অবধারিতভাবে আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা নেই। বেনিয়া সম্প্রদায় বা তাদের প্রতিনিধিরা যখন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসে, লুটেপুটে খাওয়ার পথ প্রশস্ত করবার প্রয়োজনে তখৎটি তাদের নিশ্চিতকরে শক্তপোক্ত করে নিতেই হয় আর সেইজন্যই মেলে ধরতে হয় নানা ছলচাতুরির জাল। কর্তাদের বোঝাপড়ার রহস্যের শিকড়টিও তাই ততই গভীরে থাকে। তাদের মূলনিয়ন্ত্রক প্রভুরাও সুপরিকল্পিতভাবে কখনো প্রকাশ্যে কখনো মুখোশের আড়ালে উৎফুল্ল উদ্দামে নৃত্য করতে থাকে। সবল জনভিত্তি গড়ে তোলার প্রয়োজনে রাষ্ট্রযন্ত্র মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগকে জাগ্রত করে তোলে। বিজ্ঞান ও যুক্তির বদলে সংস্কার ও দেশাচার অনুযায়ী বিশ্বাসের বিষয়টিকেই প্রতিষ্ঠা দেয়।
এইভাবেই শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তি তাদের নিজস্ব মত ও পথের সার্থক রূপায়ণের প্রয়োজনে তাদেরই আদর্শ অনুযায়ী বিভিন্ন কর্মসূচীর প্রণয়ন করে। কখনো তা দেশের আভ্যন্তরীণ সম্প্রীতির পরিবেশকে ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে অশান্ত করে তোলা, আবার কখনো দেশের নিরাপত্তা রক্ষাকারী সেনা জোয়ানদের অমূল্য জীবন বলিদানের বিনিময়ে রাজনৈতিক লাভের অঙ্ক কষে নয়তো সীমান্তযুদ্ধের পরিবেশ তৈরী করে দেশপ্রেমের জিগির তুলে। বিরাট সংখ্যক জনগণ না বুঝে অথবা বুঝেও আচ্ছন্নভাবে সিংহাসনের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের পুতুল হয়ে ওঠে। দেশীয় সম্পদ সহজেই লুটেরাদের করায়ত্ত হয়ে যায়। দীর্ঘ প্রক্রিয়া ও দীর্ঘদিন ধরে তিল তিল করে গড়ে ওঠা সরকারি সম্পত্তি ও প্রতিষ্ঠান, শিল্প-কলকারখানা, ব্যাংক, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, দেশজ বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও জলজ সম্পদ, জঙ্গল-নদী-পাহাড়, খনি এমনকি শিক্ষার অঙ্গনও অবলীলায় বিক্রি হয়ে যায়। ক্ষমতার শিবিরের অন্ধভক্ত ও মোহমুগ্ধ মানুষ দু'হাত তুলে এইসব মাৎস্যন্যায়কে সমর্থন করে। অন্যদিকে গৃহে অন্তরীণ ছিন্নবিচ্ছিন্ন বৃহত্তর অংশের জনগণ ও হতোদ্যম বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি বিমূঢ় দৃষ্টিতে বতাকিয়ে তা দেখতে থাকে। দেশের অর্থনীতি, সমাজ- সংস্কৃতি, ইতিহাস, সম্প্রীতির পরম্পরা ইত্যাদি ধ্বংসের মুখে পড়ে।
করোনা ভাইরাসের এই সংক্রমণ ও ব্যাপক বিস্তারের পিছনে বিতর্ক যা-ই থাক অর্থাৎ তা মনুষ্যসৃষ্ট অথবা আরো পরিস্কার করে বললে তা চীনের তৈরী কিনা এই বিতর্কের উত্তর ভবিষ্যতই দেবে। কিন্তু একে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বে অর্থনীতির যে টালমাটাল অবস্থা, বাজার দখলের যে অশুভ প্রতিযোগিতা ও তৎপরতা, বাণিজ্যিক জগতের বিশেষ করে স্বাস্থ্যভিত্তিক সামগ্রী উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীদের যে রমরমা কারবার সৃষ্টি হয়েছে, ধান্ধার অর্থনীতির কারবারীদের অদম্য আকাঙ্ক্ষার ফলশ্রুতিই কি এর কারণ! পৃথিবীর বেশীর ভাগ দেশের সরকার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিবৃতি ও প্রচার এবং প্রায় সারা বিশ্বেই সমস্ত দেশের মিডিয়ার প্রচার ও ভয়ের আবহ সৃষ্টি করার প্রক্রিয়ার মধ্যেই সেই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যায়। এই প্রতিবেদকের মতো স্বল্প মেধাসম্পন্ন মানুষের বোধের ভিত্তিকেও তা যথেষ্ট নাড়িয়ে দেয়।
বিচ্ছিন্নতার এই পরিমণ্ডলে মানুষের মানবিক চেতনা ও মূল্যবোধেও কি মরচে ধরে গেল? করোনার করাল থাবার নিচে ভয়ের আবর্তে মানুষের রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ড না হয় হিমঘুমে অচেতন কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ব্যাপক সংখ্যায় না হলেও, সমাজের বেশ কিছু অংশের মানুষের আচরণ এক অশুভ অশনির ঈঙ্গিত দিচ্ছে। সেই সমস্ত মানুষেরা তাদের সামাজিক ও মানবিক বোধটুকু যেন ভুলতে বসেছে। " আমাদের লড়াই রোগের বিরুদ্ধে, রোগীর বিরুদ্ধে নয় " -- এই কথাটি কি শুধুমাত্র আপ্তবাক্যই!
না হলে কোথাও কোন মানুষ যদি করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছে, আশেপাশের প্রতিবেশী মানুষজন সেই ব্যক্তি বা তার পরিবারের সঙ্গে এমন আচরণ করছে যেন অসুস্থ ব্যক্তিটি কোথাও ভয়ংকর কিছু অপরাধমূলক কাজ করে এসেছে এবং তাকে ও তার পরিবারের লোকজনদের অকথ্য গালমন্দ এমনকি বাড়ি থেকে উৎখাত করে দেবার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘ সময়ধরে সামাজিকভাবে এমনকি কোথাও কোথাও আত্মীয়তার সহজ সম্পর্ক নিয়ে পাশাপাশি বসবাস করা সত্বেও সংক্রামিত প্রতিবেশী মানুষের প্রতি এ কেমন আচরণ! যে ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত এবং শুধুমাত্র সংক্রামিত হওয়ার কারণেই যে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কায় অথবা মৃত্যুভয়ে কুঁকড়ে মরছে, মানসিকভাবে তার পাশে না দাঁড়িয়ে তার বা তার পরিবারের প্রতি সামাজিক সহায়তা ও মানবিক সাহায্যের হাত বাড়ানোর পরিবর্তে এই ধরণের অমানবিক ব্যবহার ও অত্যাচারকে কি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায়? কখনোই যায়না !
করোনার আবহ মানুষের জীবনে যেমন বিশ্রী দুর্ভোগ টেনে এনেছে অন্যদিকে আমাদের জীবনযাত্রার ভাবনায় অনেক ভাল পরিবর্তনও এনে দিয়েছে। আমাদের লোভ, বিলাসবহুল জীবনযাপনের অভ্যাস ও বিস্তর জটিলতাকে পরিহার করে জীবনকে সহজ ও পরিচ্ছন্ন করতে শিখিয়েছে। স্ব্যাস্থবিধি মেনে চলতে অভ্যস্ত হতে শিখিয়েছ। পরিবেশ ও প্রকৃতি অনেকখানি নির্মল ও স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠেছে। বিশ্বজুড়ে ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সামগ্রীক মানব চেতনায় উন্নীত হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছে। এই সমস্ত ভালো দিকগুলির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে আমরা কেন সামাজিক চেতনায় উন্নীত হয়ে উন্নত মানবিক মূল্যবোধের পূজারী হবোনা?
সুচিন্তিত মতামত দিন