মুখ দেখে কি মানুষ চেনা যায়। তেমনই প্রেম প্রেম বোধ হলেই কি ভালোবাসায় পৌঁছানো যায়? না বোধহয়। কিন্তু সুন্দরী মুখ আর উচ্চপদস্থ পেশাজীবী প্রোফাইল দেখলেই কেন তবে পারস্পরিক আকর্ষণ বোধ হয়? কিংবা কোথাও পৌঁছিয়ে দেওয়ার ছলে মাঝি সেজে কেউ যদি কাউকে হাতছানি দেয়। কোন সুন্দরী মুখকে? সেই প্রলোভন এড়ানো কজন রূপবতীর পক্ষে সম্ভব হয়? বিশেষত যদি লক্ষ্য থাকে বড়ো কোন মঞ্চে পা রাখার। নির্দিষ্ট কোন গন্তব্যে পৌঁছানোর? সকলেই চলেছে সকলের আগে। নির্দিষ্ট গন্তব্যের অভিমুখে গিয়ে পৌঁছিয়ে সর্বোচ্চ সুবিধেটুকু কুক্ষিগত করতে। গোটা বিষয়টিই অনেকটা যেন ব্যবসায়িক প্রয়োজন ও স্বার্থের মতোই। সেখানে পারস্পরিক ভালোবাসার ছদ্মবেশে প্রেমের অভিনয় যদি দুই পক্ষেরই স্বার্থ রক্ষা করে, তবে ক্ষতি কি? ক্ষতি কার? দুই পক্ষই যদি সেই অভিনয়ের বিষয়ে সচেতন থাকে, মনে হয় না কারুর কোন ক্ষতিবৃদ্ধি ঘটতে পারে। ঘটেও না সাধারণত। পারস্পরিক লক্ষ্য পূরণ হয়ে গেল। যে যার গন্তব্যে স্থিতু হয়ে গেল। এবার পরের নাটক। একটি নাটকের যবনিকা পতনের পর অন্য নাটকের স্ক্রীপ্ট। এইভাবেই কি চলছে না আমাদের সমাজ? না বলা কি সহজ? অন্তত জোর গলায়? মনে হয় না।
তাই যে যেখানে যতটুকু ক্ষমতার অধিকার অর্জন করে নিতে পারে। ততখানিই ফয়দা লোটার একটা নিরন্তর প্রয়াস থাকে তার ভিতরে। তার আরও একটা কারণ হতে পারে এই যে, সেই ক্ষমতায় পৌঁছাতে গিয়ে হয়তো অনেকটাই মূল্য দিতে হয়েছে। যে ধরণের মূল্যই হোক না কেন। এখন ক্ষমতায় পৌঁছিয়ে সেই মূল্য সুদে আসলে উশুল করে নিতে হবে। এ যেন সেই শাশুড়ী বৌমার ট্র্যাডিশনের চক্কর। বৌমা হয়ে মুখ বুঁজে একসময় শাশুরীর অন্যায় অবিচার সহ্য করতে হয়েছে বলে, পুত্রবধু ঘরে এনে, সেই জ্বালা মেটানোর খেলা। আমাদের এই বাংলার সমাজ ও সংসারে। কাঁটাতারের দুই পারেই। সেই একই ছবি। ইদানিং রাজনীতির সংস্কৃতি যত বেশি কলুষিত হচ্ছে, তত বেশি করেই যেন এই খেলাটা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। হ্যাঁ জনপ্রিয় তো বটেই। সৎ পথে পরিশ্রমের বদলে। মেধার নিরন্তর চর্চা ও অনুশীলনের বদলে। যদি কাউকে তেল দিয়ে, কাউকে আদর দিয়ে বাঁকা পথে আয়েসে কার্য সিদ্ধি হয়ে যায়, তবে আর পায় কে।
তাই ফাঁকিবাজ ছাত্রীর লক্ষ্য পারভার্টেড অধ্যাপক। না এমনটা ভাবার খুব বড়ো কোন কারণ নাই, ছাত্রী বলেই অধ্যাপকের শিকার। অধ্যাপক তো শিকারেই বেড়িয়েছেন। হাতে নানা রকম টোপ ঝুলিয়ে রেখে রূপবতীদের সাথে মিষ্টালাপ। কিন্তু রূপবতীদের চোখ ফাঁকি দেওয়া অতই সহজও নয়। তারা যে শুধু টোপটাই দেখে তা নয়। তারা কার্যসিদ্ধির ক্ষেত্রে টোপটাকে সত্য করে তোলার লক্ষেই টোপ গেলে। বা গেলার ভান করে। লাভ দুই পক্ষেরই। মিচ্যুয়াল অভিনয়ে সাপও মরবে। লাঠিও ভাঙবে না। শিকারীও বিলক্ষণ জানে শিকার শিকারীর গোঁফ দেখেই চিনে ফেলেছে। শিকারও জানে খেলাটা ধরে ফেলেছে অভিজ্ঞ শিকারী। এখন শুধু লক্ষ্য পূরণের পালায় দক্ষ অভিনয়টুকু চালিয়ে যাওয়া। সেই অভিনয়ের মুহুর্তগুলো, না শুধুই তো উপভোগ করলে চলবে না। যেরকম ভাবেই হোক না কেন, একটা রেকর্ড রাখতে রাখতে এগোনো ভালো। কেননা, যেকোন খেলার মতোই এখেলাতেও ঝুঁকি রয়েছে। তাই, কেউ কল রেকর্ডস, কি কেউ ভয়েস রেকর্ডস ধরে রাখে। কেউবা লুকানো ক্যামেরায় সযত্নে তুলে রাখে দুরন্ত অভিনয়ের চুড়ান্ত ক্লাইমেক্সের অফুরন্ত মজার জীবন্ত দৃশ্য। কেউ বা ধরে রাখে একান্ত আলাপের পারস্পরিক সংলাপের আক্ষরিক স্ক্রীনশট। কবে কখন কিভাবে কাজে লেগে যায়, কে জানে। কিন্তু হাত বলে হাতের কাছে কোন না কোন ব্রহ্মাস্ত্র মজুত করে না রাখলে, কে বলতে পারে পরে পস্তাতে হবে না। কপাল ঠুকতে হবে না ভাগ্যের চৌকাঠে? আত্মরক্ষাই হোক আর আক্রমণ শানানোই হোক। ভবিষ্যতের জন্য আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখাই এই খেলার নিয়ম। প্রত্যেক ঝুঁকিরই কোন না কোন বীমা থাকা দরকার।
না শুধুই অধ্যাপক ছাত্রীই এই খেলায় নামে না। সমাজ সংসারে হয়তো এমন কোন ক্ষেত্রই নাই। যেখানে এই মুহুর্তে চলছে না এই খেলা। এই খেলার আরও একটি বড়ো বৈশিষ্ট রয়েছে। এই করোনাকালের ফাঁকা স্টেডিয়ামের মতো, এখেলা দেখতে কোন দর্শক থাকে না। দর্শক আসে অনেক পরে। ঘটনার জল যখন কুল ছাপিয়ে ডাঙায় উঠে পড়ে তখন। তখন দর্শেকর অভাবও হয় না। উৎসাহ উদ্দীপনার কোন ঘাটতিও দেখা যায় না। আসল মজা কিন্তু তখনই। দুই পক্ষের অভিনয় তখন দর্শকের মধ্যেও সংক্রমিত হয়ে পড়ে প্রবল ভাবে। দর্শকও এমন ভান করতে থাকে। যেন ভাজা মাছটা উল্টিয়ে খেতে জানে না। এমন খেলা ইহজীবনে দেখে নাই। চারিদিকে বোধদয়ের পাতা খুলে নীতিশাস্ত্রের ছত্র আউরানোর ধুম পড়ে যায়। সকলেই যেন সত্য যুগের বাসিন্দা। ঘোর কলির এসব দৃশ্যে প্রত্যেকেরই চক্ষু চড়কগাছ। প্রতিবিধানের দাবিতে শাস্তির দাবিতে শুরু হয়ে যায় ইঁদুর দৌড়। কে কতটা সাধু গোত্রের সেকথা প্রমাণের প্রতিযোগিতায় নাম লেখাতে থাকে গুণীজন থেকে শুরু করে ইতরজনে।
ওদিকে, অফিসে আদালতে। নির্বাচনী প্রার্থীর টিকিটের লাইনে। রঙ্গমঞ্চের আলোআঁধারীর স্পটলাইটে পৌঁছানোর মইতে। ক্যামেরা সাউণ্ড লাইট একশানের ফোকাসে গিয়ে পৌঁছানোর ইঁদুর দৌড়ে। এবং কবি সাহিত্যিক সাহিত্য পুরস্কারের নামের তালিকায় ঠাঁই নিতে খেলাটা চলতেই থাকে। চলতেই থাকে। আর চার দেওয়ালের খাট মট মট করতে থাকে দুরন্ত মুহুর্তের অন্ধ স্বাক্ষীর মতো ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে। এই প্রেম এই ভালোবাসা ভালোবাসা খেলায়, আমি তুমি। তুমি আমি’র যুগলবন্দীতে বন্দী হয়ে পড়ে আমাদের সমাজ সংস্কৃতি। আমাদের মুখ আর মুখোশ। আমাদের কর্ম ও সাধনা। ক্ষমতার আস্বাদ পেতে আর ক্ষমতার আশীর্বাদ পাওয়া। এই দুই তরফের ভিতর দিয়েই বাংলার চালচিত্র এগিয়ে চলেছে দশকের পর দশক ধরে। নিজের নাম পরিচয় খ্যাতি ও প্রতিপত্তি ভাঙিয়ে মজা লোটার খেলায় খেলার সঙ্গীর কোন অভাব হয় না। হয় নি। হবেও না। সকলেরই লোভ লালসা সমাজের মগডালে ওঠার বাসনায় তা দিতে থাকে চব্বিশ ঘন্টা। সেখানে ন্যায় নীতি। শিক্ষা দীক্ষা। মনুষ্যত্ব মানবিকতা। এই গুলি বড়োই ক্লিশে বিষয়। সার্ভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্টের এই এক বাস্তব সত্য। মহামতী ডারউইন যদিও এই সত্য জেনে যেতে পারেননি। গেলে তাঁরও নিশ্চয় বিশ্বদর্শন হতো। সন্দেহ নাই।
বিশ্ব দর্শন হোক না হোক বঙ্গদর্শনের এহেন চিত্রে আমাদের জাতিসত্তার ঐতিহাসিক অগ্রগতি নির্মিত হয়ে চলেছে। আমাদেরই নাকের ডগা দিয়ে। আমাদের সকলের ব্যক্তিগত মুখোশগুলির চামড়াকে দিনে দিনে আরও বেশি গণ্ডারীয় করতে করতে। তাই আমরা সমাজের অসুখের দিকে না তাকিয়ে, কোন একজনকে খলনায়ক বানাতেই ব্যস্ত রাখি নিজেদের। পরস্পর পিঠ চাপড়িয়ে সমস্বরে কোলাহল করে উঠি। দেখ। আমরা সকলেই সকলের থেকে কতটা বেশি সৎ। ন্যায় পরায়ণ। নীতি বাগীশ। সমাজের জন্য চিন্তায় আমাদের রাতের ঘুম নষ্ট হয় কত ঘন্টা মিনিট সেকেণ্ড। বাকি সব সেকেণ্ডারি। সমাজসংস্কার নয়। নয় সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এই সমাজ এই ব্যাবস্থাকে কায়েম রাখতেই সময় সময় আমাদের প্রয়োজন কাউকে না কাউকে তার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া। না, তার অপরাধের সঠিক বিচারের দরকার নাই। দরকার শুধু দাগিয়ে দেওয়া অপরাধী বলে। আমরা বিশ্বাস করতে থাকি, তাহলেই চলমান সিস্টেম এগিয়ে চলতে থাকবে মসৃণ গতিতে। যার প্রসাদ লাভ থেকে আমাদের যার যা পাওনা, পেয়ে যাবো ঠিক মতো। অনেকটা ঠিক তোলাবাজি সংস্কৃতির বখরা ভাগের মতোন। আমরা সকলেই জানি। আমরা কে কোথায় দাঁড়িয়ে। কোন দরজার কোন লাইনে। যার যার নিজস্ব টার্ম আসার অপেক্ষা শুধু। তাই সময়ে সময়ে এক আধজনকে বলি দিয়ে সেই টার্ম আসার সিস্টেমটাকে বাঁচিয়ে রাখার দায় দায়িত্ব কর্তব্যে আমরা অবিচল। নিজের নিজের মুখোশের নেপথ্যে।
৩০শে জুলাই’ ২০২০
সুচিন্তিত মতামত দিন