অন্যের জানি। অনেক বিখ্যাত লোকের জানি। বলতে পারব না। যদি বলি, কেউ ছাপবে না। কেন ছাপবে ? সেই জিনিসই ছাপা হয়, যা পয়সা দেয়। সত্য পয়সা দেয় না। বরং পয়সা আমদানির পথ বন্ধ করে দেয়।‘’(তদেব, পৃ. ৪৭৭)

খ. ‘’অসাম্প্রদায়িক বলে কিছু হয় না। প্রতিটি লোক কোনো-না –কোনোভাবে সাম্প্রদায়িক। হয় ধর্ম, নয় সংঘ, নয় দল, নয় গোষ্ঠী, নয় চক্র-একটা-না একটাতে আর পাঁচজনের সঙ্গে বাঁধা পড়ে সাম্প্রদায়িক হয়ে আছে। মুক্তিচিন্তাও আসলে যুক্তচিন্তা। সম্প্রদায়ের গতের বাইরে যেতে পারে না।‘’ ( তদেব, পৃ. ৪৮২ )

দুটি উক্তি তুলে ধরার কারণ এই উক্তি দুটির মধ্য দিয়েই মধুময় পালের গল্পভাবনা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সম্পাদনার পাশাপাশি তিনি কেন গল্প লিখতে এলেন ? সময় সমাজ সম্পর্কে হৃদয়ে অনেকগুলি কথা জমা হয়ে আছে। যে কথার প্রকাশ আধুনিক কথাসাহিত্যে লেখা হচ্ছেনা। আমরা যতই উদার চিন্তার কথা বলি না কেন, আমরা যে কোথাও না কোথাও সংকীর্ণ তা লেখক জানেন। আমাদের জীবন থেকে নদী হারিয়ে যাচ্ছে, বহমান ক্ষমতা হারানোর ফলে এবং অচল নিকাশি ব্যবস্থার ফলে জনজীবন বিপর্যস্থ। সামান্য বৃষ্টিতেই পথে জল জমে যাচ্ছে। আত্মভোগী মধ্যবিত্ত বাঙালি সর্বদা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, নিজেকেই শ্রেষ্ঠ ভাবতে আগ্রহী। প্রিয়নাথ খুঁজতে চেয়েছে ‘কোন কাজের দাম সবচেয়ে বেশি ?’ প্রত্যেকেই নিজের পেশা আনন্দের সঙ্গে যাপন করে কিন্তু সমাজ দেখে ঘৃণার চোখে। সেই সঙ্গে আছে অপসংস্কৃতি। প্রিয়নাথের মনে হয়েছে –‘নিজেকে নষ্ট করতে পারা সবচেয়ে দামি’। মধ্যবিত্তের পরিসর কীভাবে ক্ষয়ে যাচ্ছে, নিজেকে দামি করে তুলতে গিয়ে কীভাবে সমাজের কাছে ব্যক্তির সর্বস্ব প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে তার সমগ্র স্বরূপ প্রকাশ পেয়ে যায়। প্রিয়নাথের জবানিতে যখন পাই-‘কাজ করি না। কাজের ভান করি। সেটাই বড় কাজ’- আমাদের কাছে মধ্যবিত্ত সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের চিন্তাবৃত্তি ও কর্মজীবনের চিত্র আর অস্পষ্ট থাকেনা। শুধু তাই নয় –‘বুদ্ধিজীবীরা মানুষের কথা বেশি বলে, মানুষের সঙ্গে কথা বলে না।‘-মানুষের স্বভাবের দ্বিচারিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মধুময় পাল অস্তিমজ্জা সহ মানুষের যে রূপ তা দেখেন, আমাদের দেখান। সেখানে কোন আপস নয়, আবেগ নয়, ফ্যান্টাসি নয়, মন্দটা তিনি মন্দ করেই দেখান। সেটাই বুঝি তাঁর কাছে কাজের লেখা। মুক্তির লেখা, সংগ্রামের লেখা, যাপনচিত্রের সত্য উদ্ভাসনের লেখা। ‘অলোকসফর’ গল্পে বিপ্রতীপ স্বর ফুটে উঠতে দেখি। সভ্যতা যতই প্রযুক্তি বিদ্যায় উন্নত হয়ে আলোর দিকে যাত্রা করুক না কেন সেখানে আরও বড় অন্ধকার। প্রদীপের তলায় যে অন্ধকার তা মিডিয়া, রাষ্ট্র, বুদ্ধিজীবীরা বলেনা। এই অন্ধকার তাঁরা যে জানেনা তা নয়, আসলে অন্ধকারকে ভুলে গিয়ে, ভোলার ভান করে, উপলব্ধিহীনতার ভান করে আলোকসজ্জায় ডুবে থাকে, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার ইন্ধন জোগায়। কিন্তু একজন সচেতন লেখকের পক্ষে তা সম্ভব নয়। তাই কলম তুলে নিতে হয় মধুময় পালদের মতো লেখকদের। কালীপ্রসন্ন সিংহ হুতুমের মধ্য দিয়ে কলকাতার বাবু বাঙালিকে যে ব্যঙ্গ করেছিলেন তা থেকে বাঙালি শিক্ষা নেয়নি। গণ্ডার চামড়ার মতো সমস্ত ভুলে, নিজের বিবেক বিসর্জন দিয়ে আত্মসিদ্ধিতে সচেষ্ট হয়েছে। আজকের কবি কোন ভূমিকা পালন করেছে ? রাজনীতির ক্ষমতাপ্রাপ্ত শাসক দলের নোংরামির কণ্ঠস্বর থেকে যখন বক্তব্য ঘোষিত হয়, পাশে বসে জয় গোস্বামী, আবুল বাশাররা হাততালি দেয় তখন তাঁদের কাছ থেকে কোন সাহিত্য, প্রতিবাদ , শ্রেণিচেতনা আশা করব ? মালতীবালার স্রষ্টা বা ‘যদিও স্বপ্ন স্বপ্নহীন’ এর লেখক যখন নিজেই শ্রমজীবী, মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বপ্নভঙ্গের বারোটা বাজিয়ে দেওয়ার চাবিকাঠি হয়ে ওঠেন তখন কোন প্রত্যাশা নিয়ে বসে থাকব ? বিকল্প বাস্তবের সন্ধানে যেতে হয়, তুলে নিতে হয় মধুময় পালদের মতো লেখকের আখ্যানভাবনাকে। যখন গল্পের বয়নে পাই –‘’আপনি কোন দলের পোয়েট ? আমাদের না হুলোর, না ওদের মুলোর ? মুলোর পোয়েটরা কনস্পিরেসি করিতেছি বলিয়া শুনা যায়।‘’(তদেব, পৃ. ৪৩৭ ) তখন আর বিশ্বাস থাকেনা সাহিত্যের ওপর। কিন্তু বিশ্বাসহীন হয়ে বাঁচবো কীভাবে ! রকমারি বিজ্ঞাপনে যখন ভিতরের আখ্যান নয় মলাটই প্রধান হয়ে ওঠে তখন কোন সাহিত্য পড়ব ? খুঁজে নিতে হয় বিকল্প বয়নের। সংকটের কালে যখন প্রতিষ্ঠানের পত্রিকায় ভেসে ওঠে –‘’সকালে ঘুম ভাঙলে দেখি দুপুর / দুপুরের গা ঘেঁষে হারানো পুকুর’’(তদেব, পৃ. ৪৪২ ) বেরিয়ে যেতে হয়, নিজের পাঠকসত্তার নষ্টামি রুখে দিতে বিপ্রতীপ স্বরকে খুঁজে চলতে হয়।
            
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থেকে কৃষকের মুক্তি নেই। রাষ্ট্রের কাছে কৃষক যেন মানুষ নয় নিছক সংখ্যা। রাষ্ট্র নিজের প্রয়োজনে কৃষককে ব্যবহার করে। তেমনি কৃষক বিদ্রোহ রাষ্ট্রের কাছে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, ক্ষমতা প্রয়োগে বিক্ষোভ দূর করতে চায়। তেভাগা থেকে নক্‌শাল আন্দোলন হয়েও সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের মতো ঘটনা ঘটছে। রাষ্ট্র নিজের ইচ্ছা পূরণে কৃষকের স্বার্থকে বলি দিতে চেয়েছে। ‘রক্তমেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আজও’ গল্পে তেভাগা থেকে নক্‌শালবাড়ি আন্দোলন হয়ে সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে প্রবেশ করেছেন। রাষ্ট্রের নির্মম রূপ উন্মোচন করেছেন। ইলা মিত্র, তাপসি মালিকরা যে যুগে-যুগে প্রাণ দিতে প্রস্তুত থাকে তেমনি বেশ কিছু নক্‌শাল জীবনের শেষে কীভাবে আদর্শ বিসর্জন দিয়েছে তা দেখি। চিটফান্ডের কারবার সহ, পুকুর ভরাট শুরু হয়েছে। ব্যক্তি নিজের প্রয়োজনে ক্ষমতাকে পাশে রেখেছে অথচ এঁরাই একদিন মুক্তির ডাক দিয়েছিল। হরিশদের চরিত্রের স্বরূপ পাল্টে গেছে। যে আদর্শ নিয়ে নবীন যুবকরা একদিন ঘর ছেড়েছিল, কেউ কেউ পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেছিল, বেঁচে থাকা মানুষগুলি আদর্শ বিসর্জন দিয়েছে। আসলে যৌবনের উদ্যোম হারিয়ে গেছে। অনেকে হয়ত সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম নিয়ে মিছিলেই নামেনি। মধ্যবিত্তের চোরাবালি ক্রমেই গ্রাস করেছে। গল্পকথক কন্যাকে জানিয়েছে সত্তরের উত্তাল দিনগুলির কথা। গল্পের বয়নে পাই –

‘’আমি মৃত। সত্তর দশক মৃত্যুর দশক।ঘাতকের উৎসবের দশক। ঘাতকেরা আজ সম্রাটের মতো। আমি মৃত।
মৃত্যুর স্ফুলিঙ্গ থাকে। একটি স্ফুলিঙ্গ দাবানল সৃষ্টি করতে পারে। আমি মৃত। অন্ধকার।‘’( তদেব, পৃ. ৩৬৭ )
সেই স্ফুলিঙ্গই দাবানল হয়ে প্রকাশ পেয়েছিল সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে। এবার আর ব্যর্থ নয়। রাষ্ট্রকেই পিছনে হাঁটতে ব্যর্থ করেছিল কৃষকরা। ইলা মিত্রের অত্যাচার, দ্রোণাচার্য ঘোষ সহ লেখক ফিরে গেছেন সত্তর দশকের উত্তাল দিনগুলিতে। অত্যাচারিত ফুলদিরাই যেন বিদ্রোহের বীজ বপন করে গিয়েছিল। শুধু আদর্শের মৃত্যু নয়, আদর্শের স্মৃতিও মুছিয়ে দিতে চায় ক্ষমতার রাষ্ট্র। আদর্শ মুছিয়ে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করে, মানুষকে অবিরত বিভ্রান্তির মধ্যে রেখে রাষ্ট্র নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। শুধু রাষ্ট্র নিজেই নয় তার নানা সিঁড়ি আছে। এই ক্ষমতার সিঁড়ি ধরেই একের পর এক চলে আগ্রাসন। তাই ঝুনুমতীরা যখন আসে তখন আদর্শের মৃত্যু হয়ে যায়, পথ দেখানো পথিকের মৃত্যু হয়ে যায়। রাষ্ট্র মানুষকে পথ হারানোর গোলকধাঁধায় হারিয়ে দেয়, যিনি সোজা পথে চলবেন তাঁকেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ‘ঝুনুমতীরা যখন আসে’ গল্পে আশ্বিন মাস হলেও ঝুনুমতীরা ঘরে ফেরেনি। কেননা তাঁরা পাচার হয়ে গেছে। ঝুনুমতীর মতো বহু মেয়ে পাচার হয়ে গেছে, বিক্রি হয়ে গেছে, ধর্ষিত হয়ে গেছে। দালালরা গ্রামে এসে কর্ম ও রোজগারের ফুলঝুড়ি ছিটিয়ে মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে গেছে। এই দালালদের সঙ্গে যুক্ত আছে পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতারা। এই চক্রান্ত উপলব্ধি করতে পেরেছিল মাস্টার অরুণ বিশ্বাস। নয়াপট্টির সব কীভাবে গ্রাস করছে দালালরা তা মাস্টার জনসাধারণকেই বোঝাতেই মাস্টারকে হত্যা করে দেওয়া হয়। নদী হারিয়ে যাচ্ছে, নদী বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, মিডিয়ার দাপাদাপি, বিজ্ঞাপনের চোকঝলসানো দৃষ্টিহীন নান্দনিকতা, উৎসবের আবহ, তারমধ্যেই সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। নদী ও কন্যা একাকার হয়ে যায়। লেখকের মতে মাস্টারের মৃত্যুতেই আখ্যানের শেষ হতে পারত কিন্তু ক্ষমতার আরও কিছু প্রয়োজন। সে আদর্শের স্মৃতিকেও ধ্বংস করে দিতে চায়। স্মৃতিহীন, আদর্শহীন, প্রতিবাদহীন, রাষ্ট্রের দলদাস হিসেবে মানুষকে গড়ে তুলতে চায় রাষ্ট্র। কিন্তু অলক্ষ্য থেকে বেজে ওঠে বিসর্জনের বাজনা। সেই ক্ষমতার মধ্যে যে কত গোলকধাঁধা, নষ্টামি, ঘুণপোকা তা লেখক দেখিয়ে দিয়ে যান –

‘’কর্তৃত্বের মুখের ওপর কথা ! জিভ ছিঁড়ে পড়বে ভাগাড়ে
পা চিরে ফাঁক-করা হাত এখন আরও পোক্ত কর্তৃত্বের মুখের ওপর কথা ! চোপা যাবে, শাঁখাও যাবে মা খুঁজে পাবি না, বাপ খুঁজে পাবি না, ছেলেও।
মরাইয়ে আগুন, ছিন্ন মেয়ে ধানখেতে পাটখেতে কৃষিতে আমরা এক নম্বর, মানে শীর্ষে তাপসী মালিকের ঝলসানো বডি সেঁটে দেব ঘরে ঘরে রেপের অডিয়ো বাজাব দু-শো ডেসিবেলে পুড়িয়ে –মারা নাটক হবে পুড়ে-মরার আত্মঘাত মহিলা কমিশন অন্ধ বোবা আমার ডিরেকশনে শিল্পে আমাদের এক নম্বর হতেই হবে” ( তদেব, পৃ. ৪১৩, ৪১৪ )

কী ছিল বাঙালি সংস্কৃতির স্বরূপ, আর কোন পরিসরে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি, এই দুইয়ের মধ্যে কত ব্যবধান তা নির্মাণ করে চলেন। বাঙালি সংস্কৃতি কীভাবে ধ্বংস হল, এই ধ্বংসের পিছনে রাষ্ট্র, মিডিয়া কী ভূমিকা পালন করল তা দেখান। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে কোন ভূমিকা পালন করার কথা ছিল আর প্রতিষ্ঠান মানুষকে কীভাবে বিভ্রান্ত করল –এদুয়ের মধ্যে কত ব্যবধান তা সমাজতাত্ত্বিকের মতো বিশ্লেষণের পটভূমিকায় অবতীর্ণ হন।  বিজ্ঞাপন কীভাবে সব গ্রাস করল, যৌনতা ভরা বিজ্ঞাপনের ভাষা মানুষের রুচিবোধ কীভাবে পাল্টে দিল, শিষ্ট বাংলা ভাষার রূপ কীভাবে ক্রমেই অশ্লীল হয়ে উঠল, কেন্দ্রের ভাষা বিশুদ্ধ বাংলা থেকে কীভাবে হিন্দি মিশ্রিত হয়ে জগাখুচুরি রূপ ধারণ করল এসব তাঁর গল্পের কেন্দ্রীয় সত্য। আপাত ভাবে কোন কাহিনি তাঁর গল্পে নেই, বিচ্ছিন্ন একাধিক ঘটনাপুঞ্জের মধ্য দিয়ে তিনি পরিবর্তিত বাঙালি জীবনের ভাষ্য রচনা করে চলেন। লোক ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে, কলোনিকে গ্রাস করে ফ্ল্যাট, শপিংমল, প্রকৃতিকে দংশন করে ভিত্তিহীন নগরায়ণের পরিকল্পনা যে কত অবস্তাব তা তিনি কাহিনির রন্ধে রন্ধে বুনে চলেন। রাষ্ট্র কীভাবে তার নিজস্ব ভাবনা দ্বারা জনগণের বুদ্ধিকে নাশ করছে, মিডিয়াকে হাতে রেখে জীবনের অভিমুখকে ঘুড়িয়ে দিয়ে এক মাৎস্যন্যায়ের মধ্য দিয়ে গোটা সমাজব্যবস্থাকেই ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে তা মধুময় পাল বিভিন্ন গল্প ভিন্ন ভিন্ন পরিসরে নির্মাণ করে চলেন। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.