আজ ম্যাচ ডে। ইন্টার স্কুল ক্রিকেট টুর্ণার্মেন্টের ফাইনাল আজ। এই দিনটার জন্যই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল রণিত। এতদিন ধরে দিন গুণছিলো কবে এই দিনটা আসবে। প্র্যাকটিস ম্যাচে জেভিয়ার্সে হারানো আর টুর্ণামেন্টের ফাইনালে হারানোর মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ আছে। কালকের প্র্যাক্টিস সেশনের পর ড্যাডি এটা বারবার করে বুঝিয়েছে টিমের সবাইকে। সবাই সেটা বুঝেছে বলেই মনে হল। এমনিতেই সবাই দারুণ ফর্মে রয়েছে। লিগে সুজনদা, রোহনদা, যুধাজিৎ দা – রান পেয়েছে সবাই। বোলিং-ও ছন্দে আছে। রণিত নিজেও সবার একসপেকেটশন মতই ভালো খেলেছে। নার্সিংহোম থেকে ফেরার পর পরই পাঠভবনের ম্যাচটা ছিল। ফাদার, ঋক আঙ্কেলরা রণিতকে নামাতে না চাইলেও ড্যাডি নামিয়ে ছিল। চেস করেছিল লরেন্স।লো স্কোরিং ম্যাচে নট আউট সিক্সটি টু করেছিল রণিত। তারপর থেকে ডন বস্কো ম্যাচটা বাদে সব কটাতেই হয় সেঞ্চুরি নয় নট আউট ছিল। ডন বস্কো ম্যাচটাতে হঠাৎ একটা অফ স্টাম্পের বাইরের বল চেজ করতে গিয়ে খোঁচা দিয়ে আউট হয়ে যায় কম রানে। ফেরার পথে ড্যাডির চোখের দিকে তাকাবার সাহস হয়নি। হি হেটস বিয়িং আউট। ড্যাডি বকবে ভেবেছিল রণিত, বকেনি। কেবল চুপ করে ছিল। দু’দিন রণিতের সাথে ভালো করে কথা বলেনি। এর থেকে বকতো – তাও ভালো। কথা না বললে কষ্ট হয়। মাম্মাও বেশ বুঝতে পেরেছিল, ড্যাডি কেন রাগ করেছে। ড্যাডিকে সানডে বাজারে পাঠিয়ে হঠাৎ ফোন করেছিল,
“তুষার, তাড়াতাড়ি এসো – বাবুর পেট ব্যথা করছে খুব”।
ড্যাডি তো পড়িমরি করে হাজির, রণিত শুয়েছিল। ঘরে এসেই রণিতের পাশে বসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে একাকার।
কষ্টে ড্যাডির চোখ ছলছল করছিল। স্পষ্ট দেখেছে রণিত। “কোথায় ব্যথা বাবু? কোয়েল, মা’কে ডেকে নাও জলদি –" ড্যাডিকে অস্থির লাগছিল। মাম্মা হেসেছিল,
“ব্যথাটা পেটে নয়, মনে। তুমি ভালো করে কথা না বললে তোমার ছেলে ভালো থাকে?”
ড্যাডি অবাক হলেও চোখ মুছে রণিতকে আদর করে দিয়েছিল। রণিতের খুব মজা হয়েছিল। আগে মাম্মাকে ড্যাডি বোঝাত, এখন ড্যাডিকে মাম্মা বোঝাল। তারপরের ম্যাচ গুলোতে একবারও আউট হয়নি রণিত। ড্যাডিও খুব খুশি তাই। ফাইনালে সেঞ্চুরি করলে নেক্সট সানডে মুভি নিয়ে যাবে – এটাও বলে দিয়েছে। এখন রণিত ড্যাডি আর মাম্মার সাথে শুয়ে আছে। ঘুমটা ভেঙ্গে গেল হঠাৎ। ভোর হলে উঠে পড়ত, ড্যাডির সাথে এক্সারসাইজ শুরু করে দিত। সকালে এরপর একটা ক্লাবে ভর্তি করাবে ড্যাডি, টুর্ণামেন্টেটা হলেই। মাম্মার এটা খুব একটা পছন্দ নয়, তবুও ড্যাডি যা বলবে তা-ই হবে। কালকে এমন সময় ওরা চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছে। খুব মজা হবে। সুজনদা যখন কাপ নেবে তখন রণিত জোরে জোরে হাততালি দেবে। আর ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ যদি রণিত হতে পারে, তাহলে তো আরো ভালো। কাল সিএবি থেকে সিলেক্টররা আসবে নাকি। আন্ডার ফিফটিন, সেভেনটিন, নাইনটিনের সিলেকশন করবে। সুজনদারা বলছিল – রণিত নাকি আন্ডার সেভেনটিনে চান্স পেতে পারে। ড্যাডিও নাকি টুর্ণামেন্টের পর বেঙ্গল আন্ডার সেভেনটিন কোচ হবে। এসব কথা ড্যাডিকে জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও করেনি রণিত। তাহলেই বলত,
“আগে খেল, পড়ে ওসব ভাববি”।
তবে সেভেনটিন তো অ-নেক বড়। রণিত সবে ইলেভন প্লাস। ওকে যদি বয়সের জন্য বাদ দেয়?
তা বললেই হল? পারফর্ম্যান্সটা-ই আসল। ড্যাডির কোচিং – এ খেলার জন্য কাল বেস্ট পারফর্ম্যান্স দেবে রণিত।
“বাবু, জেগে গেছিস?”
ড্যাডির গলা পেয়ে চমকে ওঠে রণিত। চুপ করে থাকে। ডাডি ওর মাথায়, কপালে হাত বোলায়,
“ম্যাচ নিয়ে বেশি ভাবতে নেই। ঘুমো”।
রণির ড্যাডির গা ঘেঁষে আসে। তুষার বোঝে ছেলের এখন আদর চাই। কপালে চুমু খায়,
“সব ভালো হবে, ডোন্ট ওরি”।
“ওরি করছি না তো”।
“তাহলে?”
“একসাইটেড ফিল করছি। এই প্রথম ফাইনালে খেলব তো”।
তুষার রণিতকে বুকের উপর শোওয়ায়,
“ওহ, এই কথা? সব কিছুরই একটা প্রথম হয়। এ নিয়ে ভাবতে নেই। আর জেভিয়ার্সকে আমরা আগেও হারিয়েছি।“।
“সে তো কাল-ও হারাব। বাট কখন হারাবো, সেটা ভাবছি”।
তুষার মনে মনে হেসে ফেলল। মুখে গম্ভীর ভাব আনল একটু,
“অত ভেবে কাজ নেই। কাল খেলা, ভাল ঘুম দরকার। এবার ঘুমো। মাম্মা জেগে যাবে না হলে”।
রণিত তৎক্ষণাৎ চোখ বুজল। তুষার ওকে কোল থেকে নামাল না। তুষারের কোলটা বাবুর খুব প্রিয় জায়গা। কোয়েল দেখলে রাগ করবে। তুষারের লাগবে ভাববে। কিন্তু তুষারের বেশ ভালো লাগে। ড্যাডির কোলে ড্যাডির বুকের উপর উপুড় হয়ে ড্যাডির গলা জড়িয়ে যখন ঘুমায় রণিত, তুষারের মন বাৎসল্যে ভরে যায়। এই বুকটাই রণিত ছোট্ট থেকে চেয়েছিল। আজ যখন পেয়েছে – শান্তিতে ঘুমাক।
ঘুম ভেঙ্গে বেশ অবাক হল কোয়েল। আজ ফাইনাল ম্যাচ, এদিকে রণিত এখনো ওঠেনি!অন্যদিন তো ওকে ভোরে তুলে দেয় ওর ড্যাডি। একসারসাইজ করায়, সামনের পার্কটায় নিয়ে গিয়ে জগিং করার,স্ট্রেচিং,ট্রেনিংও- - ও করে দু’জনে। আজ খেলার দিন দিব্যি ঘুমোচ্ছে ছেলে। আর ছেলের ড্যাডি তাকে বুকের উপর শুইয়ে রেখেছে।
“ছেলেকে তোলেনি, সাড়ে ছ’টা বাজে”!
কোয়েলের কথায় ওর দিকে তাকালে তুষার,
“না, থাক। আরেকটু ঘুমাক। রাতে ভালো করে ঘুমায়নি ম্যাচের চিন্তায়। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে, খেলবে কি করে?”
“রাত থেকেই কোলে করেই রেখেছ? তোমার আদরেই বাঁদর হবে, দেখো”।
কোয়েল একটু রাগ দেখাল।
“রাগটা সেজন্য, নাকি তুমি ভাগ পাওনি বলে?”
তুষার মুচকি হাসল,
“প্রশ্রয় আমি দিই না কোয়েল। শুধু কমপেনসেট করার চেষ্টা করি। গত দশ বছর ও অনেক কিছুই পায়নি, যা অন্য সব বাচ্চারা পেয়ে থাকে”।
কোয়েল চুপ করে যায়। ওর মনটা স্নেহে আর্দ্র হয়। তুষার হাত বাড়িয়ে দেয়।
“তুমিও কাছে চলে এসো”।
কোয়েল তুষারের বুক ঘেঁষে আসে। পাশ ফিরে একটা হাত দিয়ে ঘুমন্ত রণিতকে জড়িয়ে ধরে। অদ্ভূত শান্তি পায়। তুষার কোয়েলের কপালে একটা চুমু খায়।
“আজ যাবে তো ছেলের খেলা দেখতে?”
“চেষ্টা করব। অফিস থেকে লাঞ্চে বেরোতে পারলেও লার্স্ট হাফটা দেখতে পাবো”।
“চেষ্টা নয়, এসো। ও এক্সপেক্ট করে তোমাকে। সবার প্যারেন্টস-ই যাবে। আর এ তো আর আমার খেলা নয় যে তুমি টেনশনে দেখতেই পারবে না”।
“রণিতের খেলা দেখতেও যথেষ্ট টেনশন হয় আমার। তোমার মতই তো খেলে”।
“ওটাই ওর ন্যাচরাল গেম। কার্ভ ডাউন করতে গেলে বিপদ। তবে পাঠভবনের দিন অনেক ম্যাচিওরিটি দেখিয়েছে। টার্নিং পিচে ও অ্যাংকর রোল প্লে না করলে, টিম হারতেও পারত”।
“একটা কথা বলব তুষার?”
তুষার অবাক হল, “বলো, এতে আবার প্রশ্ন করার কি আছে?”
“ছেলেটাকে অমনোযোগের জন্য তুমি বকো, শাসন করো – কিন্তু কথা বলা বন্ধ করে দিলে ও কষ্ট পায়”।
তুষার কোয়েলের কথার মর্মার্থ অনুধাবন করে।
“হ্যাঁ, সেটা আমিও খেয়াল করলাম। আসলে ঐরকম ভুল ওর কাছে এক্সপেক্টেড নয়। আর বকাবকি আমার ধাতে নেই, তুমি জানো। রাগটা এভাবেই দেখাই,তাই না?" "জিতলে তবেই তো আন্ডার সেভেনটিনের কোচিং-টা পাবে”।
“হ্যাঁ, আর কোচিং-টা জরুরী। বাবুর কেরিয়ারের জন্য, স্পেশালি”।
কোয়েল জানে, তুষার নিজের জন্য কিছুই ভাবে না। যা ভাবনাচিন্তা সব ওর ছেলেকে ঘিরে।
“মা, বাবা যাবে আজ, জানো?”
কথা ঘোরায় কোয়েল।
“ব্যাস, তাহলে আর কি। তোমার ছেলের না চাইতেই হাজারটা গিফট এসে জুটবে। নাতির মুখ থেকে কথা খসতেও পারবে না – তার আগেই দাদুভাই। দিদান সব কিছু নিয়ে হাজির”।
“সত্যিই গো। আমাকেও এর একটা ফোঁটাও প্যাম্পার করত না মা। নাতির বেলায় কোন নিয়মকানুন নেই দেখি”।
“তোমার ছেলের মজাটা দেখি আমি। একটা করে গিফট নেয়, আর একবার করে তোমার দিকে তাকায় ভয়ে ভয়ে। আর তোমার মা সেটা দেখেও দেখেন না। তুমি কিছু বলতে গেলে তোমাকেই বকুনি দিয়ে দেবেন মনে হয়”।
কোয়েল হাসে, “থাক। মা-ও আসলে কমপেনসেট করতে চায়। আমাকে তো এসবের কিছু দেয়নি। কেবল শাসন-ই করেছে। কাছে নেবার সময় টুকুও হয়নি, এখন এই যে প্রায় দিন আসে, বাবুকে ভালোবাসে, পড়া দেখিয়ে দেয় – এটা মায়ের দিক থেকে একটা ভুল শোধরানো বলতে পারো”।
তুষার ঘাড় নাড়ে, ও সবই বোঝে। কিন্তু বেশি বৈভব রণিত পাক – সেটা ও চায়না। আরামে অভ্যস্ত হয়ে গেলেই বিপদ। তাই পড়তে বসিয়ে কোয়েল শাসন করলেও খুব একটা ঠেকায় না। মাম্মাকে যে ভয়টা পায়, সেটা থাকা জরুরী। কেবল গায়ে হাত তুললে ঠেকাতেই হয়। কোয়েলের যা রাগ – না ঠেকালে বিপদ।
“বাঁদরটাকে তোলো এবার। উঠে একটু পড়া করে যাক”।
তুষার হাসে, কোয়েলের মত ডিসিপ্লিনড মেয়ে জীবনে দেখেনি ও। রুটিনের কোন নড়চড় হবার জো নেই।
ব্রেকফার্ষ্ট টেবিলে বসে কাকার কথা শুনে থমকাল সুজন। কাকা আজ খেলা দেখতে যাবে? বাবা যাবে জানত, মা-ও হয়তো যাবে, কিন্তু বেঙ্গল রঞ্জি ক্যাপ্টেন সৃঞ্জয় ব্যানার্জীকে এক্সপেক্ট করেনি। তাও যে খেলার সাথে তুষার সান্যালের নাম জড়িয়ে আছে, সেখানে সৃঞ্জয় ব্যানার্জীর যাওয়া মানে সমস্ত ময়দানের লোক তাজ্জব হয়ে যাবে। সৌমেনও অবাক হলেন। প্রশ্নটা করেই ফেললেন,
“তুই যাবি, বুড়ো?” "হ্যাঁ। বাপিনের খেলা,ফাইনাল ম্যাচ যাবো না!লরেন্স জিতলে
অ্যাজ আ ক্যাপ্টেন ওর হাতেই তো ট্রফিটা উঠবে, নাকি? দ্যাট উইল বি আ প্রাউড মোমেন্ট ফর আওয়ার ফ্যামিলি”।
“বেশ, তবে টিমটার কোচ তুষার। এটা ভুলতে পারলে তবেই যাস। ওখানে কোন সিন ক্রিয়েট চাই না আমি। এমনিতেই চিন্ময়দা আর সিসোদিয়া পিছনে পড়ে আছে”।
সৃঞ্জয় সুবোধ বালকের মত ঘাড় নাড়ল।
“আমি কিছুই করব না। অ্যাজ আ ফ্যামিলি মেম্বার যাব। বাপিন আমার কত আদরের, এটা তো তুমি জানো দাদা। যদি তোমার কোন প্রব্লেম থাকে তো বলে দাও – যাবো না”।
ভাই – এর মুখটা অভিমানে ভরে যেতে দেখলেন সৌমেন। ষোলো বছরের ছোট, কৃতী ভাই ওনার। সন্তানের মতই প্রিয়।
“আচ্ছা, যাস। বাপিনটাকেও তোর সাথে করে নিয়ে যাস”।
“না, বাবা। আমি স্কুল থেকে স্কুল বাসে চলে যাবো,সবাই যেমন যাবে। এটাই নিয়ম”।
সুজন কিছুতেই কাকার সাথে যাবে না। কাকার যাওয়াটাও ওর পছন্দ নয়। কিন্তু বাবা যখন চায় – তো যাক। তবে সৃঞ্জয় ব্যানার্জীর মত অসৎ কারোর ভাইপো, এই পরিচয়ে বড় হতে চায় না সৃজন। বেঙ্গল রঞ্জি ক্যাপ্টেনের ভাইপো হিসাবে আলাদা সম্মানেরও দরকার নেই। যেটুকু করবে ও নিজে করবে। নিজের যোগ্যতায় করবে।
“দু’ঘা পড়েছে পিঠে?”
তুষার ছেলের মুখটা দেখেই বুঝল। স্নান করতে গিয়েছিল তুষার। রণিত মাম্মার কাছে পড়ছিল। স্নান সেরে বেরিয়েই তুষার দেখে ছেলের মুখ শুকনো, কোয়েলের মুখ থমথমে। পরিস্থিতি হাল্কা করার জন্যই বলল কথাটা।
“না পড়লে তো গাড়ি ঠিকঠাক চলে না তোমার ছেলের”।
কোয়েল জবাব দিল।“গুণধর ছেলে তোমার কি কান্ড করেছে, দেখো।"
কাল ম্যাথ ক্লাস টেস্টের খাতা দিয়েছিল। রণিত সেভেন আউট অফ টেন পেয়েছে। সেজন্য মারটা খায়নি। খেয়েছে কাল মাম্মাকে খাতাটা না দেখাবার জন্য। ভুলেই গিয়েছিল রণিত। খেলার এক্সাইটমেন্টে মনেই ছিল না। আজকেও থোড়াই মনে থাকত? মাম্মা-ই ব্যাগ খুলে খাতাটা পেল – আর ব্যাস। রণিত লুকিয়েছে ভেবে ঠাস-ঠাস করে চড়। ড্যাডিও তেমনি। তখনি স্নানে যেতে হল। এখন আবার মাম্মার কথা মন দিয়ে শুনছে।
“ছি! বাবু! লুকাতে হয় এমন? আমাকে বলবি তো”।
ড্যাডির চোখেও রাগ দেখল রণিত।
“ওভাবে বললে ওর গায়ে লাগবে না। দিনকে দিন বেয়াড়া হচ্ছে। আজ খেলা না থাকলে পিঠের ছাল রাখতাম না। লুকাতে শিখেছে মা’কে”।
তুষার কোয়েলকে চোখের ইশারায় চুপ করতে বলল।
“চল, স্নান করবি”।
রণিতের চোখ মুছিয়ে দিল তুষার।
“আমি লুকাইনি ড্যাডি, সত্যি। খেলার চিন্তায় বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম”।
তুষার বুঝল ব্যাপারটা।
“আচ্ছা, এবার কান্না থামাও। আর রেডি হও। কোয়েল, যাও ছেলেকে রেডি করে দাও”।
কোয়েলের রাগটা কমেছে ততক্ষনে। রণিত ভুলেই গিয়েছিল। নাহলে ওর ড্যাডিকে মিথ্যা বলত না।
“চল, স্নান করবি”। কোয়েল ছেলেকে বলল।
রণিত সজোরে ঘাড় নাড়ল, না বাচক।
“কেন?”
“পিঠের ছাল তুলে দেবে যে”।
কোয়েল, তুষার দুজনেই হেসে ফেলল।
“মারব না, চল”।
“তাহলে একটা কথা রাখো”।
এটা না বুঝে মারার জন্য ক্ষতিপুরণ।
“বল”।
“আজ অফিস যাবে না। আমার সাথে মাঠে চলো”।
তুষার খুশি হল।
“ঠিক বলেছিস, বাবু। আজ অফিস যাওয়া চলবে না। পিয়া, ছেলের অব্দার রাখতেই হবে”।
ড্যাডির মুড খুব ভালো থাকলে মাম্মাকে ডাকনামে ডাকে। মাম্মার ডাকনামটা রণিতের ও খুব পছন্দ।
“বেশ, তাই হবে”।
রণিতের মনটা খুশিতে নেচে উঠল। মাম্মা আর ড্যাডির সাথে একসাথে যাবে ও। মাঠে দাদুভাই, দিদান-ও আসছে। ফেরার পথে দিদানকে একটাবার বলবে – ব্যাস। বাইরে কোথাও ডিনারে যাওয়া হবে সবাই মিলে। সেই মাম্মা আর ড্যাডির রেজিস্ট্রির দিন বাইরে খেয়ে ছিল সবাই একসাথে। তারপর থেকে টুর্ণামেন্ট শুরু হয়ে গেল। ঘোরা, ফেরা, বাইরে খাওয়া- হয়নি। আজ ফাইনাল, আজ জিতে তাই একটু এনজয় করবে রণিত। কিন্তু তার আগে জিততে হবে।
পর্ব – ২
সকাল সকাল সিসোদিয়া স্যারের কল আসায় অবাক হল সঞ্জয়। সঞ্জয় শর্মা – বেঙ্গল সিলেকটর। ইন্ডিয়ার হয়ে গোটা দশেক ওয়ানডে খেলেছিল। লেফট আর্ম স্পিনার ছিল নব্বই – এর দশকে। সিসোদিয়ার বরাবরের প্রিয়পাত্র।
“ইয়েস, স্যার”।
“সঞ্জয়, আর স্কুল টুর্নামেন্টের ফাইনাল আজ,স্পেশালি এরেঞ্জড ইন ইডেন,দেখতে যাচ্ছ তো?”
“হ্যাঁ, স্যার। আপনি আসছেন?”
“আসতে তো হবেই। শোনো, রেজাল্ট যাই হোক আই ওয়ান্ট তুষার আজ মাই আন্ডার সেভেনটিন কোচ”।
“জেভিয়ার্স জিতলেও?”
“ইয়েস, তুষারের উপর আমার যে ভরসা টা আছে ওটা আর কারোর উপর করা মুস্কিল”।
“ওকে, স্যার”।
“আর, দুটো ছেলেকে ভালো করে দেখতে বলেছিলাম মনে আছে?”
“হ্যাঁ, স্যার। রণিত মজুমদার আর সুজন ব্যানার্জী”।
“রণিতের টাইটেলটা বদলেছে, সঞ্জয়, তুষার হ্যাজ ম্যারিড হিজ মম”।
“রণিত সান্যাল তাহলে, স্যার?”
“ইয়েস, রণিতকে আমি আন্ডার সেভেনটিনে চাই। ওর খেলার ফুটেজ যেটুকু দেখেছি – আইম ভেরি মাচ ক্লিয়ার ইন মাই মাইন্ড যে ও-ই হল দ্যা নেকসট বিগ থিং। মুম্বাই যেটা পেরেছে, দিল্লী পেরেছে – সেটাকে কলকাতাকেও করে দেখাতে হবে। একটা এক্সট্রাঅর্ডিনারি ট্যালেন্টকে নারচার করে পৌঁছাতে হবে সে-ই জায়গায় যেখানে তার পৌঁছানো উচিৎ। দলাদলি আর পলিটিক্সে যেন ওর ফিউচার নষ্ট না হয়”।
“ওকে স্যার, কিন্তু সুজন ব্যানার্জী কেন স্যার? ও তো ঐ সৌমেনটার ছেলে, আর সৃঞ্জয়ের ভাইপো”।
“হোক। কিন্তু ভালো খেলে। খেলাটাকে আগে দেখতে হবে, তাই না?”
সঞ্জীব চুপ করে গেল। এর উপর জবাব চলে না।
রোহনের পায়ে আচমকা চোট লেগেছে। মচকে গেছে নাকি কাল। গোড়ালির আবস্থা ভালো নয়। চিন্তার ভাঁজ পড়ল তুষারের কপালে। রোহন টপ থ্রির একজন। ও না খেললে মুশকিল। যদিও জোর করে বলছে খেলব – অথচ ভালো করে হাঁটতেও পারছে না। ও না খেললে জয়জিৎ বা নিশানকে খেলাতে হবে। যেটা তুষার চায় না। সুজনকে ইশারায় ডাকল তুষার।
“রোহন মনে হয় খেলতে পারবে না”।
সুজনও বুঝতে পেরেছিল ব্যাপারটা।
“দেন উই শ্যাল গো উইথ অ্যান অলরাউন্ডার,স্যার”।
“ব্যাটিং-টা লাইট হয়ে যাবে না?”
“মে বি, বাট স্যার জয়জিৎদের খেলানোর থেকে তো ভালো। আমি ওদের ট্রাস্ট করি না। আজ আবার কাকা মাঠে এসেছে”।
“সৃঞ্জয়? স্ট্রেঞ্জ”।
তুষার অবাক হয়। একটা ইন্টার স্কুল টুর্নামেন্টের ফাইনাল দেখতে বেঙ্গল রঞ্জি ক্যাপ্টেন আসবে – এটা অবাক হবার মতই।
“আমিও খুব অবাক হয়েছিলাম স্যার। বলছে তো আমার জন্য এসেছে – বাট কি যে করে বসবে তার ঠিক নেই। ড্রেসিংরুমে আসতে মানা করেছি তাই”।
তুষার সুজনের রিএকশনের তীব্রতা দেখে একটু হাসল।
“হয়তো সৃঞ্জয় ঠিকই বলেছে – তোমার খেলা দেখতে এসেছে। কাকা হয়, তাই না?”
“কাকা না হলেই ভালো হত”।
সুজনের চোয়াল শক্ত হয়।
“ছাড়ো ওসব – রোহনের রিপ্লেসমেন্ট তাহলে অর্ক?”
“ইয়েস স্যার। তাও আপনি একবার ভেবে নিন। ব্যাটিং নিয়ে আমি ভাবি না। ভাই আছে তো”।
সুজন রণিতের ক্ষমতায় অগাধ আস্থা রাখে।
“ভাই কই তোমার?”
তুষার ছেলে খুঁজলো।
“মাঠে চলে গেছে। স্ট্রেচিং করছে। আজ নাকি সকালে দেরিতে উঠেছে। তাই এখন স্ট্রেচিং করে নিচ্ছে”।
তুষার খুশি হল। ছেলেটাকে যা শেখানো হয় তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। যদি পড়াশুনার ব্যাপারেও এর অর্ধেক সিনসিয়ার হত – তাহলে ওর মাম্মার মাথা ব্যথা কমত অনেক।
“তোর নাম-ই রণিত, তাই তো?”
স্ট্রেচিং করে ফ্রেশ হতে ড্রেসিং রুমে ঢুকতে যাচ্ছিল রণিত। টানেলে লোকটার সাথে দেখা। লোকটাকে চেনে ও সুজনদার কাকা। সৃঞ্জয় ব্যানার্জী, বেঙ্গল ক্যাপ্টেন। রণিত জানে লোকটা বাজে। তাও ভদ্রভাবেই বলল।
“ইয়েস”।
“চিনিস আমাকে?”
রণিত ঘাড় নাড়ল। চেনে ও।
“তাহলে শুধু ইয়েস বলছিস যে! সে ইয়েস স্যার। তোর বাবা থুড়ি স্টেপ ফাদার তোকে এটুকু ভদ্রতাও শেখায় নি?”
রণিতের খুব কষ্ট হচ্ছিল, স্টেপফাদার শব্দটার সাথে ও অভ্যস্ত নয়। ড্যাডি তো ওরই ড্যাডি। স্টেপফাদার হবে কেন?
“কি হল, কথা বেরোচ্ছে না মুখ দিয়ে? নাকি ঐ হেরো, জুয়াড়ি বাপের মত গর্তে ঢুকে যেতে ইচ্ছা করছে?’
রণিতের কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। ড্যাডিকে হেরো বলছে কেন লোকটা? জুয়াড়ি বলছে কেন? ওর ড্যাডি তো ক্লিনচিট পেয়েছে। ভীষণ রাগে রণিতের মনে হচ্ছিল লোকটাকে উচিৎ শিক্ষা দেয় – কিন্তু ও কি করবে? হঠাৎ ড্যাডির গলার আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠল ও।
“সৃঞ্জয়, তুই এখানে?”
ড্যাডিকে দেখে ভুত দেখার মত চমকে উঠল লোকটা”।
“এই তো তুষারদা – বাপিনকে মানে সুজনকে খুজছিলাম”।
তুষার রণিতের চোখমুখের দিকে আড়চোখে দেখেই বুঝল কিছু একটা হয়েছে।
“পরে দেখা করিস। টস করতে যাবে এখন। বাবু, চল”।
কিছুটা দূরে যাওয়ার পরে তুষার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করল।
“সৃঞ্জয় তোকে কী বলছিল?”
রণিত একবার ভাবল সব বলে দেবে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, এখন সব বললে ড্যাডি ভীষণ রেগে যাবে। ঐ লোকটাকে ধরবে গিয়ে। ভীষণ ঝামেলা হবে একটা। টিমের ফোকাস নড়ে যাবে। তার থেকে কথাটা গিলে ফেলাই ভালো।
“সুজনদার খোঁজ করছিল”।
রণিতের চোখ যদিও অন্য কথা বলল। তুষার বুঝেও কথা বাড়ালো না। খেলার পরে সব শুনবে। একটু পরেই খেলা শুরু হয়ে যাবে। তাই এখন চুপ থাকাই ভালো।
“ধ্যাত!”
রণজয়ের কথা শুনে অবাক হলেন চিত্রা।
“কি হল?”
“টসে হেরেছে লরেন্স। জেভিয়ার্স আগে ব্যাট”।
“এতে অত মুষড়ে পড়ার কি আছে?”
“আরে, পিচ সেকেন্ড ইনিংসে টার্ণ করবে। কিউরেটরের সাথে কথা হয়েছে চিন্ময়ের। বড় রান করে ফেললেই চেজ করতে সমস্যা হবে”।
“অমন নেগেটিভ ভেবো না।তোমার দাদুভাই আছে তো। তুমি তো ওর খেলা দেখোনি। দেখেছি আমি”।
রণজয় বিরক্ত হলেন।
“শোনো চিত্রা, যা বোঝোনা তা নিয়ে কথা বলো না। ইডেনের পিচে চেজ করা দুষ্কর। তেন্ডুলকার অবধি ইন্ডিয়াকে জেতাতে পারেনি নাইন্টি সিক্সের সেমিফাইনাল”।
“না পারুক। আমার নাতি পারবে। তোমার এই নেগেটিভ কথাবার্তা থামাও”।
চিত্রার ধমকে চুপ করলেন রণজয়। কোয়েল ওনাদের পাশেই বসেছিল। মায়ের রণিতের উপর অগাধ বিশ্বাস, জানত। কিন্তু তার মাত্রা এতটা , জানল আজ। কোয়েলের নিজের অতটা আশা নেই। তবে তুষার দৃঢ় বিশ্বাস যে রণিত পারবে। ওর চোখ দিয়েই তাই স্বপ্ন দেখে কোয়েল। স্বপ্নটা সত্যি হোক, মনে প্রাণে চায়।
দেবাঞ্জনের বলটা বিশালের ব্যাটে চুমু খেয়ে ফার্ষ্ট স্লিপ পেরিয়ে সেকেন্ড স্লিপের দিকে যাচ্ছিল। বিশাল কসেরা জেভিয়ার্সের সবচেয়ে ভালো ব্যাটসম্যান। ব্যাটিং – এর স্তম্ভ। ওপেন করতে নেমে তখন ছত্রিশ রানে ব্যাট করছিল। জেভিয়ার্সের স্কোর সিক্সটি ফর নো লস। সবে দশ ওভার হয়েছে। বিশালের ব্যাট করার মধ্যে একটা শাসনের ভঙ্গিমা আছে। অনায়াস ঔদ্ধত্যে পরের পর ভালো শর্ট খেলছিল ও। ওকে না ফেরাতে পারলে বিপদ। সুজন দেবাঞ্জনকে একটা একসট্রা ওভার দিয়েছিল তাই। ওর আউট সুইংগুলো ভালো হচ্ছিল। বিশাল ক্যাচটা তুলতেই ফার্ষ্ট স্লিপে সুজন ঝাঁপাতে গিয়েও থমকে গেল। রণিত সেকেন্ড স্লিপে আজ। ও সামনের দিকে শরীর ছুড়ে দিয়েছে। নিখুঁত ক্যাচ,
“ইয়েস!”
সুজন আনন্দের প্রকাশ দেখাল, গ্যালারিতে সৌমেনও খুশি হলেন খুব।
“গুড ক্যাপ্টন্সি, তাই না, বুড়ো?”
সৃঞ্জয় মানতে বাধ্য হল।
“হ্যাঁ, দাদা, বাপিন একদম ম্যাচিওরড ক্যাপ্টেনের মত টিমকে চালাচ্ছে”।
“রোহনের জায়গায় অর্ক বলে একটা অলরাউন্ডারকে নিয়েছে দেখলাম”।
সৃঞ্জয় ভালো করেই জানে সিদ্ধান্তটা সুজনের। জয়জিৎ আর নিশানকে ও কেন ট্রাষ্ট করে না – তাও সৃঞ্জয়ের অজানা নয়।
“তুষারদার পাকামো, আমি হলে ব্যাটসম্যানই নিতাম। দেখো – এর জন্য না হেরে যায় লরেন্স”।
হারলে যেন হারার দোষটা তুষার সান্যালের উপরেই পরে এ ব্যাপারে সদা সচেষ্ট সৃঞ্জয়।
“দেখা যাক, কি হয়”।
“আরে, তুষার যে, কেমন আছিস?”
সঞ্জয় শর্মাকে দেখে অবাক হল তুষার। ড্রেসিংরুমের বারান্দায় রাখা চেয়ারে বসেছিল ও। সঞ্জয়দা বেঙ্গল সিলেকটর। আজ মাঠে
আসবে কানাঘুঁষো শুনেছিল। কিন্তু একেবারে ড্রেসিংরুমে চলে আসবে ভাবেনি।
“এই চলে যাচ্ছে, বসো”।
“কনগ্র্যাটস। তুই বেঙ্গল আন্ডার সেভেনটিন কোচ হচ্ছিস”।
তুষার অবাক হল।
“মানে? খেলা তো শেষ হয়নি”।
“আরে ইয়ার, ছোড় না। সিসোদিয়া স্যার চান তুই হোস। ব্যাস। কোথায় তুই আর কোথায় জেভিয়ার্সের মনোজ”।
“তুমি যখন বলছ, তখন ভরসা পাচ্ছি”।
সঞ্জয় শর্মার কেরিয়ার তুষারই শেষ করেছিল। কলকাতা লিগের কালীঘাট ভবানীপুর ম্যাচে পড়তি ফর্মের সঞ্জয় শর্মাকে এমন পিটিয়েছিল যে খেলা ছেড়ে বাঁচে। ওসব মনে রাখেনি মনে হয়।
“আমি তোকে কি করে ভুলি ব্রাদার? বাপরে বাপ! ছক্কে পে ছক্কা। ইন্ডিয়া খেলা স্পিনারটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলি”।
তুষার মৃদু হাসল।
“বাদ দাও পুরোনো কথা”।
“বাদ দেব কি রে! তোকে নিয়ে কত আশা ছিল বল তো!”
“কিছুই তো হল না সঞ্জয়দা”।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল তুষার।
“ফিরসে খেল না। কতই বা বয়স তোর? এই বয়সে কত-ই না কামব্যাক হয়”।
“ধুর। চোটটার কথা জানো না? আর এখন ওসব ভাবিও না”।
“রিহ্যাবে যাবি? সিসোদিয়া স্যারকে বললেই হয়ে যাবে”।
তুষার হাসল।
“না গো, এই কোচিং-ই ভালো”।
“সে সব আমি দেখছি। তুষার, বেটা চাঙ্গা হ্যায় তেরা। ভালো ক্যাচ ধরল”।
“হুম, তারপর থেকে খেলাটা ওরা ধরে নিয়েছে। এই ওয়ান ডাউনটাকে দেখে রাখো সঞ্জয়দা, মনোসিজ চ্যাটার্জি । জেভিয়ার্সের ক্যাপ্টেন। ভালো খেলে”।
“দেখছি তো। তোর টিমের ক্যাপ্টেন সৌমেনের ছেলে না?”
“হ্যাঁ গো। ভালো ছেলে”।
“কে জানে বাপু। যা ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড। স্পিনার আনতে দেরি করছে বড্ড”।
তুষার মাথা নাড়ল। পিয়ালকে আনা দরকার। অর্কর দু ওভার খুব বাজে গেছে। ফাইনালে চান্স পেয়ে ঘাবড়ে গেছে ছেলেটা। ও এক্সপেক্ট করেনি যে খেলবে। এমন-ই হয়। সেট টিম ভাঙলে দুর্ভোগ কপালে লেখা থাকে। আড়ইশোর উপর যে কোন রান তাড়া করা মুশকিল হবে।
যুধাজিতের ডাইরেক্ট হিটটা উইকেটে লাগতেই খুশিতে লাফিয়ে উঠলেন রণজয়। জেভিয়ার্সের ক্যাপ্টেনটা গেল তাহলে। বড্ড জ্বালাচ্ছিল। সত্তর রান করে গেল অবশ্য। জেভিয়ার্স তিরিশ ওভারে দেড়শো,তিন উইকেটে। অনেক রান হবে মনে হচ্ছে। ভাবতে ভাবতেই আবার আউট। আবার ডাইরেক্ট হিট। এবার রণিতের। কভারে ঝাঁপিয়ে পড়ে বল থামিয়ে ঐ এক আয়কশনেই থ্রো। একদম সঠিক নিশানায় লাগল বল। কোয়েল খুশি হল। ওর ড্যাডি রণিতকে একটা উইকেট লক্ষ্য করে থ্রো করা প্র্যাকটিস করায়। আজ অভ্যাসটা কাজে দিয়েছে। তুষারও নিশ্চয় খুশি হয়েছে। লাঞ্চে একবার ড্রেসিংরুমে যাবে কোয়েল। ওর ড্যাডির পারমিশন নিয়েই। লাঞ্চে হাতে করে খাইয়ে দেবে ছেলেকে। সেমিফাইনালে সবার মা এসেছিল। কোয়েল আসতে পারেনি। আজ তাই লাঞ্চবক্স প্যাক করে এনেছে। অন্যদিন তুষার নিয়ে আসে লাঞ্চবক্স। খেলার দিন ছেলেকে বাইরের খাবার খেতে দেয় না তুষার।নিজে হাতে করে খাইয়ে দেয় বাড়ি থেকে আনা লাঞ্চ। তা না করলে ছেলেটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে খেয়ে রেখে দেবে। এই নাকি ওর ড্যাডি ওকে মুম্বাই পাঠাবে, তারপর অস্ট্রেলিয়া।
একা একা থাকতে পারবে নাকি রণিত? একা একা ভালো করে খেতেই পারে না ছেলেটা। যতই বড়দের সাথে খেলুক – ওর বয়সটা তো দেখতে হবে। ওকে একা কোথাও ছাড়বেই না কোয়েল। হয় নিজে যাবে, না হলে তুষারকে পাঠাবে।
ড্রেসিংরুমে ফিরেই ক্ষোভে ফেটে পড়ল অর্ণব। রাগটা ওর অরিত্রর উপর। লাস্ট ওভারে কুড়ি রান খেল। দুশো সত্তর একটা বড় টার্গেট।
“যাই বলিস, সুজন, অরিত্রর অমন ফালতু বলিং করার কোন মানে হয় না”।
সুজন থামাল ওকে।
“ছাড় না, অফ ডে তো হতেই পারে। আমরা এখন চেজটা নিয়ে ভাবি”।
“রোহন নেই, একটা ব্যাটসম্যান শর্ট। বড় মাঠ। তার উপর দীপমাল্য”।
যুধাজিৎ এগিয়ে এল।
“শর্ট ভাবছিস কেন? অর্ক তো আছে”।
অর্ণব কাঁচকলা দেখাল।
“রাখ ওর কথা, যা বল করল, ওর দৌড় বোঝা হয়ে গেছে”।
সুজন জানে জয়জিৎদের না নিয়ে অর্ককে নেওয়াটা ব্যাকফায়ার করতে পারে। তবে সিদ্ধান্তটা ওর। স্যারের নামে দোষটা যেন না হয়, সেটা দেখবে ও। কিছু বলতে যাছিল হঠাৎ আন্টিকে দেখে চুপ করে গেল।
“আন্টি, স্যারকে ডাকব?”
কোয়েল সুজনকে চেনে। রণিতের খুব প্রিয় দাদা। ক্যাপ্টেন দাদা।
“ভাইকে ডাকো। খাবে ও”।
“এক্ষুনি ডাকছি”।
যুধাজিৎ খুঁজতে গেল। সুজন আন্টির কাছে গেল।
“ভাই এখন ভালো করে পড়ছেও, তাই না আন্টি?”
“তোমার ভাই যা চঞ্চল, আর অমনোযোগী। তবে আগের থেকে ভালো”।
“আমি টিফিনে ওকে নিয়ে বসি তো। যা কিছু বোঝে না বলে দিই”।
কোয়েল জানে সুজন রণিতকে খুব ভালোবাসে। একেবারে নিজের ভাই – এর মতই।
“ভালো করো। সুজন, ভাই-এর বড় অসুখের পর বলেছিলে একবার আমাদের বাড়ি আসবে – কবে আসবে? এলেই তো না”।
“এতদিন টুর্ণামেন্ট ছিল তো আন্টি। আজ জিতে নিই। এবার যাবো। ঐ তো ভাই এসে গেছে”।
মাম্মাকে দেখে অবাক হয়েছিল রণিত। মাম্মা ড্রেসিংরুমে কেন? লাঞ্চবক্সটা দেখে বুঝল কেন এসেছে।
“খাবি আয়”।
কোয়েল ছেলেকে ডাকল।অন্যদিন ড্যাডি খাইয়ে দেয়। আজ মাম্মা এসেছে, তাই মাম্মা খাওয়াবে। না হলে রণিত টেনশনে ভালো করে খাবেই না, সেটা ওরা দু’জনেই ভালো করে জানে।
অর্কর মুখটা কাঁচুমাচু হয়েছিল। ও অর্ণবদের সব কথা শুনেছে। ওর জন্য যদি টিম হেরে যায় তাহলে কি হবে ভেবেই আকুল হচ্ছিল ও। সুজন ওকে লক্ষ্য করল।
“কিরে অর্ক – চুপ কেন এমন?”
“সরি সুজন, আমার জন্য তোকে কথা শুনতে হচ্ছে”।
“আরে – এমন ভাবছিস কেন? বলে পারিসনি, ব্যাটে কমপেনসেট করে দিবি”।
সুজন অমায়িক হেসে বলল। ও ক্যাপ্টেন, প্লেয়ারকে সাহস দেওয়া ওর কাজ। যুধাজিৎ চলে এসেছিল ওখানে।
“আরে, নেগেটিভ ভাবলেই নেগেটিভ হবে। থিঙ্ক পজিটিভ। এমন-ও হতে পারে তোর জন্যই টিম জিতল। অর্ণবটা ঐরকমই। ওর কথা ধরিস না”।
সুজনের চোখে পড়ল ভাই আন্টির হাতে করে লাঞ্চ খাচ্ছে। অন্যান্য দিন স্যার খাইয়ে দেন। নিজে ভালো করে গুছিয়ে খেতে পারে না পুঁচকেটা। স্কুলেও টিফিনে গিয়ে সুজনকে চেক করতে হয় টিফিন করেছে কিনা। টার্নিং পিচ। দুশো সত্তর করেছে ওরা। এমন অবস্থায় রণিতকে ভালো করে খেলতেই হবে। ও খেললে তবেই লরেন্সের চান্স আছে। আর জিতলে ভাইকে একটা গিফট দেবে সুজন। কি দেবে সেটাও ভেবে রেখেছে।
পর্ব – ৩
রণিত ব্যাট করতে নামার আগে ড্যাডির মুখটা দেখে এসেছে। ড্যাডি ওর জন্য খুব লাকি। আর ম্যাচটাও তো ড্যাডির জন্যই জিততে হবে। শুরুটা ভালোই হয়েছে। সুজনদা আর ও দুজনেরই ভালো টাইমিং হচ্ছে। দীপমাল্যর বল সুইং হচ্ছে না একদম-ই। গায়ের জোরে বল করে যাচ্ছে শুধু। সুজনদা ওকে দুটো কভার ড্রাইভ মারল, দেখবার মতো। তবে খুব ধরে খেলছে সুজনদা। বল নাকি নীচু হওয়া শুরু করবে। উইকেট স্লো হবে আস্তে আস্তে। রণিত ভাবে তাহলে তো এখনি হাত খুলে খেলে নেওয়া উচিৎ। হাত খুলেওছে ও। পনেরো ওভারে সাতানব্বই লরেন্স। রণিত পঁয়ষট্টি, সুজন তিরিশ, আর দুই একস্ট্রা। ওভার শেষ হলে মাঝ পিচে সুজনদা বলল,
“স্পিনার আনবে এবার। প্রথম কয়েকটা বল দেখে নিস”।
“ওকে”।
“কথার কথা না – স্যার বলেছেন একটু দেখে খেলতে, খেয়াল রাখিস”।
"তুমিও দিনকে দিন মাম্মার মতো স্ট্রিকট হয়ে যাচ্ছে সুজনদা – দেখোই না কি হয়”।
সুজন বুঝল ভাই – এর মাথায় অন্য প্ল্যান ঘুরছে। আর সেটা অ্যাটাক বাদে অন্য কিছু নয়।
“দেখছ, কেমন খেলছে আমার নাতি?”
চিত্রার চোখে মুখে গর্ব ঝরে পড়ে। সদ্য লরেন্সের লেগস্পিনারটার এক ওভারে তিনটে ছয় মারল রণিত। বল টার্ন করছে। কিন্তু তা বলে ডিফেন্সের ধার কাছে দিয়ে যাচ্ছে না। রণজয়ের মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হল।
“খেলছে তো ভালো গো। কিন্তু অন্য দিকে সাপোর্ট পাচ্ছে কোথায়? ক্যাপ্টেনটা যাওয়ার পর থেকেই তো যাওয়া আসা চলছে। স্পিন খেলতেই পারছে না কেউ”।
কোয়েল বলল, “আর তো বেশি রান বাকি নেই বাবা। চল্লিশ রান বাকি। সবে পঁয়ত্রিশ ওভার শেষ হবে”।
“পাঁচটা উইকেট চলে গেছে পিয়া, আর লেগস্পিনারটা তো ভালো বল করছেই। লেফট আর্ম স্পিনারটাও। এই যে ছেলেটা নেমেছে এখন ওকে দেখেই মনে হচ্ছে কাঁপছে। নেহাত দাদুভাই ভাল খেলছে – তাই বুঝতে পারছিস না।“
অর্ক নেমেছিল। সুজন যখন আউট হয় তখন টিমের স্কোর একশো সাতষট্টি। সুজন ষাট, রণিত একশো পাঁচ। তারপর থেকেই অর্ণব, যুধাজিৎ, শুভাদীপ, ঋদ্ধি এরা কেউ ডবল ডিজিট ছোয়নি। দুশোতিরিশে পাঁচ। রণিত একশো পঁয়তাল্লিশ। উল্টোদিকে অর্ক নেমেছে। আর ওকে যথেষ্ট নার্ভাস মনে হচ্ছে। ও গেলেই টেল এন্ডাররা আসবে। রণিতের উপরেই এখন পুরোটা নির্ভর করছে। ঐটুকু ছেলে – এত চাপ নিয়ে পারবে তো। রণজয়ের কেবল এটাই চিন্তা হবে থাকে।
“তুষার, লেড়কে মে দম হ্যায় তেরা”।
ড্রিঙ্কস ব্রেক চলছিল। আর ছত্রিশ রান দরকার। হাতে পাঁচ উইকেট। পনেরো ওভার বাকি। তুষার টুয়েলভথ ম্যানকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছে রণিতকে, নিজে যতটা সম্ভব স্ট্রাইক নিতে। অর্ককে দেখে খেলতে বলে পাঠিয়েছে। যা স্ট্রোক নেবার রণিত নেবে। হঠাৎ চেনা গলাটা শুনে ভীষণ অবাক হল। সিসোদিয়া স্যার।
“আরে, স্যার, আপনি?”
“দেখছিলাম তোর ছেলেটাকে। অনেক নাম শুনেছিলাম আগে। আজ নিজের চোখে দেখলাম। শের হ্যায়। ওকে নিয়ে লড়ে যা। আমি আছি”।
“লড়ব তো বটেই। ও-ই তো আমার জীবনের লক্ষ্য”।
সিসোদিয়া তুষারের কাঁধে হাত রাখলেন।
“তুই পারবি। আজকের ম্যাচটা তো একাই টানল। আর ক’টা রান বাকি। ধরে খেলতে বলেছিস তো?”
তুষার ঘাড় নাড়ল। ধরে খেলতে বলে লাভ নেই। ও যে ছন্দে আছে, সেটা নষ্ট হয়ে যাবে। তাও সিসোদিয়া স্যারকে সেটা বলা যাবে না। পুরনোপন্থী লোক।
“এরপর থেকে তো প্রায়ই দেখা হবে। আন্ডার সেভেনটিনটাকে তুই দেখবি এবার থেকে। আমার বেঙ্গল থেকে বেঙ্গলের ছেলে ইন্ডিয়া ক্যাপ চাই রে। বাইরের ভাড়া করা ছেলে না। এটা তোকেই দেখতে হবে”।
“ইয়েস স্যার। আমি চেষ্টা করব”।
“গুড, আর নিজের কথাটাও ভাবিস একবার। ছেলে আর বাপ দুজনে একসাথে মাঠ কাঁপালে মন্দ হবে না”।
তুষার সিসোদিয়া স্যারের কথায় থমকাল একটু। সবাই এই এক কথা বলছে। তাহলে কি ওর সত্যিই কামব্যাক নিয়ে ভাবা উচিৎ?
“খেলা তো শেষ”।
মনোজের পাশে দাঁড়িয়ে বলল সৃঞ্জয়। জেভিয়ার্সের কোচ মনোজ জানে সেটা। ঘাড় নাড়ল।
“হ্যাঁ, রণিতই নিয়ে গেল, আবার”।
“ওকে সরাতে পারলে ভাল হত”।
“ছেলেটা আউট হয়না রে সৃঞ্জয়। তুষার ওকে কি ধাতু দিয়ে গড়েছে কে জানে?”
“মনোজদা, রিটায়ার্ড হার্ট বলেও একটা ব্যাপার হয় কিন্তু। আর ইউ হ্যাভ আ গুড ফার্ষ্ট বোলার”।
সৃঞ্জয়ের মুখে একটা শয়তানি খেলে যায়।
“জাষ্ট থিংক অফ ইট। ও বসে যাওয়া মানেই খেলা শেষ। ভাবো, মনোজদা – তোমার আন্ডার সেভেনটিনের কোচ হওয়ার স্বপ্নটাও তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে, নাকি?”
মনোজকে দোদুল্যমানতার মধ্যে রেখে চলে গেল সৃঞ্জয়।
দীপমাল্যর বলটা হেলমেটে রাখতেই চোখে অন্ধকার দেখল রণিত। বলটা বিমার ছিল। সরাসরি ছুঁড়েছে। পড়ে যেতে যেতে ও শুনল সারা মাঠ হায় হায় করে উঠেছে। পড়ে গিয়েও নিজেকে সামলাল রণিত। অজ্ঞান হলে চলবে না খেলতে হবে। চোখ মেলে তাকাতে চাইলও। অসংখ্য পায়ের শব্দ ওর দিকে। কে আসছে? অর্কদা? জেভিয়ার্সের ছেলেরা?
“রণিত …………”।
“আমাকে তোলো অর্কদা, আমি খেলব”।
অর্ক ওকে ধরতে গিয়েও থেমে গেল। স্যার ছুটে এসেছেন মাঠে। পিছনে একজন ফিজিও, সিএবি-র ফিজিও মনে হয়।
“রণিত ………… কি হয়েছে? আর ইউ ওকে?”
রণিত তাকাল। ড্যাডি চলে এসেছে।
“হেলমেটটা খোল”।
রণিত উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল।
“আস্তে করে খোল”।
হেলমেট খুলে দিল তুষার। খুলতেই দেখল হেলমেটে বল লাগলেও কপালটা আলু হয়ে আছে। খুব লেগেছে ছেলেটার। খুব ব্যথা নিশ্চয়। ফিজিও দেখলেন।
“খেলতে পারবে?”
ফিজিওকে উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল তুষার।
“পেইন কিলার দিচ্ছি। অজ্ঞান যখন হয়নি ………”।
“তুষার! কি করছ এখানে এখনো? দাদুভাইকে তুলে নিয়ে এসো। এক্ষুনি হাসপাতালে যেতে হবে। মাথায় চোট। সিটি স্ক্যান দরকার এখনি”।
রণজয়ের গলা শুনে চমকে উঠল তুষার। উনি এখানে ঢুকলেন কি করে একবার ভেবেও পরমুহুর্তে বুঝল কোয়েলের বাবার ডাক্তার হিসাবে যা খ্যাতি তাতে ঢোকাটা নিতান্তই সম্ভব।
“ফিজিও বলছেন তো খেলতে পারবে”।
রণজয় তুষারের এমন উত্তরে যারপর নাই অবাক হলেন।
“ফিজিও বললেই হল? তুমি আমার কথার উপর দিয়ে যাচ্ছ কেন? তুমি জানো না মাথার আঘাতে কি কি হতে পারে?”
তুষার বুঝতে পারল রণজয় এখন ডকটর রণজয় লাহিড়ী। রুগী সম্পর্কে ওনার মত-ই চুড়ান্ত মানেন।
“আর তুমি ওর বাবা হয়ে এমন নিরুত্তাপ ভাবে দাঁড়িয়ে আছো কি করে? খেলাটা বড় – না ওর প্রাণটা?”
তুষার বুঝল রণিতের দাদুকে বোঝানো দায়। উনি জীবলে খেলেননি। তাই খেলাটা খেলোয়াড়ের কাছে কতটা, সেটা বুঝবেন না। ফিজিও সমস্ত ব্যাপারটায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন।
“রণিত, চলো, এক্ষণি হাসপাতাল যেতে হবে আমাদের”।
রণিত পেইনকিলার খেয়েছিল। অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়াল।
“আমি খেলব, স্যার”।
রণিত দাঁড়িয়েই প্রথম কথাটা বলল।
“খেলবি মানে? মাথা ফুলে গেছে – এরপর মাথা ঘুরবে, বমি হবে …………”।
রণিত হেলমেট পড়ল।
“দাদুভাই, তুমি যাও। আমি একটু পরে হসপিটাল যাবো। আগে একটু কাজটা সেরে নিই”।
তুষারের বুকটা গর্বে ভরে গেল। এই না হলে ওর ছেলে? আম্পায়ারকে বলে দীপমাল্য কে ওয়ার্নং দিইয়ে মাঠ ছাড়ল ও।
“পিয়া, আবার হেলমেট পড়ে নিল তো? আবার খেলবে নাকি?”
চিত্রার চোখেমুখে অবাকভাব ফুটে উঠল।
“তাই তো মনে হচ্ছে, মা”।
“না, না – এটা ঠিক হচ্ছে না। মাথায় লাগলে কি কি বিপদ হতে পারে, জানিস তো। তোর বাবাকে বলিহারি যাই – কোথায় নিয়ে আসবে সাথে করে, তা না ………”।
কোয়েল জানে এতে বাবার কোন দোষ নেই। রণিত আসতে চায়নি। মাঠ ছেড়ে এমন সময় চলে আসার মত ছেলে ও নয়। ওর ড্যাডিও চায়নি ও মাঠ থেকে উঠে আসুক। তবে ওর যেন কোন বিপদ না হয়। মনে মনে প্রার্থনা করল কোয়েল।
“ইয়েস!”
ড্রেসিংরুমের বারান্দায় লাফিয়ে উঠল সুজন। দীপমাল্যর পরের বলটাকেই সপাটে পুল করেছে রণিত। চার। রণিত ওভাবে পড়ে যেতেই ড্রেসিংরুমের সবার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল যেন। সুজন ছুটে যেতে চাইছিল। ওর আগেই স্যার চলে গেলেন। স্যারকে কেমন উদভ্রান্তের মত লাগছিল। বল লাগতেই অস্ফুটে একবার বললেন।
“বাবু!”
আর দৌড়ে চলে গেলেন। অথচ সেই রণিতকেই মাথে রেখে এলেন। তুলে নিয়ে আসতেই পারতেন। সুজন জানে, ওর হলে – বাবা এটাই করত। কিন্তু স্যারের কাছে জেতাটা বড়, টিমটা বড়। এখানেই ফারাক স্যারের সাথে আর পাঁচজনের।
দীপমাল্যর ওভারের লার্স্ট বলটাও যখন বাউন্ডারি ছুঁল সিসোদিয়া না বলে পারলেন না।
“শের কা বাচ্চা”।
চিন্ময় পাশেই বলেছিলেন।
“তুষার করেছিল একবার এরকম, মনে আছে স্যার?”
“হ্যাঁ, রঞ্জি সেমিফাইনাল। ইউপির সাথে ছিল। কুন্দন প্রসাদ ছিল পেসারটা। মাথায় মারল। তুষারের তো ফেটেও গেছিল। ঐ ব্লিডিং নিয়ে ব্যান্ডেজ করে – একা জিতিয়েছিল টিমটাকে”।
“একদম ঠিক, স্যার। তুষারের ঐ ব্যান হয়ে যাওয়ার পর থেকে এই প্রথম কাউকে বুকের পাটা নিয়ে খেলতে দেখলাম। ব্যান থেকে ফেরা তুষারও অতীতের ছায়া মাত্র ছিল”।
“আরে বেটা কিসকা হ্যায়?”
সিসোদিয়া সহজভাবে উচ্ছাস প্রকাশ করলেন।
“হীরে আছে এই রণিত – চিন্ময়। পালিশ করতে হবে আমাদের – ব্যাস”।
চিন্ময় ঘাড় নাড়লেন। উনিও বুঝেছেন ব্যাপারটা।
অর্ক যে এমন খেলবে এই আশা তুষারও করেনি। শেষ কুড়িটা রানের মধ্যে ব্যাট চালিয়ে ষোলো রান অর্ক-ই নিয়ে নিল। রনিতের ওভাবে লাগার পর থেকে অর্ক যেন টিমকে জেতাবার দায়িত্বটা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। উইনিং শটটা বাউন্ডারি ছুঁতেই ড্রেসিংরুমে বিস্ফোরণ ঘটল। সব ছেলেরা দৌড়ে মাঠে। এমনকি গোড়ালি মচকানো নিয়েও রোহন ছুটল। এতদিনের স্বপ্ন সফল হয় ওদের। এত পরিশ্রম দাম পেলো। তুষার বাউন্ডারির ধারে গিয়ে দাঁড়ান। অবশেষে জিতেছে ও। বহুবছর ধরে হারতে হারতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল তুষার। এবারের এই জিতটা জরুরী ছিল তাই। একটা ভালোলাগা ওর মনকে ঘিরে ধরেছিল। তাহলে এখনো পারে ও। চেষ্টা করলেই পারে। রণিতের ছোঁয়া পেয়ে ঘোর কাটল। জড়িয়ে ধরেছে ড্যাডির কোমর। সাধারণত স্কুলে বা মাঠে এটা আলাউ করে না তুষার। আজ করল। ওর হেলমেট, ব্যাট সব সুজনের হাতে দিয়ে ওকে কোলে তুলে নিল। রণিত দেখল ড্যাডির চোখে জল।
“তুমি কাঁদছ কেন ড্যাডি? আমি হারতে দিইনি তো তোমাকে। আমরা জিতেছি তো?”
তুষার চোখ মুছল।
“এটা আনন্দের কান্না, পাগল। ইউ হ্যাভ মেড মি সো ভেরি মাচ প্রাউড যে জল চলে এসেছে চোখে। আসলে জিততে ভুলে গিয়েছিলাম তো। তোর হাত ধরে নতুন করে জিতছি, নতুন করে বাঁচছি। ভালো লাগছে তাই”।
“তোমাকে আমি হারতে দেব না বলেই তো উঠে আসিনি ড্যাডি। আর দেখো জিতে গেছি আমরা”।
তুষার ছেলের কপালে ব্যথা জায়গাটায় চুমু খেল।
“ব্যথা করছে?’
“না, আদর করলে – তাই কমে গেছে”।
সুজন রণিতের কথা শুনে হেসে ফেলল।
“স্যার, ভাইকে ডক্টর দেখাতে হবে না তাহলে। আপনি আদর করলেই হবে”।
অর্ণব, রোহন, যুধাজিৎ, পিয়ালরাও চলে এসেছে ততক্ষণে।
“রণিতকে কাঁধে করে মাঠে ঘোরা হল না তো। ও না থাকলে তো হেরেই যেতাম”।
যুধাজিৎ খুশিতে মাতোয়ারা হবে বলল।
“আজ থাক। রণিতের লেগেছে তো । সুজন, ছেলেদের প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশনের পর স্কুল বাসে করে পৌঁছে দিয়ে তবে তুমি ফিরবে। ঋক স্যার আর ফাদার থাকবেন যদিও …… আমি একটু রণিতকে নিয়ে হসপিটাল যাবো”। ঋক, ফাদারকে নিয়ে ড্রেসিংরুমে ঢুকে এসেছিল ততক্ষণে।
“এটাই তোকে বলতাম আমি। ফাদারও তাই বলছিলেন। টেক কেয়ার অফ হিম। হি ইস আওয়ার হিরো। স্কুলের গর্ব ও”।
রণিতের এত প্রেইজ শুনে খুব ভালো লাগছিল। ইস! যদি মাম্মা শুনত। মাম্মারও খুব গর্ব হত। এখন খুব মাম্মা যেতে ইচ্ছা করছে রণিতের। কপালে ব্যথা হচ্ছে তো। মাম্মা নিশ্চয় দেখেছে। আর খুব কষ্ট পাচ্ছে।
“চল, মাম্মা যাই সোনা”।
ড্যাডি কানে কানে বলল। ড্যাডি ওর মনের সব কথা ঠিক বুঝে নেয়। এই জন্যই ড্যাডি ওর অ্যাঞ্জেল।
চাইলেও তাড়াতাড়ি বেরোতে পারল না রণিত। ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ, ম্যান অফ দ্যা টুর্ণামেন্ট – দুটোই ও পেয়েছে। সিএবি থেকে যেতে দেয়নি ওকে। প্রাইজ নিয়ে তবে ছাড়া পেয়েছে। দাদুভাই রাগ করছে খুব, জানে রণিত। মাম্মাকে যখন মিট করতে গিয়েছিল, তখনি বলছিল চলে যেতে। বাট এভাবে যাওয়া যায় না। ড্যাডির উপরেও রাগ করেছে দাদুভাই। ড্যাডি কেন চোটের পরেও রণিতকে খেলাল – এই নিয়ে রাগ। ড্যাডি রণিতকে বুঝিয়েছে দোষটা দাদুভাই – এর না। ডাক্তাররা এইরকম করেই ভাবে। আবার প্লেয়াররাও রণিতের মত করে ভাবে। তবে দিদান খুব খুশি। কানে কানে ডিনার ট্রিটের আবদার শুনে ‘ডান’ করে দিয়েছে। সবচেয়ে খুশি মনে হয় মাম্মা। যেতেই কোলে নিয়ে আদর টাদর করে একশা। মাম্মাও কাঁদছিল অল্প। রণিতের লেগেছে বলে কষ্টের আর রণিতরা জিতেছে বলে আনন্দের। মাম্মা আর ড্যাডি – দুজনেই আজ খুব খুশি। ওদের খুশি করতে পেরে রণিত যে কতটা খুশি তা বলে বোঝাতে পারবে না ও।
সুচিন্তিত মতামত দিন