তপশ্রী পাল

রঙের দাগ, তপশ্রী পাল, শব্দের মিছিল

বিয়ের পর ঘাটশিলা বেড়াতে এসেছে শতরূপা আর অর্জুন। বসন্তের শুরুতে ঘাটশিলার প্রকৃতি বড়ো সুন্দর। হাওয়ায় শীতের আমেজ এখনো কাটে নি, কিন্তু দূরের কালো ঢেউ খেলানো পাহাড়গুলোর মাথায় সোনা রোদ খেলে যায় সকাল হলে। চারদিকে শাল মহুয়া শিমূল গাছের সারি। মহুয়া, শিমূল পলাশের রঙে রঙিন দিগন্ত। উঁচু নীচু রুক্ষ লাল মাটির রাস্তা চলে গেছে গাছের সারির মধ্য দিয়ে বেঁকে । দূর থেকে কোকিলের ডাক শোনা যায় মাঝে মাঝে। তিরতির করে পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে শীর্ণা নদী। সকাল হলে সাঁওতাল, সাওতালনীর দল বনের দিকে যায় সারি দিয়ে কাঠ, মহুয়া ফল, মধুর সন্ধানে। এই পরিবেশে এসে এক মুক্তির স্বাদ পায় শতরূপা। কদিন শ্বশুরবাড়ি নেই, চাকরী নেই, শহরের জানজট নেই! শুধু অর্জুন আর ও! ওরা এসে উঠেছে এখানকার সার্কিট হাউসে। চৌকিদার ঝুমন সিং দারুণ রান্না করে। ছটফটানো কালো দেশী মোরগ নিয়ে আসে হাট থেকে! লঙ্কা দিয়ে ঝাল ঝাল মুরগীর ঝোল অথবা দেশী মুরগীর ডিমের ডালনা আর মোটা চালের ভাত, ধোঁয়া ওঠা মুসুর ডাল, হাটের তাজা সব্জী দারুণ জমে লাঞ্চ আর ডিনার! দুদিন হলো এসেছে। তাতেই খেয়ে খেয়ে দু কেজি ওজন বেড়ে গেলো মনে হচ্ছে। সকাল বিকেল বনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে বেড়ায় ওরা। শতরূপার শত শত ছবি নানা ভঙ্গিতে তুলে ফেলে অর্জুন। এবরোখেবরো মাটিতে শতরূপা হোঁচট খেলে তাড়াতাড়ি ওর হাত ধরে জড়িয়ে নেয়! শতরূপার পড়ে যাবার বড়ো প্রবণতা। দুজনের চোখে চোখে হাসি খেলে যায়।

সেদিন দোলের সকাল। আগের দিনই হাট থেকে মারকাটারী গোলাপী আর লাল আবির কিনে রেখেছে শতরূপা। কিনেছে পিচকারী আর জল রং! অর্জুনকে হঠাত করে ভূত বানিয়ে ছাড়বে ঠিক করে রেখেছে। সকালে মোটা মোটা পুরী আর আলু সব্জী দিয়ে গেলো ঝুমন। সঙ্গে ওর বৌ লাড্ডু পাঠিয়েছে হোলির! ওর কপালেও তিলক পরিয়ে দিলো শতরূপা। বাইরে দূর থেকে কারা যেন ঢোল বাজিয়ে “হোলি হ্যায়” গেয়ে চলেছে। অর্জুন খেতে খেতে ওর ল্যাপটপে কি সব কাজ করছিলো । এখানে এসেও অফিসের কল আর কাজ পিছু ছাড়ে না। শতরূপা বালতি আর জল চেয়ে রেখেছিলো ঝুমনের কাছে। খাওয়া শেষ করে চুপি চুপি বালতির জলে ঢেলে দিলো রং, ভরে নিলো পিচকারী। তারপর নিশব্দে ঘরে ঢুকেই পিচকারী বাগিয়ে বলে উঠলো “হোলি হ্যায়!” চমকে ফিরে তাকালো অর্জুন। ওর মুখ থেকে সব রক্ত সরে গেছে! ভুরু কুঁচকে প্রচন্ড চেঁচিয়ে বলে উঠলো “খবরদার! এক ফোঁটা রং দেবে না বলছি! আমি হোলি খেলি না! মা তোমাকে বলে নি কিছু? আমাকে জিজ্ঞাসা না করে এভাবে রং দেওয়ার সাহস হয় কি করে তোমার?” এতো জোর ধমক খেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো শতরূপা। ওর মুখ শুকিয়ে আমসি, চোখে জল চলে এলো। খানিক চুপ করে থেকে বললো “আজ তো দোল, আমি বিয়ের আগে খুব হোলি খেলতাম। ভাবলাম তোমাকে অবাক করে দেবো – তুমি যে এতো আপসেট হয়ে যাবে – সরি” বলে দৌড়ে চলে গেলো।

পিচকারী ভরা রং ফেলে দিয়ে বাথরুমে ঢুকে কাঁদতে লাগলো শতরূপা। এমন ব্যবহার অর্জুনের কাছে ও একেবারে আশা করে নি। স্বভাবগত ভাবে শান্ত অর্জুন। তবে কোন বিশেষ কারণ আছে অর্জুনের এমন ব্যবহারের? কোন অতীতের ঘটনা? হঠাত মনে হলো কতদিন আর অর্জুনকে চেনে ? কত কথাই তো এখনো জানা বাকী! কিন্তু সে কথা তো ভালোভাবেও বলা যেতো। অর্জুনের রিঅ্যাকশনটা ছিলো যেন শতরূপা ওকে আক্রমণ করতে চেয়েছে এমন। সামান্য রং ভরা পিচকারী দেখে এমন?     

ওদের প্রেমের বিয়ে নয়, তবে বিয়ের আগেই অর্জুনের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো শতরূপা। যখন সম্বন্ধ হচ্ছে, তখন অর্জুনের একটা ছবি এসেছিলো হাতে। ডানদিকে ঘোরানো মুখ। দারুণ হ্যান্ডসাম চেহারা। হাইটও দারুণ। যাকে বলে টল ডার্ক হ্যান্ডসাম। সুন্দর পুরুষের ওপর শতরূপার চির দুর্বলতা। অন্যরা যেমন ছেলেদের টাকা দেখে বিয়ে করে, শতরূপা তা একেবারেই নয় । ওর দরকার সুন্দর চেহারা ও সুন্দর মনের, একটা বন্ধুর মতো ছেলে। যার সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করতে পারবে। শতরূপা ইঞ্জিনীয়ার। চাকরী করে নিজেও। তাই স্বপ্ন ছিলো দুজনে রোজগার করে নিজেরাই গড়ে তুলবে নিজেদের ভবিষ্যত। ছটফটে তরুণ অর্জুন ছিলো ঠিক যেমন শতরূপা চাইছিলো তেমনটি। তবে কথায় বলে হাজার কথা না হলে বিয়ে হয় না, তাই শতরূপার বাবা একদিন দেখা করতে গেছিলেন অর্জুনের অফিসে। ফিরে এসেছিলেন গম্ভীর মুখে। তারপর শতরূপা মায়ের সঙ্গে বাবার কথোপকথন শুনেছিলো “ছেলেটা সবদিক থেকেই ভালো, কিন্তু এখানে এগোনো যাবে না।“ মা উদ্বিগ্ন মুখে বলেছিলেন “কেন গো?” “ছেলেটির গলায় বাঁ দিকে বেশ বড়ো প্লাস্টিক সার্জারির দাগ আছে। বাঁ ভুরুর ওপরেও আছে। জিজ্ঞাসা করতে বললো একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিলো। আর কিছু বলতে চাইলো না। খুব গম্ভীর হয়ে গেলো!”

কিন্তু শতরূপা যে ঐ ছবির প্রেমে পড়ে গেছিলো। তাই বাবাকে বুঝিয়ে বলেছিলো যে সামনাসামনি একবার কথা বলে ওর নিজের চোখে যদি খারাপ না লাগে তাহলে ওর কোন আপত্তি নেই। বাবা বলেছিলেন “কার পিছনে কী ইতিহাস আছে তুমি কি জানো?” কিন্তু শতরূপাকে টলাতে পারেন নি। তারপর অফিস থেকে বেরিয়ে লাঞ্চ টাইমে পার্ক স্ট্রিটে দেখা হয়েছিলো অর্জুনের সঙ্গে। একসঙ্গে একটা রেস্তোরায় বসেছিলো ওরা। প্রথম থেকেই ওদের গল্প জমে উঠেছিলো। অল্প আলোয় অর্জুনকে বেশ হ্যান্ডসাম লাগছিলো। রাস্তায় বেরিয়ে ইচ্ছে করেই অর্জুনের বাঁ দিক দিয়ে হাঁটছিলো শতরূপা আর লক্ষ্য করছিলো ওর মুখের বাঁ দিক। একটু যে খারাপ লাগছিলো না তা নয়। অন্যমনস্ক হয়ে পাথরে হোঁচট খেয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো শতরূপা। অর্জুন তাড়াতাড়ি ধরে ফেলেছিলো ওকে। সেই মূহূর্তে ওকে খুব আপন, খুব কেয়ারিং লেগেছিলো। মনে হয়েছিলো সারা জীবন এমন করেই ওকে সামলাবে অর্জুন। চোখে সইয়ে নিয়েছিলো ওর গলার দাগগুলো । বাবাকে বলেছিলো ওর কোন আপত্তি নেই।  

ফুলশয্যার রাতে সারারাত গল্প করেছিলো ওরা। একসময় শতরূপা ওর দাগগুলোর ওপর হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলো “কি হয়েছিলো তোমার গলায়?” সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে পাঞ্জাবীর কলারটা টেনে দিয়েছিলো অর্জুন। গম্ভীর হয়ে বলেছিলো “ও কিছু নয়, অ্যাক্সিডেন্ট”। এরপর আর কিছুতেই এ ব্যাপারে আর কিছু জানা যায় নি। বাড়িতেও সবাই এ ব্যাপারে ছিলো নীরব। এখন নতুন করে সন্দেহটা দানা বেঁধে উঠলো শতরূপার মনে। তবে কি কোন অতীত আছে অর্জুনের যা ওর পক্ষে অস্বস্তিকর? কিন্তু শতরূপাকেও যদি বলতে না পারে তবে কিসের বিশ্বাস, কিসের ভালোবাসা?

রাতে বিছানায় আদরে আদরে ওর অভিমান ভাঙিয়ে দিয়েছিলো অর্জুন। শতরূপা বললো “আচ্ছা, হোলির সামান্য রং মাখতে তোমার এতো আপত্তি কেন গো? আমাকেও বলবে না? আমি তো আমার কলেজের কতো কথা, আমার আগের যতো বয়ফ্রেন্ড - সব তোমাকে বলেছি! তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না অর্জুন?”

হঠাত অর্জুন উঠে বসে বললো “খুব কৌতুহল তোমার, তাই না? আমাকে যেমন আছি তেমন ভাবে মেনে নিতে পারছো না? বেশ, সব বলবো তোমাকে, মেনে নিতে পারবে তো?” খুব আস্তে আস্তে বলেছিলো শতরূপা “তোমাকে ভালোবেসেছি, মেনে নিয়েছি বলেই বিয়ে করেছি অর্জুন!” 

“বেশ শোন তবে, কিন্তু আমি তোমাকে হারাতে চাই না” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে অর্জুন “আমার বাবা দীর্ঘদিন কাজের সূত্রে নাগপুরে পোস্টেড ছিলেন। আমার ইঞ্জিনীয়ারিং পড়া ওখানেই, তুমি তো জানো। ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে আমি, ইন্দর আর স্তুতি ছিলাম খুব বন্ধু। স্তুতি মহারাষ্ট্রিয়ান। একটা লম্বা বেণী বাঁধতো স্তুতি। সামনে দুপাশ থেকে কোঁকড়া চুলগুলো এসে পড়তো কপালের ওপর। কপালে একটা কুমকুমের টিকা অর্ধচন্দ্রের মতো আর পরণে অতি সাধারণ সালোয়ার বা শাড়ী। এই ছিলো ওর পোষাক। চোখে হালকা কাজল। পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলো স্তুতি। ইন্দর ছিলো ইউ পির ছেলে। ফর্সা, বেঁটে তাগড়া চেহারা আর মুখে সারাক্ষণ হাসি। ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ থেকে এডুকেশনাল ট্যুরে পঞ্চগনী গেছিলাম আমরা। একদিন পাহাড়ী রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে স্তুতি বললো ‘বাঙ্গালী ছেলে আমার খুব ভালো লাগে, জানো? বাঙ্গালীরা ঠিক আমাদের মতো। গানবাজনা ভালোবাসে, নরম মনের হয়।‘ বলে কি সুন্দর একটা মারাঠী ভজন গেয়ে শুনিয়েছিলো । ইন্দরের সঙ্গেও স্তুতি মিশতো খুব। ইন্দরের এতো খোলা স্বভাব আর হাসি দিয়ে ও টেনে নিতো সবাইকে। কিন্তু ফাইন্যাল ইয়ার পরীক্ষার আগে কিছু নোট নিতে গেছিলাম স্তুতির বাড়ীতে। সেদিন কেউ ছিলো না ওর বাড়িতে। ও হঠাত এসে বসে আমার হাঁটুর ওপর। তারপর বলে ‘পাশ করে আমরা চাকরী পাবো। তারপর তুমি আমায় বিয়ে করবে অর্জুন?’ কী যে ছিলো ওর কাজল কালো মায়াবী চোখে, আমি নিজেকে সামলাতে পারি নি। আমাদের প্রথম দেহমিলন হয় সেদিন! তারপর পরীক্ষার পর অবকাশে মাঝে মাঝেই যেতাম ওর বাড়ি আর সম্পর্কটাও অনেকদূর এগিয়ে গেলো। 

হঠাত একটা অদ্ভুত পরিবর্তন দেখলাম ইন্দরের ব্যবহারে। ওর সেই হাসিমুখ আর দেখতে পেতাম না। সবসময় ত্যাড়ছা চোখে তাকাতো আমার দিকে আর ঠোঁট বাঁকিয়ে কেমন একটা ভঙ্গী করতো। আমি খুব একটা পাত্তা দিই নি। পরীক্ষার ফল বেরোলো। আমি আর স্তুতি বেশ ভালো ফল করলাম আর ইন্দর বেশ কটা সাবজেক্টে ব্যাক পেলো। 

সেবার বছরের শুরুতেই বাবার বদলীর অর্ডার এলো। মার্চের মধ্যে আমাদের নাগপুর ছেড়ে চলে যেতে হবে নতুন জায়গায়। বাঁধাছাদা চলছে। এদিকে আমার তখন ইঞ্জিনীয়ারিং-এর ফাইনাল ইয়ার। তারপর রয়েছে স্তুতির আকর্ষণ! সব ছেড়ে চলে যেতে হবে? অসম্ভব! অবশেষে ইঞ্জিনীয়ারিং এর ফাইনাল পরীক্ষা পর্যন্ত আমি একা নাগপুরে থেকে যাবো ঠিক হলো।“

একমনে শুনছিলো শতরূপা। অর্জুনকে যেন নতুন ভাবে চিনছিলো। অর্জুন বলে চলে “তখন আমি বাড়িতে একা। পড়াশুনা করছি ফাইনালের জন্য । খাওয়াদাওয়ার ঠিক নেই । কোনদিন আসপাশের মৌসিরা কিছু রেঁধে দিয়ে যান আর নইলে টুটা বাসমতীর ভাত আর মাখন, এই ছিলো আমার খাওয়া। একদিন দুপুরে বড়ো একটা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে ঢুকলো স্তুতি। বললো ওর আম্মা পুরী, মটর সব্জী শ্রীখন্ড বানিয়েছে ওর জন্মদিন উপলক্ষ্যে। একসঙ্গে খাবে বলে নিয়ে এসেছে। আমাকে বেড়ে খুব যত্ন করে খাওয়ালো স্তুতি। তারপর আমরা একসঙ্গে পড়াশুনা করলাম। ওর পাশে বসে বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ওর শরীরের অজানা গন্ধ আমাকে সব ভুলিয়ে দিচ্ছিলো সেই দুপুরে। কখন যে আলগোছে ওকে জড়িয়ে নিয়েছিলাম – ওর চুর্ণ কুন্তল আমার গালে এসে লাগছিলো –“

বলতে বলতে হঠাত শতরূপার মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো অর্জুন। শতরূপার মুখ গম্ভীর, চোখের কোণে জল চিকচিক করছে! “ছিঃ ছিঃ, আমি নিজের মনে সেই দশ বছর আগের যত পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে যাচ্ছি রূপা – জানি এসব তোমার পক্ষে শোনা কতটা কষ্টকর! – থাক না এসব কথা –“ বলে অর্জুন।

“আমি শুনতে চাই! আমাকে শুনতেই হবে! যতো কষ্টই হোক!” দৃঢ় মুখে বলে শতরূপা।

“বেশ! শোন তবে। সেদিন বিকেলে হঠাত বেল বেজে উঠলো। আমরা – মানে আমি আর স্তুতি তখন –“ বলে আবার থেমে গেলো অর্জুন।

“কি তখন?” শতরূপা বলে “থেমে গেলে কেন?” বেশ খানিক অপেক্ষা করে জোর করে অর্জুন বলে ওঠে – “আমরা তখন এলোমেলো অবস্থায় ছিলাম! আমি উঠে দরজা খুললাম। স্তুতি দ্রুত নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিলো। দরজা খুলে দেখি সামনে ইন্দর। আমাদের দুজনকে দেখেই ওর মুখের চেহারা পালটে গেলো । বললো কিছু নোট ওর কাছে ছিলো না বলে চাইতে এসেছিলো আমার কাছে। কিন্তু কিছু বলার বা নোট দেওয়ার আগেই, যেমন এসেছিলো তেমন দ্রুত চলে গেলো ইন্দর!”

পরীক্ষা শেষ হলো। হোলি এলো। আমরা সাধারণতঃ কলেজে একসাথে রং খেলতাম । তাই সকালে বেরোবো বলে তৈরী হচ্ছিলাম। এমন সময় সাত আটজন কলেজের বন্ধু একসাথে ঢুকলো । ওদের মধ্যে ইন্দরও ছিলো। ওরা অলরেডি রং মেখে ভূত। হাতে একটা বালতিতে রং! আমি কিছু বোঝার আগেই “হোলি হ্যায়!” বলে সেই বালতিটা ইন্দর ঢেলে দিলো আমার গায়ে!” আমি চুপচুপে হয়ে গেলাম রং-এ! ওরা হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো । যাবার সময় ইন্দর চেঁচিয়ে বলে গেলো ‘ইয়ে রং কা দাগ উঠেগা নহী দোস্ত! ইধার সে জানে কে বাদ ভি ইয়াদ দিলায়েগা! স্তুতি মেরী হ্যায়!’ অবাক হয়ে গেলাম ওর কথা শুনে! তবে কি ইন্দরও স্তুতিকে ভালোবাসে! খানিক পর থেকে আমার সারা শরীর জ্বলতে লাগলো! গলার বাঁ পাশটা, বুকের বাঁ দিকটা, বাঁ চোখের ওপরটা যন্ত্রণায় পুড়ে যেতে লাগলো! প্রচুর ঠান্ডা জল ঢেলেও সে জ্বালা কমলো না। ডাক্তার বললো রং-এর জলে অ্যাসিড মেশানো ছিলো! আমার গলা, বুক, চোখের ওপরের চামড়া পুড়ে উঠে যেতে লাগলো! গলগল করে রক্ত বেরোতে লাগলো কোথাও চামড়া ফেটে! আয়নায় নিজেকে দেখে চিতকার করে উঠেছিলাম। হাসপাতালে ভর্তি হলাম । স্তুতি শুনে দু দিন পর দেখতে এলো আমাকে! কিন্তু আমার চেহারা দেখে ‘ও! নো!’ বলে সেই যে চলে গেলো, আর এলো না। বাবা মা এসে আমাকে নাগপুরের হাসপাতাল ছাড়িয়ে কলকাতায় বড়ো হাসপাতালে নিয়ে এলেন। প্রায় একমাস চিকিতসায় এবং প্লাস্টিক সার্জারি করে একটু একটু করে সেরে উঠলাম। প্রায় বছরখানেক পর এক বন্ধুর চিঠিতে জানলাম ইন্দর আর স্তুতি বিয়ে করেছে!”

নিস্তব্ধ হয়ে শুনছিলো শতরূপা। গল্প শেষ করে মাথা নীচু করে বসেছিলো অর্জুন। শতরূপা দেখলো আকাশে দোল পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদের আলোয় সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরা অর্জুনকে ঠিক মহাভারতের অর্জুনের মতো লাগছে! আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে অনেক আদরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো অর্জুনের গলায় বুকে চোখে। চুমুতে ভরিয়ে দিলো ওর ক্ষতস্থানগুলো। তারপর অন্ধকারে বলে উঠলো “জানো, কবিগুরুর শাপমোচন মনে পড়ছে আজ। 

কমলিকা বলে উঠলো প্রভু আমার, প্রিয় আমার, এ কী সুন্দর রূপ তোমার!" তারপর সুরেলা গলায় গেয়ে উঠলো
                  
 "বড়ো বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে        
                   কোথা হতে এলে তুমি হৃদি মাঝারে –“

এক পরম নির্ভরতায় শতরূপার বুকে মুখ গুঁজলো অর্জুন। 
    
 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.